মন রাঙানোর পালা পর্ব-১৪

0
247

#মন_রাঙানোর_পালা
#Part_14
#ইয়াসমিন_খন্দকার

বিয়ের পর সুনীতি আর অভিককে আলাদা করে কথা বলার জন্য একটি ঘরে পাঠানো হয়েছে। তবে দীর্ঘ সময় ধরে তারা দুজনেই চুপ করে আছে। কেউ কোন কিছু বলছে না৷ দীর্ঘ সময়ের নীরবতা ভেঙে অভিক বলে ওঠে,”তোমার যদি আমার থেকে কিছু জানার থাকে আমাকে প্রশ্ন করতে পারো। আমি আপাতত তোমাকে এটুকু বলতে পারি এই বিয়েটা আমি মন থেকে করেছি। তাই তোমাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে আমার কোন অসুবিধা নেই তবে তুমি নিজের সময় নিতে পারো৷ এছাড়া তোমাকে আরো একটা কথা বলার আছে। আমি আজকে সেনা ক্যাম্পে ফিরে যাব। একটা দীর্ঘ সময় আমি হয়তো ফিরব না৷ তুমি চাইলে তোমার বাবার বাসাতেই এই সময়টা কাটাতে পারো। আর যদি তোমার আমার সাথে থাকতে মন চায় বলো। আমি উপরমহলে কথা বলে সেই ব্যবস্থাও করে দেব।”

সুনীতি অভিকের কথাগুলো মনযোগ সহকারে শুনল। তৎক্ষণাৎ কোন প্রতিক্রিয়া জানালো না। একটু সময় চুপ থেকে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,”আমার সাথে গত দুই দিনে যা যা ঘটনা ঘটে গেল তারপর আমার পক্ষে সবকিছুকে স্বাভাবিক ভাবে দেখা সহজ নয়। আমি মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। তাই আপাতত আমি নিজের পরিবারের সাথেই থাকতে চাই। তবে আমি যখন পুরোপুরি স্বাভাবিক হবো তখন আপনার কাছে যাওয়ার কথা ভাবব।”

অভিক বলে,”যেমন তোমার ইচ্ছা।”

বলেই সে রুম থেকে বাইরে বের হয়৷ সুনীতি বিষন্ন চোখে অভিকের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। এই লোকটা অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই যেন তার ভরসার যায়গা হয়ে উঠেছে।

অভিক বাইরে আসতেই রাহেলা খাতুন তার সামনে এসে প্রশ্ন করল,”কি বললো ঐ মেয়েটা? ও কি তোমার সাথে যেতে চায়?”

অভিক উত্তরে বলল,”ওর মানসিক অবস্থা বর্তমানে ভালো না। সেই কারণে ও আপাতত নিজের পরিবারের সাথে সময় কাটাতে চায়।”

রাহেলা খাতুন এমনিতেই এই বিয়েটা নিয়ে খুব একটা খুশি ছিলেন না৷ তার উপর এহেন কথা শুনে তিনি কপট রাগ দেখিয়ে বলেন,”এ আবার কেমন কথা? বিয়ের পর ও কেন নিজের বাবার বাড়িতে থাকবে? তোমার সাথে না যাক অন্তত আমাদের সাথে আমাদের বাড়িতে তো থাকতে পারে।”

আহসান চৌধুরী রাহেলা খাতুনের কথা শুনে বেশ বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন,”আহ! রাহেলা। তুমি তো দেখলেই মেয়েটা কতটা ভেঙে পড়েছে৷ তারপরও কিভাবে এমন কথা বলছ?”

“তুমি তো সবসময় আমার দোষটাই দেখ। আচ্ছা, আমরা কি ওর খেয়াল রাখতে পারতাম না? এমনিতেই হুট করে এভাবে বিয়েটা হয়ে গেল, কোন আত্মীয়-স্বজনকে জানানোর সময় পেলাম না। তার উপর এখন যদি বিয়ের পর ও বাবার বাসায় থাকে তাহলে তো লোকে নানা কথা বলবে।”

“এসব নিয়ে ভেবো না৷ অভিককে তো আজ রাতেই ফিরতে হবে। এরপর যখন ও আবার ফিরবে তখন নাহয় আত্মীয়-স্বজন দেখে ধুমধাম করে ওদের বিয়েটা দিয়ে দেব। ব্যস, তাহলেই তো সব ঝামেলা মিটে যায়। ততদিন নাহয় ও নিজের বাবার বাসাতেই থাকুক।”

রাহেলা খাতুন বেশ মন খারাপ করে বললেন,”ঠিক আছে, তোমাদের বাবা-ছেলের যা ভালো মনে হয় করো। আমার মতামতের কোন গুরুত্ব আছে নাকি তোমাদের কাছে?”

আহসান চৌধুরী আর কিছু বলবেন তার পূর্বেই সামিউল খন্দকার এগিয়ে এসে বললেন,”আপনারা চাইলে সুনীতিকে এখন নিজেদের বাসায় নিয়ে যেতে পারেন। ওর উপর তো এখন আপনাদেরই অধিকার বেশি।”

আহসান চৌধুরী বলেন,”এখানে প্রশ্নটা অধিকারের নয় খন্দকার সাহেব। সুনীতির সাথে এই ক’দিন যা মেন্টাল ট্রমা গেল এখন ওর পাশে আপনাদের থাকাটা দরকার। তাছাড়া অভিক তো ৩ মাসের মধ্যে আবার বাসায় ফিরবে। ততদিনে সুনীতি মাও স্বাভাবিক হবে। তারপর নাহয় এসব ব্যাপারে ভাবা যাবে।”

