মন রাঙানোর পালা পর্ব-১৮

0
235

#মন_রাঙানোর_পালা
#Part_18
#ইয়াসমিন_খন্দকার

সুনীতি উদাস মনে তার মা-বাবার কক্ষে এসে বসে আছে। তাদের মৃত্যুর পর এক সপ্তাহ অতিবাহিত হয়েছে। এই এক সপ্তাহ অভিক সবসময় সুনীতির পাশে ছিল। তবে আজ রাতের মধ্যেই তাকে ফিরতে হবে। তবে সুনীতিকে এই অবস্থায় রেখে তার যেতে ইচ্ছা করছে না৷ এজন্য সব এরেঞ্জমেন্ট করেই রেখেছে। আজ সুনীতিকে সে নিজের সাথে করে নিয়ে যাবে।

তবে পরিবেশ খুব একটা স্বাভাবিক না। ইতিমধ্যেই পুলিশ তদন্তের মাধ্যমে জানতে পেরেছে সুনীতির মা-বাবার মৃত্যুটা কোন স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। একটি ট্রাক ইচ্ছাকৃত তাদের ধাক্কা দিয়েছে। আর সেই ট্রাকচালক কে সেটাও বেরিয়ে এসেছে তদন্তে। সে আর কেউ নয়, মন্টু। এটা জানার পর থেকে অভিক মারাত্মক দুশ্চিন্তায় আছে সুনীতিকে নিয়ে। কারণ মন্টুকে পুলিশ এখনো খুঁজে পায়নি। সে এখনো কোথাও একটা লুকিয়ে আছে। মন্টুর এভাবে লুকিয়ে থাকা সুনীতির নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি। যেই বিষয়টা অভিককে ভাবতে হচ্ছে। অভিক এখনো সুনীতিকে এই ব্যাপারে কিছু জানায় নি এবং অন্যদেরকেও জানাতে মানা করেছে। কারণ এসব শুনলে সুনীতি হয়তো আরো ভেঙে পড়বে এবং তাকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক করার যে প্রক্রিয়া তা হয়তো বাধাগ্রস্ত হবে৷ এসব ভেবেই অভিক সুনীতিকে বলেছে তার মা-বাবার মৃত্যু নিছকই দূর্ঘটনা ছিল। সুনীতিও এখন তা মেনে নিয়েছে।

অভিক দরজায় নক করে বলল,”আমি কি ভেতরে আসব নীতি?”

“হ্যাঁ, আসুন।”

অভিক রুমে প্রবেশ করে। সুনীতির পাশে বসে তার কাঁধে হাত রেখে বলে,”তুমি নিজের সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও। আজ আমাদের সিলেটে যেতে হবে।”

সুনীতি নিজের মা-বাবার ছবির দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলে,”এই ছবিটা কি আমি নিজের সাথে নিতে পারি?”

“হ্যাঁ, অবশ্যই।”

