#মন_ভেজা_শ্রাবণে
(পর্ব-১৪)
————–
চতুর্দিকে বাঁশের ছনের তৈরি দেওয়াল। পায়ের নিচে কাঁচা মাটির তৈরি মেঝে। টিনের ছাদ দিয়ে তৈরি বাড়িটিতে প্রাচীন সভ্যতার নিদারুণ বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। সারি সারি এমন কাঁচা মাটির তৈরি বাড়িগুলো দেখতে বেশ অতুলনীয়। প্রতিটি বাড়ি যেন একই ধাঁচের। একটি থেকে আরেকটি পৃথক করা দায়। ঘরগুলোর বাহিরে যেমন সৌন্দর্য ঠিক তেমনই ভেতরকার দৃশ্যও মনোমুগ্ধকর। গ্রামের মানুষেরা তাদের নিজস্ব তৈরিকৃত সরঞ্জামাদি দিয়ে প্রতিটি ঘরের দৃশ্য করে তুলেছে অনন্য। একবার দেখলে চোখ ফেরানো দায়।
প্রত্যেকের কাছেই এখানকার পরিবেশ বেশ মনে ধরেছে। একমাত্র নিহাত আর মিহু নাক সিটকাচ্ছে। তাদের মতে এমন গ্রামীণ পরিবেশ যেখানে নেই কোনো এসি.,নেই কোনো নেটওয়ার্ক, নেই কোনো আরামদায়ক ব্যবস্থা এখানে না এসে বরং সাজেক, কক্সবাজার ইত্যাদি হাই পাই জায়গায় গেলেই চলত। একমাত্র আদ্র’র সঙ্গ পেতে নিহাত এখানে এসেছে নয়তো কখনোই আসত না। আর মিহু সেও এসেছে নিজের উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে।
বাড়ির পুরোটা জায়গা জুড়ে গোল করে সারি সারি মাটির ঘর সাজানো। মাঝখানে বড় উঠান। এই এতবড় বাড়িটিতে শুধুমাত্র সাহেলের নানা-নানি আর এক মামা থাকেন। সেই মামা নাকি ওদের দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। আপন বলতে কেউ নেই তার এজন্য এখানে রাখা। তাছাড়া বৃদ্ধ বয়সে দুই বুড়ো-বুড়ির দেখাশোনার জন্যও তো একজন লোক দরকার। সেই মামা আবার ভীষণ ভালো মনের মানুষ। বয়স তার পঁয়তাল্লিশ পেড়িয়ে। তবে এখনো বিয়ের ফুল ফোটে নি৷ তিনি ইচ্ছে করেই ফোটাতে চান নি। কেন, কী কারণ তা সকলেরই অজানা। হয়তো কাউকে ভালোবেসে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি মুখে স্বীকার না করলেও তার হাবভাবে সবাই তাই বুঝে নিয়েছে। নয়তো এতো বছরে বিয়ে না করার আর কী-ই বা কারণ থাকতে পারে। সাহেলের নানা-নানিও বেশ মিশুক এবং রশিক প্রকৃতির মানুষ। ওদের পেয়ে ওনারাও ভীষণ খুশি হয়েছেন। অন্তত যে দুই দিন ওরা থাকবে বাড়িটা হৈ-হুল্লোড়ে ভরে থাকবে। এই ভেবেই তারা খুশি।
———
সারিবদ্ধ মাটির ঘর গুলোর এক একটি প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ করা হলো। যে যার মতো ঘরে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেশ হতে চলে গেল। সবার মুখেই আনন্দের ছাপ। শুধু মাত্র নিহাত আর মিহুর মুখে যেন অমাবস্যার আঁধার নেমে এসেছে। তারা ভীষণ বিরক্ত সঙ্গে আপসেট। কীভাবে থাকবে এই পরিবেশে তাও আবার তিনদিন। এটা ভেবেই আহত হচ্ছে বারংবার।
