মন ভেজা শ্রাবণে
পর্ব -১৩
————
প্রতিবারে ট্যুরে সাজেক, কক্সবাজার এসব স্থান বরাদ্দ থাকলেও এবারে মতামত ভিন্ন। তারা এবার চলেছে সাহেলের নানাবাড়ির উদ্দেশ্যে। ছোট্ট একটি গ্রাম কিন্তু অতুলনীয় সৌন্দর্যের বিবরণ এমনটাই শুনে এসেছে সাহেলের কাছে। আজ বাস্তবে দেখবে।
দুপুর দুইটা বেজে দশ মিনিট। যেতে যেতে এখনো চার-পাঁচ ঘন্টা সময় লাগবে। গ্রামটা শহর থেকে বেশ দূরত্বে। একটি নির্জন রাস্তায় আদ্র গাড়ি সাইড করে। পেছন পেছন নাবিলদের গাড়িটাও দাড়িয়ে যায়। এই মুহুর্তে লাঞ্চ করে নেওয়া টা জরুরি। কারণ বাকি রাস্তা গুলোতে এমন নির্জন রাস্তা নাও মিলতে পারে। তার ওপরে বাজেও কম নয়। এমন পরিস্থিতির আভাস পেয়ে আগে থেকেই লাঞ্চ প্যাক সঙ্গে করে এনেছিল ওরা। আদ্র গাড়ি থামাতেই পেছনের গাড়ি থেকে রওনকের ফোন এলো। আদ্র ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই সে তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,
“দোস্ত তাড়াতাড়ি লাঞ্চ সেরে নে। যেতে যেতে এখনো অনেক পথ বাকি। আর নিহাতকেও লাঞ্চ করে নিতে বলিস নাবিল বলছে বারেবার।”
“ওকে আমি দেখছি।”
ফোন কেটে আদ্র তিনটি লাঞ্চ প্যাক বের করে একটি নিহাতকে, একটি অন্তিকে আর একটি নিজের জন্য নিল। নিহাত মুচকি হেসে প্যাকটি নিয়ে খেতে আরম্ভ করল। অন্তি মুড অফ করে বসে আছে। আদ্র নিজের খাবারে হাত দিতে গিয়ে অন্তির মলিন মুখশ্রী নজরে এনে বলল,
“কী হয়েছে? খাচ্ছিস না কেনো? বিরিয়ানি আছে ভেতরে।”
অন্তি চোখ মুখ কুঁচকে বলল,”খেতে ইচ্ছে করছে না।”
“এমন বললে চলবে। সেই কোন সকালে খেয়ে এসেছিস। এখনই খেতে হবে। আবার কখন পৌঁছতে পারব কে জানে?”
আদ্র আর কথা না বাড়িয়ে অন্তির হাত থেকে খাবারটা নিয়ে নিজের হাতে লোকমা তুলে অন্তির মুখের সামনে ধরল। কড়া গলায় বলল,”মুখ খোল।”
অন্তি উপায়ন্তর না পেয়ে খেতে শুরু করল। আদ্র অন্তিকে খাওয়ানোর ফাঁকে ফাঁকে নিজেও খাচ্ছে। একটা প্যাক থেকেই দু’জনে খাচ্ছে। এদিকে এসব দেখে তেলে বেগুন জ্বলে উঠল নিহাত। নিজের এতো পছন্দের বিরিয়ানি তখন বি’ষ হয়ে গলায় আটকে পড়ার উপক্রম। সহসা সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে বিষম খায় সে। এই দৃশ্যে অন্তির ওষ্ঠদ্বয়ে মৃদু হাসি। সে ইচ্ছে করেই না খাওয়ার বাহানা করেছে। যাতে করে আদ্র তাকে খাইয়ে দেয় এবং নিহাত কষ্ট পায়। এই মেয়েকে শিক্ষা দেওয়ার একটা পথও এবার আর ছাড়বে না অন্তি। নিহাতকে এভাবে বিষম খেতে দেখে আদ্র বিরক্ত হয়ে পানির বোতল এগিয়ে দেয়। নিহাত কোনোরকমে বোতলটি নিয়ে ঢকঢক করে পুরোটা পানি খেয়ে নেয়। পানি পান করে যেন তার স্বস্তি মেলে। পরক্ষণেই আদ্র – অন্তিকে আবার অমন অবস্থায় দেখে রাগে, দুঃখে কর্কশ কন্ঠে বলে ওঠে,
“কী হচ্ছে এসব। আদ্র তুমি ওকে খাইয়ে কেনো দিচ্ছ। ওর নিজের হাত নেই নাকি?
এই মেয়ে তুমি নিজে হাতে খেয়ে নাও। এসব আদিখ্যেতা ছাড়।”
অন্তি কিছু বলতে যেতেই দেখে আদ্র’র বিরক্তিকর মুখশ্রীতে তীব্র ক্রোধের আভাস পেয়ে থমকে যায়। আদ্র ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে কড়া গলায় বলল,
“দ্যাট’স নন অফ ইওর বিজনেস। তুমি তোমার কাজে মনোযোগী হও।”
“কিন্তু আপনি কেনো বুঝতে চাইছেন না এসব আমার সহ্য হচ্ছে না। আপনি শুধু আমার! আমার! আমার!”
