#মন_ভেজা_শ্রাবণে
#পর্ব-১৭)
—————
নিস্তব্ধ রজনী। কোলাহল মুক্ত শান্ত পরিবেশ। চতুর্দিক অন্ধকারাচ্ছন্ন। এই আলো- আঁধারির মাঝে দুটো অবয়ব একে অপরের সম্মুখে দন্ডায়মান। একটি ছেলে তো আরেকটি মেয়ে। মেয়েটি যখন ছেলেটির একেবারে নিকটে এসে দাড়িয়েছে ঠিক তখনই ছেলেটি একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে তার সম্মুখে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তারপর শোনা গেল সেই স্নিগ্ধময়, পবিত্র কন্ঠ।
“সাত বছর কী কম কথা প্রেয়সী? সেই সাত সাতটি বছর অপেক্ষার পর আমি তোমায় পেয়েছি। চোখের সামনে তোমাকে বড় হতে দেখেছি। অপেক্ষা করেছি সেই শুভক্ষণ কখন আসবে যখন আমি আমার প্রেয়সীকে জানাব তাকে নিয়ে এই হৃদয়ে বেড়ে ওঠা সকল অনূভুতি, আহ্লাদ, অভিযোগ, অভিমান, ভালবাসা,চাওয়া-পাওয়ার গল্প। আজ সেই শুভক্ষণ আগত। আজ আমি তোমাকে আমার মনের সকল অনূভুতির সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা আমার অন্তঃকরণের তীব্র আর্তনাদ শোনাতে চাই। প্রাণ খুলে বলতে চাই ভালবাসি প্রেয়সী ভালবাসি। তোমার সকল অভিমান, অনূভুতিকে ভালবাসি। তোমার দুঃখ, কষ্ট, হাসি,আনন্দ সবকিছুকে ভালবাসি। তোমার স্নিগ্ধ, পবিত্র হৃদয় টাকে ভালবাসি। ভালবেসে, ভালবেসে আমার ভালবাসায় বন্দিনী করে রাখতে চাই তোমাকে। তুমি হবে কী আমার? গ্রহণ করবে কী তোমার এই পাগলাটে প্রেমিককে নিজের অর্ধাঙ্গ রুপে?”
দীর্ঘ অনূভুতি প্রকাশের পর ছেলেটি মেয়েটির দিকে গোলাপ গুচ্ছ গুলো এগিয়ে দিল। অন্ধকারের আচ্ছাদনে পুরোপুরি ভাবে বোঝা গেল মেয়েটি উচ্ছ্বসিত হয়ে লাফিয়ে উঠে গোলাপ গুলো গ্রহণ করল। তারমানে সে ছেলেটির প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। গ্রহণ করেছে ছেলেটিকে। ছেলেটি আনন্দিত হলো ভীষণ। আজ যে তীব্র উচ্ছ্বাসের দিন। ছেলেটি চাইল মেয়েটির আরও একটু কাছে আসতে। মেয়েটির সম্মতি আছে কথাটি মেয়েটির নিজ মুখ থেকে শুনতে। সেই প্রয়াসে সে যখন আরও একটু এগোল ঠিক তখনই জোরে জোরে তাল তালির আওয়াজ ফেসে এলো। আওয়াজ টি তাদের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। ছেলেটি থমকে দাড়িয়ে পড়ল। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। কে আসছে তবে এদিকটায়? ছেলেটি যখন তীব্র উত্তেজনায় ওদিক পানে তাকিয়ে আছে তখনই আলো জ্বলে উঠল। আলোক শূন্য পরিবেশ মুহুর্তেই জ্বলজ্বল করে উঠল কৃত্রিম বাল্বের আলোক ছটায়। ভেসে উঠল তিনটি মুখ। মুখোমুখি হলো তিনটি স্বত্বা। কেঁপে উঠল একটি হৃদয় কিছু হারানোর আশঙ্কায়। আরেকটি হৃদয় কাঁপল প্রিয় মানুষটির সুনিপুণ ভাবে আরেকজনকে প্রেম নিবেদন দেখে। আর আরেকটি হৃদয় কেবল আনন্দে উচ্ছ্বসিত। তার কোনো দিকে হেলদোল নেই। নিজ পরিকল্পনা সার্থক হয়েছে এতেই সে খুশি।
———-
“অ অ অন্তি!”
