#মন_রাঙানোর_পালা_2
#Part_30(ধামাকাদার পর্ব)
#ইয়াসমিন_খন্দকার
সুনীতি যখন প্রবল আবেগ ও অনুভূতির সাথে অভিককে জড়িয়ে ধরেছিল তখন অভিকের চোখে এক ধরনের দ্বিধা কাজ করছিল। এদিকে অভীক্ষার কাছেও এতক্ষণে স্পষ্ট হয় কেন প্রথম দেখায় লোকটিকে তার এত চেনা চেনা লাগছিল। কারণ লোকটা তার জন্মদাতা পিতা। বুঝ হওয়ার পর থেকে সে শুধু বাবার ছবিই দেখেছে কখনো সামনাসামনি দেখেনি। আর ২০ বছর পেরিয়ে যাওয়ায় অভিকের চেহারাতেও কিছু বদল এসেছে যার কারণে তাকে কখনো সামনাসামনি না দেখা অভীক্ষার প্রতি নিজের বাবাকে চেনা খানিকটা কঠিন ছিল৷ কিন্তু সুনীতির সাথে অভিকের হৃদয়ের আত্মিক বন্ধনের কারণে সে খুব সহজেই নিজের ভালোবাসা, নিজের অভিককে চিনে নেয়।
সুনীতি অভিককে জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই বলে,”এতদিন কোথায় ছিলে তুমি? জানো, আমি কোথায়, কোথায় খুঁজেছি তোমায়? কিন্তু কোথাও তোমার সন্ধান পাইনি। আজ সুদীর্ঘ ২০ বছর পর তোমায় নিজের চোখের সামনে দেখলাম। এতদিন কোথায় ছিলে তুমি অভিক? কেন একবারও আমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করো নি? তোমার অনুপস্থিতি আমাদের জন্য কতটা কষ্টকর ছিল জানো? তোমার বাবা তো তোমার শোকে নিজের জীবনই দিয়ে দিলেন, তোমার বৃদ্ধ মা আজও তোমার অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছে। আর আমাদের ছোট্ট অভীক্ষাকে তোমার মনে আছে? আজ ও অনেক বড় হয়েছে। একজন প্রতিষ্ঠিত ফ্যাশন ডিজাইনার ও, এমনকি ওর বিয়েও হয়ে গেছে। অভীক্ষা মা, এসো দেখো তোমার বাবা ইনি..”
বলেই অভীক্ষার দিকে তাকায় সুনীতি। অভীক্ষাও স্টেজে উঠে পড়ে তার বাবার দিকে তাকিয়ে আবেগঘন স্বরে বলে,”একজন আমার তোমার প্রতি একটা টান অনুভব হচ্ছিল তখন, বাবা? তুমি..তুমি আমার জন্মদাতা পিতা অথচ প্রথম দেখায় আমি তোমায় চিনতেই পারলাম না। জানো, আমার জীবনে তোমার অনুপস্থিতি কতটা জোরালো ছিল? আমি জীবনে প্রত্যেকটা মুহুর্তে বাবার অভাব বোধ করতাম। আজ এতগুলো বছর পর যে তোমায় একদম সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে ফিরে পাবো তা কখনো কল্পনাতেও আনিনি, আমি।”
অভিক সুনীতি ও অভীক্ষার মুখের পানে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে৷ সুনীতি অভিককে বলে,”কিগো! কিছু বলছ না কেন মেজর সাহেব?”