নিহাত কেমন পাগলের মতো করছে। অন্তি এবার ঘাবড়ে যায়। নিহাতের ব্যবহার সত্যিই অস্বাভাবিক লাগছে। তারমানে নিহাতের সত্যিই প্রবলেম আছে। সে সুস্থ নয়। অন্তির চিন্তায় ছেদ পড়ে আদ্র’র ধমকিত কন্ঠে।
“আর একটা কথা বললে এখনই গাড়ি থেকে বের করে দিবো।”
গাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার কথা শুনে নিহাত চুপসে যায়। আর যাই হোক গাড়ি থেকে কিছুতেই বের হওয়া যাবে না। নয়তো বাকি রাস্তা ওদের নজরে কী করে রাখবে। নিহাতের চুপসে যাওয়া মুখের দিকে আদ্র ফের কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“আমি কী করব না করব সেটা তোমার দেখার বিষয় নয়। এক কথা বারবার বলা আমার পছন্দ না। তুমি কেনো বুঝতে চাইছ না তুমি যাকে ভাবছ আমি সে নই। তুমি আমার লাইফে একটা অহেতুক ঝামেলা মাত্র। নেক্সট টাইম তোমার এই পাগলামি আমি বরদাস্ত করব না বলে রাখছি। পরবর্তীতে যদি এমন করো তাহলে কিন্তু এই আদ্র’র ভয়ংকর রুপ অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। মাইন্ড ইট!!”
“নাহ নাহহ নাহহহ!! আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না। আপনিই আমার আদ্র। এবং আপনি শুধু আমার। আগের বারের মতো ভুল বোঝাতে এবারে আর পারবেন না। আমি কিচ্ছুটি শুনব না। আপনি যতই আমাকে তাড়িয়ে দিননা কেন আমি আর অভিমান করে চলে যাব না। সবসময় আপনার সঙ্গে লেগে থাকব। কোথাও হারাতে দেবো না আপনাকে।”
“ওহহ জাস্ট শাট আপ। তোমাকে বোঝায় কার সাধ্যি?”
অন্তির আত্মা যেন শুকিয়ে এসেছে এদের এসব কান্ডে। তবে বারংবার তার মন একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে। নিহাত আদ্রকে কী ভাবছে,কাকে ভাবছে, কেনো ভাবছে? এসবের কিছুই মাথায় ঢুকছে না অন্তির। কিছু জিজ্ঞেস করার সাহসও পাচ্ছে না। আদ্র যেই পরিমাণে রেগে আছে। পরক্ষণেই আদ্র নিজেকে শান্ত করার প্রচেষ্টায় নেমে পড়ল। চোখ বন্ধ করে বারকয়েক জোর নিশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে চোখ খুলল। আগের ন্যায় অন্তির মুখের সামনে খাবার তুলে ধরল। তবে এবারে সে একেবারে গম্ভীর, ভারাক্রান্ত। পেছনে বসে নিহাত নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে আর অপলক চেয়ে আছে আদ্র’র দিকে। অন্তি আড়চোখে একবার দেখল। এই প্রথম তার নিহাতের জন্য খারাপ লাগছে। মেয়েটা হয়তো সত্যিই আদ্রকে খুব ভালবাসে। এজন্যই তো এতো অবহেলা সহ্য করেও ছুটে আসে। কিন্তু এই মেয়ের পেছনে বড় কোনো রহস্য আছে এটাও অন্তি বুঝতে পারছে। আর দেরি করলে চলবে না। আদ্র’র থেকে সময় বুঝে সবটা জেনে নিতে হবে। অন্তির আকাশ-পাতাল ভাবনার মধ্যে বাম হাত ঢুকিয়ে দেয় আদ্র। মৃদু ধমকে বলে,
“কী হলো মুখ খুলছিস না কেন? মনে তো হচ্ছে ভেবে ভেবে একেবারে নিউটনের মতো কঠিন সূত্র আবিষ্কার করছিস?”
অন্তি আনমনেই বলল,”সূত্র আবিষ্কার না করলেও মেলানোর চেষ্টা করছি।”
আদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল,”কীহ।” তাতেই অন্তির হুঁশ ফিরল যেন। সে থতমত খেয়ে বলল,”কই কিছু না তো এমনিই। আচ্ছা দেন।” এই বলে সে আবার আগের ন্যায় খেতে লাগল। কয়েক লোকমা খেয়েই আর খাবে না বলে বায়না ধরল। আদ্র চোখ গরম দেখালেও কাজ হলো না। বিশেষ করে সে নিহাতকে আর কষ্ট দিতে চাইছে না। এমনিতেই মেয়েটা অনেক কষ্টে আছে। একজন মেয়ে হয়ে আরেকজন মেয়েকে কীভাবে এতো কষ্ট সে দিতে পারবে। তার ছোট্ট মনে মায়া,ভালবাসার অভাব নেই। হোক তা সবার জন্য!!
——————
নিহাতকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে গাড়ির সিটে মাথা রেখেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল অন্তি। সে অবস্থায় গাড়ির ধাক্কায় তার মাথা জানালায় বারি লাগতে যায়। দেখা যায় তার আগেই আদ্র এক ঝটকায় অন্তিকে নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়। অতি যত্নে অন্তির মাথাটা নিজের বুকের ওপর রেখে আরামসে ড্রাইভ করতে থাকে। অন্তির ঘুমন্ত মুখশ্রীতে একটু পরপর চোখ বুলিয়ে মনের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিচ্ছে। ঘুমন্ত পিচ্চি টাকে একদম ঘুমরাজ্যের রাজকন্যার মতো লাগছে। কী যে স্নিগ্ধ, স্বচ্ছল, পবিত্র!!
—-
চলবে,
✍️সাদিয়া আফরিন নিশি