আদ্র’র হাত পা কাঁপছে। কী থেকে কী হয়ে গেল। অন্তির জায়গায় নিহাত কী করে এলো। অন্ধকারে বুঝতেও পারে নি। এখন কী করবে সে? কীভাবে কী বলবে অন্তিকে? অন্তি কী কিছু শুনতে চাইবে? নাকি কিছু বিশ্বাস করবে? ওই ছোট্ট হৃদয়ের অভিমান কমাতে যে পরিকল্পনা সে করেছিল অজান্তেই তার থেকে দ্বিগুণ ভ’য়ং’ক’র কষ্ট দিয়ে ফেলল সে তার প্রেয়সীকে। কী হবে এখন?কী হবে? কী হবে?
আদ্র’র গলা শুকিয়ে কাঠ। পায়ের শক্তি যেন লোপ পেয়েছে। এগোনোর মতো শক্তি টুকু অবশিষ্ট নেই। অন্তি নিশ্চুপ। এক দৃষ্টে চেয়ে আছে আদ্র’র পানে। নয়ন ছলছল। দৃঢ় চাহনি। দেখা মাত্রই যেন আদ্র’র বক্ষ দ্বিগুণ কেঁপে ওঠে। ওই প্রগাঢ় চাহনি নিশ্চয়ই কিছু ছিল যাতে আদ্র নিজের ধ্বং’স অনিবার্য দেখতে পাচ্ছে। নিহাত গোলাপ গুলো নাড়াচাড়া করছে আর উদ্ভট চাপা হাসিতে মেতে উঠেছে। আশ্চর্য আনন্দ হচ্ছে তার।
———-
অন্তি বিনাবাক্যে ধীরে ধীরে আদ্রের চোখের আড়াল হয়ে যায়। আদ্র থামাতে গিয়েও পারে না। ধপ করে নিচে বসে পড়ে। এত শক্ত, কঠিন মানুষটার চোখ বেয়ে আজ বেড়িয়ে আসতে চাইছে নোনাজল। আদ্র শক্ত ভঙ্গিতে মাটির দিক তাকিয়ে ওভাবেই গেড়ে বসে রইল। নিহাত বুঝল অবস্থা তেমন একটা ভালো নয়। যেকোনো সময় তার ওপর আ’ঘা’ত আসতে পারে তাই সুযোগ বুঝে কেটে পড়ল। ততক্ষণে সেখানে উপস্থিত হয়ে গেছে তিহা, রওনক আর সাহেল। ওরা এতক্ষণ পাশেই ছিল। সবটা দেখেছে। কিন্তু কেউ আসার সা’হ’স পাচ্ছিল না। অন্তিকে নিয়ে তিহা যখন উপস্থিত হয় তার আগেই নিহাত টুক করে ওখানে ঢুকে পড়ে। এটা যখন ওরা জানতে পারে তখন অনেক দেড়ি হয়ে গেছে। মানে অন্তি তখন ওখানে উপস্থিত। তাই কেউ কিছু করার আগেই অন্তি এসব দেখে নেয়। এসেছিল আদ্র’র বি’প’দের খবর পেয়ে এখন দেখছে নিজেরই বি’প’দ হাজির। নাবিল এখনো আড়ালেই ঠায় দাঁড়িয়ে। তার আদ্র’র সম্মুখে উপস্থিত হওয়ার বিন্দু মাত্র অবস্থা নেই। কী মুখে আসবে সে? কী বলবে এসে? সবকিছুর আড়ালে আরও একটি মুখ ভ’য়া’ব’হ হাসিতে মেতে উঠেছে সকলের অগোচরে। তার বহু বছরের মনের ক্ষত আজ কিছু টা হলেও কমে এসেছে। অদ্ভুত শান্তি, শান্তি অনুভব হচ্ছে। সবকিছু ভীষণ ভালো লাগছে। মনের শান্তিই যে বড় শান্তি!!
“আ আদ্র আ’ম সরি দোস্ত। এসব কী করে কী হয়ে গেল সত্যিই আমরা কিছু বুঝতে পারছি না। নিহাত কীভাবে এখানে? অন্তিকে নিয়ে ঢুকার পূর্বেই দেখি এখানে অলরেডি সিন শুরু হয়ে গেছে। প্রথমে বুঝতে অসুবিধা হয় কিন্তু পড়ে যখন বুঝতে পারি ততক্ষণে অনেকটা দেড়ি হয়ে গেছে। অন্তি তার আগেই দেখে নিয়েছে।”
তিহার কথা কতটুকু কানে গেল আদ্র’র তা ঠিক বোঝা গেল না। সে সেভাবেই পাথর মূর্তি রুপ ধারণ করেই শক্ত কন্ঠে বলল,
“কীভাবে জানল ও? কে বলল ওকে? কীভাবে আসল এখানে?”
