মন ভেজা শ্রাবণে পর্ব-১৮

0
525

#মন_ভেজা_শ্রাবণে
#পর্ব_১৮
————–
“ভালবাসি, ভালবাসি শুধু তোমাকে!”

গম্ভীর, ভারাক্রান্ত,পুরুষালি ফিসফিসে কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই এক অদ্ভুত কম্পনে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে অন্তি। সর্বাঙ্গ জুড়ে কেমন তীব্র শিহরণ বয়ে চলেছে। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। মুহুর্তেই যেন সকল হৃদয় ভাঙা কাহিনী বিলীন হয়ে উঠল তীব্র সুখকর অনূভুতির ছোঁয়ায়। কী যেন হয়ে গেল হঠাৎ করে অন্তির। সকল লাজলজ্জা, মান-অভিমান, রাগ-ক্ষোভ বিসর্জন দিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে জায়গা করে নিল আদ্র’র বক্ষগহ্বরে। খুব দৃঢ় সে অনূভুতি, সে ছোঁয়া! আদ্র যেন ভাবতেই পারেনি এমন কিছু হবে। আশ্চার্যান্বিত হয়ে সেও নিজের সঙ্গে প্রগাঢ় ভাবে জড়িয়ে নেয় অন্তিকে। অকস্মাৎ শোনা যায় ফোঁপানোর আওয়াজ। আদ্র একটুও ভড়কাল না। কারণ সে জানত এমনটা হওয়ারই ছিল। এখন যেন দুজনেরই মনের ব্যথা কিঞ্চিৎ উপশম হলো। সহসা অন্তি তার কোমল কন্ঠস্বর নাড়িয়ে ব্যথিত সুরে বলে উঠল,

“আমার সাথেই কেন এমন হয়?”

আদ্র কিছু বলতে পারল না। দ্বিগুণ শক্ত করে অন্তিকে জড়িয়ে নিল। মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “সব ঠিক হয়ে যাবে কলিজা।”

অন্তি দুহাতে খামচে ধরল আদ্র’র শার্টের অংশবিশেষ। চাপা আর্তনাদে বলল,”কবে শেষ হবে!ঠিক কবে বলতে পারেন?”

আদ্র দীর্ঘ শ্বাস ফেলে কিছু বলতে উদ্যত হয় কিন্তু তার আগেই আরও একটি কন্ঠস্বরে ওরা দুজনেই ছিটকে দূরে সরে যায়। নাবিল অপরাধীর ন্যায় ঠায় দাঁড়িয়ে। আদ্র নাবিলকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল, “কিছু বলবি?”

“হুম বলব তবে তোকে নয় অন্তিকে।”

অন্তি, আদ্র দু’জনেই অবাকন্বিত চাহনি নিক্ষেপ করল নাবিলের পানে। নাবিল তা দেখে কিঞ্চিৎ হাসার চেষ্টা করে বলল, “নিহাত যেমন আমার অন্তিও তো আমার বোনের মতোই। তাই এক বোনের ক্ষতি করে আরেক বোনের উপকার করার মতো ভাই আমি নই৷ ভালো যখন চাই তখন দুজনেরই ভালো হোক। দুজনেই ভালো থাকুক।”

এ পর্যায়ে আদ্র দ্বিগুণ আশ্চর্যান্বিত হয়ে পড়ে। নাবিল ঠিক কী করতে চাইছে তাই তার মাথায় ঢুকছে না। নাবিল কিঞ্চিৎ এগিয়ে এসে ওদের পাশেই পুকুর পাড়ে বসে পড়ল। অন্তির মাথায় মৃদু স্পর্শে হাত বুলিয়ে দিয়ে আকাশ পানে চেয়ে বলতে শুরু করল,

