মন ভেজা শ্রাবণে পর্ব-১২

0
504

#মন_ভেজা_শ্রাবণে
(পর্ব – ১২)
——————
আদ্র’র মায়ের শরীর এখন বেশ ভালো। রুপালি বেগম আসতে চেয়েও সুস্থতার খবর পেয়ে আর আসেনি। অনিক এসেছে। বিকেলে অন্তিকে নিয়ে যাবে। অন্তির মনটা সেই থেকে খচখচ করছে। মন বলছে নিহাতের পেছনে বড় কোনো রহস্য আছে কিন্তু আদ্র সেটা ফ্লাশ করছে না। কিন্তু কেনো এই লুকোচুরি? মলিন মুখশ্রী, নির্জীব শরীর নিয়ে শুয়ে আছে সে আরিয়ার বিছানায়। তখনই আদ্রের উপস্থিতি সেখানে। আরিয়া ঘরে নেই রুহানা বেগমের রুমেই ঘুমিয়ে গেছে। মেয়েটা এমনই মায়ের কিছু হলে এক চুলও সেখান থেকে নড়বে না। সহসা দরজার কর্কশ শব্দে সেদিকে দৃষ্টি দেয় অন্তি। আদ্র তার দিকেই আসছে। মুহুর্তেই হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে পড়ে সে। আদ্র বেশ দ্রুতই অন্তির কাছে গিয়ে বসে। অন্তি কৌতুহলী কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে,

“কী হয়েছে?”

“একটা কথা বলার ছিল।”

“তো বলুন না।”

“সামনের মাসে আমরা বন্ধুরা মিলে ট্যুরে যাচ্ছি। তুই যাবি আমাদের সঙ্গে?”

“আমি কিন্তু কীভাবে? বাড়ি থেকে ছাড়বে না কিছুতেই। তার ওপর আপনার বন্ধুরা মানবে কেনো?”

“আহহহা তোকে এতকিছু ভাবতে হবে না। তুই শুধু যাবি কি না বল?”

অন্তি কী বলবে ভেবে পায় না। ইতস্ততবোধ করছে। অন্তির দিকটা বুঝতে অসুবিধা হয় না আদ্র’র। সে অন্তির হাতের আঙুলের ভাঁজে নিজের আঙুল গলিয়ে দিয়ে বলল,

“এই ছোট্ট মাথায় এতকিছু ভাবনা আসে কীভাবে? তোর জায়গায় অন্য কেউ হলে কখন রাজি হয়ে যেত। আর তুই? বাই দি ওয়ে, তুই তৈরি থাকিস বাকিদের ম্যানেজ করার দ্বায়িত্ব আমার।”

অন্তি শুধু ছোট্ট করে “হু” বলে। মুখটা এখনো মলিন হয়ে আছে। আদ্র সেদিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে আচমকায় অন্তির ললাটে টুক করে একটা চুমু খায়। অন্তি হকচকিয়ে উঠে তাকাতেই আদ্র মুচকি হেসে মাথা চুলকাতে চুলকাতে পালিয়ে যায়। অন্তি আদ্রর কারবার দেখে হেসে ফেলে। বিড়বিড়িয়ে বলে,”পাগল পুরুষ মানুষ।”

————–
দেখতে দেখতে মাস পেড়িয়ে যায়। আদ্রদের ট্যুরে গমনের সময়কাল আগত। এই একমাসে আদ্র, অন্তির ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে অনেক। দুজন দুজনকে চোখে হারায় যেন সর্বক্ষণ। অন্তি আদ্রকে এখন আগের মতো ভয় পায় না। মাঝে মধ্যে বড়দের মতো শাসন করে বসে। আদ্র এসব খুব উপভোগ করে। কিন্তু ওদের এসব কাছাকাছি, ঘেঁষাঘেঁষি চোখ এড়ায়নি একজনের। প্রথম প্রথম লক্ষ্য না করলেও বি’ষ ঢালার লোকের তো আর অভাব নেই। ঠিক সেভাবেই নিহাতকে মিহু শুরু থেকেই অন্তির ব্যাপারে এটা-সেটা বুঝিয়েছে। নিহাত সেসব কথা পর্যবেক্ষণ করে পুরোপুরি অন্তির ওপর চোটে আছে।

সকাল সকাল ফোনের টুং টাং শব্দে তন্দ্রা কাটে অন্তির। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে উঠে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে আদ্র’র ফোন। অন্তি সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা রিসিভ করে নেয়।