অন্তির অবস্থা নাজেহাল। এমন পরিবেশে দারুণ লাগলেও বিপত্তি ঘটল একা এক ঘরে থাকা নিয়ে। বাড়িতে একা থাকা পর্যন্ত ঠিক আছে কিন্তু এই গ্রামীণ, অচেনা পরিবেশে এভাবে ইনসিকিউর ভাবে থাকাটা বড্ড ভীতিকর তার পক্ষে। লজ্জায় তখন কাউকে কিছু বলতেও পারেনি। তার ওপর নিহাতের সম্মুখে নিজেকে দূর্বল রুপে প্রকাশ করতে চায়নি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে কতটা বিপদে পড়েছে। কোনোরকমে লাগেজ খুলে একটা সুতি ড্রেস বের করে পড়ে নিল সে। পরপরই দরজার বাহিরে থেকে কড়া নাড়ার শব্দ ভেসে এলো। কেউ একজন রাতের খাবারের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। অন্তি মোবাইলের স্কিনে তাকিয়ে দেখল আট টা বেজে পাঁচ মিনিট। এখানে পৌঁছে সবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এটা সেটা দেখতে দেখতে কখন যে আট টা বেজে গেল খেয়ালই করেনি। কিন্তু এখন তো ডিনার টাইম নয়। শুনেছে গ্রামের মানুষেরা সন্ধ্যার পরপরই ডিনার সেরে ঘুমিয়ে পড়ে আবার কাকভোরে উঠে দৈনন্দিন কাজে লেগে পড়ে। এসব ভাবনা থেকেই সে আর দ্বিমত না করে সম্মতি জানিয়ে দিল। ওপাশের বৃদ্ধা কন্ঠস্বর সম্মতি পেয়ে চলে গেলেন। হয়তো তিনি সাহেলের নানি ছিলেন। অন্তির কেমন জানি আনইজি লাগছে সবকিছু। আদ্র সঙ্গে থাকলে তবুও একটু সাহস পেত কিন্তু তা কী করে সম্ভব? চাপা নিশ্বাস ফেলে রুম থেকে বের হয় অন্তি।এপাশ ওপাশ একবার দেখে নিয়ে থম মে’রে দাড়িয়ে রয়। কোনদিকে যাবে ঠিক ঠাওর করতে পারছে না। ঠিক তখনই কোত্থেকে ঝড়ের বেগে আদ্র এসে তার হাত ধরে হাঁটতে শুরু করে। ডান সাইড ধরে তারা এগিয়ে চলেছে। অন্তি হতবিহবল হয়ে আদ্রর থেকে নিজের হাত ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কাচুমাচু কন্ঠে বলে, “কী করছেন? হাতটা ছাড়ুন। ওনারা দেখলে কী ভাববেন?”
আদ্র হাঁটা অব্যাহত রেখেই চোখ পাকিয়ে অন্তির দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল, “তোকে এতো ভাবতে হবে না। মুখ বন্ধ রাখ।”
অন্তি চুপসে গেল। আদ্র এক পল সেদিকে দেখে নিয়ে সামনে দৃষ্টি সরিয়ে নিল।
সারিবদ্ধ ঘরগুলির একটির সম্মুখে যেয়ে আদ্র অন্তির হাত ছেড়ে দিল। ইশারা করল ভেতরে ঢুকতে। অন্তি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। ঘরের মধ্যে দৃষ্টি দিল। সেখানে অলরেডি সকলে উপস্থিত। তারমানে তারাই সবথেকে লেট। অন্তি মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকে গেল। সকলে লম্বা লাইন ধরে বসে গেছে খেতে। প্রত্যেকের শরীরের নিচ বরাবর এক একটি শতরঞ্জি পাতা। শুধু মাত্র নিহাত আর মিহুর জন্য চেয়ারের আয়োজন। তারা নাকি এমন মেঝেতে বসে খেতে পারবে না। এদের ভাব দেখে মুহুর্তেই অন্তির ছোট্ট মাথায় কিঞ্চিৎ ক্রোধের আভাস দেখা দিল। সে রীতিমতো ওদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। ঘোর কাটে আদ্রর কন্ঠে,
“কী হলো বসছিস না যে?”