আদ্র’র কঠিন গলায় করা প্রশ্নে সকলেই শঙ্কিত। তবুও অন্তরে দীর্ঘ সাহস সঞ্চার করে সাহেল বলল,
“আমরা তো তা বলতে পারছি না দোস্ত। এই রহস্য ঠিক বের করে ছাড়ব দেখিস৷ কিন্তু তোর এখন এভাবে বসে থাকলে চলবে না। অন্তিকে বোঝাতে হবে তো। মেয়েটা নেহাৎই ছোট। আবেগে গা ভাসিয়ে কী থেকে কী করে বসে। তুই আগে ওর কাছে যা। আমরা তোর সাথে আছি।”
সাহেলের হ্যাঁ-তে বাকিরাও হ্যাঁ মেলাল। আদ্র নিজেও সম্মতি প্রশণ করল।
———-
ঘরের মধ্যে অন্তিকে কোত্থাও পাওয়া গেল না। কিন্তু আদ্র’র অবচেতন মন প্রেয়সীর খোঁজে উতলা হয়ে উঠল। বাড়ির আনাচে কানাচে সকল জায়গায় খুঁজল। কিন্তু ফলাফল শূন্য। অবশেষে বাড়ির পশ্চাৎ ভাগে অবস্থিত সুবিশাল পুকুরটির বাঁধাই করা পাড়ের ওপর দেখা মিলল অন্তির। এই আলো-আঁধারির রাতে মেয়েটা একা একা এখানে ওর কী বিন্দু মাত্র ভয় – ডর করছে না। নাকি মনের শোক পৃথিবীর সব ভয়কে জয় করেছে। আদ্র ধীর পায়ে এগোল কাঠ হয়ে বসে থাকা অন্তির নিকট। ধীরে ধীরে খুব সন্তপর্ণে গিয়ে অন্তির পাশের জায়গাটুকু দখল করে নিল। অন্তি একটিবার ফিরে দেখল না। সে সেভাবেই মূর্তিমান হয়ে ঠায় বসে। দৃষ্টি পুকুরের পানিতে। আদ্র কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। অতঃপর ক্ষনকাল চলে গেলে অতি আদরের সহিত অন্তির কোমল হাত জোড়ার একটি নিজের দখলে নিয়ে নিল। অন্তি তখনও নিশ্চুপ। না আদ্র’র থেকে তার হাত মুক্ত করতে চাইছে আর না একটি প্রতিবাদী বাক্য প্রয়োগ করছে। আদ্র অন্তির এমন রুপে বেশ ভয় পাচ্ছে। যে মেয়ের এতো অভিমান, এতো অভিযোগ সে কীভাবে নিশ্চুপ থাকতে পারে?
“অন্তি! প্রেয়সী! কলিজা আমার!
আজ যা হলো জানি তার পরে কোন মুখে কথা বলছি সত্যিই আমার জানা নেই। তবে আমি মানছি এতে করে দোষ পুরোটাই আমার। আমার আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। আমি আমার কলিজার অভিমান ভাঙাতে গিয়ে তাকে আরও দ্বিগুণ কষ্ট দিয়ে ফেললাম। আমি আমার………”
“ভাগ্যিস বি’প’দ টা আপনার না হয়ে আমার হলো। কী ভ’য়ং’ক’র সে অনূভুতি ছিল।
আদ্র যেন শক্ত হয়ে গেল। অন্তির এতটুকু কথাই তার কঠিন হৃদয়ে রক্তক্ষরণ সৃষ্টি করল। তোলপাড় হয়ে এলো চতুর্দিক। মনে মনে এক ভ’য়ং’ক’র পরিকল্পনা করে নিল। অন্তির মান ভাঙানোর পর যারা এ সকল ঘটনার পেছনে আছে অবশ্যই নিজ হাতে তাদের কঠিন শা’স্তির বন্দবস্ত সে করবে। একটুও গাফিলতি করবে না।
—–
চলবে,
সাদিয়া আফরিন নিশি ®____