#মন_ভেজা_শ্রাবণে
#পর্ব_১৬
—————————–
ভোর হওয়ার আধঘন্টা আগেই নিজের ঘরে চলে যায় আদ্র। যাওয়ার পূর্বে ভুল ক্রমেও আর দৃষ্টি দেয় নি অন্তির পানে। যাওয়ার আগে একবার ভেবেছিল অন্তিকে ডেকে দরজা লাগিয়ে নিতে বলবে। পরক্ষণেই ভাবল, মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে ঘুমিয়ে থাক। এখন তো প্রায় ভোর। একটু পর সকলে এমনিতেই উঠে পড়বে। ভয়ের কিছু নেই। এই ধারণা থেকে দরজা একদম সুন্দর মতো ভিড়িয়ে দিয়ে আদ্র নিজের ঘরে চলে যায়। বাহিরে থাকা দেখে বোঝার উপায় নেই অন্তির ঘরের ছিটকিনি খোলা। খুব নিখুঁত ভাবে কাজটি সম্পন্ন করেছে আদ্র।
ঘুম ভেঙে অন্তি আদ্রকে না দেখে তেমন একটা প্রতিক্রিয়া দেখায় নি। কারণ সে আগেই জানত আদ্র ভোরে চলে যাবে। তাই বিছানা থেকে নেমে চুপচাপ বাহিরে চলে আসে৷
প্রায় সকলেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। নিহাত, মিহু আর আদ্র নেই শুধু। তারমানে এরা এখনো ঘুম। অন্তির মনে মনে রাগ হচ্ছে আদ্র’র ওপর। এখনো কেন উঠল না। তাকে এভাবে একা রাখার মানে কী? কিন্তু অন্তি তো আর এটা জানে না ওর প্রতি তীব্র আকর্ষণে ছেলেটা সারারাত ঘুমতেই পারেনি। সারারাত ছটফট করে অবশেষে সিগারেটের ধোঁয়াও নিজেকে সিক্ত করেছে। এখন নিজের ঘরে একটু ঘুমচ্ছে।
বেলা এগারোটা বাজতেও যখন আদ্র’র কোনো দেখা নেই তখন অন্তি উদ্যত হয় আদ্রের ঘরের উদ্দেশ্যে। প্রথমে ইতস্তত করলেও শেষমেশ মন শক্ত করে ঠিক চলে যায়। দরজা ভেড়ানো। ভেতর থেকে ছিটকিনি খোলাই ছিল এজন্য ভেতরে ঢুকতে সমস্যা হয় না। অন্তি আশেপাশে ভালো করে নজর বুলিয়ে টুক করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। আগের ন্যায় দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে যেই না পেছন ফিরে সঙ্গে সঙ্গে তার মাথা চক্কর দেওয়ার উপক্রম। সারা শরীরে অদ্ভুত ক্রোধের আগমন। তার সর্বাঙ্গ থড়থড়িয়ে কাঁপছে। মুখ থেকে বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। অতঃপর বহু কষ্টে দাঁতে দাঁত চেপে কঠিন সুরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“হোয়াট ইজ দিস?”
ততক্ষণাৎ তড়িঘড়ি করে লাফিয়ে ওঠে নিহাত। সে এতক্ষণ ঘুমন্ত আদ্র’র বক্ষে স্থান করে নিয়েছিল। সেই দৃশ্যই সুস্পষ্ট রুপে অন্তির চোখে ধরা পড়ে। নিহাত ছিটকে দূরে সরে যায়। অন্তির চোখ দিয়ে যেন অগ্নি ঝড়ছে। না পারে এখনই নিহাতকে চিবিয়ে খেয়ে নেয়। অন্তি ফের তেজস্বী কন্ঠে বলে ওঠে,
“এসব কী করছিলে তুমি? তোমার সাহস কী করে হয় এভাবে ওনাকে টাচ করার? ওনার ঘুমের ফায়দা লুটছ লজ্জা থাকা উচিত। বেশরম মেয়ে মানুষ।”
নিহাতের গায়ে লাগে অন্তির কটুক্তি গুলো। সে কিছু বলতে নেয় তার আগেই লক্ষ্য করে আদ্র আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় উঠে বসছে। ওদেরকে এখানে দেখে আদ্র ভ্রু কুঁচকে বলে,
“কী হচ্ছে এখানে? এত চেঁচামেচি কীসের? ঘুমের বারোটা বেজে গেল আমার।”
অন্তি তখনো কটমট চোখে চেয়ে আছে নিহাতের দিকে। আদ্র’র প্রশ্নে নিহাত আমতা আমতা করতে করতে হুট করে দৌড়ে চলে যায় ঘর থেকে। এমন কান্ডে আদ্র বেশ অবাক হয়। সে অবাকন্বিত কন্ঠে অন্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“কী হল এটা। ও এভাবে চলে গেল কেন?”
অন্তি যেন এবার দ্বিগুণ ক্ষীপ্ত হয়ে উঠল। ক্ষীপ্র কন্ঠে বলল,
“এভাবে দরজা মেলে ম’রা’র মতো পড়ে থাকলে যে কেউ তো তার ফায়দা লুটবেই। এখন এসেছে নাটক দেখাতে।”
অন্তি আর এক মুহূর্ত দাড়াল না ক্রোধে ধপাধপ পা ফেলে চলল নিজের ঘরে। এদিকে আদ্র চেয়ে চেয়ে দেখল সবটা। কিছু বলা বা করার মতো পেল না। সে বুঝতে পারছে নিহাত নিশ্চয়ই বাড়াবাড়ি কিছু করেছে নয়তো এভাবে রাগতে অন্তিকে কখনো দেখা যায় নি। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বিছানা থেকে নেমে পড়ে আদ্র। পাগলী টার রাগ ভাঙাতে হবে যে। সে তো ওর জন্যই দরজা না লাগিয়ে ঘুমিয়েছিল। যদি ওর দরকার পড়ে তাই। কিন্তু ঘটনা ঘটে গেল পুরোই উল্টো!!