“আজ থেকে চার বছর আগে নিহাত তখন সবে সবে কলেজে উঠেছে। তখন নিহাত আলাদা কলেজে পড়ত। ভাই-বোন এক কলেজে আমরা কখনোই পড়তে চাই নি৷ সেই সুবাদে বাবা আমাদের আলাদা কলেজে ভর্তি করিয়ে দেয়৷ সেই থেকে নিহাত ওর মতো আর আমি আমার মতো পড়াশোনা করতে লাগলাম। আদ্র’র সঙ্গে আমার এ কলেজেই পরিচয়। আদ্র কখনো আমাদের বাসায় যায় নি। সাহেল, রওনক প্রায়ই যেত কিন্তু আদ্র কখনো যায় নি। হাজার বলেও তাকে কেউ নিতে পারে নি। এভাবেই চলতে থাকে সবকিছু। সে বছর শেষে নিহাতের ইয়ার ফাইনাল এক্সাম শুরু হয়ে যায়। আমিও তখন পড়াশোনা৷ নিয়ে তীব্র ব্যস্ত। বোনের দিকে নজর দেওয়ার সময় কই। সেটাই ছিল আমার মস্ত বড় ভুল। নিহাত চলে গেল বিপথে। মন দিয়ে বসল ভুল মানুষকে। ছেলেটি নাকি ওর থেকে ওয়ান ইয়ার সিনিয়র ছিল। এক্সাম শেষে ধীরে ধীরে নিহাতের মধ্যে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করতে থাকি। আমার হাসিখুশি, প্রাণচ্ছল বোনটা কেমন ঝিমিয়ে পড়তে লাগল। নিজেকে সবসময় গুটিয়ে রাখত ৷ স্পষ্ট কিছু একটা লুকতে চেষ্টা করত। অকস্মাৎ একদিন দেখি নিহাত পাগলের মতো বাহির থেকে দৌড়ে এসে নিজের ঘরে চলে যায়। আমি তখন ড্রইংরুমে বসে টিভি দেখছিলাম। বোনকে এভাবে ছুটতে দেখে আমিও হতভম্ব হয়ে ওর পিছু ছুটি। ঘরে গিয়ে দেখি সে ওয়াশরুমে। ভেতর থেকে পানির শব্দ স্পষ্ট ভেসে আসছে। হয়তো শাওয়ার নিচ্ছিল। আমি বার কয়েক ওকে বাহির থেকেই ডাক দেই কিন্তু ও কোনো উত্তর দেয় না৷ বাধ্য হয়ে তখন আমি নিচে নেমে আসি। ঘন্টা খানেক পর আবারও রুমে যাই। মনের মধ্যে কেমন খচখচ করছিল। সেখানে গিয়ে দেখি নিহাত এখনো বের হয়নি। ভেতর থেকে পানির শব্দ ঠিক একইভাবে ভেসে আসছে। কুল-কিনারাহীণ হয়ে আমি তখন কাজের মেয়েটির সাহায্যে দরজা ভেঙে ফেলি। বোন আমার তখন অচেতন হয়ে শাওয়ারের নিচে পড়ে আছে। হাত-পা অলরেডি ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। শীতের রাত তার ওপর ঠান্ডা পানির নিচে ঘন্টা খানেক পরে থাকার ফল খুব একটা ভালো হয়নি। আমি তখন আমাদের পারিবারিক ডক্টর আক্কেলকে কল করি। বাবা সেদিন বাড়িতে ছিলেন না। ব্যবসায়িক কাজে চিটাগং গিয়েছিলেন। আমি একা হন্তদন্ত হয়ে কী করব না করব বুঝতে পারছিলাম না। ডক্টরকে আসতে বলে কাজের মেয়েটিকে বলি ওর ড্রেস চেঞ্জ করে দিতে। কিছুক্ষণের মধ্যে কাজ হয়ে যায়। ডক্টরও ততক্ষণে চলে এসেছে। ডক্টর এসে জানায় ও মানসিক দিক দিয়ে ঠিক নেই। মনের ওপর গভীর কোনো চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। যা তার মন,মস্তিষ্ক উভয়ের জন্যই ক্ষতিকারক। ডক্টর তখন সাময়িক ট্রিটমেন্ট দিয়ে চলে যায়। আর বলে যায় অসুবিধে হলে জানাতে। সে রাতে নিহাতের প্রচন্ড জ্বর আসে। সেই জ্বর অব্যাহত থাকে ঠিক এক মাস। দুদিন পর বাবাও চলে এলেন। বড় বড় ডক্টর দেখানো হলো ওকে কিন্তু কোনো লাভ হল না। সকলেরই এক কথা কিশোরী মনে কোনো এক যন্ত্রণার বিরূপ প্রভাব পড়েছে। আগে ওর ভেতরে কী চলছে তাই উদঘাটন করতে হবে নয়তো তেমন কোনো ট্রিটমেন্টে কাজ হবে না। কিন্তু কীভাবে কী? কী করে জানব কী হয়েছে ওর যেখানে সে নিজেই জ্বরে অচেতন থাকত সর্বক্ষণ। সামান্য স্যালাইনের ওপর জীবন টিকে ছিল ওর। তারপর দিশেহারা হয়ে একদিন ওর ঘর সার্চ করি যা বড় ভাই হিসেবে কখনো আমি করিনি। অবশেষে পেয়ে যাই একটা ডায়েরি। সেখানে নিহাতের প্রেম