সুনীতি দেয়াল থেকে ছবিটা তুলে নেয়। পরম আবেশে ছবিটা জড়িয়ে ধরে। কোনরকমে চোখের জল আটকে রাখে। কিন্তু জল যেন বাঁধ মানতে নারাজ। হঠাৎ করেই ডুকরে কেঁদে ওঠে সুনীতি। অভিক এক পলক অপেক্ষা না করে সুনীতিকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়।

~~~~~~~~~~~
সুনীতির সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখেছেন রাহেলা খাতুন। এমনকি এখন তিনি সুনীতির পছন্দের শামি কাবাবও বানাচ্ছেন। আহসান চৌধুরী সকাল থেকে স্ত্রীকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তাকে রান্নায় ব্যস্ত দেখে বলেন,”সকাল থেকে এত কি রান্না করছ?”

রাহেলা খাতুন বলেন,”আজ সুনীতি অভিকের সাথে সিলেটে চলে যাচ্ছে। জানি না, এরপর কবে আবার আসবে! তাই ওর পছন্দের কিছু খাবার বানাচ্ছি।”

আহসান চৌধুরী মুগ্ধ চোখে নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকেন। সত্যিই মানুষকে শুধু তার একটা দিক দেখে বিচার করা যায়না। কোন মানুষই সম্পূর্ণ ভালো কিংবা সম্পূর্ণ খারাপ না। ভুল, ত্রুটি মিলিয়েই তো মানুষ। এই যেমন রাহেলা খাতুন, প্রথম প্রথম তিনি সুনীতিকে মন থেকে নিতে পারেন নি কিন্তু এখন সেই সুনীতির জন্যই কত চিন্তা করছেন।

এরইমধ্যে অভিক সুনীতিকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে এলো খাবার খাওয়ার জন্য। তাদেরকে আসতে দেখে রাহেলা খাতুন ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দ্রুত সব খাবার সাজিয়ে তাদেরকে পরিবেশন করতে লাগলেন।

সুনীতির পাতে শামি কাবাব তুলে দিয়ে বললেন,”আমি তোমার জন্য তোমার প্রিয় শামি কাবাব বানিয়েছি। খেয়ে দেখো তো কেমন হয়েছে।”

শামি কাবাব দেখে সুনীতি আবেগাপ্লুত হয়ে গেল। কারণ তার মাও তার জন্য এই শামি কাবাব বানাত এছাড়া বাড়ির শামি কাবাব খেতে ইচ্ছা না করলে কতবার বাবাও তো রেস্টুরেন্ট থেকে এনে দিত। পুরাতন কথা ভেবে তার চোখে জল এলো। আলগোছে জলটুকু মুছে সে খাওয়ায় মনযোগী হলো। রাহেলা খাতুন আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে সুনীতির দিকে। সুনীতিকে খেতে দেখে তিনি বলেন,”কেমন হয়েছে খেতে?”

“অনেক ভালো হয়েছে মা..”

কথাটা বলে সুনীতির মন বিষন্নতায় ছেয়ে গেল। সে বিষন্ন সুরে বলে,”আসলে আমি ভুল করে…”

“ভুল করে আবার কি? আমি কি তোমার মা নই? আমি যখন অভিকের মা তার মানে আমি তোমারও মা।”

আহসান চৌধুরীও বলে ওঠেন,”আর আমি তোমার বাবা।”

নিজের শ্বশুর শাশুড়ীর মাঝে যেন বাবা-মায়ের ছায়া দেখতে পেল সুনীতি। এত কষ্টের মাঝেও অনুভূত হলো সুখের অনুভূতি।

~~~~~~~
অভিক এবং সুনীতির যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এলো। অহনা আজ এসেছে সুনীতির সাথে দেখা করার জন্য। আজকের পর না জানি সুনীতি কতদূর চলে যাবে। এরপর আর কবে তাদের দেখা হবে। দুই বান্ধবী অনেকক্ষণ ধরে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল। অতঃপর কিছুটা শান্ত হলো।

রাহেলা খাতুন সুনীতির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,”সাবধানে থেকো। আর মানসিক ভাবে একটু স্ট্রং হবার চেষ্টা করো। বাস্তবতাটাকে তো আমাদের মেনে নিতেই হবে। জানি এটা সহজ নয় কিন্তু আমাদের চেষ্টা তো কর‍তেই হবে!”

সুনীতি মাথা নাড়ায়। আহসান চৌধুরীও তাকে কিছু অনুপ্রেরণার বাণী শোনান। রাহেলা খাতুন অভিককে বলেন,”নিজের আর সুনীতির যত্ন নিও। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।”

অভিক সম্মতি জানায়। অতঃপর সুনীতিকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইটে করে সিলেটে পৌঁছে যায় অভিক ও সুনীতি। অতঃপর একটা গাড়িতে করে রওনা দেয় তাদের গন্তব্যে। অভিক সুনীতিকে রাখার জন্য উপরমহলে যোগাযোগ করেছিল৷ তাদের জন্য একটা কোয়ার্টারের ব্যবস্থা করা হয়েছে ক্যাম্পের ঠিক পাশেই। সুনীতি এই প্রথমবার সিলেটে পা রাখল। তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা সবই পুরান ঢাকায়। এর বাইরে কয়েকবার গাজীপুরে মামাবাড়িতে গেছে। একমাত্র মেয়ে হওয়ায় মা-বাবা সবসময় অনেক আগলে রাখত। যার কারণে এর বাইরে কোথাও যাওয়া হয়নি।

