মন রাঙানোর পালা পর্ব-১৭

0
237

#মন_রাঙানোর_পালা
#Part_17
#ইয়াসমিন_খন্দকার

সুনীতির জ্ঞান ফেরার পর থেকে সে একদম চুপচাপ হয়ে বসে আছে। না কোন কথা বলছে, না কারো ডাকে সাড়া দিচ্ছে। একদম যেন জলজ্যান্ত পাথরে পরিণত হয়েছে। যার মাঝে বিন্দুমাত্র অনুভূতি বেঁচে নেই।

সুনীতিকে ইতিমধ্যেই তার বাসায় আনা হয়েছে। বাসায় আত্মীয়-স্বজন পাড়া-পড়শীদের ভিড় লেগেছে। সালমা খন্দকারও আজ সব আক্রোশ দূরে ঠেলে অপরাধবোধের টানে ছুটে এসেছেন। সুনীতির পায়ে ধরে পর্যন্ত তার ক্ষমা চাইতে বাঁধেনি কিন্তু সুনীতি প্রতিক্রিয়াহীন।

আহসান চৌধুরী ও রাহেলা খাতুন উদাস পানে চেয়ে আছেন সুনীতির দিকে। অভিককে ইতিমধ্যেই ব্যাপারটা জানানো হয়েছে। সে খুব দ্রুতই এসে পৌঁছে যাবে। নিজের শ্বশুর-শাশুড়ীর জানাজাতে অংশ নেয়ার কথা আছে তার। আপাতত সে আহসান চৌধুরী ও রাহেলা খাতুনকে সুনীতকে সামলানোর দায়িত্ব দিয়েছেন। যে শোকে মাতম করতে ব্যস্ত তাকে হয়তো সামলানো যায় কিন্তু যে শোকে একদম পাথর হয়ে যায় তাকে সামলানো কি আদৌ সম্ভব?

সুনীতির এই নীরবতার মাঝেই অহনা এসে পড়ে সেখানে। এসেই সুনীতিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। সুনীতির মা-বাবা কখনো অহনাকে পর করেনি। সবসময় নিজের মেয়ের মতোই দেখেছেন। তাই তো তাদের মৃত্যু অহনাকে আজ এত ব্যথিত করছে। তার উপর রয়েছে নিজের প্রিয় বান্ধবীর চিন্তা। অহনা সুনীতিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলেও সুনীতি তখনো প্রতিক্রিয়াহীন।

এরইমধ্যে অভিকও চলে আসে। অভিক ফিরে এসেই হন্তদন্ত হয়ে সবার আগে সুনীতির মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। সে ভেবেছিল সুনীতি হয়তোবা তাকে দেখে নিজের সব আবেগ নিংড়ে কেঁদে ফেলবে। কিন্তু এমনটা হলো না। সুনীতির ভাবগতির কোন পরিবর্তন এলো না। অভিক সুনীতির কাঁধে হাত দিয়ে ঝাকাতে ঝাকাতে বলে,”এই নীতি..তাকাও আমার দিকে..আমি তোমাকে স্ট্রং হতে বলেছিলাম ইমোশনলেস হতে বলিনি। ইউ হ্যাভ টু ক্রাই। তোমার মা-বাবা আর নেই..তাদের শেষ বিদায়ের সময় এতটা নির্জীব থেকো না।”

“এই নীতি..লিসেন টু মি..তুমি বুঝতে পারছ আমার কথা? ইউ হ্যাব টু ক্রাই..”

সুনীতি এতক্ষণে একটু নড়েচড়ে বসল কিন্তু কাঁদল না। দীর্ঘ সময়ের নীরবতা ভেঙে শুধু এতটুকুই বলল,”মা-বাবা আমাকে কেন ছেড়ে গেল? আমি কি এতটাই পচা মেয়ে হয়ে গেছিলাম? আমি তো ওদের সব কথা শুনে চলার চেষ্টা করি। কোন দুষ্টামি তো করি না..তাহলে কেন ওরা আমায় একা করে রেখে চলে গেল? কেন?”

সুনীতির এমন শিশুসুলভ আচরণ দেখে অভিক আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না। সুনীতিকে শক্ত করে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল,”তুমি একা নও নীতি। আমি আছি তোমার পাশে। জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আমি তোমার পাশে থাকব।”

সুনীতি বলে উঠল,”কাউকে আমার পাশে থাকতে হবে না। আমার কাউকে চাই না..কাউকে না..”

বলেই ফোপাঁতে লাগল। অভিক আলতো করে সুনীতির মাথায় হাত বোলাতে লাগল৷ কিন্তু সুনীতি ক্ষেপে গিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলে,”দূরে থাকুন আমার থেকে..আমি চাই না কারো সাহায্য..আমি একা..সম্পূর্ণ একা।”

“তুমি একা নও। আমরা সবাই তোমার পাশে আছি। দেখো এখানে কত মানুষ।”

“সব নাটক সব। এই পৃথিবীতে কেউ কারো আপন হয়না৷ সবাই শুধু ছেড়ে চলে যেতে আসে। আপনিও আমায় ছেড়ে চলে যাবেন, তাইনা? আপনিও পচা। আপনাদের কাউকে আমার লাগবে না। যান আমার সামনে থেকে।”

