#মন_ভেজা_শ্রাবণে
(পর্ব-১৫)
————–
হারিকেনের নিভু নিভু আলোয় অন্তির ভীত-সন্ত্রস্ত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল আদ্র। যা ভেবেছিল ঠিক তাই। একা ঘরে মেয়েটা যে চরম ভয় পেয়েছে তা তার চেহারায় স্পষ্ট। আদ্র এক হাতে অন্তির ছোট্ট, কোমল দেহটা টেনে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নিল। অন্তি অস্ফুটস্বরে বলল,”কী করছেন?”
আদ্র অন্তিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নমনীয় কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “খুব কী বেশি ভয় লেগেছে?”
অন্তি শুকনো মুখে উত্তর দিল, “উহুম।”
“মিথ্যে বলছিস তাও আবার আমাকে।”
অন্তি আর কিছু বলল না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ঝাপিয়ে পড়ল আদ্র’র বক্ষগহ্বরে। এতক্ষণের ভয়,কষ্ট, ছটফটানি এবার অশ্রু হয়ে ঝড়ে পড়ছে প্রিয়’র বক্ষে। আদ্র দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে নিল অন্তিকে। অন্তির কাঁধে মুখ ডুবিয়ে দিয়ে ভারি আওয়াজে বলল, “সরি জান আমার আরও আগে আসা উচিত ছিল। আ’ম ভেরি সরি।”
কিছুসময় কাটল নিরবতায়। থেকে থেকে অন্তির ফোঁপানোর ধ্বনি ভেসে উঠছে। অতঃপর আদ্র খুব সন্তপর্ণে অন্তিকে বিছানায় বসিয়ে দিল। আদেশের সুরে বলল, “শুয়ে পড়।”
এতক্ষণে যেন অন্তির ঘুমন্ত মস্তিষ্ক জেগে উঠল। সে ততক্ষণাৎ বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়াল। মনের মধ্যের ভয়-ভীতি এক পাশে ঠেলে রেখে চোখ জোড়া রসগোল্লার আকৃতি ধারণ করে বলল,”শুয়ে পড়ব মানে তাহলে আপনি এখানে কী করবেন?”
“আমিও শুয়ে পড়ব।”
“কোথায়?”
“এখানেই।”
“পাগললল আপ…..”
অন্তির চিৎকারে আদ্র দ্রুত ওর মুখ চেপে ধরে। চোখ গরম করে ফিসফিস শব্দে বলে,”আস্তে বল সবাই জেগে যাবে তো।”
অন্তি চোখের ইশারায় আদ্র’র হাত ওর মুখের ওপর থেকে সরাতে বলছে। মুখ দিয়েও বলার চেষ্টা করছে তবে আদ্র’র হাতের কারণে তা বিকৃত শব্দ হয়ে ভেসে আসছে। আদ্র বুঝতে পেরে অন্তির মুখ থেকে নিজের হাত গুটিয়ে নেয়। ছাড়া পেয়ে অন্তি দীর্ঘক্ষণ লম্বা শ্বাস টানে। অতঃপর নিম্ন আওয়াজে বলে,
“আপনি কী বলছেন এসব? আপনার কী মাথাটা সত্যিই খারাপ হয়ে গেছে?”
“মাথা খারাপের কী দেখলি?”
“তা নয়তো এখানে থাকতে কেন চাইছেন?”
“তবে কী করব তোকে এভাবে একা ফেলে চলে যাব?”
“সেটা বড় কথা নয়। কথা হলো…..”
“সেটাই বড় কথা!! তুই কতটা ভয়ে ছিলি তা আমি তোর মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছি৷ আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম তবে সকলের ঘুমের অপেক্ষায় ছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আসলে কেউ টের পেয়ে যেত। এতে করে তোর জন্য ভালো হত না।”
“হ্যাঁ এখনই বা আমার কীসে ভালো হচ্ছে? এভাবে আপনাকে কেউ দেখে নিলে কী হবে বুঝতে পারছেন। আর তাছাড়া আমি কী করে আপনার সঙ্গে এক ঘরে থাকব।”
আদ্র অন্তির শেষোক্ত কথায় ভ্রু কুঁচকে ফেলল। কিছুক্ষণ গোটা অন্তিকে পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে ধীরে ধীরে অন্তির নিকটে এগোতে লাগল। আদ্র’র কোনো প্রতিত্তোর না পেয়ে সামনে তাকাতেই অন্তি ভড়কে উঠল। এ কেমন চাহনি? আদ্র শীতল দৃষ্টিতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে ওর চোখে কোনো নেশা লেগে গেছে। আদ্র যত এগোচ্ছে অন্তি ক্রমশ পেছচ্ছে। এক পর্যায়ে অন্তির পা গিয়ে ঠেকে বিছানায়। এপাশ – ওপাশ করে আর কোথাও যাওয়ার জায়গা না দেখে সে এক শুকনো ঢোক গিলে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আদ্র’র চোখে চোখ মেলায়। আদ্র ততক্ষণে তার একদম নিকটে চলে এসেছে। এক হাতে শক্ত করে অন্তির কোমর পেচিয়ে নেয়। আরেক হাত অন্তির আঙ্গুলের ভাঁজে ঢুকিয়ে নেয়। নেশাক্ত ভরাট কন্ঠে বলে,
“আমার সঙ্গে একঘরে থাকলে কী তোর জাত যাবে নাকি বিশ্বাস করে উঠতে পারছিস না?”