“হ্যালো।”

“তৈরি হয়েছিল? আর মাত্র এক ঘন্টা পরই কিন্তু রওনা হব।”

অন্তি তড়িঘড়ি করে ঘড়ির কাটায় চোখ বুলালো। অলরেডি আটটা বেজে গেছে। তারমানে ন’টার সময় বেড়বে। অন্তি ব্যস্ত কন্ঠে আদ্রকে, ‘আসছি,আসছি’ বলে কলটা কেটে দেয়। অতঃপর দ্রুত তৈরি হতে ছোটে। আদ্র ফোনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। সে জানত অন্তি এখনো ঘুমিয়ে আছে। তাই তো আগে ভাগে ডেকে তুলেছে। এমনিতেই কত কাহিনী করে বাড়ির সবাইকে ম্যানেজ করেছে। কেউ তো ছাড়তেই চাচ্ছিল না অন্তিকে। তবে মিহু, তিহা আছে বিধায় যেতে দিয়েছে। নয়তো কখনোই এতগুলো ছেলের সঙ্গে ছাড়ত না তাতে যতই আদ্র সঙ্গে থাকুক না কেনো।

কালো হিজাব, কালো থ্রি-পিস, কালো চুড়ি, কালো জুতা মোট কথা সবকিছুই ম্যাচিং মতো। অন্তির এই এক খুতখুতানি স্বভাব সবকিছু তার ম্যাচিং চাই। কাকতালীয় ভাবে আদ্র ও পড়েছে কালো শার্টের সঙ্গে কালো জিন্স, কালো সানগ্লাস, কালো হ্যান্ড ঘড়ি। দুজনেই আজ কালোতে জলন্ত। দুজন যখন পাশাপাশি হেঁটে গাড়ির কাছে এসেছে তখন সকলের দৃষ্টি না চাইতেও ওদের ওপর পড়ছে। আদ্র অন্তিকে মাঝে মধ্যেই আড়চোখে দেখছে কিন্তু অন্তি একদম নত বদনে হাঁটছে। তার কেনো জানি ভীষণ লজ্জা লাগছে। গাড়ির কাছে আসতেই রওশক এসে একদম আদ্র’র সঙ্গে চিপকে দাড়িয়ে কী যেন ফিসফিস করে বলল। উত্তরে আদ্র তার পিঠে স্বজোরে চাপড় মে’রে বলল,’সময় থাকতে ভালো হই যা।’

রওনক হাত ঘুরিয়ে পিঠ ডলতে ডলতে ব্যথাতুর কন্ঠে বলল,’ ভালো তুই হ শালা! পিঠ টা জ্বলে গেলো আমার।’

এদিক এদের কান্ড দেখে তিহা,সাহেল, ইসতি হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এক ফাঁকে অন্তির সঙ্গে সকলে সাক্ষাৎ করে নিয়েছে। এরই মধ্যে সেখানে নিহাত, নাবিল আর মিহু উপস্থিত। নাবিল, মিহু ঠিক আছে কিন্তু নিহাতকে দেখে আদ্র, অন্তি দুজনেই চমকে গেল। অন্তি আদ্র’র মুখের দিকে তাকাতেই আদ্র চোখ দিয়ে ইশারা করে বোঝালো , ‘সে দেখছে।’ আদ্র ওদের দিকে তাকিয়ে একটু জোরেই বলল,’নিহাত কী করতে এসেছে এখানে?’.

কেউ কিছু বলবে তার আগেই মিহু ফোরন কেটে বলে উঠল, ‘অন্তি যা করছে নিহাত ও তাই করতে এসেছে।’

বাকি সকলে চুপ করে রইল। নাবিল অসহায় ফেস করে তাকিয়ে রইল আদ্র’র পানে। আদ্র বুঝতে পারল এখানে কথা বলে তেমন একটা লাভ হবে না। তার ওপর যাত্রাকালে আর কোনো ঝামেলা করতে সে ইচ্ছুক নয়। এটা তার আর অন্তির একসঙ্গে ফার্স্ট ট্রাভেল কী না। আদ্র কোনো কথা না বলে চুপচাপ অন্তিকে টেনে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। নিজে চলে গেল ড্রাইভিং সিটে। অন্তি আদ্রের পাশের সিটেই আছে। আদ্র গাড়িতে উঠে সাহেলকে বলল,’তাড়াতাড়ি সকলকে উঠতে বল। বেলা অনেক হয়েছে।’

