#মন_রাঙানোর_পালা_2
#Part_8
#ইয়াসমিন_খন্দকার
অভীক্ষা সুনীতির সাথে ঢাকায় ফিরে আসে। ঢাকায় আসার পর থেকে অভীক্ষা অনেকটাই চুপচাপ হয়ে যায় এবং সর্বক্ষণ একা থাকতে থাকে। তার মধ্যে একধরনের মানসিক অবসাদ দেখে দেয়। যা দেখে সুনীতি ও রাহেলা খাতুন দুজনেই চিন্তিত হয়ে পড়েন। সিলেট থেকে ফেরার এক সপ্তাহ পর, যখন অভীক্ষা অনেকটাই ঘরকুনো হয়ে যায় তেমন একদিন সুনীতি রাহেলা খাতুনকে বলেন,”মা, আপনার মনে হয়না আপনার নাতনী অনেকটা বদলে গেছে?”
“ব্যাপারটা আমারো চোখে পড়ছে বৌমা, আগে তো মেয়েটা সবসময় হাসিখুশি থাকত, কথাবার্তাও বলত অফুরন্ত। এখন তো প্রয়োজন ছাড়া কিছু বলেও না৷ কাজেও অনেকটা অমনোযোগী হয়ে পড়েছে। আমি তো মুন্নির কাছে শুনলাম, ওদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাশন শো অভীক্ষা বাতিল করে দিয়েছে।”
সুনীতির বুকটা ধক করে ওঠে। সে বলে,”ও কি আমার উপর রাগ করে এমন হয়ে গেল? সেদিন আমি ওকে থাপ্প*ড় মে*রে আর জোর করে সিলেট থেকে ফিরিয়ে এনে কি ভুল করলাম? কিন্তু আমারো যে আর কিছু করার ছিল না। সেদিন সুনীতিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে আমি এতটাই ভয় পেয়ে গেছিলাম যে মাথা কাজ করছিল না।”
“তোমার ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি বৌমা। তবে আমার মনে হয় না, সখী এমন কোন সাধারণ বিষয় নিয়ে রাগ করে থাকবে। হয়তো ঘটনা অন্যকিছু। তাছাড়া যেদিন ও নিখোঁজ ছিল সেদিনকার ঘটনা সম্পর্কেও বিস্তারিত কিছু বলেনি।”
“আমার তাহলে এখন কি করা উচিত?”
“তুমি একটু ওর সাথে স্বাভাবিক ভাবে মেশার চেষ্টা করো। যাতে ও নিঃসংকোচে তোমাকে ওর মনের কথা বলতে পারে।”
“ঠিক আছে।”
~~~~~~~~~
নিজের কক্ষে বসে জানালার পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অভীক্ষা। এক সপ্তাহ অতিবাহিত হয়ে গেলেও আজো সে ঐ ঘটনার ধাক্কা সেরে উঠতে পারেনি। প্রতিদিন স্বপ্নে ঐদিনের ঘটনা ভেসে ওঠে। যা তাকে ঘুমাতে দেয়না। অভীক্ষার অন্তর থেকে কেউ একজন বলে ওঠে,”তুই এখন বিবাহিত অভীক্ষা। চাইলেও এই সত্যটা অস্বীকার করতে পারবি না। ঐ সেনাবাহিনীর মেজর এখন তোর স্বামী।”
অভীক্ষা নিজের কান চেপে ধরে বলে,”না, না। আমি এই বিয়েটা মানি না৷ এটা আমাদের জীবনে একটা দুঃস্বপ্ন। যা আমি ভুলতে চাই।”
এমন সময় সুনীতি অভীক্ষার কক্ষে প্রবেশ করে বলে,”কি হয়েছে মামনী? তুমি এমন করছ কেন?”
