#মন_রাঙানোর_পালা_2
#Part_6
#ইয়াসমিন_খন্দকার
অভীক্ষার জ্ঞান ফিরতেই সে নিজেকে ঘন জঙ্গলের মাঝে আবিষ্কার করে। তড়িঘড়ি করে উঠে বসতেই আরো অবাক হয় নিজের পাশে একজন আগন্তুক ব্যক্তিকে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে দেখে। সাথে ভীষণ ভয়ও পায়। অভীক্ষা একটু নড়েচড়ে উঠতেই সজাগ হয় সারজিস। চোখের পাতা মেলে জিজ্ঞেস করে,”আপনি ঠিক আছেন তো?”
অভীক্ষার সর্বপ্রথম নজর যায় সেনাবাহিনীর পোশাক পরিহিত ব্যক্তিটির চোখের নীল মনির দিকে। যেটা তাকে একদম অবাক করে দেয়। কেননা, লোকটাকে দেখে তো বাংলাদেশীই মনে হচ্ছে। সকল প্রকার দ্বিধাদ্বন্দ্ব পাশে ঠেলে অভীক্ষা বলে ওঠে,”কে আপনি? আর এটা কোন যায়গা?”
সারজিস একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”এই প্রশ্ন তো আমার আপনাকে করা উচিৎ। কে আপনি? আর এই রকম একটা সময়ে এমন অসুরক্ষিত একটা স্থানে কেন এলেন আপনি? জানেন, এটা কতটা বিপদজ্জনক হতে পারত।”
অভীক্ষা জবাবে তৎক্ষণাৎ কিছু বলে না৷ দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”আমি এই জঙ্গলে ভীষণ জরুরি একটা কাজে এসেছিলাম। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল ঠিক বুঝলাম না। আমরা এখন কোথায় আছি বলতে পারবেন?”
“আমি আপনার নাম এবং পরিচয় জানতে পারি কি?”
“আমার নাম অভীক্ষা চৌধুরী, আমি একজন ফ্যাশন ডিজাইনার। আপাতত এর থেকে বেশি কিছু বলতে পারছি না।”
“আমি সারজিস খন্দকার। আমি সেনাবাহিনীর একজন মেজর। আজ আমরা এখানে একটা মিশনে এসেছিলাম যা ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমানে আমরা গভীর অরণ্যে বসবাস করছি এবং এখান থেকে বের হবার রাস্তাও আমার জানা নেই, কেননা এতটা গভীরে আগে কখনো আসা হয়নি।”
অভীক্ষা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়।
“তাহলে এখন উপায়?”
“আপনি আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন মিস অভীক্ষা। আমি নিজেকে আর আপনাকে এখান থেকে উদ্ধার করার কোন বন্দবস্ত করব।”
“আপনার কাছে ওয়াকি টকি বা এরকম কোন ডিভাইস নেই যা দিয়ে সংকেত পাঠানো সম্ভব?”
“দূর্ভাগ্যজনক ভাবে, না। এখানে আসার সময় সেসব কোথাও একটা হারিয়ে ফেলেছি।”
অভীক্ষা এখনো পুরোপুরি সারজিসকে বিশ্বাস করে উঠতে পারছিল না। একা এমন এক জঙ্গলে একটা ছেলের সাথে স্বাভাবিকভাবেই কোন মেয়ে নিরাপত্তা বোধ করবে না। সারজিস যেন বুঝল ব্যাপারটা। তাই তো সে অভীক্ষার থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে বলল,”আমার উপর এটুকু বিশ্বাস রাখতে পারেন যে আমার দ্বারা অন্তত আপনার কোন ক্ষতি হবে না। এই জঙ্গলটা আমাদের জন্য নিরাপদ নাও হতে পারে। তাই আশেপাশে কোন লোকালয় আছে কিনা আমাদের সেই খোঁজ করতে হবে।”
