#মন_রাঙানোর_পালা_2
#Part_1
#ইয়াসমিন_খন্দকার
অভিকের তরুণ সময়ের একটি ছবি হাতে নিয়ে বেলকনি ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে সুনীতি। পরম আবেশে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে সেই ছবির উপরে৷ একসময় টুপ করে দুফোটা জল পড়ল। পরক্ষণেই সবার অলক্ষ্যে সেই জল মুছে ফেলল। ছবিটা রুমে নিয়ে এসে যথাস্থানে রেখে করুণ স্বরে বলল,”কতদিন তোমায় দেখিনা আমি, কতদিন তোমার বাহুডোরে ঘুমাই না৷ তোমার কি আমার কথা একটুও মনে পড়ে না অভিক? এতগুলো দিন কিভাবে আমার থেকে লুকিয়ে আছ? তোমাকে ছাড়া আমি ২০ টা বসন্ত পার করে দিলাম। আমার এই অপেক্ষার প্রহর কি কেবল দীর্ঘই হবে?”
সুনীতির বুক চিরে বের হলো দীর্ঘশ্বাস। চোখ বন্ধ করতেই মনে পড়ে যায় সেই কালো রাতের কথা। যেদিন অভিক তাকে নিজ বাহুডোরে আবদ্ধ রেখে বলেছিল,”আজ আমার খুব জরুরি একটা মিশন আছে। আজ ঐ শমসের আলমকে আমি হাতেনাতে ধরবোই৷ ও আমাদের দেশের অনেক ক্ষতি করছে, ওকে আমি আর কোন সুযোগ দেব না।”
সুনীতি সেদিন ভীষণ ভীত হয়ে অভিককে বলেছিল,”তুমি আবার সুস্থ সবল ভাবে আমার কাছে ফিরবে তো?”
অভিক বুক ফুলিয়ে গর্বের সাথে বলেছিল,”ফিরব, জয়ী হয়ে।”
কিন্তু অভিক সেকথা রাখেনি। সেদিন রাতে সে ফেরেনি। সেই রাতের পর থেকে সুদীর্ঘ ২০ বছরের প্রত্যেকটি রাত সুনীতি কাটিয়েছে অভিকের অপেক্ষায়৷ কিন্তু অপেক্ষা শুধু দীর্ঘই হয়েছে। সবাই কত বলেছে, অভিকের আশা ছেড়ে দিতে। সে আর হয়তো এই দুনিয়ায় নেই। কিন্তু সুনীতি সেসব কোন কথা বিশ্বাস করে নি। কারণ সুনীতির বিশ্বাস তার অভিক কখনো তাকে মিথ্যা বলতে পারে না। সে যখন বলছিল, সে ফিরবে তার মানে ফিরবেই। তাছাড়া, অভিকের মৃতদেহও তো কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। যদিও অনেকে বলেছিল, হয়তো কোন পাহাড়ের খাদে পড়ে গেছে সে তবুও সেসব কথা সুনীতি গায়ে মাখেনি। তার একটাই বিশ্বাস, অভিক ফিরবে। আজ নাহয় কাল সে ফিরবেই। ফিরে এসে সুনীতিকে জড়িয়ে ধরে বলবে,”দেখো নীতি, আমি ফিরে এসেছি।”
লোকে সুনীতিকে পাগল বলুক, মানসিক রোগী বলুক। তবুও সে জীবনের শেষ দিন অব্দি অভিকের অপেক্ষায় প্রহর গুনবে। এসব ভাবতে ভাবতেই সুনীতি নিজের পিঠে কারো হাতের স্পর্শ বুঝতে পারল। পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখতে পেল নিজের শাশুড়ি রাহেলা খাতুনকে। তাকে দেখামাত্রই সে মুখে হাসি ফুটাল৷ রাহেলা খাতুন বুঝলেন এই হাসি মেকি। স্বামী-সন্তানকে হারিয়ে এখন নিজের বৌমা আর নাতনীকে ঘিরেই তার জীবন। লাঠিতে ভড় দিয়ে চলাফেরা করেন। শরীরে নানা রোগ বাসা বেঁধেছে। চোখেও ঘোলা দেখেন। তবে এই ঘোলা দৃষ্টি দিয়েও তিনি সুনীতির দুচোখে লুকিয়ে থাকা কষ্টের মাত্রা বুঝতে পারলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,”আর কত বৌমা? আর কত? তোমার এই অপেক্ষা আর কতদিন চলবে?”
