মন রাঙানোর পালা পর্ব-৩০+৩১

0
4

#মন_রাঙানোর_পালা
#Part_30
#ইয়াসমিন_খন্দকার

অভিক ও সুনীতি সিলেট থেকে ঢাকায় ফেরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। অভিক এক সপ্তাহের জন্য ছুটি পেয়েছে। সুনীতি সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে তৈরি হয়ে নিয়েছে। তার পরনে একটি গাঢ় মেরুণ বর্ণের শাড়ি৷ সুনীতিকে দেখে অভিক একটি সুন্দর শাড়ি উপহার দেয়। অভিকের পরণে একটি ওফ হোয়াইট শার্ট।

সুনীতি অভিকের কাছে এসে বলে,”তাহলে চলো আমরা বের হই।”

অভিক মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। সুনীতি ও অভিক তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ে। অহনাও আগে ভাগে বেরিয়ে পড়েছে। সে এতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে আরাফাতের সাথে গল্প করছিল। সুনীতি বেশ কয়েকদিন থেকে লক্ষ্য করছে আরাফাত ও অহনার মধ্যে বেশ ভাব হয়েছে। দুজনেই বেশ অনেকটা সময় ধরে গল্প করে। প্রথম প্রথম তো দুজনের বুনো ওল আর বাঘা তেঁতুলের মতো সম্পর্ক ছিল। তবে বর্তমানে তাদের সেই সম্পর্ক একদম বদলে গেছে। দুজনের বেশ ভাব হয়েছে। অভিক আরাফাতের কাছে গিয়ে বলে,”তোর গল্প করা শেষ হলে একটু সড়ে দাড়া। আমাদের এখন যেতে হবে।”

আরাফাত এমন কথা শুনে বিব্রতবোধ করে চুপ হয়ে যায়। অহনাও বেশ লজ্জা অনুভব করে। সুনীতি অহনার কানে কানে বলে,”কি ব্যাপার বল তো? কি চলে তোদের মাঝে হুম?”

“কই কি?”

বলেই অহনা তড়িঘড়ি করে গাড়িতে উঠে পড়ে। অভিক আরাফাতের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তুইও আজ আমাদের সাথে ফিরলে পারতি।”

আরাফাত বলে,”ফিরতে তো চেয়েছিলাম কিন্তু কিছু জরুরি কাজ পড়ে গেছে এখানে। আমি কালকের মধ্যে ঢাকার উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিব। এবার ঢাকায় ফিরে অনেক জরুরি কাজ আছে।”

বলেই গাড়ির জানালা দিকে মুখ বাড়িয়ে থাকা অহনার দিকে তাকায়। অহনা একটা স্মিত হাসি উপহার দেয়। যা আরাফাতের মনে ভালো লাগার সঞ্চার ঘটায়। অভিক হালকা কেশে বলে,”এখন তাহলে আমরা রওনা দেই। কাল তোর সাথে দেখা হচ্ছে।”

“আচ্ছা।”

“সুনীতি তুমি গাড়িতে ওঠো।”

অভিকের কথামতো সুনীতি গাড়িতে উঠে বসে। সুনীতি গাড়িতে ওঠার পর আরাফাত অভিকের পিঠে হাত রেখে বলে,”দোস্ত, আমার মনে হয় এবার অন্তত তোর ভাবিকে সবটা জানানো উচিৎ! ভাবি যদি পরে কোন ভাবে জানতে পারে তুই ওনার মা-বাবার মৃত্যুর ব্যাপারে সত্যটা ওনার থেকে লুকিয়ে গেছিস তাহলে তোদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হতে পারে।”

