#মন_ভেজা_শ্রাবণে
#পর্ব_১১
—————
অন্তির মেজাজটা বেশ তিরিক্ষি হয়ে আছে। ক্লাসে ঢুকেই সে স্নেহার পাশে ধপাস করে বসে পড়ল। স্নেহা ছাড়া তার আর কারো সঙ্গেই তেমন সখ্যতা গড়ে ওঠে নি তাই স্নেহাই বেস্ট অপশন। তার ওপর তারা তো আবার ফ্রেন্ডশিপ করেছে। স্নেহা অন্তির মেজাজ খারাপ দেখে হাসতে হাসতে বলল,
“কী রে তোকে দেখে তো মনে হচ্ছে সতিনের সঙ্গে মারামারি করে এসেছিস।”
অন্তি ক্রোধিত নয়নে ডান হাতের শাহাদাৎ আঙ্গুল স্নেহার দিকে তাক করে বলল,
“একদম রাগাবি না বলে দিচ্ছি। এমনিতেই মেজাজ চরম লেভেলে উঠে আছে।”
স্নেহা অন্তির আঙুল নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিচে নামিয়ে নিয়ে মুচকি হাসি টেনে বলল,
“তা কী সেই রহস্যের পেছনের ইতিহাস! জানতে পারি কী?”
অন্তি বিরক্তিকর ভাব ফুটিয়ে বলে,”আমার জীবনে এক রাক্ষসীর আগমন ঘটেছে। তার যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছি প্রতিমুহূর্তে। কবে যে মুক্তি মিলবে আল্লাহ মালুম।”
স্নেহা অবাক মিশ্রিত কন্ঠে বলে,”কী বলছিস আমার মজার ছলে বলা কথাটা তাহলে পুরোপুরি মিথ্যে নয়, বল?”
অন্তি মাথা কিঞ্চিৎ নামিয়ে হতাশার সুর টেনে বলল,”বাদ দে এখন এসব সময় করে বলবো সব।”
ক্লাসের সময় হয়ে যাওয়ায় স্নেহাও সায় দিল অন্তির সঙ্গে। একটু পড়েই ক্লাসে স্যার চলে এলো। অন্তি বারকয়েক জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো কিন্তু ফলাফল শূন্য। আদ্রর কোনো দেখা নেই। তবে কেনো রাতে মেসেজে লিখেছিল তাড়াতাড়ি কলেজ আসতে? উত্তর খুঁজে পায় না অন্তি। বিষন্ন মন নিয়েই ক্লাসে মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা চালায়।
★★★★
এদিকে আদ্র’র আসতে আজ একটু বেশিই লেট হয়ে গেছে। তার ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে শুরুতেই। এটেন্ড তো করতেই হবে। অন্তির সঙ্গে দেখা করার সময় টুকুও পেল না। লেট হওয়ার অবশ্য একটা গুরুতর কারণ আছে। রুহানা বেগম হঠাৎই ভোর বেলা থেকে একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। প্রেসার ফল করেছে হয়তো। আদ্র, আরিয়া এবং ওদের বাবা সেই থেকে ওনার পাশে বসে ছিল। একবার ভেবেছিল আজ কলেজে আসবে না তবে এখন অনেকটা সুস্থ আছে তাই এসেছে। তার ওপর আবার এই ক্লাসটা ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট।
ক্লাস শেষে আদ্র বন্ধুদের থেকে বিছিন্ন হয়ে গেল। উদ্দেশ্য অন্তির সঙ্গে দেখা করা এবং ওকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া। আরিয়া আজ কলেজে আসেনি। ওর তেমন কোনো ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস নেই বলে মায়ের কাছে থেকে গেছে। অন্তিকে রুহানা বেগমের শরীর খারাপের কথা জানালে অবশ্যই ও তার কাছে যেতে চাইবে। আর আদ্র সেই অপেক্ষাতেই আছে। পথিমধ্যে অন্তির সঙ্গে আদ্রর দেখা হয়ে গেল। দুজনই যেন দুজনকে খুঁজছিল। তাইতো দ্রুতই দেখা মিললো। অন্তি আদ্রকে দেখা মাত্রই গাল ফুলিয়ে কিঞ্চিৎ ক্রোধিত কন্ঠে কিছু বলতে নিবি ঠিক তখনই আদ্র তাড়া দিয়ে বলে,
“তাড়াতাড়ি চল কথা বলার সময় কম। আম্মু অসুস্থ দ্রুত যেতে হবে।”
এই একটি কথাই অন্তির জন্য যযথেষ্ট ছিল। সে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কেনো কী হয়েছে খালামনির? খুব কী শরীর খারাপ? প্রেসার ঠিক আছে তো? এখন কেমন আছে? কখন থেকে এমন হচ্ছে? এক্সাক্টলি হয়েছে টা কী?”