————–
সকাল থেকে রাত অব্দি আদ্র’র সঙ্গে তেমন কোনো কথা বলল না অন্তি। আদ্র শত চেষ্টা করেও পারেনি। মেয়েটা একটু বেশিই জেদি কী না। কিন্তু সবকিছুর পরে সারাদিন পেড়িয়ে নামল রাতের আধার। এখন তো আদ্রকে তার প্রয়োজন হবেই। এই আশা নিয়ে আদ্র এগোল অন্তির ঘরের সামনে। কিন্তু এ কী ঘর ঠিকই ভেতর থেকে বন্ধ। আদ্র ফোন বের করে অন্তিকে মেসেজ করল। কিন্তু নো সিন। পরপরই কল করল ফোন সুইচড অফ। রাগে আদ্র কপালের রগ ফুলে উঠল। জোর গলায় ডাকতেও পারছে না। আশেপাশে সবাই জেগে যাবে এই ভয়ে। পাক্কা আধ ঘন্টার মতো দাড়িয়ে থেকে বাধ্য হয়ে নিজের ঘরে চলে গেল সে। রুমে এসে পরপর এক প্যাকেট সিগারেট শেষ করে ফেলল। তবুও রাগ, উত্তেজনা কোনটাই কমছে না। আজ সারাদিন অন্তি তার সঙ্গে কথা বলেনি এটা তার একদম সহ্য হচ্ছে না। এই রাতটাও এভাবেই ছটফটিয়ে কাটিয়ে দেয় সে। ওদিকে অন্তির চোখেও ঘুম নেই। আদ্র’র সঙ্গে কথা না বলে তারও যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু নিহাতকে ওভাবে দেখার দৃশ্যটা কিছুতেই ভুলতে পারেছে না।
—————-
আজই এ গ্রামে আদ্রদের লাস্ট দিন। আগামীকাল খুব সকালে তারা রওনা হবে নিজেদের শহরের উদ্দেশ্যে। এই অল্পক্ষণের মধ্যে আদ্র’র মস্তিষ্কে এক গভীর প্ল্যান ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই ভাবনা থেকে সে সাহেলকে একান্তে ডেকে নিয়ে বলল,
“দোস্ত একটা প্ল্যানিং করেছি এখন তোদের হেল্প চাই।”
“কী প্ল্যান বলে ফেল?”
আদ্র সাহেলকে প্ল্যানিং এর ব্যাপারে বললে সে তো মহা খুশি। বন্ধুর জন্য এমন কিছু করতে পারলে ওর অবশ্যই ভালো লাগবে। তার ওপর ওদের গ্রামে এসে এতকিছু হলে দিনটা বিশেষ ভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেও বটে।
বিকেল বিকেল আদ্র’র সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী সবটা তৈরি করে ফেলে সাহেল। ওদের সঙ্গে রওনক, তিহা এবং নাবিলও উপস্থিত ছিল। সকলেই বেজায় খুশি। কিন্তু এ বিষয়ে এখনো ঘুণাক্ষরেও জানে না মিহু, নিহাত। ওদেরকে ইচ্ছে করেই জানানো হয় নি। ওরা জানলে বিরাট ঝামেলা বাঁধাতে পারে।
—————
ঘরের মধ্যে মন খারাপ করে বসে আছে অন্তি। একটু আগে তার সাহেলের নানুর সঙ্গে দীর্ঘক্ষন কথপোকথন চলেছে। এক পর্যায়ে তিনি ওকে নানারকম প্রেম বিষয়ক রসিকতাও করেছেন। মূলত সেসব শুনে তার মনটা দ্বিগুণ খারাপ হয়ে পড়েছে। আদ্র’র সঙ্গে বিবাদ হলে বেশি কষ্ট সে ই পায়। কিন্তু ছোট্ট মনে অভিমানের পরিমাণ টাও যে বেশি। নানাবিধ ভাবনা চিন্তার মধ্যেই অন্তির ঘরের দরজায় টোকা পড়ে। বাহিরে থাকা তিহা তাকে ডাকছে। অন্তি মনের ভাবনা সরিয়ে রেখে লম্বা নিশ্বাস ফেলে দরজা খুলে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে তিহা ব্যস্ত ভঙ্গিতে ওকে ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ে। অস্থির চিত্তে বলতে থাকে,
“অন্তি আদ্র’র অনেক বড় বি’প’দ হয়েছে তুমি এখুনি চল আমার সঙ্গে।”
অন্তির মস্তিষ্কে যেন কেউ ধড়াস করে কর লাঠির বারি দিল। দুনিয়া যেন ক্ষণেকের জন্য ওখানেই থেমে গেছে। হুঁশ ফেরাতে তিহা ওকে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলে,
“কী হলো চল তাড়াতাড়ি। এমন মুহুর্তেও ও শুধু তোমাকে দেখতে চাইছে বারেবার।”
আদ্র’র বি’প’দের কথা শুনে এতটাই শকড হয়েছে যে কী বি’প’দ আদৌ সে খবর নিতে ভুলে গেছে অন্তি। তিহার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এবার সেও হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে পড়ে আদ্রের কাছে।
—-০০
চলবে,
সাদিয়া আফরিন নিশি ®