#মন_সায়রের_পাড়ে
#Tahmina_Akhter
১..
— হোয়াট দ্যা হেল! জীবনেও কি সুন্দর ছেলে দেখেন নাই? যেই না সুুন্দর ছেলে দেখলেন ওমনি গায়ে ধাক্কা…
বাকি কথা পূরণ করার আগে সপাটে থাপ্পড় পরল পূর্নার গালে। পূর্ণা গালে রেখে কিছু বলতেই চাচ্ছিল। কিন্তু, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অগ্নিরুপি মেয়েটাকে দেখে গলা থেকে আর শব্দই বের হলো না।
— আরেকটা কথা বললে আমি আবারও থাপ্পড় দিতে দ্বিধাবোধ করব না। ফাজলামি পেয়েছো। আমাকে দেখতে টিনএজ মনে হয়? সুন্দর ছেলে হয়েছে তো কি হয়েছে? আমার বংশে এর থেকেও সুন্দর ছেলে আছে। তো কি আমরা ঢাকঢোল পিটিয়ে বেড়াই!
এমনসময় পূর্ণার পাশে এসে দাঁড়ালো সায়র। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
— কি হয়েছে রে??
— উনি আমাকে থাপ্পড় মেরেছে।
সায়র বিস্মিত হয়ে তাকালো বোরকা পরিহিতা মেয়েটার দিকে। কারণ, মেয়েটা পরিপূর্ণ পর্দায় আবৃত। এমন মেয়ে কি না পূর্ণাকে থাপ্পড় মেরেছে! সায়র মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করতে যাবে এমন সময় মেয়েটা দূরে সরে যায়। হাত দিয়ে ইশারা করে বুঝায় সে কথা বলতে আগ্রহী নয়। সায়র কিছু বলতে যেয়েও পারেনি। কারণ, ওর ইগোতে লেগেছে। সায়রকে ইগনোর করেছে মেয়েটা৷ একটিবার ওর দিকে তাকায়নি। পোশাক-আশাকে বোঝা যায় মেয়েটার মধ্যে কথিত ধর্মীয় বিশ্বাসের গোঁড়ামি আছে। এই সব মানুষদের কাছে আর কি বা এক্সপেক্ট করা যায়!
সেদিন বাড়িতে ফেরার পর সায়র পূর্ণাকে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছিল সেখানে? পূর্ণা প্রথমে বলতে চায়নি কিন্তু সায়রের ধমকে শেষমেষ ওকে বলতে হলো। সবটা জানার পর সায়র পূর্ণাকে থাপ্পড় মারার ভঙ্গিতে বলল,
— এখন আমারও ইচ্ছে করছে তোকে থাপ্পড় দিতে। মেয়েটাকে তুই ইচ্ছে করে পায়ে পা লাগিয়ে ফেলে দিয়েছিস । আবারও দোষ দিয়েছিস। আর তোর ছেলে বন্ধুগুলোর কি মাথা খারাপ যে এমন ভুতওয়ালি সরি বোরকাওয়ালির সঙ্গে ফ্লার্ট করতে চায়?
— বোরকার আড়ালে কি আছে তা আমরা জানি ভাইয়া? মেয়েটা মারাত্মক সুন্দরী। রেস্টুরেন্টের ওয়াশরুমে মেয়েটাকে দেখার পর আমারই অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমি কিছু বলতে যাওয়ার জন্য এগিয়ে গিয়েছিলাম ওমনি মুখের ওপর নিকাব ফেলে দিলো। আমি ওর আচরণে খানিকটা কষ্ট এবং অপমানিত ফিল করেছিলাম। তাই আমি ওকে শিক্ষা দেয়ার জন্য রিফাতের গায়ের ওপর ইচ্ছে করেই ফেলে দিতে…
—স্টপ পূর্ণা। যা এবার ঘরে যা।
পূর্ণা চলে যায়। সায়র কপালে হাত ঠেকিয়ে মেয়েটার ওকে ইগনোর করার মূহুর্তটাকে ভাবতে থাকে। এমন যুগেও কি এমন মহীয়সী সরি এমন শক্ত ধার্মিক মুসলিম নারী পাওয়া যায়!!