“যতদিন না পর্যন্ত,আপনার ছেলে ফিরে আসছে।”
“তোমার কি এখনো বিশ্বাস হয় যে, অভিক ফিরবে৷ যদি ওর ফেরারই হতো, তাহলে কি এতদিনে ফিরত না?”
“ও আমায় কথা দিয়েছিল, ও ফিরবে। আমি জানি, ও একদিন ফিরে আমায় চমকে দেবে। অভিক ওর সব কথা রাখে। এই কথাও রাখবে। আমি নিশ্চিত।”
রাহেলা খাতুন সুনীতির নিষ্পাপ মুখপানে চেয়ে থাকে। বয়স পেরিয়েছে ৪৫ এর কোঠা। তবুও যেন রূপ-লাবণ্য ধরে রেখেছে এই নারী। অভিক নিখোঁজ হবার পর থেকে তো কত ভালো ঘর থেকে সম্মন্ধ এলো। কিন্তু সুনীতি তাদের সবাইকে ফিরিয়েছে। কারণ সুনীতির প্রতি ফোটা রক্তের সাথে যে মিশে আছে একটিই নাম, “অভিক”।
“আপনি তো মনে হয় সকালের ওষুধ এখনো নেন নি, ব্রেকফাস্টও বোধহয় হয়নি। আমি এখনই সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”
বলেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে সুনীতি। রাহেলা খাতুন তাকে থামিয়ে বলে,”এতটা ব্যস্ত হইওনা বৌমা, আমি ব্রেকফাস্টও করেছি ওষুধও নিয়েছি।”
সুনীতি অবাক কন্ঠে শুধায়,”আমি তো এখনো ব্রেকফাস্ট বানাই নি তাহলে,,,”
রাহেলা খাতুন হেসে বলেন,”তুমি বানাও নি তো কি হয়েছে? আমার অভীক্ষা সখী আছে না? ওই সব করেছে।”
সুনীতির মুখে আঁধার নেমে আসে। সে বলে,”অভীক্ষাকে আমি কতবার মানা করেছি আগুনের পাশে না যেতে। তবুও আমার কোন কথা শোনে না, আজ ওর একদিন কি আমার।”
“আহ, বৌমা। তুমি এভাবে বলছ কেন?”
“এভাবে বলব না তো কি? আপনি তো জানেনই ওর আগুনে ফোবিয়া আছে। তাও কেন ও রান্নাঘরে গেছে?”
“আরে ও তেমন কিছু করেনি। বয়েল মেশিনে করে আমায় ডিম সিদ্ধ দিয়েছে আর জ্যাম-পাউরুটি দিয়েছে। আগুনের কাছে যায়নি।”
সুনীতি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,”ওহ, তাই বলুন। আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম। জানেনই তো, মেয়েটাকে নিয়ে কত চিন্তায় থাকি। ঐ তো এখন আমার সব। অভিক আমায় সবসময় বলতো, মেয়েটা সর্বোচ্চ সুখী দেখতে চায়। আমিও তো সবসময় সেই চেষ্টাই করি। হঠাৎ যদি কোন একদিন অভিক এসে আমায় বলে, আমাদের মেয়েকে কেমন মানুষ করেছ দেখি, তখন তো আমায় দেখাতে হবে নাকি? যে আমাদের মেয়েকে একদম আমি রাজকন্যার মতোই মানুষ করেছি। যাতে ও আমাদের উপর প্রসন্ন হয়। তাই না বলুন?”
