মন বোঝেনা পর্ব-২৫ এবং শেষ পর্ব

0
62

#মন_বোঝেনা
#Tahmina_Akhter

~অন্তিম পর্ব~

অর্কিড ফুল দিয়ে সাজানো পুরো ঘরটায় আলাদা এক আভা ছড়াচ্ছে। মোমবাতির আলোয় মিশে যেন এক অনন্য ভূবন। বিছানায় বৌ সেজে বসে আছে অথৈ। না চাইতেও আজ অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এই ফুলের বাসরে যদি প্রহর থাকত? কত স্বপ্ন ছিল দু’জনের কিন্তু আজ সব কেবল মনের কল্পনা ,,,

— খুব বেশি অপেক্ষায় রাখলাম তোকে, সরি।

রুমের মধ্যে প্রবেশ করে দরজা লাগাতে লাগাতেই কথাটি বলল আবির। অথৈ কথাগুলো শুনেও না শোনার ভান ধরল। আবির অথৈর দিকে এগিয়ে যায়। অথৈর পাশে গিয়ে বসল। অথৈ শক্ত হয়ে বসে রইল। কারণ, চাইলেই যে আজ পালিয়ে যেতে পারবে না। কেন বিধাতা ওর এত পরীক্ষা নিচ্ছে? প্রথমে বাবা-মাকে, তারপর প্রহরকে। স্বইচ্ছায় মৃত্যুকে বেছে নিলো কিন্তু মৃত্যু যেন ওর উপর উপহাস করল। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারে নাই ঠিকই তবে সেদিন পঙ্গুত্বকে গ্রহণ করতে হয়েছিল।

— এই দুইটা বছরে হয়ত তুই বুঝে গিয়েছিস মানুষটা আমি সুবিধার নই। শহরের যত বড় বড় মাদকদ্রব্যের কারখানা সবই আমার। খুন করা আমার বা হাতের খেলা। আমি কখনোই বাংলাদেশের স্থানীয় ছিলাম না। কিন্তু, একবার ঢাকায় যাওয়ার পর পথে তোকে দেখেছিলাম। সেই দেখাই যেন আমার কাল হয়েছিল। আমেরিকায় ফিরে আসার পর কেমন শূন্যতা ভর করেছিল আমার উপর। শূন্যতা যে কেন অনুভব করেছিলাম কারনটা বুঝতে আমার পাঁচদিন লেগেছিল। প্রথমে নিছক মনের ভ্রম ছাড়াই কিছুই ভাবিনি। কিন্তু, দিন যতই গড়িয়ে যাচ্ছিল আমি ততটাই বেসামাল হয়ে যাচ্ছিলাম। দিকবিদিকশুন্য এই মানুষ আমি সামান্য তোর মাঝে নিজেকে ধারণ করার অদম্য বাসনাকে পূরণ করার জন্য বাংলাদেশে আবারও ফিরে গেলাম। তবে “বড় ভাই মেসবাহ” হিসেবে নয় সহজ সরল আবির সেজে। তোর ভার্সিটিতে এডমিশন নিলাম। কয়েকদিন ক্লাস করার পর বুঝতে পারলাম তোর ভেতরে ফ্রি মিস্কিংয়ের ভূত আছে। তাই আমিও সাহস দেখিয়ে তোর কাছ থেকে বন্ধুত্ব ছিনিয়ে আনলাম। বিশ্বাস কর তোর ভালোবাসায় আমার প্রতিনিয়ত জর্জরিত হচ্ছিলাম। এরই মাঝে সব কিছু আমার প্ল্যান মোতাবেক চলছিল কিন্তু তোর আমার মাঝে প্রহর মির্জা চলে এলো। খবর জানলাম তুই নাকি প্রহরের বাল্যকালের বৌ। জানিস সেদিন আমার কি অবস্থা হয়েছিল??পাগলের মত সারাদিন কেঁদেছিলাম আমি। তুই যদি কষ্ট পাস তবে তোর কষ্ট ভাগ করে নেয়ার লোকের অভাব নেই। কিন্তু, আমার তো কেউ নেই অথৈ। সেদিন আমি নিজেই নিজের অনূভুতির সঙ্গে লড়াই করেছিলাম। তারপর, দেখ আজ আমার সকল বাসনা পূরণ হয়ে গেছে। আমার এই বিশাল বড় বাড়িতে, আমার রুমে, আমার হৃদয়ের কাছে তুই বৌ সেজে বসে আছিস।

কথাগুলো বলতে বলতেই আবির অথৈর গলায় মুখ গুঁজে দেয়। অথৈর চোখ বন্ধ করে ফেলে। আবিরের স্পর্শ যে মৃত্যুর যন্ত্রনাসম অনূভুতি দিচ্ছে। না এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেই হবে।

হুট করে আবিরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল অথৈ। আকস্মিক অথৈর আচরণ দেখে আবির অবাক হয়ে গেলো। অথৈকে বুক থেকে সরিয়ে এনে ওর গালে হাত রেখে বলল,

— তুই ঠিক আছিস তো বাবুই পাখি??