অভিক অবাক স্বরে বলে,”কে আপনারা? আর এসব কি বলছেন? কে অভিক? আপনা তো আমি ঠিক চিনতে পারছি না।”
অভিকের কথায় সুনীতি ও অভীক্ষা যেন বড় একটা ধাক্কা খায়। বিশেষ করে সুনীতির মনে এতদিন পর জ্বলে ওঠা আশার আলোটা যেন নিভে যেতে বসে। সে দুই ধাপ পিছিয়ে বলে,”কি বলছ টা কি তুমি? আমায় তুমি চিনতে পারছনা অভিক? আমি সুনীতি, তোমার স্ত্রী।”
অভিকের মাথায় হঠাৎ করে তীব্র যন্ত্রণা হতে থাকে। সে নিজেকে মাথা চেপে ধরে। কিছু অস্পষ্ট স্মৃতি ভেসে ওঠে তার মাথায়। সে চিৎকার করে বলতে থাকে,”না,না। আমি তোমাদের কাউকে চিনি না। চলে যাও আমার সামনে থেকে। চলে যাও।”
বলতে বলতেই হঠাৎ সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায়। কালিয়াসহ রূপনগর গ্রামের আরো কিছু সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসে মঞ্চের মধ্যে। এদিকে অভিকের মুখে এহেন কথা শুনে সুনীতি পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। অভিকের এহেন অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার প্রবণতাও তাকে অস্থির করে তোলে। এমতাবস্থায় অভীক্ষা সুনীতির কাধে ভরসার হাত দিয়ে বলে,”তুমি চিন্তা করো না, মা। এতদিন পর যখন ভাগ্য আমাদের আবার বাবার সাথে দেখা করিয়ে দিয়েছে তখন আমরা কিছুতেই আর হার মানবো না। কোন কারণে হয়তো বাবা আমাদের চিনতে পারছে না। কিন্তু আমার বিশ্বাস, আমরা আবারো বাবাকে ফিরে পাবো।”
নিজের মেয়ের কথা সুনীতি আবারো তার হারানো বিশ্বাস ফিরে পায়।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সুনীতি এবং অভীক্ষা এখন বসে আছে কালিয়ার মুখোমুখি। অভিকের জ্ঞান তখনো ফেরেনি। এই রূপনগর গ্রামে অভিকের সাথে কালিয়ার সম্পর্কই যেহেতু সবথেকে ঘনিষ্ঠ তাই অভীক্ষা ও সুনীতি তা সাথেই অভীকের বিষয়ে কথা বলতে আসে।
সুনীতি কালিয়াকে জিজ্ঞেস করে,”তোমার সাথে ওনার প্রথম পরিচয় কোথায় হয় এবং কিভাবে?”
কালিয়া বলে,”আমার বাবা রূপনগরের পাশের একটি জঙ্গলে বাস করতেন। আমরা ছিলাম আদিবাসী এবং সেই জঙ্গলে আদিবাসীদের দলপতি ছিলেন আমার বাবা। তো, একদিন আমাদের আদিবাসী দলের কিছু সদস্য শিকারের উদ্দ্যেশ্যে জঙ্গলে যায় সেখানে তারা হঠাৎ করেই একটি খাদের নিচে ওস্তাদজীকে পড়ে থাকতে দেখতে পান। ওনার পরনে ছিল আর্মির পোশাক। তারা দ্রুতই ওনাকে নিয়ে আমার বাবার কাছে নিয়ে আসেন। বাবা দলের সবাইকে নির্দেশ দেয় ওনার প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে৷ ওনাকে দেখে মনে হচ্ছিল অনেক উঁচু খাদ থেকে পড়ে গেছে এবং তার শরীরে গুলির চিহ্নও ছিল। তাই প্রাথমিক চিকিৎসার পর ওনাকে জঙ্গল থেকে কিছুটা দূরে মফঃস্বল এলাকার একটা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ওনাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য শহরে পাঠানো হয়। অবশেষে চিকিৎসা শেষে উনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু সুস্থ হওয়ার পর যখন ওনার কাছে ওনার পরিচয়, পরিবারের ঠিকানাসহ যাবতীয় তথ্য জানতে চাওয়া হয় তখন উনি কিছুই বলতে পারেন না। যার ফলে সেই সময় ওনার কোন গতি করা সম্ভব হয়নি। তাই সেই সময় বাধ্য হয়ে আমরা ওনাকে আবারো আমাদের