— হৃদি??
— জি ; আব্বা?
— তোমার জন্য একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। আমি চাই এবার তুমি এই বিষয়ে আমার ওপর কোনো কথা বলবে না?
হৃদি ওর আব্বার দিকে তাকালো। ধূসর রঙের পাঞ্জাবি গায়ে ওর আব্বাকে খানিকটা বুড়ো দেখা যাচ্ছে। সময়গুলো কত দ্রুত চলে যায়। শক্ত বলবান মানুষগুলো কালের পরিক্রমায় বয়সের ভারে নুইয়ে পরে। অপেক্ষা করে জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর এবং অপরিবর্তনীয় মূহুর্তের জন্য। যেদিন এই দুনিয়ার সকল মায়া এবং সম্পর্কের শিকলের বেড়ি থেকে নিজেকে মুক্ত করে রওনা হতে হয় পরকালের জীবনে। পরকাল কেমন কাটবে কে জানে? হয়ত শাস্তি কিংবা শান্তি! কারণ আল্লাহ তাআ’লা কুরআনে বলেছেন,
— প্রত্যেকে নিজ নিজ কর্মের জন্য দায়ী থাকবে। কেউ অন্যের (পাপের) বোঝা বহন করবে না। তারপর তোমাদের পালনকর্তার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তখন তিনি সেসব বিষয়ে বলে দেবেন, যা নিয়ে তোমরা মতবিরোধ করতে।”
(সুরা : আনআম, আয়াত : ১৬৪)
হৃদি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নীচুস্বরে ওর আব্বাকে বলল,
— আব্বা, আমি কখনোই আপনার উপরে কথা বলতে চাইনি। কিন্তু, একটা মানুষকে ঠকানো নিশ্চয়ই ঠিক হবে না।
একটি মানুষ বিয়ে করে সংসার সাজায়, বাচ্চাকাচ্চা হয়। কিন্তু, আমাকে যে বিয়ে করবে তার কি বাচ্চার প্রয়োজন নেই আব্বা?
মেয়ের কথা শুনে রহমান সাহেব মন খারাপের সুরে বললেন,
— আমারও তো ইচ্ছে করে তোর সাজানো গোছানো একটা সংসার দেখতে। বাবা হিসেবে আমার এই চাওয়া কি খুব অন্যায়?
— না আব্বা। অন্যায় নয়। কিন্তু, কাউকে গুমরাহ করে বিয়ের মত একটা পবিত্র সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়া উচিত হবে না। যে আমাকে গ্রহন করবে সে যদি আমার কমতি সহকারে আমাকে গ্রহন করে তবে আমি তার নামে আমার পুরো জীবন দিয়ে দিব।
রহমান সাহেব অশ্রুসিক্ত চোখে বেড়িয়ে এলেন মেয়ের ঘর থেকে। হৃদি মুচকি হেসে আনমনে বলল,
— আমি জানি আপনি (আল্লাহ) আমার জন্য উত্তম কিছু ভেবে রেখেছেন। আমি সেদিনের জন্য অপেক্ষায় আছি।
************
— আপনার স্ত্রীকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। আমরা দুঃখিত।
ওটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সায়রের মনে হলো জীবনের সবচেয়ে তিক্ত একটি ভাষা সে শুনতে পেলো। তার প্রিয়তমা স্ত্রী আর নেই! “নেই” শব্দটা কতটা সহজভাবে উচ্চারণ করা যায়। কিন্তু এই শব্দের ভারটুকু কতটা সহনীয় পর্যায়ের শুধুমাত্র তারাই জানে যারা এই শব্দের ভার সইছে।
সায়র ডক্টরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। চোখের কোণে অশ্রু নেই। তবুও যেন এই আঁখিযুগলে কেবল বিষাদে ভরে আছে। অথচ কয়েকমূর্হুত আগেও এই দুই চোখে ছিল কারো বেঁচে থাকার আশা। সায়র ডক্টরের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল,,
— একটি প্রাণের কতটা মূল্য ডক্টর??