আহসান চৌধুরীর কথা শুনে তার দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন সামিউল খন্দকার। যেন তার বুকের উপর থেকে অনেক বড় একটা বোঝা নেমে গেল।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
অভিককে আজ তার ক্যাম্পে ফিরে যেতে হবে যেটা মূলত সিলেটে। সে এখন যাওয়ারই প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাহেলা খাতুন প্রতিবারের মতো আজও ঘরের দরজা বন্ধ করে কান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এ যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। প্রতিবার যখন অভিক ক্যাম্পে ফিরে যায় তার মা এমনই করে। তিনি তো অভিকের সেনাবাহিনীর চাকরি করাটাই পছন্দ করেন না। তার কথা ছিল, অভিকের বাবার তো সম্পত্তির অধিকার নেই। একমাত্র ছেলে হিসেবে সেই সবকিছুর উত্তরাধিকার তো অভিকই। তাই তার আলাদা করে সেনাবাহিনীর চাকরি কেন করতে হবে? কিন্তু অভিকের ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছা ছিল সেনাবাহিনী হবার। তাই তো সে নিজের জেদে অটল থেকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে।

অভিক নিজের সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বাইরে এসে দেখতে পায় আহসান চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছেন তার রুমের দরজার কাছেই। অভিক বাইরে বেরিয়ে এসে নিজের বাবার সামনে দাঁড়ায়। আহসান চৌধুরী আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে অভিককে জড়িয়ে ধরেন। তার চোখ দিয়ে হয়তো অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে না কিন্তু এই মুহুর্তে তার হৃদয়ে যেন রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তিনিও মন থেকে চান নি তার একমাত্র ছেলে এত দূরে গিয়ে কাজ করুক। কিন্তু তিনি নিজের ছেলের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাই তো নিজের স্ত্রীকে বুঝিয়ে ছেলেকে আর্মির জব করতে পাঠিয়েছেন।

অভিক আহসান চৌধুরীকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,”ভালো থেকো বাবা। নিজের আর মায়ের যত্ন নিও।”

“তুমিও নিজের যত্ন নিও। আর হ্যাঁ, এখন কিন্তু তুমি আর একা নও। তোমার স্ত্রীও রয়েছে। জানি তোমাদের কাজে কতটা ব্যস্ত সময় পার করতে হয় কিন্তু তবুও যথাসাধ্য চেষ্টা করবে নিজের স্ত্রীর খোঁজ খবর নেয়ার। শুধুমাত্র কালেমা পড়ে বিয়ে করলেই কিন্তু হয়না, বিয়ের পর সমস্ত দায়-দায়িত্বও সঠিকভাবে পালন করতে হয়।”

“জ্বি, আচ্ছা বাবা। আমি সবদিক খেয়াল রাখব।”

“গুড। এখন যাও বেরিয়ে পড়ো। তোমার যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে।”

বলেই তিনি অভিককে ছেড়ে দেন। অভিক বাড়ি থেকে বের হতে যাবে এমন সময় সামিউল খন্দকার সুনীতিকে সাথে নিয়ে সেখানে চলে আসেন। সুনীতি এবং অভিক মুখোমুখি হয়ে পড়ায় হঠাৎ করেই তাদের চোখাচোখি হয়। সুনীতি লজ্জায় নিজের চোখ নামিয়ে নেয়। সামিউল খন্দকার মৃদু হেসে বলেন,”শুনলাম, তুমি এখনই ফিরে যাচ্ছ। তাই আমি আর সুনীতি মিলে তোমার সাথে দেখা কর‍তে এলাম।”

অভিকও সামান্য হেসে বলল,”জ্বি, আঙ্কেল। আমায় এখন ফিরতে হবে।”

একথা বলেই সে সুনীতির দিকে তাকিয়ে বলে,”নিজের খেয়াল রেখো। তোমার নাম্বারটা আমি নিয়ে রেখেছি। সময় পেলে কল দিয়ে খোঁজ-খবর নেবো। আমি তোমাকে স্ট্রং দেখতে চাই। কারো কথায় একদম ভেঙে পড়বে না। আর হ্যাঁ, নিজের পাশাপাশি নিজের মা-বাবারও খেয়াল রেখো। তোমাকে নিয়ে তারা অনেক দুশ্চিন্তায় থাকে।”

অভিকের কথাগুলো শুনে সুনীতি হা করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। আর ভাবতে থাকে একটা লোক কতটা দায়িত্বশীল হতে পারে। অথচ এই লোকটাকেই ভুল বুঝে সুনীতি তার বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল। এসব ভাবতেই তার নিজের উপর রাগ হয়। আসলেই সে হিরা এবং কাঁচের পার্থক্য বুঝতে পারে নি। নাহলে কি আর অভিকের পথে হিরাকে ফেলে সাজিদকে পছন্দ কর‍ত? এসব ভেবেই একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সুনীতি বলে,”আপনিও নিজের খেয়াল রাখবেন। আবার দেখা হবে।”

সুনীতি কথায় অভিক একটা অমায়িক হাসি দেয়। সুনীতিও হালকা হাসে। অতঃপর অভিক বলে,”আমি তাহলে এখন বের হচ্ছি।”

বলেই সে বাড়ি থেকে বের হয়। এখান থেকে সে বিমানবন্দরে যাবে তারপর সেখান থেকে ফ্লাইটে করে সিলেট। সুনীতি অভিকের যাওয়ার পানে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। আজ থেকে তার বিরাট অপেক্ষার পালা শুরু হলো।

To be continue…….