অভিক আরাফাতের কথায় সায় জানিয়ে বলে,”তুই একদম ঠিক বলেছিস। এমনিতেই এই ক’দিনে আমাদের অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আমি চাই না, নতুন করে আবার কোন ঝামেলা হোক। তাই এটাই ভালো হবে যদি আমি ওকে সবটা বলে দেই। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবার ঢাকায় ফিরেই একদিন ঠান্ডা মাথায় সুনীতিকে সবটা জানাবো। শুধু তাই নয়, আমি ভেবে রেখেছি এই ৭ দিনের মধ্যে যে করেই হোক ঐ মন্টুকে খুঁজে বের করব এবং ওর উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করব।”

আরাফাত অভিককে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,”ঠিক আছে, সাবধানে যাস। আর কোন হেল্প লাগলে নিঃসংকোচে আমাকে জানাবি। আমি নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে তোকে হেল্প করার চেষ্টা করব।”

“ঠিক আছে। আল্লাহ হাফেজ।”

বলেই অভিক গাড়িতে উঠে বসে। ড্রাইভার ড্রাইভিং করা শুরু করে। গাড়ি সামনে চলতে শুরু করে। অহনা গাড়ির কাচের মধ্য দিয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা যায় আরাফাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। একইভাবে আরাফাতও তাকিয়ে থাকে যতক্ষণ না গাড়িটা তার চোখের আড়াল হয়।

~~~~~~~~~~~~
দীর্ঘ কয়েক ঘন্টার জার্নির পর ঢাকা এসে পৌঁছায় অভিকরা। অহনাকে তার বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে অভিক সুনীতিকে নিয়ে তাদের বাসায় চলে আসে। এতদিন পর অভিক ও সুনীতিকে ফিরতে দেখে আহসান চৌধুরী এবং রাহেলা খাতুন ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। রাহেলা খাতুন তো অভিক ও সুনীতির পছন্দমতো খাবার বানাতে লেগে পড়েন আর আহসান চৌধুরী চলে যান হরেক রকম বাজার করতে।

অভিক ও সুনীতি ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। সুনীতি গোসল সেড়ে নিয়ে শাড়ি পড়ে তৈরি হয়ে নেয়৷ এমনিতে সে খুব একটা শাড়ি পড়ে না। বিয়ের পর এই প্রথম শাড়ি পড়ল। এদিকে সুনীতিকে শাড়িতে দেখে অভিকের অবস্থা বেসামাল হয়ে যায়৷ শাড়ি পড়লে সব মেয়েদেরই সৌন্দর্য স্বাভাবিকের থেকে বেড়ে যায়। সুনীতিকেও শাড়িতে অপরূপা সৌন্দর্যের অধিকারী লাগছিল। অভিক উঠে দাঁড়িয়ে আচমকা সুনীতিকে নিজের কাছে টেনে নেয়। সুনীতির কপালে হালকা করে চুমু খেয়ে বলে,”ভালোবাসি,,ভীষণ ভালোবাসি।”

“আমিও ভালোবাসি।”

অভিক বলে,”তুমি আমায় বিশ্বাস করো তো সুনীতি?”

“নিজের থেকেও বেশি।”

“কখনো কোন কারণে আমায় ভুল বুঝবে না তো?”

“প্রশ্নই ওঠে না।”

অভিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ভেবে নেয় এখনই সুনীতিকে তার মা-বাবার ব্যাপারে সবটা বলে দেবে। অভিক কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই সুনীতি অভিককে মৃদু ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে বলে,”আমি রান্নাঘরে যাই। মাকে রান্নায় হেল্প করি। পরে কথা হবে।”

বলেই সুনীতি আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করেই চলে যায়। যার ফলে অভিকের আর কিছু বলা হয়না। সে ভাবে রাতেই সময় করে শান্তভাবে সুনীতিকে বুঝিয়ে বলবে সবটা।

সুনীতি রান্নাঘরে গিয়ে এসে দেখতে পায় রাহেলা খাতুন রান্নায় ব্যস্ত সময় পার করছেন৷ সুনীতিকে রান্নাঘরে দেখে তিনি বলেন,”তুমি এসেছ?! এই দেখ আমি তোমার প্রিয় শামি কাবাব রান্না করেছি। একটু খেয়ে দেখো তো কেমন লাগে।”

সুনীতি শামি কাবাব একটু মুখে দিয়ে বলে,”ভীষণ সুন্দর হয়েছে। আচ্ছা, আমি কি আপনাকে রান্নায় হেল্প করব মা?”

“না,না। তুমি এত দূর জার্নি করে এলে। এখন আর কষ্ট করে রান্না করতে হবে না। তুমি গিয়ে বিশ্রাম নাও।”

সুনীতি একটু জোরাজোরি করে বলে,”আমার ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে না, মা। আমাকেও একটু রান্না করতে দিন।”

“ঠিক আছে, কোন ব্যাপার না। কিন্তু তুমি যে রান্না করবে বলছ কিছু কি রাঁধতে পারো?”

“হ্যাঁ, পারি তো। আমি অনেক সুন্দর চিকেন কাটলেট বানাতে পারি।”

“বেশ তো। আমার অভিক তো চিকেন কাটলেট খেতে অনেক পছন্দ করে। তুমি যদি ওকে এটা বানিয়ে খাওয়াও তাহলে অনেক খুশি হবে।”

রাহেলা খাতুনের কথায় খুশি হয়ে সুনীতি চিকেন কাটলেট বানাতে শুরু করে দেয়। রান্নাবান্না শেষ করে সে রাহেলা খাতুনের হাতেনাতে সবকিছুতে সাহায্য করে এবং সবশেষে সবকিছু গুছিয়ে রেখে ড্রয়িংরুমে যায়।

