মন রাঙানোর পালা পর্ব-২৭

0
3

#মন_রাঙানোর_পালা
#Part_27
#ইয়াসমিন_খন্দকার

অভিকের বন্দি অবস্থায় থাকার পর অনেক সময় পেরিয়ে যায়৷ এত দীর্ঘ সময় অভিককে কিছুই খেতে দেওয়া হয়নি৷ তাই অনেক দূর্বল অনুভব হচ্ছে অভিকের। অভিক এক ফোটা পানির জন্য তড়পাচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ করে আনিসা অভিকের সামনে এসে দাঁড়ায়। আনিসাকে দেখেই অভিক ঘৃণায় নিজের চোখ সরিয়ে নেয়। আনিসা অভিকের চোখে এই ঘৃণা দেখে সেটা সহ্য করতে না পেরে বলে,”আমি জানি..এখন আমি যাই বলি না কেন তোর কাছে সেটা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটাই মনে হবে। কিন্তু বিশ্বাস কর, অভি। আমি সত্যি নিরূপায় ছিলাম।”

অভিক ব্যাঙ্গাত্মক হেসে বলে,”তোর কাছে আমি কোন কৈফিয়ত চেয়েছি? কেন এসেছিস এখানে? নিজেকে তো সেইফ করতে পারছিস। এখন যা আনন্দ কর।”

“তোর এই অবস্থা যে আমি সহ্য করতে পারসি না অভি।”

“এসব নাটক প্লিজ বন্ধ কর। আমার আর সহ্য হচ্ছে না তোর এইসব নাটক।”

আনিসা কান্নাভেজা চোখে অভিকের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ অভিকের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”তোকে তো অনেক দূর্বল লাগছে অভি। একটু পানি এনে দেই, পানি খাবি?”

অভিক রেগে বলে,”বিষ নেই তোর কাছে? থাকলে আমায় এনে দে৷ বিষ খাইয়ে একেবারে মেরে ফেল।”

আনিসার মধ্যে অপরাধবোধ বাড়তে থাকে। সে আর এক মুহুর্ত অভিকের সামনে দাঁড়িয়ে না থেকে স্থান ত্যাগ করে। অভিক আনিসার পানে ফিরেও তাকায় না। নিজের বন্ধুত্বের জন্য অনেক করেছিল সে৷ বিনিময়ে ধোকা ছাড়া আর কিছুই পেল না।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
অভিক নিখোঁজ হওয়ার পর ২৪ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। অথচ এখনো তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। সুনীতির অবস্থা এখন আরো বেসামাল। চিন্তায় চিন্তায় না খেয়ে একদম অসুস্থ হয়ে গেছে মেয়েটা। বর্তমানে সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী সে। অহনা যতটা পারছে সুনীতির খেয়াল রাখছে। অনেক চেষ্টা করেও সুনীতিকে এক ফোটা পানিও খাওয়াতে পারেনি অহনা। শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছে৷ বর্তমানে অহনা সুনীতিকে বলছে,”তুই আর কতক্ষণ এভাবে না খেয়ে থাকবি? এভাবে চলতে থাকে তোরই তো বড় কোন ক্ষতি হয়ে যাবে। একটু কিছু অন্তত খেয়ে নে।”

সুনীতি নিরুত্তর। অহনা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। এরইমধ্যে আরাফাত চলে আসে। আরাফাতকে আসতে দেখে অহনা উত্তেজিত হয়ে বলে,”আপনি দুলাভাইয়ের কোন খবর পেলেন?”

আরাফাত দুঃখী দুঃখী মনে মাথা নাড়িয়ে ব্যর্থতার প্রমাণ দেয়। অহনা আর আগের মতো রেগে যায়না। বরঞ্চ দুঃখের সহিত বলে,”সুনীতির অবস্থা ভীষণ খারাপ। কালকে থেকে ও একদম না খেয়ে আছে। আমি অনেক চেষ্টা করেও ওকে কিছু খাওয়াতে পারছি না। বর্তমানে ওর গায়ে ভীষণ জ্বর। দূর্বলতা ওকে একদম গ্রাস করে নিয়েছে৷ এভাবে চলতে থাকলে ও একদম শেষ হয়ে যাবে।”

আরাফাত সুনীতির কাছে এসে বলে,”আপনি নিজেকে কেন এত কষ্ট দিচ্ছেন ভাবি? আমরা সবাই তো নিজেদের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আমরা নিশ্চয়ই অভিককে খুব শীঘ্রই খুঁজে বের করব। কিন্তু আপনি যদি এভাবে না খেয়ে অসুস্থ হয়ে যান তাহলে তো অভিক ফিরে এসে ভীষণ কষ্ট পাবে। নিজের জন্য না হলেও অভিকের জন্য তো একটু খেয়ে নিন।”

সুনীতি কাপা কাপা গলায় বলে,”আমি জানি না,আমার অভিক বর্তমানে কোথায় আছে,কেমন পরিস্থিতিতে আছে। ও আদৌ কাল থেকে কিছু খেয়েছে কিনা। এই রকম একটা পরিস্থিতিতে আমার গলা দিয়ে কিভাবে খাবার নামবে ভাইয়া? আমি সত্যি পারবো না।”

আরাফাত বুঝতে পারে সুনীতিকে বুঝিয়ে কোন লাভ নেই। সে নিজের জেদে অটল থাকবে। আরাফাত একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে অহনার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আপনি ভাবির যথাসম্ভব খেয়াল রাখার চেষ্টা করুন। আমরা নিজেদের কাজ অবিরত ভাবে করে চলেছি। আশা করছি, শীঘ্রই কোন ভালো খবর দিতে পারব।”