জঙ্গলে ফিরিয়ে আনি। তবে এই জঙ্গলের পরিবেশে যে ওনাকে রাখা ঠিক নয় এটা বুঝতে পেরে আবার বাবা ওনাকে নিকটবর্তী গ্রাম অর্থ্যাত এই রূপনগরে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। এখানেই একটি সরাইখানায় উনি থাকতে শুরু করেন। ওস্তাদজী যে কয়দিন আমাদের ওখানে ছিলেন সেই কয়দিনের মধ্যে ওনার সাথে আমার খুব সুন্দর একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। তাই আমি মাঝে মাঝেই ওনার সাথে দেখা করতে রূপনগরে আসতাম। তবে কিছু বছর পর হঠাৎ করে আমার বাবার মৃত্যুর পর আমাদের দলের মধ্যে কিছু বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আমি যেহেতু তখন অনেক ছোট ছিলাম তাই আমাকে আদিবাসী দলনেতা মানতে কেউ প্রস্তুত ছিল না। যে কারণে আমার চাচা এই সুযোগের ফায়দা তুলে নেতা বনে যান। আমার মা বুঝতে পারে নিজের স্বার্থের জন্য আমার চাচা আমার ক্ষতি করতে দুবার ভাববেন না। এই কারণে আমাকে নিয়ে চলে আসেন এই রূপনগরে। অতঃপর আমি ওস্তাদজীর সাথে আরো বেশি সময় কাটাতে থাকি। ওস্তাদজী তার পুরাতন জীবনের কোন কথাই মনে করতে পারতেন না। তবে ওনার মধ্যে যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ছিল তা আমায় মুগ্ধ করে। উনি সবসময় জ্ঞানের কথা বলতেন যা আমি মনযোগ দিয়ে শুনতাম। একসময় উনি গ্রামের মানুষদের মঙ্গলের জন্য চিন্তা করতে শুরু করেন। আর সেই উদ্দ্যেশ্যেই তার উদ্দ্যেগে বদলে যায় এই রূপনগর গ্রাম।”
কালিয়ার সব কথা মনযোগ দিয়ে শোনে সুনীতি ও অভীক্ষা। সব শুনে অভীক্ষা বলে,”তার মানে খাদ থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পাওয়ার জন্য বাবা তার পুরাতন জীবনের সব স্মৃতি ভুলে গিয়েছে। আর এজন্যই উনি মাকে চিনতে পারছেন না।”
কালিয়া বলে,”হ্যাঁ। কিন্তু জানেন, ওস্তাদজী কিছুদিন থেকে আমায় বলছিল ওনার মনে হচ্ছে যে, ওনার কোন আপনজনের সাথে উনি আবার মিলিত হতে যাচ্ছেন। আমি তখন ওনার কথাকে ওতোটা গুরুত্ব দেইনি। ভেবেছিলাম উনি হয়তো ভুল ভাবছেন। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, উনি ভুল কিছু বলছিলেন না।”
সুনীতির চোখ জলে ছলছল করছিল। তবে সে এত সহজে ভেঙে না পড়ার পণ করে। সুনীতি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে বলে,”আমি জীবনে অনেক লড়াই লড়েছি। অভিকও আমায় বলত, জীবনযুদ্ধে কখনো হার মানতে নেই। অভিকের মতো একজন সাহসী, অকুতোভয় সৈনিকের স্ত্রী হওয়ার দরুণ তাই আমিও হার মানব না। যেকোনমূল্যে আমার স্বামীর হারানো স্মৃতি আমি ফিরিয়ে আনবো আর এটা আমার চ্যালেঞ্জ।”
এরইমধ্যে গ্রামের একজন তরুণ এগিয়ে এসে বলে,”ওস্তাদজীর জ্ঞান ফিরেছে।”
এই খবর পেয়ে কালিয়া, সুনীতি ও অভীক্ষা সবাই দ্রুতবেগে ছুটে চলে যায় অভিকের কাছে। অভিক কালিয়াকে দেখেই উদ্বিগ্ন স্বরে বলেন,”ওরা কারা কালিয়া? ওরা তখন ওসব কি বলছিল?”
কালিয়া বলে,”ওরাই আপনার আসল পরিবার ওস্তাদজী। আপনি কয়েকদিন থেকে আমায় বলছিলেন না, আপন কারো আসার ইঙ্গিত পাচ্ছেন, আপনার ধারণাই মিলল। ইনি হলেন আপনার স্ত্রী, আর উনি আপনার মেয়ে।”
অভিক সুনীতি ও অভীক্ষার দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে,”আমার পরিবার!”
