মন রাঙানোর পালা ২ পর্ব-৩৪ এবং শেষ পর্ব

0
19

#মন_রাঙানোর_পালা_2
#Part_34(Last)
#ইয়াসমিন_খন্দকার

সুনীতি ও অভিককে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে৷ অভীক্ষা সমানে কান্না করে চলেছে। রাহেলা খাতুন পরিস্থিতির জটিলতা বুঝতে পেরে এই বৃদ্ধ বয়সেও নিজেকে যথাসাধ্য শক্ত রাখার চেষ্টা করে নাতনির পাশে ভরসা হয়ে উঠছেন। সুনীতিকে আশ্বাস দিয়ে বলেন,
“ভরসা রাখ, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।”

যদিও তার নিজের চোখেও ছলছল করে জল বের হচ্ছে। এরইমধ্যে সারজিস, অহনা, সাজিদ, সাগর ও আমায়রা ছুটে আসে। সারজিস এসেই অভীক্ষার কাছে এসে বলে,”এসব আমি কি শুনলাম অভীক্ষা? আঙ্কেল, আন্টির অবস্থা এখন কেমন?”

অভীক্ষা বলে,”আমি কিচ্ছু জানি না, ভেতরে ওনাদের চিকিৎসা চলছে।”

বলেই কাঁদতে থাকে। অহনা অভীক্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

সাজিদ চরম ক্রোধ নিয়ে বলে,”ইভা এমন একটা কাজ কিভাবে করলো?! ও যে খারাপ সেটা আমি জানতাম৷ কিন্তু এতটা নিচে নামবে সেটা ভাবতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত কিনা খু/নের চেষ্টা ছি!”

সাগর বলে,”উনি তো শুনলাম গুলি করে পালাতে গিয়ে সিকিউরিটি গার্ডের হাতে ধরা পড়েছেন। এখন তো ওনাকে পুলিশে নেয়া হয়েছে। সেখানেই সব সত্য প্রকাশিত পাবে। আমার যতদূর মনে হয় এসবের পেছনে আরো কারো হাত আছে। ভাবির পক্ষে একা এসব কিছু করা সম্ভব নয়।”

সারজিস রাহেলা খাতুন ও অভীক্ষার সামনে নতজানু হয়ে বলে,”আপনাদেরকে নিজের মুখ দেখানোরও অবস্থা নেই। আজ আমার মায়ের জন্য আপনাদের পরিবারে এত দূর্ভোগ নেমে এসেছে। আমার তো এটা ভাবতেও লজ্জা করছে যে ঐ মহিলা আমার মা হন। পারলে আমায় ক্ষমা করবেন।”

রাহেলা খাতুন বলে ওঠেন,”এসব তুমি কি বলছ সারজিস? তুমি কেন ক্ষমা চাইছে। এখানে যা ঘটেছে তাতে তোমার তো কোন দোষ নেই।”

অভীক্ষাও বলে,”যে আমার মা-বাবার ক্ষতির চেষ্টা করেছে সে উপযুক্ত শাস্তি পাবে। আপনি তো এসবে জড়িত নন তাই আপনাকে ক্ষমা চাইতে হবে না।”

তাদের কথায় সারজিস স্বস্তি পায়। এরইমধ্যে একজন ডাক্তার ছুটে এসে বলেন,”মিস্টার অভিকের জ্ঞান ফিরেছে। উনি ওনার পরিবারের লোকদের সাথে দেখা করার জন্য ছটফট করছে। ওনাকে কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না, তাই দয়া করে আপনাদের মধ্যে থেকে ওনার মা, মেয়ে আমার সাথে চলুন।”

অভীক্ষা ও রাহেলা খাতুন অভিকের কেবিনের দিকে যেতে থাকে। তারা কেবিনে প্রবেশ করা মাত্রই অভিক রাহেলা খাতুনের উদ্দ্যেশ্যে আবেগঘন স্বরে বলে ওঠে,”মা!”

