মন রাঙানোর পালা পর্ব-০১

0
19

#মন_রাঙানোর_পালা
#Part_1
#ইয়াসমিন_খন্দকার

নিজের হবু বর হিসেবে সেনাবাহিনীর মেজর অভিক চৌধুরীকে দেখে চমকে উঠলো সুনীতি। যেই লোকটাকে যমের মতো ভয় পায়, যার আশেপাশে কয়েক সেকেন্ড থাকলেই কাপাকাপি শুরু হয়ে যায়, তাকে কিনা আজীবন সহ্য করতে হবে! সুনীতি আর ভাবতে পারলো না। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বলল,”আমি এই বিয়েটা করতে পারবো না।”

সুনীতির বাবা সামিউল খন্দকার যেন মেয়ের কথা গ্রাহ্যই করলেন না। বেশ হাসিমুখেই বললেন,”এটা মজা করার সময় নয় সুনীতি। আমরা এখানে একটা সিরিয়াস ম্যাটার নিয়ে কথা বলছি।”

সুনীতির এবার কান্না পেয়ে গেলো। নিজের বাবাই যদি এমন করে তাহলে সে কাকে বোঝাবে? এই ভেবে একবার আঁড়চোখে তাকালো অভিকের দিকে। অভিক পুরো ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছে। যেন কি হচ্ছে তাতে তার কোন পরোয়াই নেই। সুনীতি মনে মনে বলল,”অসম্ভব! এই খারুশ লোকটাকে তো আমি মরে গেলেও বিয়ে করব না।”

অভিকের বাবা আহসান চৌধুরী সুনীতির অস্থিরতা লক্ষ্য করলেন। তাই তো তিনি সুনীতির উদ্দ্যেশ্যে বললেন,”সত্যিই কি তুমি এই বিয়েটা করতে চাও না, মা?”

সুনীতি একবার নিজের বাবা তো একবার অভিকের দিকে তাকিয়ে না-বোধক মাথা নাড়ালো। আহসান চৌধুরী একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সামিউল খন্দকারের উদ্দ্যেশ্যে বললেন,”দেখুন, মিস্টার খন্দকার। আমার মনে হয়, সুনীতি সত্যিই এই বিয়েটা করতে চায় না। তাই আমাদের আর এই বিষয়ে কথা না বাড়ানোই মঙ্গল। কি বলো তুমি রাহেলা?”

বলেই নিজের স্ত্রী রাহেলার দিকে তাকালেন। রাহেলা খাতুন বেশ নাখোশ হলেন। সুনীতিকে তার বেশ পছন্দ ছিল। একই এলাকায় বাড়ি হবার কারণে মেয়েটাকে ছোট থেকে দেখেছেন। মেয়েটা যথেষ্ট ভদ্র এবং শালীন। ব্যবহারও অমায়িক। তাই তো চেয়েছিলেন নিজের ছেলের বউ করে নিয়ে যেতে। কিন্তু মেয়েটার এভাবে মুখের উপর না বলে দেয়াতে তিনি বেশ নারাজ হলেন। তাই তো গম্ভীর স্বরে বললেন,”তোমার যা ইচ্ছা!”

আহসান চৌধুরী বেশ বুঝতে পারলেন তার ঘরনী ভীষণ চটে গেছেন। তাই আর তাকে বেশি খোঁচাতে চাইলেন না। পাছে না আবার নিজের মেজাজ হারিয়ে মুখ ফসকে কিছু বলে দেয়। তখন সেটা একদম ভালো দেখাবে না। তাই তো তিনি ভদ্রতার সহিত সামিউল খন্দকারকে বলেন,”এখন তাহলে আমরা উঠি। তুমি আবার সুনীতির উপর বেশি রাগারাগি করো না। ওর নিজের জীবনের সকল সিদ্ধান্ত নিজে নেয়ার অনুমতি আছে।”