To be continue…….
#মন_রাঙানোর_পালা_2
#Part_31
#ইয়াসমিন_খন্দকার
সুনীতি ও অভিককে আলাদা করে কথা বলার সুযোগ করে দেয়ার জন্য সবাই মিলে ঘর থেকে বের হয়। অভিক সুনীতির সাথে এভাবে একা অবস্থায় কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে, যেহেতু তার আগের কোন স্মৃতি মনে ছিল না। সুনীতি অভিকের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তোমার কি সত্যি কিছু মনে পড়ছে না অভিক? আমাকে তুমি চিনতে পারছ না?”
অভিক স্তিমিত স্বরে বলে,”না। যদিও আপনি দাবি করছেন, আপনি আমার স্ত্রী হন কিন্তু আমার এই সম্পর্কিত কোন স্মৃতিই মনে নেই। আমি…আমি বড্ড অসহায়। আমার শুধু এটাই মনে আছে যে আজ থেকে ২০ বছর আগে আমার যখন জ্ঞান ফেরে তখন আমি আর অতীতের কোন ঘটনা মনে করতে পারিনি। আর এখনো অব্দি আমার অতীতের কোন স্মৃতিই আমি মনে করতে পারিনি।”
সুনীতি কাদো কাদো সুরে বলে,”আমি বুঝতে পারছি তোমার অবস্থাটা। কিন্তু তোমায় আমাকে ভরসা করতে হবে। আমার হাত ধরে তোমায় ফিরতে হবে নিজের দেশে, নিজের বাড়িতে। আমার বিশ্বাস, আবারো নিজের অতীতের পরিচিত স্থানে ফিরে গেলে ধীরে ধীরে তোমার সব স্মৃতি আবার ফেরত আসবে। তোমার বৃদ্ধ মা অপেক্ষা করছে যে তোমার জন্য। তার শেষ জীবনে যদি তোমার সান্নিধ্য পায় তাহলে শান্তিতে জীবনের শেষ সময় অতিবাহিত করতে পারবে। এখন সিদ্ধান্ত তোমার হাতে। তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করবে?”
অভিক কিছুটা ভেবে বলে,”আমার সময় লাগবে। আমাকে কিছুটা ভাবতে হবে।”
“বেশ, তুমি সময় নেও। আশা করব, তুমি সঠিক সিদ্ধান্তটাই নেবে।”
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
রূপনগর গ্রামে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। রূপনগরের বাচ্চা থেকে বুড়ো সবার চোখে জল। কারণ এই রূপনগর গ্রামের দেবদূত স্বরূপ মানুষটা আজ চলে যাবে এই গ্রাম ছেড়ে। কালিয়ার চোখের জল আর বাঁধা মানতে রাজি নয়। ছোটবেলা থেকে সে এই লোকটার সান্নিধ্যেই বড় হয়েছে। অথচ আজ এই লোকটা অনেক দূরে চলে যাচ্ছে।
মূলত অভিক সুনীতি ও অভীক্ষার সাথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও তার অতীতের কোন স্মৃতি মনে নেই কিন্তু সুনীতি ও অভীক্ষার কথায় তার মনে ভরসা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া সে তাদের প্রতি যে আত্মিক টান অনুভব করেছে তাও ফেলে দেওয়ার নয়৷ এজন্য অভিক বিশ্বাস করেছে তাদের কথায়। রূপনগর গ্রাম থেকে অভিকের বিদায়ের সময় গ্রামের নানা মানুষ এসে চোখের জল ফেলে। তারা অভিক তথা তাদের ওস্তাদজী শেষ বিদায় জানানোর জন্য আসে। অভিক আবেগপ্রবণ হয়ে কালিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে,”তোর সাথে হয়তো আমার কোন রক্তের সম্পর্ক নেই কিন্তু তোকে সবসময় আমি নিজের ছেলের মতোই দেখেছি। ভালো থাকিস রে, গ্রামটাকে দেখে রাখিস।”
কালিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলে,”আমাকে ভুলে যাইয়েন না ওস্তাদজী।”
অভিক বলে,”ধুর, পাগল। তোদের কি আমি ভুলতে পারি? মাঝে মাঝে সময় পেলে ঠিকই রূপনগরে ঘুরতে আসব।”
সুনীতি গ্রামের সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলে,”আপনারা যে এতগুলো দিন ধরে আমার স্বামীর খেয়াল রেখেছেন তার জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব। আর কালিয়া, তোমার ঋণ কোনভাবেই ভোলার না। আমরা সময় পেলে এখানে আসব, তুমিও আমাদের দেশে ঘুরতে যেও। ঠিকানা তো দেওয়াই আছে।”
কালিয়া বলে,”আপনারা ভালো থাকবেন আর আমার ওস্তাদজির খেয়াল রাখবেব। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করব যেন, ওস্তাদজী দ্রুত ওনার আগের সব হারানো স্মৃতি ফিরে পান এবং আপনারা আবার আগের মতো সুখী জীবন যাপন করতে পারেন।”
অভীক্ষাও সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে। অতঃপর তারা সপরিবারে রূপনগর থেকে বিদায় নিয়ে আসামের গুয়াহাটির বিমানবন্দরে আসে। অতঃপর সেখান থেকে বাংলাদেশের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেয়।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
বাংলাদেশে পৌঁছে সুনীতি প্রথমে অভিককে নিয়ে একটি সেলুনে যায়। যাতে করে তার বড় বড় দাড়িগুলো ছেটে ফেলা যায়। এতে করে অভিকের আগের হারানো জৌলুস অনেকটাই ফিরে আসে। সুনীতি তো মেকওভারের পর অভিককে দেখে একদম অবাক হয়ে যায়। এ যেন তার সেই আগের অভিক। যদিও চেহারায় বয়সের ছাপ বোঝা যাচ্ছে কিন্তু ওতোটাও না। সুনীতি এভাবে অভিকের দিকে তাকিয়ে থাকায় অভিক কিছুটা লজ্জা পায়। সুনীতি অভিককে বলে,”তোমাকে একদম আগের মতোই লাগছে।”
অভিক সামান্য হাসে।
অভীক্ষা বাড়িতে ফিরে তার দাদিকে বলছিল,”দাদি, দ্রুত তৈরি হয়ে নাও। তোমার জন্য অনেক সুন্দর একটা সারপ্রাইজ আছে। যা তোমায় অবাক করে দেবে।”
রাহেলা খাতুন অবাক সুরে বলেন,”এসব কি বলছিস তুই সই?”
অভীক্ষা বলে,”একটু পরই তুমি সেটা বুঝবা। দেখিও, খুশিতে আবার অজ্ঞান হয়ে যেও না।”
রাহেলা খাতুন নিজের নাতনীর কথা কিছু বুঝে উঠতে পারেন না। এরইমধ্যে বাড়ির কলিং বেল বেজে ওঠায় অভীক্ষা গিয়ে দরজা খুলে দেয়৷ দরজা খুলে সারজিসকে দেখতে পেয়েই থমকে যায়। সারজিস অভীক্ষার পানেই তাকিয়ে ছিল। সারজিসের পেছন পেছন অহনা, সাগর, আমায়রা, সাজিদ সবাই চলে আসে। অভীক্ষাই তাদের ডেকে পাঠিয়েছে। তাদের সবাইকে একসাথে দেখে অভীক্ষা বলে,”আপনারা সবাই ভেতরে আসুন।”
অহনা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,”সবকিছু ঠিক আছে তো অভীক্ষা? তুমি হঠাৎ আমাদের সবাইকে এভাবে ডেকে পাঠালে কেন? তুমি তো সুনীতিকে নিয়ে আসামে গেছিলে। ফিরলে কবে? সবকিছু ঠিক আছে তো? সুনীতির কিছু হয় নি তো?”