এতদিন পর নিজের ছেলের মুখে মা ডাক শুনে রাহেলা খাতুনের মনে অন্যরকম অনুভূতি খেলে যায়। তিনি ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরেন নিজের ছেলেকে৷ অভিকের মাথায় ব্যান্ডেজ করা। অভিক বলে,”আমার অতীতের সব কথা মনে পড়ে গেছে মা। সব কথা….আচ্ছা..সুনীতি এখন কেমন আছে? ওর তো গুলি লেগেছে ও ঠিক হয়ে যাবে তো?”

রাহেলা খাতুনের মনে একসাথে খুশি ও দুঃখের অনুভূতি হয়। তিনি তো নিজেও সুনীতিকে নিয়ে চিন্তিত তবুও তিনি নিজের ছেলেকে আশ্বাস দিয়ে বলেন,”সুনীতি ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করিস না।”

অভীক্ষা নিজের বাবার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তোমার সত্যি সব মনে পড়ে গেছে রে?”

“হ্যাঁ, আমার প্রিন্সেস। আমার সব মনে পড়ে গেছে। তোমাকে কত ছোটবেলায় দেখেছিলাম আমি..সেসসময় তুমি আমার কোলে চড়ে সবসময় ঘুরে বেড়াতে আর আলতো স্বরে বাবা বলে ডাকতে..কি এক মধুর অনুভূতি ছিল৷ কিন্তু তারপর এক কালো ছায়া পড়ে আমাদের জীবনে। যার জন্য আমার জীবনের ২০ টি বছর নষ্ট হয়ে গেছে। আর এসবের পেছনে যে আছে তাকে শাস্তি পেতেই হবে।”

অভীক্ষা জানতে চায়,”কে আছে এসবের পেছনে?”

“আবির চৌধুরী।”

অভীক্ষার কাছে নামটা অনেক চেনা চেনা লাগতে থাকে। হঠাৎ করে তার মনে পড়ে যায় এটা তো মুকিতের বাবার নাম! তাহলে তিনিই এসবের পেছনে আছেন! কিন্তু কেন?!

এরইমধ্যে সাগর সেই কেবিনে প্রবেশ করে অভিককে স্যালুট দিয়ে বলে,”ইভা ভাবির স্বীকারোক্তিতে ইতিমধ্যেই আবির চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যদিও উনি দেশ থেকে পালানোর পায়তারা করছিলেন কিন্তু তার সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। এখন তিনি কারাগারেই আছেন।”

অভিক বলে,”ঐ আবির চৌধুরী অনেক অন্যায় করেছে। ও অনেক কঠিন শাস্তি ডিজার্ভ করে। আমি ওর সব অন্যায় সবার সামনে তুলে ধরবো।”

সাগর বলে,”আমি ইতিমধ্যেই ওর অনেক অন্যায় সম্পর্কে তথ্য পেয়েছি। ড্রাগ স্মাগলিং এর পাশাপাশি ও ইদানীং কালে আমাদের ফ্যামিলিতেও অনেক অশান্তি সৃষ্টি করেছে। এমনকি আমায়রা-সারজিসের বিয়ের দিন যা হয়েছিল তার পেছনেও আবিরের হাত ছিল। নিজের মেয়ের বিয়েতে অতীতের সবকিছু ভুলে আমি আমার পুরাতন বন্ধুকে দাওয়াত দিয়েছিলাম। আর ও তার এমন মূল্য দিলো। ষড়যন্ত্র করে আমাদের পরিবারে ভাঙন ধরালো। আর আমরা সবাই শুধু শুধু সারজিস আর অভীক্ষাকে ভুল বুঝলাম।”

