মন রাঙানোর পালা ২ পর্ব-৩২

0
16

#মন_রাঙানোর_পালা_2
#Part_32
#ইয়াসমিন_খন্দকার

অভিককে নিয়ে তড়িঘড়ি করে একটা হাসপাতালে চলে এসেছে সুনীতি সহ তার পরিবারের বাকি সবাই। অভিককে নিয়ে আর কোন প্রকার ঝুঁকি নিতে রাজি নয় তারা। ডাক্তার কেবিনে অভিককে পর্যবেক্ষণ করছে। এদিকে বাইরে দাঁড়িয়ে দুশ্চিন্তায় পদচারণ করে চলেছে সুনীতি। অভীক্ষা নিজের মায়ের এমন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থা দেখে এগিয়ে এসে তার কাধে হাত রেখে বলে,”তুমি কোন চিন্তা করো না, মা। দেখবে বাবার কিছু হবে না। সবকিছু একদম ঠিক হয়ে যাবে।”

সুনীতি কাতর স্বরে বলে,”কি করে চিন্তা না করে থাকবো বলো তো মামনী? আজ কতগুলো বছর পর লোকটাকে ফিরে পেলাম। আর এখনই ওনার এই অবস্থা হতে হলো। ঘরপোড়া গরু তো তাই সিঁদূরে মেঘ দেখলেই ভয় হয়।”

অহনা এগিয়ে এসে বলে,”তুই এত দুশ্চিন্তা করিস না, সুনীতি। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। দেখছিস না, রাহেলা আন্টি কেমন আল্লাহর নাম জপ করছেন আর নিশ্চিন্তে আছেন। তুইও তাই কর।”

রাহেলা খাতুনও সুনীতিকে ভরসা দিয়ে বলে,”তুমি এত চিন্তা করো না,বৌমা। আল্লাহ যখন এতগুলো দিনপর আমার ছেলেটাকে আবার ফিরিয়ে দিয়েছে তখন দেখবে ওর আর কোন বিপদ হবে না। আল্লাহ এতটা নিষ্ঠুর হবেন না। আমার ছেলে আবার সুস্থ হয়ে যাবে এ আমার স্থির বিশ্বাস।”

এরইমধ্যে একজন ডাক্তার কেবিন থেকে বের হতেই সবাই মিলে তাকে ঘিরে ধরে। সুনীতি প্রশ্ন করে,”আমার স্বামীর এখন কেমন অবস্থা ডাক্তার? ও ঠিক হয়ে যাবে তো?”

ডাক্তার একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেন,”চিন্তার কোন কারণ নেই। উনি একদম ঠিক হয়ে যাবেন। আমি ওনার কিছু রিপোর্ট চেইক করে দেখেছি, বহুবছর আগে মাথায় জোরালো আঘাত পাওয়ার কারণে উনি নিজের স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছেন। হঠাৎ করে পুরাতন কথা মনে করার চেষ্টা করায় ওনার মাথায় চাপ পড়েছে। তাই স্ট্রেস নিতে না পেরে উনি জ্ঞান হারিয়েছেন। এটা খুব সিরিয়াস কিছু না। কিন্তু এখন থেকে আপনাদের একটু সাবধান থাকতে হবে। কারণ বারবার এমনটা হতে থাকলে সেটা ভালো কিছু ফল বয়ে আনবে না। ওনার উপর যেন এরকম স্ট্রেস আর না পড়ে। আপনারা ওনার সাথে বেশি করে সময় কাটান। ওনার অতীত সম্পর্কে টুকটাক কথা বলুন এভাবে হয়তো উনি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হবেন। কিন্তু যদি জোরপূর্বক কিছু মনে করানোর চেষ্টা করেন তাহলে সেটা ওনার জন্য ভালো হবে না।”

সুনীতি বলে,”আপনি যেমনটা বলছেন তেমনটাই হবে।”