অভীক্ষা মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানালো। আসার সময় সেও ভুল করে ফোনটা ফেলে রেখে এসেছিল। তাই এখন আর কোন উপায় নেই তার হাতে। সারজিস সামনে চলতি শুরু করল। অভীক্ষা তার পিছু পিছু। অনেকক্ষণ যাবৎ তারা চুপচাপ হাটতে লাগল কিন্তু লোকালয়ের কোন চিহ্ন খুঁজে পেল না। দুজনেই নিদারুণ হতাশ হলো। একজন আর্মি হওয়ায় সারজিসের জঙ্গলের দূর্গম পথে অনেকক্ষণ যাবৎ হাঁটার অভ্যাস থাকলেও অভীক্ষার তা নেই। তাই অভীক্ষা ক্লান্ত হয়ে একটা বড় গাছের নিচে বসে পড়ল। সারজিস ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অভীক্ষাকে বলল,”আপনি একটু এখানে বিশ্রাম নিন। আমি একটু আশপাশটা খুঁজে দেখি।”
এটা বলে সারজিস সামনে যেতে নিবে কি অভীক্ষা তার হাত চেপে ধরে বলল,”দয়া করে আমায় একা ছেড়ে কোথাও যাবেন না।”
অভীক্ষার এই স্পর্শ যেন সারজিসের মনে অন্যরকম এক শীতল স্রোত বইয়ে দিল। সে ভীষণ অস্বস্তি বোধ করল। অভীক্ষা ব্যাপারটা বুঝে সারজিসের হাত দ্রুত ছেড়ে দিয়ে বলে,”দুঃখিত৷ আসলে,,”
“ঠিক আছে, আমি এখানেই আছি। আপনি বিশ্রাম নিন।”
অভীক্ষা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে গাছের নিচে বসে পড়ে। সারজিসের পাশেই একটি বড় ফলের গাছ দেখতে পায় এবং ঢিল ছুড়ে সেখান থেকে কিছু ফল পাড়ে। অতঃপর নিজের জন্য সামান্য কয়েকটা ফল রেখে বাকি ফলগুলো অভীক্ষার দিকে বাড়িয়ে দেয়৷ অভীক্ষার ভীষণ খিদে পেয়েছিল কারণ অনেকক্ষণ সে না খেয়ে ছিল৷ এজন্য গপাগপ সে ফলগুলো খেতে থাকে৷ সারজিস অভীক্ষার পানেই চেয়ে থাকে। ফর্সা মুখশ্রীর হুডি আর জিন্স পরিহিত এই মেয়েটিকে যেন সৃষ্টিকর্তা সমস্ত মায়া ঢেলে দিয়েছেন। এমন মায়াবী চেহারা সারজিস জীবনে খুব কমই দেখেছে।
খাওয়া শেষ করে অভীক্ষা সারজিসের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”এখন আমি ঠিক আছি। চলুন আশেপাশে খুঁজে দেখি কোথাও যদি লোকালয়ের সন্ধান পাই।”
“হুম,চলুন।”
দুজনে একসাথে চলা শুরু করে৷ তবে এবার আর তারা চুপ থাকে না। টুকটাক কথাবার্তা বলে। একসময় সারজিস কৌতুহলের বশে অভীক্ষাকে জিজ্ঞেস করে বসে,”আচ্ছা, আপনি এই জঙ্গলে কি কাজে এসেছিলেন?”
অভীক্ষা এখন সারজিসের সাথে অনেকটাই ফ্রি হয়ে গেছে। কোথায় যেন একটা ভরসাস্থল হয়ে উঠেছে সারজিস তার জন্য। এজন্য সে নির্দ্বিধায় বলে দেয়,”আমি আসলে এখানে আমার বাবাকে খুঁজতে এসেছিলাম।”
“বাবাকে খুঁজতে?!”