রাহেলা খাতুন বলেন,
“অবশেষে যে সব সত্য সামনে এসেছে এটাই অনেক। এখন আমার আল্লাহর কাছে শুধু একটাই প্রার্থনা, সুনীতি একদম সুস্থ হয়ে যাক। তাহলেই সব আধার কেটে যাবে আমাদের জীবন থেকে।”

~~~~~~~~~~
১ মাস পর,
পুরো বাড়িতে আজ উৎসবমুখর আয়োজন। আজকের দিনটা অনেক স্পেশাল। কারণ আজ “অভীক্ষা ও সারজিসের শুভ পরিণয়” সম্পন্ন হবে পরিবারের সবার উপস্থিতিতে ধুমধাম করে। সুনীতির বেশি কোন ক্ষতি হয়নি। সে এখন অনেকটাই সুস্থ। নিজের মেয়ে বিয়ে নিয়ে তার মধ্যে অনেক উৎসাহ উদ্দীপনা। এরইমধ্যে আজকের দিনটা আরো বেশি স্পেশাল কারণ আজ ইভা ও আবিরের শাস্তিও কোর্ট থেকে ঘোষণা করা হয়েছে যেখানে ইভার ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং আবিরের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও ইভার জন্য সারজিস ও সাজিদের একটু হলেও খারাপ খারাপ লাগছে শতহোক মা আর প্রাক্তন স্ত্রী তো তবে সে যা অন্যায় করেছে তাতে এই শাস্তিরই যোগ্য বলে মনে করে। তাছাড়া সাজিদ যেহেতু ইভাকে তালাক দিয়েই দিয়েছে তখন আর এই সম্পর্ক নিয়ে উচ্চবাক্যের প্রয়োজন নেই। ইভার আর কোন ছায়া তারা নিজেদের পরিবারে দেখতে চায় না।

এসবের মধ্যে অহনা খেয়াল করেছে তার মেয়ে আমায়রার মন একদম ভালো নেই। অহনা আমায়রাকে কয়েকবার জিজ্ঞেসও করেছে তার মন খারাপের কারণ কি কিন্তু অহনা উত্তর দেয়নি। তাই আমায়রাও আর বেশি ঘাটায় নি৷ এদিকে আমায়রা যখন থেকে জেনেছে তার জন্মদাতা পিতা আরাফাতের খু-***নি মুকিতের বাবা আবির চৌধুরী তখন থেকে সে মুকিতের সাথে যোগাযোগ অফ করে দিয়েছে। মুকিত বারকয়েক তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও সে রেসপন্স দেয়নি এমনকি মুকিতকে চূড়ান্ত অপমানও করেছে। এরপর মুকিতও কিছুদিন থেকে আর আমায়রার সাথে যোগাযোগ করেনি। আজ কেন জানি আমায়রার মুকিতের কথা খুব বেশিই মনে পড়ছে।

এরইমধ্যে আমায়রার ভাই সোহেল তার কাছে এসে বলে,”আপু..তোমার সাথে জরুরি কথা ছিল।”

“হুম, বল।”

“মুকিত ভাইয়া আজ দেশ ছেড়ে চিরতরে আমেরিকা চলে যাচ্ছে।”

খবরটা শুনে আমায়রার বুক কেপে ওঠে। তবুও সে বলে,”এই কথা আমায় কেন বলছিস? উনি যেখানে খুশি যাক তাতে আমার কি?”

“আপু..তুমি এমন কেন করছ? তোমার মতো আমিও প্রথমে ভেবেছিলাম যেহেতু ওনার বাবা তোমার জন্য ঘৃণ্য তাই তোমায় ওনার থেকে দূরে থাকা উচিত কিন্তু তুমি ওনার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করার পর উনি যেভাবে ডেসপারেটলি আমার মাধ্যমে তোমার প্রতি মুহুর্তের খোঁজ নিয়েছে, যেভাবে এত অপমানিত হবার পরেও তোমার কথা ভেবেছে তাতে বোঝা যায় উনি মানুষ হিসেবে কতটা ভালো। আচ্ছা, দোষ তো ওনার বাবা করেছেন? তাহলে ওনাকে কেন ভুগতে হবে? উনি তো কোন অন্যায় করেন নি।”

“তুই ছোট, তাই এত কিছু বুঝবি না।”

এমন সময় অভীক্ষা তাদের মাঝে উপস্থিত হয়ে বলে ওঠে,”সোহেল ছোট হতে পারে কিন্তু এখানে ছেলেমানুষী তুমি করছ! আমি তোমার ব্যাপারটা বুঝছি আমায়রা কিন্তু একটু ঠান্ডা মাথা চিন্তা করে দেখো তো..তুমি মুকিতের উপর যে কারণে রেগে আছ তার দায় কি মুকিতের উপর বর্তায়? তোমার চোখে মুকিতের অপরাধ তো এটাই যে সে আবির চৌধুরীর ছেলে..কিন্তু এটাতে কি মুকিতের কোন হাত আছে? তাছাড়া আমি মুকিত ওর বাবাকে চরম ঘৃণা করে। সেই ছোট থেকেই। কারণ মুকিতের বাবা তার মাকে ফেলে রেখে অন্য মহিলার সাথে বিয়ে সংসার করেছে।এমনকি আরো অনেক মহিলার সাথে অবৈধ সম্পর্কও রেখেছে। কিন্তু মুকিত ওর বাবার মতো নয়। ওকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। ও অনেক ভালো একটা ছেলে..যখন ও আমাকে ভালোবাসত তখন আমার প্রতি ওর সেই ভালোবাসা শতভাগ খাটি ছিল..ও আমায় জীবন দিয়ে ভালোবাসত কিন্তু ভাগ্যের ফেরে আমাদের এক হওয়া হয়নি। এখন কিন্তু তেমনিভাবে ও তোমাকেই একইভাবে ভালোবাসে। এবার অন্তত তুমি ভাগ্যকে ওর সাথে এত কঠোর হতে দিও না। নাহলে যে ছেলেটা শেষ হয়ে যাবে। এক্ষুনি যাও এয়ারপোর্টে আর আটকাও ওকে।”

অভীক্ষার কথাগুলো আমায়রার মাঝে দারুণ প্রভাব ফেলে। সে আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে দৌড় লাগায় এখন তার উদ্দ্যেশ্যে এয়ারপোর্টে যাওয়া।

গাড়িতে করে এয়ারপোর্টে পৌঁছে যায় আমায়রা। অতঃপর এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখতে পায় মুকিত বসে আছে। মুকিত আমায়রাকে দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে উঠে দাডিয়ে বলে,”আপনি!”

আমায়রা হাফাতে হাফাতে বলে,”দয়া করে আমায় ছেড়ে যাবেন না মুকিত। আমি জানি না কখন আর কিভাবে আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু এখন এই ভালোবাসার টানটা বুঝতে পারছি। আপনাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। আমার মন একবার ভেঙেছে দ্বিতীয় বার আর আমার মনকে ভাঙবেন না।”

মুকিত ছুটে এসে আমায়রাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আর বলে,”মোটেই দেব না। আমিও যে আপনাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই আমায়রা!”