“গুড। ওনার যেহেতু সেরকম কোন সিরিয়াস অবস্থা হয়নি তাই আজ বিকেলের মধ্যেই আপনারা ওনাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরতে পারেন। শুধু খেয়াল রাখবেন, যেন উনি কোন স্ট্রেস না নেন।”

“আচ্ছা। ধন্যবাদ ডাক্তার।”

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সেদিন দুপুরেই অভিককে নিয়ে বাসায় ফিরে সুনীতি, অভীক্ষা ও রাহেলা খাতুন। সারজিস সহ তার পুরো পরিবার হাসপাতাল থেকেই বাড়ি ফিরে যায়। তবে সারজিস আসার সময় অভীক্ষাকে ইঙ্গিত দিয়েছে সে খুব শীঘ্রই আবার অভীক্ষার সাথে সবকিছু সমঝোতার পথে হাটবে। অভীক্ষা বিষয়টা নিয়ে খুব একটা রেসপন্স দেখায় নি। তবে মনে মনে কিছুটা হলেও অন্যরকম অনুভূতি হয়েছে তার।

২ দিন পর,
অভিক নিজের ঘরে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। এমন সময় সুনীতি খাবার নিয়ে তার রুমে প্রবেশ করে। সুনীতিকে আসতে দেখে অভিক উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”আপনি..না মানে তুমি..”

সুনীতি হালকা হেসে বলে,”তোমার জন্য খাবার নিয়ে এলাম।”

বলেই সে সামনে এগিয়ে এসে বলে,”দেখো, তোমার জন্য আমি চিকেন কাটলেট বানিয়েছি খেয়ে দেখ কেমন হয়েছে।”

অভিক অবাক স্বরে বলে,”আমার প্রিয়?”

“হ্যাঁ। তোমার তো অনেক পছন্দ ছিল চিকেন কাটলেট। বিশেষ করে আমার বানানো চিকেন কাটলেট।”

অভিক সামান্য হেসে বলে,”ও।”

সুনীতি তার সামনে খাবারের প্লেটটা রাখতেই অভিক খেতে শুরু করে। আর সুনীতি অপলক চোখে অভিকের খাওয়া দেখতে থাকে। আগে হলে হয়তো অভিক বিব্রত বোধ করত কিন্তু আজকাল কেন জানি এসব তার ভালোই লাগে। যদিও অভিকের আগের কোন স্মৃতি এখনো ফিরে আসেনি কিন্তু সুনীতি যখন তার পাশে থাকে তখন তার মনে ভীষণ সুন্দর এক অনুভূতি হয়। তার মন চায় সুনীতি যেন সবসময় এভাবেই তার পাশে থাকে। একেই বোধহয় বলে হৃদয়ের টান।

সুনীতি অভিকের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আমি একটা সুন্দর পাঞ্জাবি বের করে দিচ্ছি। আজ বিকেলে তুমি সেটা পড়ে তৈরি হয়ে থেক।”

“কেন? কোন বিশেষ কিছু?”

“তোমার মেয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে লোক আসবে৷ তাদের সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে৷ এতদিন তো সব আমি সামলেছি। এখন যেহেতু ওর বাবা এসে গেছে তাই তোমাকেই দেখতে হবে ব্যাপারটা।”

অভিক অবাক স্বরে বলে,”আমার মেয়ে মানে তো অভীক্ষা..ওর বিয়ে হয়েছে?”