অভীক্ষা হাসিমুখে বলে,”কারো কিছু হয় নি, আন্টি। তোমাদের সবার সাথে খুশি শেয়ার করার জন্য আমি এখানে ডেকেছি। আমাদের পরিবারের পুর্নঃমিলনের সাক্ষী হও তোমরা সবাই।”
অহনা অভীক্ষার কথার কিছু বুঝতে পারে না। সারজিস বলে,”কি হয়েছে অভীক্ষা? একটু খোলাসা করে বলো।”
আমায়রাও বলে,”হুম, আমার কেমন জানি চিন্তা হচ্ছে।”
এরইমধ্যে সুনীতি সেখানে এসে বলে,”আমি সবটা বলছি।”
অহনা সুনীতিকে সহি সালামত দেখে বলে,”যাক এটা দেখে নিশ্চিত হলাম যে তুই ঠিক আছিস।”
সুনীতি হেসে বলে,”ঠিক তো আমাকে থাকতেই হতো। ২০ বছর…সুদীর্ঘ ২০ বছরের অপেক্ষার পর আজ আমার জীবনে সেই কাঙ্খিত মুহুর্ত এসেছে যার জন্য আমি এতগুলো দিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম?”
রাহেলা খাতুন অস্থির হয়ে বলেন,”মানে?”
সুনীতি পিছনে তাকিয়ে বলে,”কই গো তুমি? ভেতরে এসো।”
ধীরে ধীরে চৌকাঠ পেরিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে অভিক। অভিককে এত গুলো বছর পর একদম সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে দেখে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সবাই। সবার চোখে যেন এক অদ্ভুত বিস্ময়। রাহেলা খাতুনের চোখেও জল জমছে। তিনি যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছেন না। এতদিন ধরে তো তিনি আশাও করেন নি এই জীবনে আবারো নিজের ছেলেকে সুস্থ অবস্থায় ফেরত পাবেন। কিন্তু ভাগ্য তাকে যে শেষ বয়সে এসে এই সুখ দেবেন তা অবিশ্বাস্য ছিল। রাহেলা খাতুন চোখের জল মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে বললেন,”তুমি ফিরে এসেছ অভিক? আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? আমার ছেলেটা বেঁচে আছে..এটা কি সত্যি..হায় আল্লাহ!”
সুনীতিও আবেগঘন স্বরে বলে,”হ্যাঁ, মা। এটাই সত্যি। আপনার ছেলে বেচে আছে এবং সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় আপনার সামনে দাঁড়িয়ে।”
রাহেলা খাতুন আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন,”এতদিন তুমি কোথায় ছিলে অভিক? এই বুড়ো মা টার কথা একবারও মনে পড়েনি? তোমার বাবা তো তোমার ফেরার আশায় থাকতে থাকতে চোখ বুঝলেন। আর আমি..আমাকে বোধহয় আল্লাহ এই সুখের দিনটা দেখানোর জন্য বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। আমার আর আল্লাহর কাছে কোন অভিযোগ নেই, নিজেকে পরিপূর্ণ লাগছে।”
অহনা সুনীতিকে বলে,”এটা কি সত্যি সুনীতি? অভিক ভাই আবার ফিরে এসেছেন?”
“হ্যাঁ, এটাই সত্যি।”
সারজিস অভীক্ষাকে বলে,”ইনি তোমার বাবা? যিনি এত বছর নিখোঁজ ছিলেন?”
অভীক্ষা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝায়। সাগর এগিয়ে এসে অভিককে স্যালুট জানিয়ে বলে,”আপনি সবসময় আমার আদর্শ ছিলেন, আজো আছেন। আপনাকে এতদিন পর ফিরতে দেখে ভীষণ ভালো লাগল। আমি ভাবতেও পারিনি আপনি আবার ফিরবেন। এতদিন কোথায় ছিলেন আপনি?”
হঠাৎ এতগুলো অপরিচিত মুখকে একসাথে দেখে অভিকের মাথায় হঠাৎ ব্যাথা অনুভূত হয়। যন্ত্রণায় মাথা চেপে ধরে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। সুনীতি চিৎকার করে বলে ওঠে,”অভিক!”
To be continue…….