মন রাঙানোর পালা পর্ব-৪৫

0
182

#মন_রাঙানোর_পালা
#Part_45
#ইয়াসমিন_খন্দকার

সুনীতি মন খারাপ করে অহনার পাশে বসেছিল। আরাফাতের মৃত্যুর পর এক মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে। এই এক মাসে অনেক কিছুই বদলে গেছে। সবাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারলেও, অহনা এখনো শোকে নিমগ্ন। নিজের খেয়ালও সে ঠিকমতো রাখছে না। বর্তমানে অহনা তার বাড়িতেই অবস্থান করছেন। কিন্তু সেখানেও নানা ঝামেলা। কারণ সুনীতির মা থাকে তার মামার বাড়িতে। সুনীতির মামা সবকিছু মেনে নিলেও মামী এবং মামাতো ভাই-বোনেরা অহনার এখানে থাকাটা ভালো চোখে নিচ্ছে না। তাদের মত, অহনা যেহেতু এখন গর্ভবতী তাই তার শ্বশুর বাড়িতে থাকা উচিত। ওদিকে আনোয়ারা বেগম তো এই সন্তানকে নিজের বংশের সন্তানের মর্যাদা দিতেই রাজি নয়। শফিক ইসলাম অনেক বুঝিলেও কোন লাভ করতে পারেন নি। তাই শেষ অব্দি হার মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। অহনার মামীর কথার সুরও অনেকটা আনোয়ারা বেগমের মতো। তার মতে, অহনার বিয়ের দিন যা হয়েছিল তাতে তাদের সম্মান নষ্ট হয়ে গেছে। তাই তিনি অহনাকে মেনে নিতে পারছেন না।

সুনীতি আজ এসেই অহনার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তুই আমাদের সাথে চল। এখানে তোকে এত গঞ্জনা সহ্য করে থাকতে হবে না।”

অহনা মলিন হেসে বলে,”না, রে। আমি আর কারো উপর বোঝা হতে চাই না। এখানে থেকে নাহয় কিছু মন্দ কথা শুনতে হচ্ছে। কিন্তু কেউ তো আর আমাকে বের করে দিচ্ছে না।”

সুনীতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

“নিজের কথা না ভাবিস, অন্তত নিজের সন্তানের কথা ভাব। তোর তো এখন নিজের সন্তানের জন্য হলেও নিজেকে ভালো রাখতে হবে। এটুকু তো আমি আশা করতেই পারি।”

“আমার সন্তানকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমার। ওর বাবা তো ওর সব দায়িত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। তাই এখন যা করার আমার একাকেই করতে হবে। তবে চিন্তা নেই। আমি তো ছোটবেলা থেকে নিজের মাকে দেখেছি, সিঙ্গেল মাদার হয়ে কিভাবে বাঁচতে হয় জানি আমি। ভাবছি, অনলাইনে একটা কোন বিজনেস শুরু করব। সেখান থেকে যা উপার্জন হবে তা দিয়েই আমার সন্তানের চলে যাবে। তাছাড়া আরাফাত আমাদের জয়েন্ট ব্যাংক একাউন্টে কিছু টাকা জমিয়েছিল আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। ওখানে ৫ লাখের মতো টাকা আছে। সেটা আমার সন্তানের ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।”

সুনীতি বলে,”বাংলা সেনাবাহিনীর তরফ থেকে যে ১০ লাখ টাকা দেয়া হয়েছিল সেটা তো আরাফাত ভাই এর মা সম্পূর্ণ দখল করে নিলো। তুই এটা নিয়ে কিছু বললি না কেন?”

অহনা রাগী স্বরে বলে,”আমার স্বামীর জীবনের বিনিময়ে পাওয়া টাকা নিয়ে এতটা ছোটোলোকি করার মানসিকতা আমার হয়নি। ওনার সন্তানের টাকা উনি নিয়েছেন সেটা ওনার ব্যাপার। আমি এব্যাপারে কিছু বলব না।”