কাহিনী সেই অমানুষকে ঘিরে যার প্রতিটি ভাষা স্পষ্ট। শুরু থেকে ওদের পরিচয়, প্রেমের শুরু, আলাপ-আলোচনা সবকিছু স্পষ্ট ভাষায় উল্লিখিত। শুরুটা পড়ে আমারও ভালো লেগেছিল। কথায় আছে না ভালবাসা দেখেও শান্তি। কিন্তু যতটা শান্তি শুরুতে পাই ঠিক তখনটাই স্তব্ধা খাই শেষটা পড়ে। সে কী হৃদয় বিদারক গল্প। উহুম গল্প নয় বাস্তব! ছেলেটি না ভাবে আমার বোনকে প্রেসার দিয়ে টাকা নিত। নিহাত কিছু বলত না দিয়ে দিত। পরে একসময় সে নিহাতকে হু’ম’কি দেয় বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে তাকে বিয়ে করতে নয়তো ওর সঙ্গে রিলেশন ছিন্ন করবে। নিহাত তখন সবে কলেজে উঠেছে তাই আমি বা বাবা কেউই বিয়ের ব্যাপারটা মেনে নিতাম না। তাই বাধ্য হয়ে নিহাত ছেলেটির কথায় রাজি হয়ে যায়। যাওয়ার দিন ছেলেটি বলে নিহাতের সকল গহনা,টাকা-পয়সা সবকিছু সঙ্গে করে নিয়ে আসতে নয়তো তারা সংসার গোছাবে কী নিয়ে। আমার বোকা বোনটি তখন ভালবাসায় অন্ধ হয়ে ছেলেটির সকল কথায় নিয়ম করে পালন করে। বাড়ি থেকে সবকিছু নিয়ে বেড়িয়ে যায় সে রাতে। আর ফিরে আসে বিধস্ত হয়ে। ছেলেটি আমার বোনের থেকে সকল টাকা-পয়সা, গহনাগাঁটি ছিনিয়ে নিয়ে আমার বোনের দুচোখ ভরা সুখের স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে চলে যায় দুর থেকে বহু দূরে। নিহাতকে তুলে দিয়ে যায় তার-ই কিছু কুলাঙ্গার বন্ধুদের হাতে। সে থেকে বোনটি আমার বহু কষ্টে পালিয়ে আসে কিন্তু তার মনে রয়ে যায় সে রাতের প্রেমিক পুরুষ থেকে দেওয়া গভীর যন্ত্রণা, ছটফটানি, বেদনার ছাপ। শেষোক্ত কথা গুলো হয়তো নিহাত প্রথম দিকে জ্বরের ঘোরেই লিখেছিল। কারণ ভাষাগুলো এলোমেলো, অস্পষ্ট ছিল। লেখাগুলো ভাঙা ভাঙা ছিল। আমার গোছালো, পরিপাটি বোনটা নিমেষেই এক বদ্ধ উন্মাদে পরিণত হল। সেই ছেলেকে হাজার খুঁজেও আমরা নাগাল পাইনি। খোঁজ খবর নিয়ে দেখি তার বায়োডাটা পুরোটাই ছিল নকল। তারমানে এসব পূর্ব পরিকল্পনা করা ছিল। এমনটাই ওর উদ্দেশ্য ছিল। সেই থেকে নিহাত হয়ে গেল মানসিক রুগী। ঘরের মধ্যে থেকেই তার ট্রিটমেন্ট চলত। এভাবেই চলছিল। আমাদের হাসিখুশি ছোট্ট সংসারে নেমে এলো অমানিশার কালো ছায়া। এরই মধ্যে একদিন আমার ফ্রেন্ডগণ সকলে আমাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত। আদ্রকেও জোরপূর্বক সকলে নিয়ে আসে সেদিন। সকলে মিলে আমরা বাড়িতে আড্ডা দিচ্ছি এমন সময় দেখি নিহাত ঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। পাগলের মতো বলতে থাকে, “কই কই আমার আদ্র! কই আমার আদ্র! কই কই কই!” প্রথমে আমিও বুঝে উঠতে পারি না। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে যায় ওকে যে ধোঁকা দিয়েছে সেই ছেলেটির ফেইক নেম ছিল আদ্র। নিহাত ছেলেটিকে আদ্র নামেই চিনত। এক পর্যায়ে নিহাতের এমন পাগলামিতে সকলেই ভড়কে যায়। ওদের মধ্যে থেকে নিহাত খুঁজে পায় আদ্রকে। সেই থেকে নিহাত মানতে শুরু করে এই আমার বন্ধু আদ্র-ই হলো তার ভালবাসা আদ্র। শত চেষ্টায়ও ওকে কেউ বোঝাতে পারি নি। ধীরে ধীরে নিহাত সুস্থ হতে থাকে। তবে সেই সুস্থতা শুধু বাহ্যিক। ভেতরে ভেতরে তার মস্তিষ্ক অনেক কিছুই ভুলে গেছে। আমার নরম হৃদয়ের বোনটা হয়ে উঠেছে বর্বর। কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। আদ্রকেই এখন সে নিজের পৃথিবী ভাবতে শুরু করে দিয়েছে।