এই ঘটল বিপত্তি। একটি গাড়িতে ছয়জনের বেশি যাওয়া সম্ভব নয় সেখানে তারা নয়জন। তাই দুটো গাড়ি আনা হয়েছে। একটি আদ্র’র আরেকটি নাবিলের। মিহুর ইশারায় সকলে গিয়ে নাবিলের গাড়িতে বসল। কিন্তু নিহাত টুক করে ঢুকে গেলো আদ্র’র গাড়িতে। এটা দেখে মিহু বাঁকা হাসল। নিহাত গাড়িতে উঠে প্রশান্তির শ্বাস ফেলল তবে পুরোটুকু নয় কারণ আদ্র’র পাশে অন্তি বসে আছে। সে মনে করে সেটা তার জায়গা। কিন্তু এই দৃশ্যে বাকি সবাই অবাক। কারণ সকলে ভেবেছিল মিহু ওদেরকে নাবিলের গাড়িতে বসতে বলছে আদ্র-অন্তিকে আলাদা স্পেস দেওয়ার জন্য কিন্তু না। এটা একটা প্লানিং ছিল। সকলেই ভীষণ বিরক্ত হলো মিহু নিহাতের ওপর। কারণ আদ্র-অন্তির সম্পর্কের কথা সকলেই জানে। সেই সঙ্গে মিহু অন্তিকে অপছন্দ করে এবং নিহাতকে আশকারা দেয় এটাও সকলে জানে।

নিহাতকে আয়েশ করে সিটে বসতে দেখে আদ্র এবারে আর চুপ থাকতে পারল না। তরান্বিত কন্ঠে বলল, ‘তুমি এখানে কেনো? তোমাদের গাড়িতে যাও।’

নিহাত আয়েশি ভঙ্গিতে বলল,’উহুম আমি এটাতেই যাবো আপনার সঙ্গে।’

আদ্র চরম বিরক্ত হচ্ছে। সবসময় এতো ঝামেলা ভালো লাগছে না। ভেবেছিলো অন্তির সঙ্গে একান্তে যাবে। কিন্তু এই মেয়ে এখানেও হাজির। আদ্র এক পল অন্তির দিকে তাকালো। অন্তি আদ্র’র দিকেই তাকিয়ে ছিল। আদ্র ততক্ষণাৎ গাড়ির ডোর ওপেন করে নাবিলকে ডাকতে গেলো। কিন্তু ‘নাবি….’ বলার আগেই অন্তি তার হাত ধরে টান দিলো। আদ্র থেমে গিয়ে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকালো। ইশারায় বোঝালো ‘কী হয়েছে?’ অন্তি আদ্রকে অনেকটা কাছে টেনে এনে বলল,’ও থাক না। গেলোই না হয় আমাদের সঙ্গে। আপনিই তো বলেন ওর মানসিক কন্ডিশন ক্রিটিকাল। তাহলে?’

“তুই বুঝতে পারছিস না পিচ্চি। ও একটা না ঝামেলা করবেই। আমার সঙ্গে তোকে দেখে এমন করছে।’

” আহহ বললাম তো থাকতে দিন।আমি দেখে নেবো।”

“তুই তুই কী দেখ….”

আদ্র আর কিছু বলতে পারল না। অন্তি চোখ গরম করে শাসালো তাকে। আদ্র ভদ্র ছেলের ন্যায় চুপচাপ ড্রাইভিং স্টার্ট দিলো। পেছনে বসে নিহাতের মনে লাড্ডু ফুটছে। এবার জমবে মজা। অন্তিকে সে কিছুতেই শান্তিতে থাকতে দিবে না। এদিকে অন্তি গাড়ির মিররে নিহাতের ভাবভঙ্গি দেখছে। তার অধর কোণে ফুটে উঠেছে রহস্যময়ী হাসির রেখা। এমনি এমনি তো আর নিহাতকে সে তাদের সঙ্গে নেয় নি। এর পেছনেও মক্ষম কারণ আছে। ওদের গাড়ির পেছন পেছন নাবিলদের গাড়িটা আসছে। ওই গাড়ি থেকে হৈ-হুল্লোড়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। প্রতিবার আদ্রও একসঙ্গে থাকে৷ এবার শুধু ভিন্ন। তবুও শান্তি প্রেয়সী সঙ্গে আছে। এরচেয়ে মানসিক শান্তি কী আর জগতে আছে?

—-
চলবে,
✍️সাদিয়া আফরিন নিশি