রাহেলা খাতুনের চোখে জল চলে আসে। সুনীতি পরিবেশ স্বাভাবিক করতে বলে,”তা, আমার রাজকন্যা এখন কোথায়? সকাল থেকে তো ওকে দেখছি না।”
রাহেলা খাতুন চোখের জল মুছে বলেন,”আমার সখী কি আর ঘরে বসে থাকার মেয়ে? সকালে উঠে আমায় ব্রেকফাস্ট করিয়েই বেরিয়ে গেছে শরীরচর্চা করতে। দুপুরে নাকি কোন একটা বিউটি শোতে যাবে। সেজন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।”
সুনীতি বিরক্ত হয়ে বলে,”এই মেয়েকে নিয়ে আমি আর পারিনা। এত সকাল সকাল একা এভাবে ব্যায়াম করতে বেরিয়ে গেল?! এমনিতেই দিনকাল ভালো না। আমার চিন্তাটা ও কখনো বুঝবে না।”
“তুমি এত চিন্তা করো না, বৌমা। আমার সইয়ের কোন বিপদ হবে না৷ ও নিজেকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করতে জানে। কি জন্য বলছিল সেদিন, হ্যাঁ কুম্ফু, ক্যারাটে,,এসব তো প্রাক্টিস করেছে ও।”
“এসব যথেষ্ট নয় মা। যা দিনকাল পড়েছে এখন একটা মেয়ে যতই স্ট্রং দেখাক নিজের আত্মরক্ষা করতে সে যথেষ্ট নয়। ও আসুক আজকে তারপর আমি দেখাচ্ছি মজা।”
“তুমি আমার সখীকে বেশি বকা দিও না বৌমা। নাহলে আবার রাগ করে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেবে।”
“খাওয়া দাওয়া বন্ধ করবে বললেই হলো। আমি ঠেসে ঠেসে খাইয়ে দেব।”
রাহেলা খাতুন হেসে ফেলেন।
~~~~~~~~~~~~~~~~
কানে এয়ারবাড লাগিয়ে পার্কের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে ২৫ বছর বয়সী এক অতীব সুন্দরী রমণী। বেঁধে রাখা চুলও মাঝেমধ্যে বাঁধা অমান্য করে হাওয়ার তালে উড়ছে। আশেপাশে সব ৮-৮০ যত পুরুষ আছে সবার দৃষ্টি সেই সুন্দরী রমনীর দিকে। কিন্তু রমনীটির কারো দিকেই কোন ধ্যান নেই। সে আপনমনে দৌড়ে চলেছে। কানে লাগানো এয়ারবাডে বাজছে বিখ্যাত ইংলিশ বয় ব্রান্ড One Direction এর গান, “Only getting older baby” গানের মধ্যেই যেন সে হারিয়ে গেছে। এমন সময় হঠাৎ কলের রিংটন বেজে উঠল। রমণীটি একটা বড় অশ্বত্থ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কলটা রিসিভ করল। কল রিসিভ করতেই শুনতে পেল বিপরীত দিক থেকে তার এসিন্ট্যান্ট মুন্নির কন্ঠস্বর। মুন্নি বলছিল,”ম্যাম, আপনার আজকের স্ক্যাজিউলটা শোনাতে এলাম।”
“হুম, বলো শুনছি।”
“আজ দুপুর ১২ টায় বনানীর গ্রান্ড প্যালেসে একটা বিউটি শোতে আপনায় গেস্ট হিসেবে থাকতে হবে। আর রাত ৯ টার দিকে মিরপুর ১২ এ একটি বিদেশী ব্রান্ডের সামনে আপনার ডিজাইন করা নতুন কিছু ড্রেস প্রেজেন্ট করা হবে।”
“ওহ। গুড। এরপর বলো।”
“আর ম্যাম, পরশু আপনাকে একটু সিলেটে যেতে হবে।”
সিলেট নামটা শুনেই রমনী থমকে গেল। মনে পড়ে গেলো কিছু নির্মম স্মৃতি। ভাসা ভাসা গলায় বলল,”কেন?”
“সিলেটে হঠাৎ করে একটা ফ্যাশন শোয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে আমাদের কোম্পানি থেকে। মিজানুর স্যার আমাকে বলেছিল কালকেই এটা আপনাকে জানাতে কিন্তু আমি ভুলে গেছিলাম।”
“ড্যাম ইট। ফোন রাখো এখন।”
মুন্নি তড়িঘড়ি করে ফোন রেখে দিল। রমনীটি অশ্বত্থ গাছের নিচেই একটি ব্রেঞ্চে বসে পড়ল৷ কিছুক্ষণ জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বলল,”সিলেট! যেই শহর আমার বাবাকে আমার থেকে কেড়ে নিয়েছে আবার কিনা সেখানেই যেতে হবে!”
To be continue……
মন রাঙানোর পালা সিজন-০১ পড়তে লেখাটির উপর ক্লিক করুন