নাবিল দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। মৌন কন্ঠে ফের বলে, “কথা ছিল নিহাতের গ্রাজুয়েশন কম্পিলিট হয়ে গেলে বিদেশে নিয়ে যথার্থ ট্রিটমেন্ট করানো হবে কিন্তু এখন দেখছি আগে থেকেই এ ব্যবস্থা করতে হবে। আর যাই হোক এক বোনের জন্য অন্য বোনের ক্ষতি হোক তা এই ভাইটি কখনোই চাইবে না। ভ্রাতৃ অস্তিত্ব বড়-ই অদ্ভুত!!

নাবিল ফের অন্তির মাথায় হাত রেখে বলল, ” শুনলে তো সবটাই। আদ্র’র কোনো দোষ নেই। ও শুধু আমার কথা রাখতেই নিহাতকে সহ্য করে আসছে। ভেবেছিলাম বোনটা যদি একটু ভালো থাকে। আচ্ছা তোমরা তবে থাকো আমি এখন উঠি। কালই বাড়িতে ফিরে নিহাতের পাসপোর্ট, ভিসা কনফার্ম করতে হবে। আর নিজেদের মধ্যে দূরত্ব রেখ না৷ সবটা মিটিয়ে নাও। ভালবাসা অমূল্য ধন!একবার হেলায় হারালে সহজে ধরা দেয় না!!

—–
চলবে,
সাদিয়া আফরিন নিশি ®___