সুনীতির এমন উদ্ভট আচরণ সবাইকে নাড়া দিয়ে যায়। সবার মনে ঘুরপাক খেতে থাকে অদ্ভুত সব চিন্তা। তাহলে কি মা-বাবাকে হারানোর শোকে মেয়েটা পাগল হয়ে গেল?

~~~~~~~~~~~~~~
সামিউল খন্দকার ও নয়না খন্দকারকে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করে পুনরায় বাড়িতে ফিরে এসেছে সবাই। অভিক বাড়িতে ফিরেই সুনীতির খোঁজ করতে শুরু করে দিয়েছে। আহসান চৌধুরী সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছেন। অভিক চিন্তিত হয়ে তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,”নীতি কোথায় বাবা?”

আহসান চৌধুরী মাথা তুলে বললেন,”তোমার মায়ের রুমে।”

অভিক দ্রুত সেদিকে যেতে নিতেই আহসান চৌধুরী বলে ওঠেন,”শোন”

“হ্যাঁ, বলো।”

” মেয়েটার যত্ন নিও। ওর এখন তোমাকে সবথেকে বেশি প্রয়োজন। মা-বাবাকে হারানোর পর এখন তুমিই ওর সবথেকে কাছের জন।”

অভিক মাথা নাড়িয়ে সামনের দিকে পা বাড়ায়।

রাহেলা খাতুন সুনীতির মুখের সামনে ভাত ধরে বলেন,”গতকাল থেকে তুমি কিছু না খেয়ে আছ..এভাবে থাকলে তো তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে। এটুকু খেয়ে নাও।”

সুনীতি হঠাৎ করেই মায়াভরা চোখে রাহেলা খাতুনের দিকে তাকায়৷ তার চোখে জল টলমল করছে। আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বলে ওঠে,”আমার মাও না ঠিক এভাবে আমায় খাইয়ে দিত..যখন আমি খেতে চাইতাম না তখন আমায় নানারকম গল্প বলে বলে খাওয়াতো..”

“তুমি গল্প শুনবে? আমিও অনেক ভালো গল্প জানি।”

“না, থাক..জানেন আপনার শরীর থেকেও আমি মা, মা গন্ধটা পাচ্ছি। আমি কি আপনার কোলে মাথা রেখে একটু শুতে পারি আন্টি? তাহলে আমার মনে হবে, আমি আমার মায়ের কোলে শুয়ে আছি।”

রাহেলা খাতুন নিজের চোখের জল আটকে রাখতে পারলেন না। এটা ঠিক সুনীতির উপর পূর্ববর্তী ঘটনার জন্য তার রাগ ছিল। এজন্য সুনীতির সাথে অভিকের বিয়েটাও তিনি মন থেকে মানতে পারেন নি। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে মেয়েটা তার মন গলিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। তিনি শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুলহে বলেন,”অবশ্যই, পারো।”

সুনীতি রাহেলা খাতুনের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। রাহেলা খাতুন সুনীতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল৷ সুনীতি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে নিশ্চুপ রইল। তারপর হঠাৎই ডুকরে কেঁদে উঠল,”ও মা…ও বাবা..”
বলে। রাহেলা খাতুনও সমান তালে কেঁদে চলেছেন। অভিক দরজার বাইরে থেকে এই দৃশ্য দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারল না। তার চোখ দিয়েও এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

সময় কিছুটা অতিবাহিত হয়। সুনীতি রাহেলা খাতুনের কোলে শোয়া অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়ে। রাহেলা খাতুন আস্তে করে সুনীতির মাথা বালিশে রেখে উঠে দাঁড়ান। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা অভিককে দেখে তিনি বলেন,”তুমি এসে ওর পাশে শুয়ে পড়ো। মাঝরাতে উঠে আবার কান্নাকাটি করতে পারে। তখন তোমাকেই ওকে সামলাতে হবে আর যদি একা সামলাতে না পারো তো আমাকে ডেকো।”

“আচ্ছা।”

রাহেলা খাতুন চলে যান। তিনি যেতেই অভিক দরজা লাগিয়ে দিয়ে সুনীতির পাশে শুয়ে পড়ে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। সুনীতির কপালে চুমু খেয়ে বলে,”আমি তোমার জীবনসঙ্গী হিসেবে সুখ এবং দুঃখ সবসময় তোমার পাশে থাকব। তোমার মনের সব মলিনতা দূর করে রঙিন করে তোলাই আমার দায়িত্ব। তুমি কখনো নিজেকে একা ভেবো না নীতি। জীবনের প্রতিটা পরিস্থিতিতে তুমি আমাকে নিজের পাশে পাবে। শুধু আমাকে তোমার পাশে থাকতে দাও। প্রথমবার যেই ভুলটা আমি করেছি, দ্বিতীয় বার আর সেই ভুল করতে চাই না। এবার আমি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে আগলে রাখতে চাই। নিজের প্রথম ভালোবাসাকে আমি আগলে রাখতে পারিনি কিন্তু আমি তোমায় জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আগলে রাখবো আর এটাই আমার প্রতিজ্ঞা।”

বলেই অভিক একটা দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করে। সুনীতির নির্জীব মুখ পানে অসহায় ভাবে তাকিয়ে বলে,”তোমার সকল মন খারাপের ওষুধ আমি হতে চাই,তোমার সকল একাকীত্বের সঙ্গী আমি হতে চাই। তোমার সব দুঃখকে নিংড়ে সুখের হদিশও আমি হতে চাই।”

To be continue…….