“আমার বাবাও আপনার মতো একজন সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। আজ থেকে ২০ বছর আগে এই জঙ্গলে এসেই তিনি একটা মিশনের কাজে হারিয়ে যান। তখন থেকে তার কোন সন্ধান নেই। অনেক খোঁজার পরেও তাকে পাওয়া যায়নি। এজন্য একসময় তার খোঁজ থেমে যায় এবং সন্দেহ করা হয় যে এখানে কোন খাদে পড়ে তার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু আমার মা এই দাবি মেনে নিতে নারাজ। তার মতে, আমার বাবা এখনো জীবিত আছে। এমনকি আমার নিজেরও তাই মনে হয়। এজন্যই আমি এই স্থানে বাবাকে খুঁজতে এসেছি কারণ এখানেই বাবাকে শেষ দেখা গেছিল।”
সারজিস নম্রতার সহিত বলে,”আপনার কথা শুনে আমি ভীষণ মর্মাহত বোধ করছি। তবে আমার মনে হয়েছে, আপনার এখানে একা এভাবে আসার সিদ্ধান্ত হটকারিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। দেখুন, আজ বড় কোন বিপদও হয়ে যেতে পারত। এমনকি এখন আমরা যে এই জঙ্গলে হাটছি এখানেও কোন বিপদ হানা দিতে পারি।”
“আপনি ঠিকই বলেছেন। এখানে ভুলটা আমারই। এজন্যই মা আমাকে এখানে আসতে মানা করেছিল কিন্তু আমি তার কথা শুনলাম না, এখন আফসোস হচ্ছে।”
“আমি নিজের যথেষ্ট চেষ্টা করব আপনাকে নিরাপদে পৌঁছে দেয়ার। বাকিটা দেখা যাক।”
অনেকক্ষণ ধরে জঙ্গলের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে তারা দুজনেই ক্লান্ত হয়ে যায়। এরইমধ্যে আঁধার নামে। আকাশের অবস্থাও ভালো না। মেঘের তর্জন গর্জন শুরু হয়ে গেছে। সারজিস এমতাবস্থা দেখে বলে,”আমাদের এখন আশেপাশে কোন বড় গাছের নিচে আশ্রয় নেয়া উচিৎ। যেকোন মুহুর্তে বৃষ্টি আসতে পারে আবার রাতও গভীর হচ্ছে মনে হয়।”
অভীক্ষা সম্মতি জানায়। দুজনে কিছুটা দূরে গিয়ে একটা গাছের তলায় বসে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি নামে। বড় গাছের নিচে আশ্রয় নিলেও অভীক্ষা এবং সারজিস বেশ খানিকটা ভিজে যায়। বৃষ্টি থামতেই সারজিস সংগ্রহ করে রাখা কিছু শুকনো কাঠ এবং পাথর দিয়ে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করে। অভীক্ষার ফোবিয়া থাকায় সে কিছুটা দূরে সরে বসে। কিছুক্ষণ চেষ্টার পরে সফল হয়। সারজিস অভীক্ষার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি রাত জেগে পাহাড়া দিব।”
“আপনাকে শুধু একা কেন কষ্ট করতে হবে? যদি খুব ঘুম পায় তখন আমায় ডেকে দিতে পারেন।”
“এমনটা না। আমার না ঘুমিয়ে থাকার অভ্যাস আছে। আপনি বিশ্রাম নিন। সারাদিন এভাবে হেঁটে নিশ্চয়ই অনেক ক্লান্ত আপনি।”
অভীক্ষা আসলেও অনেক ক্লান্ত ছিল। চোখ বন্ধ করার কিছু সময় পরেই ঘুমের ঘোড়ে ঢুলে পড়ে। আগুনের বহ্নিশিখায় সারজিস ঘুমন্ত অভীক্ষার পানে তাকিয়ে থাকে। ঘুমন্ত অবস্থায় মেয়েটাকে যেন আরো বেশি মায়াবী লাগে। সারজিস বুঝতে পারে না তার সাথে এসব কি হচ্ছে। আগে কোন মেয়েকে দেখে তো তার মনে এমন অনুভূতি আসেনি। তাহলে এই মেয়েকে দেখে এমন হচ্ছে কেন?
রাত একটু গভীর হলে শীত বাড়ায় অভীক্ষা ঘুমের মধ্যেই কাপতে থাকে। সারজিস ব্যাপারটা লক্ষ্য করে নিজের শার্টটা খুলে অভীক্ষাকে পড়িয়ে দেয়। তবুও অভীক্ষার কম্পন থামছে না দেখে সে উপায়ন্তর না পেয়ে অভীক্ষাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়। আর বলে,”আমায় ক্ষমা করবেন অভীক্ষা। এছাড়া আমার কাছে আর কোন উপায় ছিল না।”
অভীক্ষাকে এভাবে জড়িয়ে ধরায় সারজিসের হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়। সে বুঝে উঠতে পারে না এসবের কারণ। এরমধ্যে তার চোখেও ঘুম নামে।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতেই সারজিস অবাক হয়। নিজের চোখের সামনে সে ৪-৫ জন সাধারণ মানুষকে দেখতে পায় যারা তাদের ঘিরে রেখেছে।
To be continue…….