অন্তি আমতা আমতা করে কিছু বলতে নেয় কিন্তু আদ্র তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“থাক কিছু বলতে হবে না। বিশ্বাসের সহিত শুয়ে পড়। আর আমি খুব ভোরেই বেড়িয়ে যাব কেউ দেখার আগে। এভাবে তোকে একা এমন একটা জায়গায় রেখে কিছুতেই নিজে শান্ত হয়ে ঘুমতে পারছিলাম না। আর এখন এসে পড়ে তোর যা অবস্থা দেখলাম তাতে করে এবার তো একদমই অসম্ভব। আচ্ছা শুয়ে পড়।”
অন্তি আর কথা বাড়ায় না। চুপটি করে বিছানার এক কোণে শুয়ে পড়ে। আদ্র বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ঘরের মধ্যে থাকা একটা বেতের চেয়ারে বসে পড়ে। অন্তি সেদিকে লক্ষ্য করে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
“ওখানে বসলেন যে৷”
“আমি এখানেই আছিন। তুই ঘুমা।”
“আপনি ঘুমাবেন না?”
“হুম।”
“তো না শুয়ে ওখানে বসলেন কেন? এখানে এসে শুয়ে পড়ুন।”
“ওখানে শুলে তোর অসুবিধে হবে। আমি এখানেই ঘুমিয়ে নিব।”
“আমি তো আর হাতির বাচ্চা নই যে এত বড় বিছানা টা একাই দখল করে নেব। আমার এই ছোট্ট দেহ এমনিতেই বিছানার এক কোণে পড়ে থাকে। অপর পাশে নিসন্দেহে আপনার মতো একজন ডায়নোসরের জায়গা হয়ে যাবে।”
আদ্র ভ্রু উঁচিয়ে বলল,”আমি ডায়নোসর?”
অন্তি কী বলেছে বুঝতে পেরে জিভে্ কামড় দিয়ে কাঁথার নিচে ঢুকে পড়ে। কাঁথার মধ্যে থেকেই তার উত্তর, “শুয়ে পড়ুন।”
আদ্র হারিকেনের আলো নিভিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে বিছানার এক কোণ দখল করে নেয়। অন্তি কাঁথার মধ্যে থেকে শক্ত হয়ে থাকে। আদ্র’র কষ্ট হবে ভেবে বলে তো দিল বিছানায় শুতে কিন্তু এখন তার কী হবে? সে কী করে ঘুমবে? ভীষণ আনইজি ফিল হচ্ছে। আদ্রর ওপর পূর্ণ বিশ্বাস আছে। কিন্তু ভয় তো সেখানে না। প্রেমিক পুরুষের সঙ্গে একা ঘরে, একা বিছানায় শোয়া কী চারটিখানি কথা। অনূভুতিরা হাঁসফাঁস করে না বুঝি? মনের মধ্যে যে তীব্র ঝড় ওঠে কে থামায় সেই ঝড়? এলোমেলো লাগে সবকিছু।
সুখ সুখ অনুভূতি হয়।
রাশভারি চাপা কন্ঠে টনক নড়ে অন্তির। আদ্র গুমোট কন্ঠে বলছে, “নিজের স’র্ব’না’শ নিজেই ডেকে এনেছিস ৷ এরপর যদি কোনো অঘটন ঘটে যায় তার দায় কিন্তু কেবল তোর একার।”
এমন উক্তিতে অন্তির শূন্য মস্তিষ্কে হিম শীতল প্রবাহ বয়ে গেল যেন। অশান্ত অনুভূতিগুলো দ্বিগুণ এলোমেলো হয়ে তীব্র ঝড়ের সৃষ্টি করছে। সারা শরীর জুড়ে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে চলেছে।কাঁথার মধ্যে থেকে ঘন ঘন শ্বাস প্রশ্বাসের আনাগোনা শোনা যাচ্ছে। আদ্র ঠোঁট কামড়ে বিনা আওয়াজে হাসল। সে ইচ্ছে করেই এমন কথা বলেছে। প্রেয়সীকে এতটা কাছে পেলে যেকোনো প্রেমিক পুরুষের মনেই বিপরীত বাসনা জাগ্রত হওয়া স্বাভাবিক। আদ্রও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম নয় তবে তার মধ্যে আছে সহ্যশক্তি বলে এক অনন্য ক্ষমতা। এই ক্ষমতা কিছু পুরুষ রপ্ত করতে পারে আবার কেউ কেউ ব্যর্থ হয়ে ভুল পদক্ষেপ নিয়ে বসে। আদ্র তার এই ক্ষমতা দ্বারা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছে।
রাত যত গভীর হয় মনের কোণে জমে থাকা সুপ্ত বাসনা গুলি ততই জাগ্রত হতে থাকে। অন্তি ঘুমিয়ে গেছে। গরমের প্রভাবে ঘুমের মধ্যে গায়ের কাঁথা ফেলে দিয়েছে। পরনের কাঁপড় খানিক এলোমেলো। বাঁশের ছন ভেদ করে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করা জ্যোস্নার আলোয় ঘুমন্ত অন্তিকে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। এ দেখাই যেন কাল হলো আদ্র’র জন্য। নিজেকে যেভাবে কন্ট্রোলে রেখেছিল এখন তাও দায় ছাড়া হয়ে পড়ছে। খুব করে ইচ্ছে করছে প্রেয়সীর কোমল দেহে আদুরে স্পর্শ এঁকে দিতে। কিন্তু তা তো একেবারেই বারণ। উপায়ন্তর না পেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে সে। পরিহিত প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর দিয়াশলাই বের করে নেয়। একটি সিগারেট বের করে জ্বালিয়ে নেয়। সিগারেটের ধোঁয়া গুলো খুব জোর টানে একবার ভেতরে তো একবার বাহিরে ফেলছে। মনের মধ্যে জ্বলে ওঠা দাবানল যেন এই ধোঁয়াই বের করে নিয়ে আসতে সক্ষম হচ্ছে। কী অদ্ভুত!!!
চলবে,
(সাদিয়া আফরিন নিশি ®___)