~~~
সারজিস ও অভীক্ষা তাদের বিয়ের কোন আনুষ্ঠানিকতা শুরু করতে দিচ্ছে না। সবাই অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে। সাজিদ জানতে চায়,”কি সমস্যা হয়েছে?”

সারজিস বলে,”একটু পরই জানতে পারবে।”

এরইমধ্যে আমায়রা মুকিতের হাত ধরে বিয়ের আসরে উপস্থিত হয়। তাদের আসতে দেখে সবাই অবাক। সারজিস হেসে বলে,”এজন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম। আজ এই বিয়ের আসরে একটা নয়, দুটো বিয়ে হবে। আর এই হলো দ্বিতীয় বিয়ের বর-কনে।”

সবাই অবাক চোখে আমায়রা ও মুকিতকে দেখতে থাকে। আমায়রা সাগর ও অহনার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”মুকিত অনেক ভালো ছেলে। আমি যদি ওকে বিয়ে করি তাহলে তোমাদের কোন আপত্তি নেই তো?”

দুজনেই কিছুক্ষণ মুখ গম্ভীর করে থাকে। অতঃপর একসাথে হেসে উঠে বলে,”আমরা তো আগে থেকেই সব জানতাম। সোহেল আমাদের সব বলেছিল। আমাদের এই বিয়েতে কোন আপত্তি নেই।”

আমায়রা সোহেলের দিকে তাকাতেই সোহেল হেসে উঠে।

এরইমধ্যে তাদের বিয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। অবশেষে কবুল বলার মাধ্যমে দু জোড়া জুটির মিলন সম্পন্ন হয়। সারজিস, অভীক্ষা এবং মুকিত ও আমায়রাও শীঘ্রই মেতে উঠবে মন রাঙানোর পালায়।

আজ দুই পরিবারে বয়ে গেল খুশির বন্যা!
The End