বলেই নিজের স্ত্রীকে ইশারা করলেন উঠে দাঁড়াতে। রাহেলা খাতুন থমথমে মুখ নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। অভিকও অনেকক্ষণ থেকে হাসফাস করছিল। সেও দ্রুত উঠে স্থান ত্যাগ করলো। সুনীতি তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। সামিউল খন্দকার ভীষণ লজ্জা বোধ করছেন। মেয়েটা এভাবে মুখের উপরে না করে দিয়ে ঠিক করল না৷ পরে তো বুঝিয়ে বলা যেত। বাসায় আসা গেস্ট এভাবে ফিরে গেলে ভালো দেখায় না। তাই তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সহিত বললেন,”আপনার তো এখনো কিছু খেলেন না। অন্তত নাস্তাটুকু করে যান।”

আহসান চৌধুরী কিছু বলার পূর্বেই রাহেলা খাতুন বলে উঠলাম,”তার কোন প্রয়োজন হবে না। আমাদের ক্ষিধে নেই।”

বলেই তিনি গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলেন। আহসান চৌধুরীও চলে গেলেন তার পিছু। সবাই বেরিয়ে যাবার পর সামিউল খন্দকারের সব রাগ গিয়ে জমা হলো নিজের মেয়ের উপর। তাই তিনি সুনীতির উপর চেচামেচি করতে শুরু করে দিলেন,”তোমার কি কোন সেন্স নেই? জীবনে দেখেছ এভাবে কেউ মুখের উপর না বলে?”

সামিউল খন্দকারের স্ত্রী নয়না খন্দকার রান্না করছিলেন। তিনি রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে বলেন,”কি হলো? মেয়েটার উপর এত চেচামেচি করছ কেন?”

“কেন করছি সেটা তোমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করো। ও চৌধুরী সাহেবের মুখের উপরেই বলে দিয়েছে যে, এই বিয়েটা ও করতে পারবে না। ওনারা অপমানিত বোধ করে না খেয়েই চলে গেলেন।”

“সেকি! আমি যে ওনাদের জন্য কত কিছু বানালাম!”

“সেটা তুমি নিজের গুণধর মেয়েকে বলো। আদর দিয়ে তো আমায় তুলেছ।”

নয়না খন্দকার নিজের মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”এভাবে বলো না। একটাই তো মেয়ে আমাদের। ওকে আদর করব না তো কাকে করব। আর তাছাড়া ওর বয়সটাও তো কম, এখনো বাচ্চা। তাই বুঝতে পারেনি।”

সামিউল খন্দকার এবার নিজের স্ত্রীর উপর রাগারাগি করে বললেন,”তোমার মেয়ে এখনো ছোট আছে? ২০ বছর পেরিয়ে গেছে, ভার্সিটিতে পড়ে তোমার মেয়ে, তবুও নাকি সে ছোট। লোকে শুনলে হাসবে।”

সুনীতি অসহায় দৃষ্টিতে তার মায়ের দিকে তাকালো। নয়না খন্দকার সুনীতির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,”তুমি যাও মামনী, তোমার রুমে গিয়ে রেস্ট নাও। আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলছি।”

সুনীতি মায়ের কথামতো তখনই নিজের রুমের দিকে রওনা দিলো। সামিউল খন্দকার নিজের স্ত্রীর উদ্দ্যেশ্যে বললেন,”এভাবেই মেয়েকে মাথায় তুলে নাচো। আমি আর কিছু বলব না।”

নয়না খন্দকার বললেন,”তুমি তো জানো, ও শুধু বয়সেই বেড়েছে। এখনো তেমন বোধবুদ্ধি হয়নি। আর তাছাড়া ও বিয়েটা করতে চায়নি তাই না বলেছে। এ নিয়ে আর কথা না বাড়ানোই ভালো। এমনিতেও আমার এসব আর্মি প্রফেশন ভালো লাগে না। ওদের জীবনের তো কোন নিশ্চয়তাই নেই। আমার একমাত্র মেয়েকে আমি এমন অনিশ্চিতয়তার মধ্যে ফেলতে চাইনি।”

“কিন্তু অভিক ছেলেটা অনেক ভালো ছিল। তাছাড়া মিস্টার এবং মিসেস চৌধুরীও খুব পছন্দ ছিল সুনীতিকে।”