“হু হুম বসছি৷”
অন্তি, আদ্র দুজনেই পাশাপাশি বসল। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সাহেলের নানা-নানি এবং মামার সঙ্গে টুকটাক আলাপ আলোচনা করল ওরা। বেশ হাসিঠাট্টাও চলল। সুন্দর আনন্দ ঘন মুহূর্ত পেড়ল যেন সকলে।
——-
সবথেকে চরম আশঙ্কাগ্রস্থ পরিস্থিতিতে এবার পড়ল অন্তি।
একা একা ঘুমানোর মতো তীব্র সংকটে এবার সে। সঙ্গী হিসেবে ফোন টাকে যে ইউজ করবে সে উপায়ও নেই। এখানে নেটওয়ার্কে চরম সমস্যা। ফোনের মধ্যে মন,মস্তিষ্ক ঢুকিয়ে ভীতি দূর করার মতো ইউনিক আইডিয়াও বিফলে গেল। এখন শুধু এপাশ – ওপাশ করে ছটফটানি করা ছাড়া উপায় নেই। ভয়ে হারিকেনের আলো জ্বালিয়ে রেখে দিয়েছে। আদ্রকে ফোন করতে গিয়েও করছে না। কেমন জানি এসব কথা আদ্রকে বলাটা বেমানান মনে হচ্ছে। সে একটা ছেলে মানুষ হয়ে কী-ই বা করতে পারবে? এমন সব নানারকম চিন্তা-ভাবনা করতে করতে বিছানায় থাকা একটি নকশিকাঁথা টেনে নিয়ে আপাদমস্তক পেঁচিয়ে নিল সে। কাঁথার মধ্যে থেকে চোখ জোড়া বের করে পিটপিটে চাহনিতে তাকিয়ে আছে হারিকেনের আলোর দিকে। মনে মনে দোয়া দরূদ পড়ছে আর আল্লাহ কাছে আকুতি মিনতি করছে রাতটা যেন তাড়াতাড়ি শেষ হয়। আশেপাশের থেকে ব্যাঙ ডাকার শব্দ ভেসে ভেসে আসছে সেই সঙ্গে ঝিঁঝি পোকার ডাক। কাঁথার মধ্যে থেকে অন্তির সর্বাঙ্গে যেন হিম ধরে আসছে সে সব শব্দে। শরীর ভিজে জবুথবু। মনে হচ্ছে সদ্য শাওয়ার নিয়ে ফিরেছে। মস্তিষ্ক শূন্য, হৃদয় শঙ্কিত, সর্বাঙ্গ কম্পিত। এমন পরিস্থিতিতে মোবাইলের বিরক্তিকর টুং টাং শব্দ তার এলোমেলো অনূভুতিগুলোকে দ্বিগুণ সজাগ করে তুলল। ধীরে সুস্থে সেদিকে দৃষ্টি ফেলতেই কিঞ্চিৎ প্রাণ ফিরে পেল যেন। আদ্রর ম্যাসেজ, “দরজা খোল। আমি বাহিরে দাড়িয়ে।”
অন্তি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পাল্টা মেসেজ দিল, “আপনি এখানে কেন?”
সঙ্গে সঙ্গে এ্যাংরি রিয়েক্টের সঙ্গে আদ্র’র রিপ্লাই, “খুলতে বলেছি আগে খোল। তারপর বলছি।”
কাঁথার মধ্যে থেকে ঘামে সিক্ত ছোট্ট শরীরটি বেড়িয়ে এলো। কেমন নিস্তেজ দেহটা টানতে টানতে দরজা অব্দি নিয়ে গেল। খট করে দরজার খিড়কি খুলতেই ব্যস্ততার সহিত আদ্র ভেতরে প্রবেশ করল। অন্তি কিছু বলে ওঠার আগেই সে তড়িঘড়ি করে খিড়কি আটকে দিতে দিতে কড়া আদেশে বলল, “টু শব্দটিও যেন না হয়।”
—–
চলবে,
®সাদিয়া আফরিন নিশি