সিলেটের অপরূপ সৌন্দর্য এত কষ্টের মাঝেও সুনীতির মনে কিঞ্চিৎ আনন্দের সঞ্চার করে। চা-বাগানের পাশ দিয়ে যাবার সময় সেই আনন্দ যেন আরো বেড়ে যায়৷ এতদিন সুনীতি চা-বাগানের ব্যাপারে শুধু বইয়েই পড়েছে আর ফোনে দেখেছে। তবে আজ চাক্ষুষ এই নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে সে আপ্লুত।

দীর্ঘ সময়ের যাত্রার শেষে অবশেষে তারা নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছে যায়। তাদের পৌঁছাতে পৌঁছাতে অবশ্য বেশ রাত হয়ে যায়। সুনীতি ও অভিক গাড়ি থেকে নামে। কয়েকজন লেফট্যানান্ট এগিয়ে এসে মেজর অভিককে স্যালুট জানায়। অভিক তাদের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”সব এরেঞ্জমেন্ট হয়ে গেছে তো?”

“জ্বি, স্যার।”

“গুড।”

একজন বলে,”ম্যাডাম আপনি আসুন আমরা সব জিনিসপত্র ভেতরে নিয়ে যাচ্ছি।”

সুনীতি অভিকের সাথে সাথে হেটে যেতে থাকে। কোয়ার্টারে ঢুকে সুনীতি দেখে বেশ সুন্দর করে সবকিছু সাজানো। যায়গার কিছুটা সংকুলান হলেও ডেকোরেশন টা ভালো। যা যে কারোরই চোখ ধাধিয়ে দেবে। অভিক সুনীতিকে জিজ্ঞেস করে,”পছন্দ হয়েছে তো?”

সুনীতি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ায়। অভিক একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। এরইমধ্যে তাদের সব জিনিসপত্র ভেতরে এনে রেখে লেফটেন্যান্টরা অভিকের থেকে অনুমতি নিয়ে চলে যায়।

অভিক সুনীতিকে বলে,”আজ থেকে এখানেই আমাদের ছোট্ট সংসারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলো। জানি না,তোমায় কতটা সুখে রাখতে পারবো৷ তবে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবো তোমায় ভালো রাখার।”

সুনীতি অভিকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,”আপনার উপস্থিতিই আমার ভালো থাকার একমাত্র কারণ। আমার আর বেশি কিছুর প্রয়োজন। সব হারিয়ে নিঃস্ব আমি”র এখন শুধু আপনিই একমাত্র সম্বল। আপনি শুধু নিজেকে ভালো রাখবেন, তাহলেই আমি ভালো থাকব।”

সুনীতি এমন আবেগঘন কথা শুনে অভিকও আবেগী হয়ে পড়ে। সুনীতিকে কাছে টেনে নিয়ে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে। সুনীতির ঘাড়ে হালকা করে চুমু খেয়ে বলে,”আমি তোমায় কথা দিচ্ছি, নিজেকে ভালো রাখব। তোমার জন্য হলেও নিজেকে ভালো রাখব।”

বলেই অভিক সুনীতির মাঝে ডুবে যেতে থাকে। সুনীতিরও অভিকের স্পর্শ ভালো লাগছিল। তাই সে সাড়া দেয়। এতে অভিক ভরসা পায়। সে সুনীতিকে নিজের আরো কাছে নিয়ে আসে। ধীরে ধীরে তারা হারিয়ে যায় ভালোবাসার অতল গহীনে। এই রাত সাক্ষী হয় তাদের পবিত্র বন্ধনের।

To be continue……