কিছুটা সময় সে বসে বসে রাহেলা খাতুনের সাথে গল্প করে। এরপর রাহেলা খাতুন বিশ্রান নেয়ার জন্য নিজের কক্ষে চলে যান। সুনীতি তখন ড্রয়িংরুমে বসে টিভিতে নিউজ দেখছিল। এমন সময় হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠে৷ সুনীতি উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়। দরজা খুলতেই দেখতে পায় তাদের প্রতিবেশী মিসেস বিলকিস বেগম এসেছেন।সুনীতি মৃদু হেসে সালাম জানায়। বিলকিস বেগম ভেতরে প্রবেশ করেন এবং ড্রয়িংরুমে এসে সুনীতির সাথে টুকটাক কথাবার্তা বলেন।

“তোমার শাশুড়ী কোথায়?”

“মা একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন।”

“ওহ, তা তোমার অবস্থা এখন কেমন?”

“জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”

বিলকিস বেগম কিছুটা দুঃখের সহিত বলেন,”তোমার কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি। এত কম বয়সে এভাবে নিজের মা-বাবাকে হারিয়ে ফেললে। তাও কোন স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, পরিকল্পিত মার্ডার।”

বিলকিস বেগমের কথা শুনে সুনীতি বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে থাকে। হতবাক হয়ে বলে,”এসব কি বলছেন আপনি? আমার মা-বাবা তো সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গেছে। মার্ডার হতে যাবে কেন,,”

বিলকিস বেগম অবাক স্বরে বলেন,”ওমা! সেকি কথা! তুমি জানো না? গোটা এলাকার মানুষ তো জানে তোমার মা-বাবা খুন হয়েছে। তাও তোমাকে যেই ছেলেটা বিরক্ত করত, তুলে নিয়ে গেছিল,,কি যেন নাম হ্যাঁ, মন্টু ওর হাতে। এলাকায় তো পুলিশও এসেছিল। তুমি কি এসব কিছুই জানো না?!”

সুনীতি কিছু বলার মতো খুঁজে পায়না। অভিক তো তাকে বলেছিল যে তার বাবা-মার মৃত্যু শুধুই একটা দূর্ঘটনা ছিল। সুনীতি বিড়বিড় করে বলে,”তুমি আমায় এভাবে ঠকালে অভিক! এত বড় সত্যটা আমার থেকে লুকিয়ে গেলে!”

To be continue……

#মন_রাঙানোর_পালা
#Part_31
#ইয়াসমিন_খন্দকার

সুনীতি মনমরা হয়ে সোফায় বসে পড়ে। বিলকিস বেগম একটু আগেই ফিরে গেছেন। যাওয়ার আগে সুনীতিকে আরো একটু সান্ত্বনা দিয়ে গেছেন। কিন্তু সুনীতির কানে সেসব কথা যায়নি। সে তো ভাবছে শুধু অভিকের বলা সেই কথাটা,”তোমার বাবা-মায়ের মৃত্যুটা একটা দূর্ঘটনা ছিল। একটা ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তোমাদের গাড়িতে ধাক্কা দেয় যার ফলবশত তোমার মা-বাবা মারা যায় এবং তুমি মারাত্মক ভাবে আহত হয়।”

সুনীতির চোখে জল চলে আসে। সে এখনো কিছুতেই এটা মানতে পারছে না যে অভিক তার থেকে এত বড় একটা সত্য লুকিয়ে গেছে। তার উপর এমন একটা মিথ্যা কথা বানিয়ে বলেছে। সুনীতি কিছুক্ষণ এই ব্যাপার নিয়ে ভেবে নিজের চোখের জল মুছে নিয়ে বলে,”তোমাকে এর জবাব দিতেই হবে অভিক! কেন তুমি আমার থেকে এত বড় একটা সত্য লুকিয়ে গেলে? আমার কি নিজের মা-বাবার মৃত্যু সম্পর্কে জানার কোন অধিকার ছিল না?”

সুনীতির এহেন ভাবনার মাঝেই আহসান চৌধুরী ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হন। সুনীতির চোখে জল দেখে বলেন,”তুমি কাঁদছ কেন মা?”

সুনীতি হচকচিয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,”মা-বাবার কথা খুব মনে পড়ছে।”

আহসান চৌধুরী এগিয়ে এসে স্নেহের সহিত সুনীতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,”তোমার কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু কি করবে বলো, এটাই তো বাস্তবতা।”

সুনীতির কাছে আহসান চৌধুরীকে ভরসাযোগ্য একজন মানুষ মনে হয়। তাই সে আহসান চৌধুরীকে প্রশ্ন করে বসে,”আচ্ছা, আমার মা-বাবার মৃত্যুটা কি স্বাভাবিক কোন দূর্ঘটনা ছিল? আপনাকে আমি ভীষণ বিশ্বাস করি৷ দয়া করে সত্যটাই বলবেন।”

আহসান চৌধুরী একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,”তুমি যখন এমন প্রশ্ন করছ তার মানে নিশ্চয়ই তুমি সবটা জেনেই গেছ। অভিক আমাদেরকে তোমায় এসব জানাতে মানা করেছিল তাই আমি বা রাহেলা তোমাকে কিছু বলি নি। তুমি এই বিষয়টা নিয়ে অভিককে ভুল বুঝোনা,,ও তোমার ভালোর জন্যই এমনটা করেছে।”

সুনীতি কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। সুনীতির এমন নীরবতা দেখে আহসান চৌধুরী বুঝতে পারেন তার একটু একা থাকা প্রয়োজন। এজন্য তিনিও নীরবে স্থান ত্যাগ করেন। সুনীতি আহসান চৌধুরীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”আমার ভালো অভিক একটু বেশিই বুঝে ফেলেছে। যা আখিরে আমার জন্য ক্ষতিই বয়ে আনল। আমি তো অভিককে ভরসা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ও আমার ভরসাটা পুরোপুরি ভেঙে দিল।”