— হ্যা আমি ঠিক আছি।

— কিন্তু,,

— ভেবে দেখলাম তোকে মেনে নেয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই৷ তাই…

খুশিতে আত্মহারা আবির। অথৈকে জড়িয়ে ধরতে গেলেই আবিরের হুট করে চেহারায় আকৃতি বদলে যায়। অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো অথৈর দিকে। অথৈ মুচকি হেসে বলল,,

— কেমন সারপ্রাইজ দিলাম আবির??

আবির যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। অথৈ? কি করে পারল?

— এই যে দেখ তোর গলা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে তাই না? আমার বাবা-মায়েরও ঠিক একই কষ্ট হয়েছে। চাইলেই তোর মাথাটা একেবারে তোর শরীর থেকে আলাদা করে ফেলতে পারি কিন্তু করছি না। কেন জানিস? মৃত্যুর আগে আরও একবার আমাকে মন খুলে দেখে নে। তোর জীবন ধ্বংসের কারিগরকে আরেকবার দেখে নে।

আবির ধপাস করে খাট থেকে মেঝেতে পরে যায়। আবিরের এই পরিস্থিতি যেন অথৈকে আনন্দ দিচ্ছিল। আবির এখন অথৈর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখগুলো যেন হাজারও প্রশ্নের উত্তর চাইছে। চোখদুটো কেমন নিভু নিভু হয়ে আসছে। হুট করে ওর মনে হলো অথৈ ওর দিকে এগিয়ে আসছে তাও আবার পায়ে হেঁটে। কিন্তু,, এ কি করে সম্ভব? অথৈ তো…

— কি ঝটকা লেগেছে তো?? আমাকে হাঁটতে দেখে নিশ্চয়ই ভীষণ আনন্দে হচ্ছে তাই না আবির? না হেঁটে উপায় আছে বল? তুই কত ডক্টরের কাছে নিলি। সুস্থতা নিশ্চয়ই প্রাপ্য আমার। গত একমাস আগেই নিজ পায়ে হাটতে শিখেছি আমি। ভাবলাম তোকে যেহেতু আমি এত বড়ো সারপ্রাইজ দেব। তাহলে এই সারপ্রাইজটা তোলা থাক। কেমন লাগল সারপ্রাইজ??

আবির কিছু বলতে চাইছে কিন্তু বলতে পারছে না। হাত বাড়িয়ে অথৈকে স্পর্শ করতে গেলে অথৈ উঠে দাঁড়ায়। তারপর, আবিরের বাড়িয়ে দেয়া ওই হাতে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল,,

— তোর মত একটা নিকৃষ্ট কীট কখনোই মানুষের ভালোবাসা পাবার যোগ্য না। তোদের স্থান হচ্ছে নর্দমার পাশে।

অথৈর দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় আবিরের মৃত্যু হয়। অথৈ গিয়ে ফুলে সাজানো সেই খাটে গিয়ে বসল। কারণ, নাটক মাত্র শুরু হয়েছে। আরও অনেক অভিনয় করা বাকি।

সকাল হতেই পুলিশ হাজির। আবিরের লাশ নিয়ে যাওয়া হয়। আর অথৈকে পুলিশের হেফাজতে। কারণ, পুলিশের ধারণা আবিরের হত্যাকারী অথৈ। কিন্তু বাড়ির সকল মেইডদের সাক্ষীর ওপর নির্ভর করে অথৈ মুক্তি পায়। পায়ে চলতে পারে না এমন একটা মানুষ কি করে একটা সুস্থ সবল মানুষের গলায় ছুড়ি চালাতে পারবে।

*******************

— জানো তোমাদের দেখার জন্য আমি কতটা ছটফট করেছি। তোমাদের হত্যার প্রতিশোধ আমি নিয়েছি।

অথৈ ওর বাবা-মায়ের কবরস্থান থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিল। এমনসময় ওর পাশে এসে একজন দাঁড়ালো। অথৈ তাকিয়ে দেখল প্রহর এসেছে। অথৈ কাঁদতে কাঁদতে প্রহরের বুকে মাথ রেখে বলল,,

— এমনটা কি হবার কথা ছিল? আমার পরিবার এক নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো।

প্রহর অথৈর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। অথৈ শান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করে। কিছু সময় পর অথৈ শান্ত হয়। প্রহর ওর হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। তারপর নিজে গাড়ি চালিয়ে রওনা হলো বাড়ির উদ্দেশ্য। বাড়িতে পৌঁছানোর পর প্রহর অথৈর হাত ধরে প্রবেশ করল। নাজিফা রান্নাঘর থেকে ছেলে এবং ছেলের বৌয়ের এক ঝলক দেখে দৌড়ে বেরিয়ে এলেন। অথৈর সামনে গিয়ে প্রহরের হাত থেকে অথৈর হাত ছাড়িয়ে সোফাতে নিয়ে বসালো অথৈকে। প্রহর মুচকি হেসে অথৈর অপজিট সোফায় গিয়ে বসল।

— অথৈ কই গিয়েছিলি মা?