“রিল্যাক্স রিল্যাক্স!! এতো প্রশ্ন একবারে করলে এ্যান্সার কেমনে দেই। আচ্ছা বাইকে উঠ যেতে যেতে বলছি।”
অন্তি আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত উঠে বসল। এদিকে নিহাত দূর থেকে ওদেরকে একসঙ্গে দেখে ছুট্টে আসছিল। কিন্তু শেষমেশ আর ধরতে পারল না। তার আগেই আদ্র বাইক টান দিয়েছে। অজানা ক্রোধে কেঁপে উঠল তার সর্বাঙ্গ। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ সংবরনের চেষ্টা করলো। এমনিতেই সকাল থেকে আদ্রকে পায়নি তার ওপর এখন আবার অন্তির সঙ্গে চলে গেল। ব্যাপারটা নিহাতের পক্ষে মেনে নেওয়া চরম ঈর্ষার।
★★★★
“রাগ করে আছিস নিশ্চয়ই। কিন্তু কী করব বল ভোর বেলা থেকেই মায়ের শরীর টা খারাপ হয়। প্রেসার আপ-ডাউন করছে। গত রাতে গরুর মাংস খেয়েছিল কয়েক পিস এজন্যই বোধ হয়। কলেজে আসতাম না তবে ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস থাকায় আসতে হলো। আরিয়া জানালো এখন অনেকটাই সুস্থ আছে। ডক্টর শাহাদাৎ এসে দেখে গেছেন।”
অন্তি আদ্রর পিঠের সঙ্গে মাথা ঠেকায়। ছোট্ট করে বলে,”অনেক ঝামেলায় ছিলেন তাই না।”
আদ্র বুঝতে পারে অন্তি মনে মনে অনুশোচনা করছে আদ্রকে একান্তে ভুল বোঝার জন্য। আদ্র মলিন হেসে বলল,”হুম অনেক।”
অন্তি সেভাবেই পড়ে রইল। বাইকের ধাক্কায় মাঝেমধ্যে হেলে পড়ছে তবু উঠছে না। ক্ষণকাল যেতে ফের শোনা গেল তার নির্জীব কন্ঠ,
“জানেন আজ আপনার নিহাত এসেছিল। আমাকে পিঞ্চ করছিল। বলছিল ওকে ‘ভাবি’ বলে ডাকতে। আমিও কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দিয়ে এসেছি। রাগ করেছেন আপনি।”
অকস্মাৎ বাইক থেমে গেল। অন্তি ভড়কে উঠল। আদ্র কী সত্যি সত্যি রাগ করল তবে? পরপরই আদ্র’র ভরাট কন্ঠ,
“নেমে দাড়া।”
অন্তির শঙ্কা জোরদার হলো। বারকয়েক ঢোক গিলে গলা ভেজানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ফলাফল শূন্য। অতঃপর শুকনো গলায় আমতা আমতা করে বলল,”আ-আপনার অপছন্দ হলে আর বলবো না।”
আদ্র এবার দ্বিগুণ কড়া গলায় বলল,”নামতে বলেছি।”
অন্তি কাচুমাচু হয়ে নেমে দাড়াল। পরপরই তরিৎ গতিতে আদ্র নামাল। একদম অন্তির সামনে এসে দাড়ালো। অন্তি মাথা নিচু করে হাত কচলাতে ব্যস্ত। আদ্র অন্তির ভয়ার্ত মুখশ্রী খুব সন্তপর্ণে ওপরে তুলে ধরে। অন্তি চোখ খিঁচে বন্ধ করে আছে। তার মনে হচ্ছে আদ্র এখনই তার গালে চড় বসিয়ে দেবে। কিন্তু অন্তিকে অবাক করে দিয়ে আদ্র নিজের দু হাতের বন্ধনে অন্তির কোমল মুখশ্রী আবদ্ধ করে নিল। খুব যত্নে, কোমল, নমনীয় কন্ঠে ধীরে ধীরে বলল,
“তুমি একদম উচিত কাজ করেছ। যেটা আমি চেয়েও করতে পারছি না সেটা তুমি করেছ। অবশ্যই এভাবেই সবসময় নিজেকে প্রটেক্ট করবে৷ অন্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে। তোমাকে কেউ আঘাত করলে তাকে পাল্টা আ’ক্র’ম’ণ করবে। তা সে যেই হোক না কেনো। নিজেকে দূর্বল ভাববে না কখনো। আমার পিচ্চি পরীটা ক্রমশ বড় হয়ে চলেছে। আমার ভীষণ ভালো লাগছে। তাকে একান্ত নিজের করে নেওয়ার সময় খুব শীঘ্রই চলে আসছে।”
অন্তি কী বলবে বুঝতে পারছে না। তবে শেষোক্ত বাক্যটিতে কিঞ্চিৎ লজ্জা পায়। কিন্তু সেদিকে তোয়াক্কা না করে দৃঢ় কন্ঠে বলে ওঠে, “কেনো আপনি চেয়েও ওই নিহাতকে কিছু বলতে পারছেন না? শুধু কী ওর মানসিক সমস্যার কথা ভেবে নাকি আরও গভীর কোনো কারণ যা আমার অজানা?”
আদ্র থতমত খেয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। অন্তির সন্দিহান দৃষ্টি আদ্র’র থেকে উত্তরের অপেক্ষায়। কিন্তু আদ্র কিছুই বলছে না। অন্তি আদ্র’র কাঁধে হাত রাখে। অকস্মাৎ আদ্র চমকে ওঠে। অন্তির দৃষ্টিতে দৃষ্টি পড়তেই আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। কোনো রকমে থমথমে কন্ঠে বলে, “পড়ে বলবো একদিন সময় করে। এখন তাড়াতাড়ি যেতে হবে। আম্মুর কী অবস্থা কে জানে। ” পরপরই দ্রুত বাইকে গিয়ে বসে অন্তিকে বসতে ইশারা করে। যেন এই প্রশ্নের হাত থেকে পালাতে চাইছে।
অন্তি বুঝতে পারল আদ্র কিছু একটা লুকতে চাইছে। তবে পড়ে বলবে যখন বলেছে তখন অন্তি শুনেই ছাড়বে। শুধু মাত্র মানসিক সমস্যার কারণে এতটা সাপোর্ট করার পাত্র তো তার আদ্র ভাই নয়। তাহলে কী সেই কারণ?
অন্তি চুপচাপ বাইকে উঠে বসে। বাকি রাস্তা টুকু কাটে নিস্তব্ধতায়।
—-
চলবে,
✍️সাদিয়া আফরিন নিশি