~~~~~~~~~~~~~
রাতে ডিনারের সময় অভিক এসে খেতে বসে পড়ে। তার চোখ অবশ্য খুঁজছে সুনীতিকে। আজ বিকেল থেকে সে সুনীতিকে দেখে নি। সুনীতি আজ সারাদিন তার চোখের আড়ালে ছিল। অভিক তাই ভীষণ ছটফট করছে এক পলক সুনীতিকে দেখার জন্য। অবশেষে তার এই অপেক্ষার অবসান ঘটে যখন সুনীতি খাবার হাতে নিয়ে ডাইনিং টেবিলের সামনে উপস্থিত হয়। সুনীতিকে দেখে অভিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু সুনীতি একদম রোবটের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। রাহেলা খাতুনও অনেকক্ষণ থেকে নজর করছেন সুনীতির নির্লিপ্ততা। এই তো বিকেলেও কি আগ্রহ নিয়ে অভিকের জন্য চিকেন কাটলেট বানালো। কিন্তু তারপর থেকে কেমন জানি নির্জীব লাগছে তাকে। আহসান চৌধুরী অবশ্য পুরো ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারছেন কিন্তু তিনিও কোন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না। কারণ তার মতে,এমনটা হওয়ারই ছিল। এখন অভিককেই সুনীতিকে সামলানোর দায়িত্ব নিতে হবে। এজন্যই তিনি শুরুতেই অভিককে বলেছিলেন যেন অভিক এই ব্যাপারটা সুনীতির থেকে লুকিয়ে না রাখে।