সুনীতি বুঝতে পারে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তাই সে একদম চুপ হয়ে যায়। কিছু সময় চুপ থেকে অহনার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তুই থাক। আমি তাহলে আজ উঠি।”

~~~~~~~~~~~
রাতের বেলা হঠাৎ সুনীতি ভীষণ অসুস্থ বোধ করে। অভিক বর্তমানে সিলেটে সেনাক্যাম্পে অবস্থান করছে আর সুনীতি ঢাকায় শ্বশুর বাড়িতে। তাই সুনীতি ঘরে একাই ছিল৷ রাতে পেটে তীব্র ব্যথা অনুভূত হওয়ায় সে নিজের শ্বশুর-শাশুড়ীকে ডাকতে থাকে। পাশের রুম থেকে আহসান চৌধুরী ও রাহেলা খাতুন ছুটে আসেন। দুজনেই সুনীতির এহেন অবস্থা দেখে হচকচিয়ে যায়। রাহেলা খাতুন ভীত স্বরে বলেন,”আমার মনে হয়,ওর প্রসববেদনা উঠেছে আমাদের এখনই ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।”

আহসান চৌধুরীও সম্মতি জানিয়ে বলেন,”তুমি একটু বৌমার পাশে থাকো। আমি এখনই এম্বুলেন্সে কল করছি। অভীককেও ব্যাপারটা জানাতে হবে।”

আহসান চৌধুরী ব্যতিব্যস্ত হয়ে সব কাজ করতে থাকেন। এদিকে রাহেলা খাতুন সুনীতিকে শান্তনা দিয়ে বলেন,”তুমি নিজেকে সামলাও বৌমা, দেখবে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহর নাম নাও। আল্লাহ তোমার আর তোমার বাচ্চাকে একদম ঠিক রাখবেন।”

“আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে মা, মনে হচ্ছে আমি একদম শেষ হয়ে যাব।”

“এরকম কথা বলতে নেই। এসময় একটু ব্যাথা হয়। তুমি চিন্তা করো না।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই এম্বুলেন্স চলে আসে। রাহেলা খাতুন ও আহসান চৌধুরী মিলে সুনীতিকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেয়।

আহসান চৌধুরী অভিককে ফোন করে সবটা জানিয়ে দিয়েছেন। অভিক সুনীতির হঠাৎ এই অসুস্থতার কথা শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। তার ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছিল কিন্তু তার কিছু করারও ছিল না। অনেক ভেবে সে উপরমহলে যোগাযোগ করে। অতঃপর অনেক কষ্টে একদিনের ছুটি ম্যানেজ করে রাতেই ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেয়।

সিলেট থেকে ঢাকায় পৌঁছেই অভিক হাসপাতালের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেয়। ইতমধ্যে সে খবর পেয়েছে যে সে কন্যা সন্তানের পিতা হয়েছে। তার স্ত্রী এবং সন্তান দুজনেই ভালো আছে। মূলত নরমাল ডেলিভারিই হয়েছে, সিজারের প্রয়োজন পড়েনি।

তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে পৌঁছে ভীষণই সুন্দর একটি দৃশ্যের সাক্ষী হয় অভিক। তার মায়ের কোল জুড়ে আছে ছোট্ট একটি প্রাণ। অভিককে দেখামাত্রই রাহেলা খাতুন তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,”এই দেখো অভিক, তোমার মেয়ে। একদম তোমার মতোই দেখতে হয়েছে। আমি তো ওকে দেখামাত্রই অবাক হয়ে গেছিলাম। এ যেন আমার ছোট্ট অভিকের প্রতিচ্ছবি।”

অভিক নিজের ছোট্ট মেয়েকে কোলে তুলে নেয়। মেয়েটা কোন কান্না করছে না৷ চুপচাপ পৃথিবীকে অবলোকন করছে। অভিক কিছুটা ভয় পেয়ে বলে,”ও কি কান্না করে নি?”

রাহেলা খাতুন বলেন,”জন্মের পর থেকে তো সে কি কান্না। একটু আগেই চুপ হলো। এখন কি বিজ্ঞের মতো গোটা পৃথিবীটা দেখছে। আমার মনে হচ্ছে, আমার নাতনী অনেক মেধাবী হবে।”

অভিক নিজের মেয়ের মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমার মেয়েকে তো আমার মতো মেধাবী হতেই ওকে। ওকে নিয়ে যে আমার অনেক স্বপ্ন।”

এরইমধ্যে তার মাথায় সুনীতির চিন্তা আসে। সে বলে,”আচ্ছা, সুনীতি কেমন আছে?”

আহসান চৌধুরী বলেন,”ও সুস্থ আছে। ওকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে।”

অভিক নিজের মেয়েকে সাথে নিয়ে সুনীতির কেবিনের দিকে পা বাড়ায়। অভিক কেবিনে প্রবেশ করতেই সুনীতি সজাক হয়। অভিকের পানে তাকাতেই তার কোলে নিজের ছোট্ট অংশকে দেখে সুনীতির চোখ জুড়িয়ে যায়। সে আবেগপ্রবণ গলায় বলে,”আমাদের ছোট্ট রাজকন্যা!”

অভিক খুশি মনে এগিয়ে এসে বলে,”একদম তোমার আর আমার প্রতিচ্ছবি আমাদের মেয়ে। আমি তো ওর নামও ঠিক করে রেখেছি। আমার মেয়ের নাম হবে, ❝অভীক্ষা❞ তোমার পছন্দ হয়েছে তো নামটা? এমনিতেও আকিকার পর ওর সুন্দর একটা নাম রাখা হবে। তবে আমি ওকে অভীক্ষা বলেই ডাকব, অভিকের মেয়ে অভীক্ষা।”

সুনীতি হেসে বলে,”নামটা সত্যিই অনেক সুন্দর।”

“আমাদের দায়িত্ব আরো বেড়ে গেল নীতি। এখন আমাদেরকে আমাদের সন্তানকে ভালো করে মানুষ করতে হবে। আমি তো নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করব ওকে যতটা সম্ভব ভালো রাখা যায়। তুমি আমার সাথে থাকবে তো এই যাত্রায়? আমি হয়তো নিজের ব্যস্ততার জন্য আমাদের মেয়েকে যথেষ্ট সময় দিতে পারব না। কিন্তু তোমাকে কিন্তু সবসময় ওর খেয়াল রাখতে হবে। ওকে ভালো-মন্দ সব শেখাতে হবে। একজন সুনাগরিক হিসেবে এবং মানবিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।”

সুনীতি বলে,”মা হিসেবে আমি নিজের দায়িত্বে কোন কমতি রাখব না৷ আমাদের মেয়ে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। দেখে নিয়েন।”

অভিক একটা সুন্দর হাসি দেয়৷ সুনীতি সেই হাসির দিকে তাকিয়ে বলে,”আমাদের মেয়ের জীবনও যেন এমন সুখে-শান্তিতে ভড়ে ওঠে। সেই কামনাই করি!”
To be continue…….