অভীক্ষা উঠে দাঁড়িয়ে ছুট্টে গিয়ে জড়িয়ে ধরে তার মাকে। সুনীতিও পরম আবেশে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”তুমি একদম ভয় পাবে না। মা, আছে তো তোমার সাথে। কি হয়েছে আমাকে নির্ভয়ে বলো।”
অভীক্ষা বলে,”আমার জীবনে অনেক বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে মা,,,আমি বুঝতে পারছি না এখন আমার কি করা উচিৎ।”
সুনীতি উৎকন্ঠার সাথে বলে ওঠে,”কি হয়েছে?”
অভীক্ষা নিজেকে সামলে নেয়। মনে মনে বলে,”আমায় ক্ষমা করে দিও মা, তোমাকে সত্যটা বলার সাহস আমার নেই।”
আর তার মাকে বলে,”আমার উদ্দ্যেশ্য ছিল সিলেটে গিয়ে বাবাকে খুঁজে বের করা। কিন্তু সেটা আমি করতে পারলাম না। নিজেকে ভীষণ ব্যর্থ মনে হচ্ছে।”
“তাহলে কি সেদিন তুমি তোমার বাবার খোঁজে বেরিয়েছিলে?”
অভীক্ষা কোন উত্তর দেয় না৷ সুনীতি অভীক্ষার মুখটা ঘুরিয়ে নিজের পাশে করে নিয়ে বলে,”তোমাকে এত হীন্যমনতায় ভুগতে হবেনা, মামনী৷ যেখানে এত সেনাসদস্য,গোয়েন্দা টিম এতদিন চেষ্টা করেও কিছু করতে পারে নি সেখানে তুমি কি করতে পারবে? তুমি যে চেষ্টা করেছ এটাই অনেক। যদি ভাগ্যে থাকে তাহলে দেখবে তোমার বাবা ঠিক একদিন আমাদের কাছে ফিরে আসবে।”
সুনীতি অভীক্ষার বিরস মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”এই ব্যাপারটা নিয়ে আর মন খারাপ করে থাকতে হবে না। এর থেকে ভালো, কাল চলো আমরা দুই মা-মেয়ে কোথাও ঘুরতে যাই৷ তাহলে মনটাও ফুরফুরে হয়ে যাবে।”
“কাল তো হবে না, মা। আমার একটা ফ্যাশন শো আছে। এই সপ্তাহে আমার অনেক ব্যস্ত স্ক্যাজিউল।”
“ও কোন ব্যাপার না৷ তুমি কাজে মন দাও। তাহলে এই ট্রমা থেকে বের হতে পারবে। আমরা নাহয় সময় করে একদিন ঘুরতে যাব কোথাও।”
“আচ্ছা।”
মায়ের সাথে কথা বলার পর অভীক্ষার মন অনেকটাই ফুরফুরে হয়ে যায়। সে আবার সবটা ভুলে নতুন উদ্যমে জীবনটা শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়।
~~~~~~~~~~~~
৩ মাস পর,
দীর্ঘ সময় পর আবারো নিজ শহর ঢাকায় পা রাখল সারজিস। এবার এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে এসেছে সে। ভেবেছে এই সময়টা পরিবারের সাথে অনেক সুন্দরভাবে কাঁটাবে। সারজিস বাড়িতে প্রবেশ করতেই তার চাচাতো ভাই সোহেল ছুটে এসে বলে,”ভাইয়া, তুমি এসেছ। চাচা, চাচি, আম্মু, আব্বু, আপি কোথায় তোমরা। এক্ষুনি এসে দেখ কে এসেছে।”
ইভা ও অহনা রান্নাঘরেই ছিল৷ সোহেলের ডাক শুনে তারা দুজনেই ছুটে আসে। ইভা তো এসেই সারজিসকে জড়িয়ে ধরে। আবেগঘন স্বরে বলে,”এতদিন পর মমের কথা মনে পড়ল!”
“কি যে বলো না মম! আমার তো সবসময় তোমার কথাই মনে পড়ে।”
সাগর বর্তমানে সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার। কর্মসূত্রে চট্টগ্রামে তার অবস্থান। অনেকদিন পর সে ঢাকায় ফিরেছে। সাগর ও সাজিদ দুই ভাই আসতেই সারজিস তাদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে সাগরের সাথে সারজিসের ভীষণ ভালো সম্পর্ক। তার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই তো সারজিস আজ একজন সেনাবাহিনীর মেজর হয়েছে।
অহনা ইভার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আজ অনেকদিন পর আমাদের পরিবারটাকে আবার পরিপূর্ণ লাগছে তাইনা?”