সুনীতিকে চুপচাপ অনেক সময় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাহেলা খাতুন গলা খাকারি দিয়ে বলেন,”সুনীতি, তুমি অভিককে চিকেন কাটলেট টা দাও। বিকেলে যে কত যত্ন করে বানালে। জানো অভিক, তোমার চিকেন কাটলেট পছন্দ জন্য সুনীতি কত আনন্দ করে তোমার জন্য এটা বানিয়েছে।”

অভিক স্মিত হেসে বলে,”সত্যি? তাহলে তো খেয়ে দেখতে হয় কেমন হয়েছে।”

সুনীতি গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে অভিকের পাতে চিকেন কাটলেট তুলে দেয়। অভিক চিকেন কাটলেট টা ভীষণ তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে বলে,”এটা ভীষণ ভালো খেতে হয়েছে। গুড জব নীতি।”

এমন প্রশংসাসূচক বাক্যও সুনীতির মধ্যে কোন পরিবর্তন আনতে পারে না। এবার অভিক বুঝতে পারে সুনীতির নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। তাই সে এমন আচরণ করছে। দ্রুত খাওয়া-দাওয়া শেষ করে অভিক উঠে দাঁড়িয়ে সুনীতিকে বলে,”একটু ঘরে আসো তো, তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।”

বলেই সে চলে যায়। অভিক যাওয়ার পর সুনীতিও তার পিছু পিছু যায়। রাহেলা খাতুন তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আহসান চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করেন,”কি হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছ তুমি? সুনীতির ব্যবহার কেমন অদ্ভুত না? বিকেল অব্দি তো স্বাভাবিকই ছিল।”