“আচ্ছা, এসব কথা এখন ছাড়ো। আমরা নাহয় দুজনে মিলে ওনাদের কাছে গিয়ে সুনীতির ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়ে আসব।”

“যা ভালো মনে করো।”

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সুনীতি নিজের রুমে এসে চুপচাপ বসে আছে। তার যেন এখন কিছুই ভালো লাগছেনা। এমন সময় তার ফোন বেজে উঠল। সুনীতি ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল তার বেস্টু অহনা ফোন দিয়েছে। সুনীতি ফোনটা রিসিভ করতেই অহনা বলে ওঠে,”কিরে! কি খবর তোর?!”

সুনীতি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে,”কি খবর চাস!”

“তোকে এত উদাসীন লাগছে কেন?”

সুনীতি অহনাকে আজকের সকল ঘটনা খুলে বলল। সব শুনে অহনা হতাশামিশ্রিত কন্ঠে বলল,”এটা তুই কি করলি পাগলী?”

“আমি আবার কি করলাম?”

“মেজর অভিককে তো দেখেছিলাম গতবার তোদের পাড়ায় গিয়ে। উফ কি হ্যান্ডসাম লোকটা। আর কি তার এটিটিউড! আমি তো প্রথম দেখায় তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। তুই কিভাবে এই প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিতে পারলি?”

সুনীতি বলল,”আমার ওনাকে ভীষণ ভয় লাগে। ওনার কন্ঠস্বরটা কি গম্ভীর আর সবসময় কিভাবে রাগী, রাগী চোখে তাকান। উফ! আমি আর ভাবতে পারছি না। ছোটবেলায় একবার ওনার ধমক খেয়েছিলাম। আজও ঐ ঘটনা দুঃস্বপ্নে দেখি। তোর যদি ওনাকে এত পছন্দ হয় তো তুই বিয়ে করে নে।”

“প্রয়োজনে তাই করব। ধন্যবাদ আমার রাস্তাটা পরিস্কার করে দেয়ার জন্য।”

মজা করেই কথাটা বলে ফোন রেখে দিলো অহনা। আর সুনীতি ফোন রেখে দিয়ে অহনার বলা কথাগুলো ভাবতে লাগল। আসলেই লোকটা ভীষণ সুদর্শন! তখনই তার কানে ভেসে উঠল ১০ বছর আগের সেই ধমক,”এই মেয়ে…আমার গিটারে হাত দিয়েছ কেন। ওটা রেখে দাও বলছি।”

ব্যস, অতীত থেকে বেরিয়ে এসে সে বলে,”আল্লাহ বাচাইছে!”

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
এদিকে বাড়িতে এসে অভিক নিজের রুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে চারিদিকে যা পাচ্ছে ছুড়ে ফেলছে। এখনো সে ঐ মুহুর্তটা ভুলতে পাচ্ছে না। ঐ মেয়েটার এত বড় সাহস, অভিককে রিজেক্ট করে! অভিক যে সুনীতিকে পছন্দ করতো ব্যাপারটা এমন নয়। কিন্তু সুনীতি তাকে এভাবে রিজেক্ট করায় ব্যাপারটা তার আত্মসম্মানে লেগেছে। তাই সে এত রিয়্যাক্ট করছে। এদিকে রাহেলা খাতুন নিজের স্বামী আহসান চৌধুরীর উদ্দ্যেশ্যে বললেন,”সব দোষ তোমার!”

“আমি আবার কি করলাম? তুমিও তো সুনীতিকে দেখতে যেতে চাইছিলে।”

“আমার কিছু ভালো লাগছে না। ঐ মেয়ের এত বড় সাহস, আমার হিরের টুকরো ছেলেকে রিজেক্ট করে। দেখবে ওর কোনদিনও ভালো হবে না।”

“এভাবে কাউকে বদদোয়া দেওয়া ঠিক না রাহেলা। তুমি নিজেকে সামলাও।”

to be Continue……