“ঠিক বলেছ, তবে আরো পরিপূর্ণ লাগবে যখন আমাদের সম্পর্কের সমীকরণ বদলে দুই যা থেকে দুই বেয়ান হবো।”
অহনা স্মিত হাসে। একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল আমায়রা৷ সারজিসকে এতগুলো দিন পর দেখে সে যেন নিজের দুই নয়নের কতগুলো দিনের তেষ্টা মেটাচ্ছিল। অহনা একবার নিজের মেয়ের পানে তো একবার সারজিসের পানে তাকায়। অতঃপর বলে ওঠে,”সারজিস কি আমাদের এই সিদ্ধান্তে রাজি হবে? ওকে তো আগে থেকে কিছু জানানোও হয়নি। ওরও তো কোন পছন্দ অপছন্দ থাকতে পারে।”
“তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো অহনা। আমি সারজিসের সাথে কথা বলেছিলাম গতবার। ওর পছন্দের কেউ নেই। আমাদের সিদ্ধান্ত ও অবশ্যই মানবে।”
অহনা একটু নিশ্চিত হয়।
~~~~~~~~
সারজিস নিজের রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নেয়। ওয়াশরুম থেকে বাইরে আসতেই দেখতে পায় ইভা তার বিছানায় বসে আছে।
“মম, তুমি কি কিছু বলবে আমায়?”
“ইয়েস, মাই সান। তোমাকে আমার কিছু বলার আছে।”
“বলো।”
“আমরা বড়রা মিলে একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দেখো, তোমার ছোট্ট চাচ্চু অনেকদিন পর ছুটি পেয়েছেন আর তুমিও। এরপর না জানি আর কখন তোমরা একসাথে ছুটি পাবে। তাই এটাই আমাদের কাছে সুবর্ণ সুযোগ হয়েছে। এই এক সপ্তাহের মধ্যেই আমরা তোমার আর আমায়রার বিয়েটা দিয়ে দিতে চাই।”
ইভার কথা শুনে যেন সারজিসের মাথায় বজ্রপাত হয়। সে বলে ওঠে,”এটা কি করে সম্ভব মম?”
“দেখো, এই ব্যাপারে আমি তোমার সাথে আগেও কথা বলেছি। তাই আমি কোন আপত্তি শুনব না।”
সহসাই সারজিসের মনে ভেসে ওঠে অভীক্ষার চেহারা। যেই মেয়েটার সাথে যেভাবেই হোক তার বিয়ে হয়েছিল, এখন কিভাবে সে আরেকটা বিয়ে করবে? সারজিসের মাথা কাজ করছিল না।
“এটা একটু বেশি তাড়াহুড়ো হচ্ছে না?”
‘মোটেই না। তোমার তো বিয়ের বয়স হয়ে গেছে আর আমায়রাও যথেষ্ট বড় হয়েছে। এবার ওর গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হলো। ওর বাহিরে কোন জব-টব করার ইচ্ছা নেই। সংসারী হতে চায়। তাই আমিও চাই ওকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের ছেলের বউ করে আনব। আর আজ হোক বা কাল ওকে তো আসতেই হবে৷ এতে তাড়াহুড়োর কিছু নেই।’
“কিন্তু মম,,”
“আমি তোমার কোন কিন্তু শুনব না। আমরা যেটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটাই ফাইনাল। এর আগে তুমি নিজের ইচ্ছায় সব করেছ কিন্তু এবার আমাদের কথা শুনতে হবে। নাহলে ভুলে যেও যে আমি তোমার মম!”
“মম!”
সারজিস যেন অকুল পাথারে পড়ে। এখন কি করবে সে? কি সিদ্ধান্ত নেবে?
To be continue……