আহসান চৌধুরী বলেন,”আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি যে, সুনীতি আর অভিকের মধ্যে হয়তো মান-অভিমানের পালা আসতে চলেছে। এখন এটাই দেখার পালা যে এই মান অভিমান তাদের সম্পর্কে কি প্রভাব ফেলে। তারা কি সব মান-অভিমান ভুলে আবারো একে অপরের মন রাঙিয়ে দিতে পারে নাকি ভুল বোঝাবুঝির মাধ্যমে সম্পর্কের দূরত্ব বাড়ায়।”

~~~~~~~~~~~~~~~~
অভিক অস্থির হয়ে পুরো ঘরময় পায়চারি করে চলেছে। সুনীতির এমন শীতল ব্যবহার তাকে বড্ড ভাবাচ্ছে। এমন সময় হঠাৎ সুনীতি রুমে চলে আসে। তাকে আসতে দেখেই অভিক তার মুখোমুখি হয়ে বলে,”কি ব্যাপার বলো তো নীতি? তোমায় এমন লাগছে কেন?”

“এমন মানে?”

“এই যে কেমন চুপচাপ,,,,এর কারণ কি?”

সুনীতি মলিন হেসে বলে,”যখন কাউকে নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি কিন্তু সে সেই বিশ্বাসের অমর্যাদা করে তখন কি এমন ব্যবহার করাই স্বাভাবিক নয়?”

অভিক হতবাক স্বরে বলে,”মানে?”

“আমার মা-বাবার মৃত্যুটা যে স্বাভাবিক কোন দূর্ঘটনা নয় বরং তাকে ঐ মন্টু খু*ন করেছে এই ব্যাপারটা তুমি কেন আমার থেকে লুকিয়ে গেলে? আমার কি কোন অধিকার ছিল না আমার মা-বাবার মৃত্যুর ব্যাপারে জানার?!”

“তার মানে তুমি সব জেনে গেছ নীতি?”

“কেন? আমি জেনে বুঝি তোমার অনেক অসুবিধা হয়ে গেল। আমার থেকে সত্যটা লুকিয়ে আমায় অন্ধকারে রেখে কি লাভ পেলে তুমি অভিক?”

“তুমি আমায় ভুল ভাবছ নীতি..”

“ভুল আমি তোমায় ভাবছি না অভিক। বরং তোমায় এতদিন আমি ভুল ভাবতাম। অন্ধের মতো বিশ্বাস করতাম তোমায় আর তুমি তার এই প্রতিদান দিলা।”

“আমাকে অন্তত নিজেকে এক্সপ্লেইন করার সুযোগটা দাও!”

“জানি, তুমি কি বলবে! এটাই বলবে তো যে, যা করেছ আমার ভালোর জন্যই করেছ। আমার মানসিক অবস্থার কথা ভেবে করেছ, ব্লা ব্লা ব্লা,,কিন্তু এসব কথা আমার কাছে কোন দাম রাখে না। আমার মা-বাবার পর তুমিই ছিলে আমার ভরসার যায়গা। যাকে আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারতাম। আমার বিশ্বাস ছিল তুমি অন্তত আমার থেকে কিছু লুকাবে না কিন্তু তুমি সেই বিশ্বাস নিজেই ভেঙে দিলে। এরপর হয়তো আমি আর কখনোই কাউকে বিশ্বাস করতে পারব না।”

“আমি তোমাকে সবটা জানাতেই চেয়েছিলাম।”

“কবে জানাতে? আরো একযুগ পর? আমার মা-বাবার খু*নী এখনো খোলা আকাশের নিচে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশ এখনো তাকে ধরতে পারেনি আর তুমি এমন ভাবে ছিলে এতদিন যেন সবটা কত স্বাভাবিক।”

“আমার উপর বিশ্বাস রাখো নীতি। আমি এবার ঢাকায় ঐ মন্টুকে ধরার জন্যই এসেছি। তোমার মা-বাবার খুনিকে আমি উপযুক্ত শাস্তি পাইয়ে দেবোই।”

“অনেক ভরসা করেছি তোমার উপর, আর না। এবার থেকে আমি নিজেকে ছাড়া আর কাউকে ভরসা করব না। তুমি যথেষ্ট করেছ, তোমাকে আর কিছু করতে হবে না। আমার মা-বাবার খু*নিকে আমিই শাস্তি পাইয়ে দেব। তোমার কাছে শুধু একটাই অনুরোধ, পারলে আমায় একটু একা থাকতে দাও। তোমার উপস্থিতিও আমায় কষ্ট দিচ্ছে।”

সুনীতির কথা অভিকের বুকে ঝড়ের সৃষ্টি করে। সে দ্রুত পা চালিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
To be continue…….