“হুম। সেদিন দেখলে না একটা সুদর্শন ছেলে এসেছিল অহনাদের সাথে। ও হলো সারজিস তোমার মেয়ের জামাই।”

অভিক ভীষণ অবাক হয়ে বলে,”ওহ! আমি তো জানতামই না।”

“জানো, ওদের মধ্যে না কিছু ভুল বোঝাবুঝি চলছে। ওদের বিয়েটাও স্বাভাবিক ভাবে হয়নি৷ একদিন সময় করে আমি তোমায় সব বলব। কিন্তু এখন আমি চাইনা যে, ওদের সম্পর্কটা ভেঙে যাক। কারণ সারজিস সত্যিই অভীক্ষাকে ভালোবাসে আর আমি যতদূর বুঝেছি অভীক্ষার মনেও সারজিসের প্রতি অনুভূতি আছে। যদিও আমি সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ মেয়ের উপর ছেড়ে দিয়েছি যে ও কি করতে চায়। তবুও মা-বাবা হিসেবে আমরা তো পরামর্শ দিতেই পারি।”

“সেটা তুমি ঠিকই বলেছ। যদিও আমি বিস্তারিত কিছু জানি না। তবে একটা সম্পর্ক এভাবে ভেঙে দেওয়া ঠিক নয়, বিশেষ করে যখন দুজন দুজনকে ভালোবাসে।”

~~~~~~~~~~~~~~~
বিকেলে সাজিদ, সারজিস এবং অহনা এসে উপস্থিত হয় চৌধুরী বাড়িতে। তাদের মুখোমুখি বসে আছে অভিক, সুনীতি এবং অভীক্ষা। সারজিস এসে থেকে অভীক্ষার দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু অভীক্ষা একটিবারও তার দিকে তাকায় নি৷ সাজিদ সবার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তো যেই বিষয়ে এসেছি সেটা নিয়ে কথা হয়ে যাক।”

অভিক বলে,”নিশ্চয়ই।”

“আপনি হয়তো জেনে গেছেন এতক্ষণে যে আপনার মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে কিছু ভুল বোঝাবুঝি চলছে এবং তা মেটানোর জন্যই আমরা বড়রা এখানে একত্রিত হয়েছি।”

অভিক বলে,”সুনীতি আমাকে সবটাই বলেছে। ওদের বিয়ে হওয়া থেকে শুরু করে তার পরবর্তী সব ঘটনা আমি জেনেছি। সব শুনে যা মনে হয়েছে তাতে আপনার ছেলের তরফ থেকে কিছু ত্রুটি আছে৷ তবে তার চোখে অনুতাপের ছাপও স্পষ্ট। আমি মনে করি, নিজের ভুলটা বুঝতে পারা একটা বড় ব্যাপার। কিন্তু এখানে মূল কথা হচ্ছে, অভীক্ষা একজন স্বাধীনচেতা মেয়ে, ও যথেষ্ট বড় হয়েছে এবং নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে। তাই এই সম্পর্কর ভবিষ্যত নিয়ে ও কি ভাবছে সেটা ওই ঠিক করুক। ও যদি অতীত ভুলে সারজিসকে দ্বিতীয় সুযোগ দিতে চায় তাহলে সেখানে আমার বা সুনীতির কোন আপত্তি নেই৷ কিন্তু ও যদি ঠিক করে এই সম্পর্ক আর টিকিয়ে রাখবে না সেক্ষেত্রেও আমাদের কিছু করার নেই। আমরা ওর যেকোন সিদ্ধান্ত মেনে নেব।”

অহনা অভীক্ষার উদ্দ্যেশ্যে জানতে চায়,”তুমিই বলো অভীক্ষা। তোমার সিদ্ধান্ত কি?”

সারজিস অভীক্ষার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকায়। উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে বলে,”সবার সামনে আমি তোমার কাছে একটা শেষ সুযোগ ভিক্ষা চাইছি। দয়া করে আমায় ফিরিয়ে দিও না।”

সুনীতিও মনে মনে চাইছিল অভীক্ষার মন গলুক। সবার দৃষ্টি অভীক্ষার দিকে যে অভীক্ষা কি সিদ্ধান্ত নেয়। এদিকে অভীক্ষা নিজের সিদ্ধান্ত দৃঢভাবে সবার সামনে তুলে ধরে বলে,
“আমি চাই..”

To be continue……