অহনা মাথা নাড়ায়। আরাফাত বেরিয়ে যেতে নেয়। অহনা হঠাৎ যেন কি মনে করে বলে,”শুনুন…”

আরাফাত পিছন ফিরে তাকায়। অহনা হালকা হেসে বলে,”সাবধানে যাবেন।”

আরাফাতও সামান্য হেসে অহনার দিকে তাকিয়ে প্রস্থান করে।

~~~~~~~~~~~~
অভিকের ভীষণ দূর্বল বোধ হচ্ছে। অনেকক্ষণ থেকে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। কাল থেকে কিছু খায়ওনি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই শরীরের অবস্থা বেশি ভালো না। হঠাৎ করে অভিক লক্ষ্য করল কেউ তার দিকে এগিয়ে আসছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখল আনিসা। অভিক ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলো। আনিসা লক্ষ করল অভিকের চোখে তার জন্য কতটা ঘৃণা। অগোচরে চোখের জল মুছে সে অভিকের দিকে খাবারের থালা নিয়ে এগিয়ে এলো।

অভিকের একদম সামনে এসে দাঁড়ালো আনিসা। কিন্তু অভিক তার দিকে ফিরেও তাকাল না। আনিসা গলা ঝাকারি দিয়ে বলল,”আমার উপর যত রাগ করার করিস। কিন্তু এই খাবারটা অন্তত খেয়ে নে।”

অভিক রাগী কন্ঠে বলল,”তোর এসব ন্যাকামি আমার সহ্য হচ্ছে না৷ ভালো চাইলে আমার সামনে থেকে দূর হ।”

আনিসা মলিন হেসে বললো,”ন্যাকামি বলিস আর যাই বলিস, এটা তোকে খেতে হবেই।”

“মরে যাবো তাও খাবো না।”

“এতোটা ঘৃণা করিস আমায়?”

“হ্যাঁ, করি।”

আনিসার বুকে তীরের মতো বিঁধছিল অভিকের কথা। তবুও সে খাবারের লোকমা অভিকের মুখের সামনে ধরে বলে,”দয়া করে খেয়ে নে।”

অভিক খায় না৷ আনিসা এবার হার মেনে নিয়ে বলে,”অন্তত একটু পানি খা।”

অভিক সেটাও খায় না। আনিসা এবার অসহায় কন্ঠে বলে,”আমি নিরূপায় ছিলাম অভি…৮/৯ টা বছর,,,,এটা কম নয়। এতগুলো দিন ঐ শয়তানটা আমায় বন্দি করে রেখেছে। এতগুলো দিন আমি পৃথিবীর আলো বাতাস থেকে বঞ্চিত হয়েছি,,প্রতিনিয়ত ওর দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছি। আমার খুব মুক্তির প্রয়োজন ছিল। আমি চেয়েছিলাম আবার আগের মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে কিন্তু এর জন্য এছাড়া আমার হাতে আর কোন উপায় ছিল না। শিহাব আমায় এটাই শর্ত দিয়েছিল যে, যদি আমি তোর বিশ্বাস জিতে তোকে এখানে নিয়ে আসতে পারি তাহলে ও আমায় ছেড়ে দেবে।”

“তুই আমাকে বিশ্বাস করে সবটা জানাতে পারতি। আমি তোকে সাহায্য করতাম। তা না করে তুই ঐ দেশদ্রোহী, সন্ত্রাসী শিহাবের কথা শুনলি,,,”

আনিসা বলে,”আমার কিছু করার ছিল না। শিহাব আমার শরীরে লুকিয়ে একটা চিপ রেখেছিল। যদি আমি কোন চালাকি করতাম তাহলে ও আমাকে শেষ করে দিত।”

“তুই যত যাই বলিস,,,তুই ওর মতো একটা সন্ত্রাসীর সঙ্গ দিয়ে পাপ করেছিস। এর শাস্তি তুই পাবিই।”

আনিসা মলিন হেসে বলে,”শাস্তি তো সেই ৯ বছর ধরেই পাচ্ছি। আর কত শাস্তি পাবো আমি? এবার শাস্তির উচিৎ আমায় একটু মুক্তি দেয়া। একটা ভুল মানুষকে পছন্দ করাই আমার জীবনে কাল হলো,,হিরে চিনতে আমি ভুল করেছিলাম,,”

আনিসা একটু থেমে বলে,”আচ্ছা, তুই যে ৯ বছর আগে আমায় একটা কথা বলেছিস সেটা কি,,,”

আনিসার পুরো কথা শেষ হবার আগেই অভিক বলে,”অতীতের কথা বাদ দে। এখন আর সেসব বলে কোন লাভ নেই।”

আনিসা মলিন হেসে বলে,”ঠিকই বলেছিস। আমার নিজের ভাগ্য আমি নিজেই নষ্ট করেছি। এখন সেই নষ্ট ভাগ্য নিয়েই,,,যাইহোক আমাকে একটা সুযোগ দিবি অভিক? আমি তোকে সাহায্য করব, নিজের সব ভুল শুধরে নেব।”

“আমি আর যাইহোক তোকে অন্তত বিশ্বাস করব না কোনমতেই।”

আনিসা বলে,”তোকে বিশ্বাস করতে হবে না। আমায় সুযোগ দিতেও বলছিনা। কিন্তু এটা মনে রাখবি,,,তোর বিপদে সবার আগে আমিই এগিয়ে আসব।”

বলেই আনিসা চলে যায়। আনিসা চলে যাবার পরই অভিক তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে বলে,”তুই কি করবি বা করবি না সেই আশায় আমি বসে নেই। নিজের কাজ আমি ঠিকই করেছি। এবার ঐ শিহাবের অন্যায়ের সাম্রাজ্যের পতন ঘটবেই!”
To be continue…….