— আব্বু-আম্মুর সাথে দেখা করতে।

— এই শরীর নিয়ে কোথাও যায় মানুষ? যদি তোর কিছু হয়ে যেত?

— কিছু হবে না আম্মি। জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম লড়াই আমি একাই লড়েছি। এটা তো সামান্য মাত্র।

কথাগুলো বলেই ওর পেটে হাত রাখল। ওর ভেতরে ছোট একটি প্রাণ বেড়ে উঠছে। নাজিফা অথৈর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যায়। প্রহর উঠে অথৈর পাশে এসে বসল। অথৈর হাত শক্ত করে চেপে ধরল। তারপর, অথৈর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

— তোমাকে আবারও ধন্যবাদ অথৈ আমার জীবনে ফিরে আসার জন্য। তুমি তো জানো না আমি তোমাকে না পেয়ে কতটা ডেস্পারেট হয়ে গিয়েছিলাম। ডিভোর্স লেটার, তোমার চিঠি পড়ার পর আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তুমি আমাকে ধোঁকা দিয়েছো। তারপর, একদিন আমার ভ্রম ভাঙল। একজন আগুন্তক এসে আমার ভ্রম ভাঙালেন। তার বদৌলতে আমি তোমাকে খুঁজে পেয়েছি তোমায়। নয়ত, আমেরিকার মত এত বড়ো একটা রাজ্যে তোমাকে কিভাবে খুঁজে পেতাম বলো?

কথাগুলো শেষ করে অথৈর হাতের পিঠে চুমু খেলো প্রহর। অথৈ চোখ বন্ধ করে এই স্পর্শকে গ্রহন করল। এইতো সেই পবিত্রতা। যা কেবল প্রহরের কাছেই আছে। প্রহর অথৈর কাঁধে মাথা রাখল। অথৈ প্রহর হাত শক্ত করে ধরল। প্রহর অথৈর চোখের দিকে তাকালে অথৈ বলল

— সেই আগুন্তকের পরিচয়?

— বলতে মানা। কিন্তু, সে তোমার এবং আমার শুভাকাঙ্খী।

রাত বারোটা বাজে,

—অথৈ তুই তোর বদদোয়া ফিরিয়ে নিয়েছিলি তাই না? তাই তো তোর হাতেই আমার মৃত্যু হলো। কতটা সৌভাগ্যবান আমি! বেঁচে থাকতে সবসময় চাইতাম আমি বেঁচে থাকতে তোর সাথে যাতে কোনো অঘটন না ঘটে। নয়ত, তোর বদদোয়া, আর তার অনুপস্থিতি নিয়ে আমি কেবল জিন্দালাশ হয়ে থাকতাম। মাঝে মাঝে একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরে তুই যেহেতু আমাকে মারার প্ল্যান করেছিলি তবে বিয়ে পর্যন্ত অপেক্ষা করলি কেন?

কথাগুলো বলতে বলতে অট্টহাসিতে ফেটে পরল আবির। এদিকে অথৈ ঘুমের ঘোড় থেকে জেগে উঠল। ওর পুরো শরীর ঘেমে জবজব করছে। পাশের বালিশে চোখ রাখতেই দেখতে পেলো প্রহর ঘুমিয়ে আছে। ব্যস এবার মনে শান্তি পেলো অথৈ। এতক্ষণ তবে স্বপ্ন দেখছিল।

অথৈর আর ঘুম আসবে না এখন। তাই ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। ধীর পায়ে হেঁটে বারান্দায় চলে গেলো। দূর আকাশের শুকতারার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,,

— কারো জীবনে আবিরের মত ভালোবাসা না আসুক। প্রহরের মত কেউ আসুক। যে কিনা অগোছালো জীবনটাকে নিজ হাতে সাজিয়ে দেবে। আমাকে আমেরিকা থেকে ফিরিয়ে আনার পর লোকটা একটি প্রশ্ন করল না। জানতে চাইল না আবিরের মৃত্যু কি করে হলো? কিছুই জানতে চায়নি। শুধু আমাকে চেয়েছিল। হয়ত আমি ভাগ্যবতী নয়ত এত ভালো একটা মানুষ আমার ডিজার্ভ করার কথা না। ভালোবাসা হাজারটা ভুলকে মাফ করার ক্ষমতা রাখে। হয়ত মন – মস্তিষ্কের খেলায় মন হিসাব বোঝেনা। মন বোঝেনা।

#সমাপ্ত