ডক্টর অবাক হয়ে তাকালো সায়রের দিকে। সায়র ডক্টরের অবাক হয়ে যাওয়া চেহারার দিকে না তাকিয়ে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে।
— দেখুন না আমি কত কিছু করলাম আমার প্রিয়তমাকে বাঁচাতে? নিজের পরিচয়, পরিবার, দেশ ছেড়ে এসেছি কিন্তু তারা আমাকে একেবারে নিঃস্ব করে ফেলেছে। যাকে দেখে নতুন করে জীবনের স্বাদ পেয়েছিলাম আজ তাকেই হারিয়ে ফেলেছি। বলুন না ডক্টর একটি প্রাণের কতটুকু মূল্য?
ডক্টর ইমান কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রেমিক নামক মানুষটাকে কি বলে স্বান্তনা দেয়া যায় তার জানা নেই। আজ বড্ড আফসোস হচ্ছে! কেন ডক্টর হয়েও মাঝে মাঝে নিজেকে অসহায় মনে হয় যখন বিধাতার নিয়তির কাছে পরাস্ত হতে হয়।
— সায়র! এই সায়র শুনতে পাচ্ছ?
দূর থেকে চিরচেনা সেই ডাক শুনতে পাচ্ছে সায়র। চট করে চোখ খুলে তাকাতেই নিজেকে আবিষ্কার করল ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা পরা কবরস্থানের উত্তরদিকে। হুট করে নিজেকে অসহায় মনে হলো সায়রের। ডানহাত দিয়ে প্রিয়তমা স্ত্রীর কবর ছুঁয়ে আনমনে বলে উঠল,
— আমার সঙ্গে তুমি এত নিষ্ঠুরতা করবে জানলে তোমাকে আমার হৃদয়টা দিতাম না। তুমি জানো না হৃদি তোমাকে ছাড়া আমার এই পৃথিবীর সবটা ফাকা লাগে। অথচ, তুমি সবকিছু জানার পরও চলে গেলে আমায় একা রেখে। একটিবারও ভাবলে না তোমার সায়র তোমাকে ছাড়া কিভাবে বেঁচে থাকার লড়াই করবে?
সায়রের প্রিয়তমা কি তার সায়রের বুকভাঙা আর্তনাদ শুনতে পেলো কিনা কে জানে? কিন্ত, কবরের উপরের মাটিগুলো সায়রের এক ফোঁটা চোখের জল শুষে নিচ্ছে।
সায়র নিজের কাঁধের ওপর কারো হাতের উপস্থিতি টের পেলো। চোখের কোণে জমে থাকা জল মুছে ঘুরে তাকালো। জায়িন এসেছে। জায়িনকে দেখার পর সায়র যেন নিজের মধ্যে আর রইল। বন্ধুর হাতের ওপর নিজের কপাল ঠেকিয়ে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে। জায়িন এতদিন সায়রের কঠিন রুপ দেখছে। কিন্তু,, আজ সেই কঠিন মানুষটার এহেন রুপ দেখার পর কেমন লাগছে তা নিজেও বুঝতে পারছে না। বুকের কোণে সুক্ষ্ম কষ্ট অনুভব হচ্ছে।
জায়িনের ঘুম ভাঙল সায়রের গোঙানির শব্দে। জায়িন পাশ ফিরে দেখল সায়র ঘেমে নিয়ে একাকার। স্বপ্নে হয়তো কিছু দেখছে। জায়িন সায়রকে বেশ কয়েকবার ডাক দিতেই সায়র চোখ খুলে তাকালো। চোখ খুলে তাকাতেই যখন নিজেকে নিজের ঘরে আবিষ্কার করল ঠিক তখনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। জায়িন শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করল,
— খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস?
— খারাপ ও না। কিন্তু কেমন অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম জানিস?
— বাদ দে। চল এবার ফ্রেশ হয়ে নে। আজ একটি স্পেশাল জায়গায় যাব।
— কোথায়??
বিছানা থেকে নামতে নামতে প্রশ্ন করল সায়র। জায়িন মুচকি হেসে বলল,
— আগে চল তারপর বলব।
সায়র আর কিছু না বলেই ওয়াশরুমে চলে গেল আর জায়িন মোবাইল হাতে নিয়ে কাউকে কল করল।
জায়িন আর সায়র বসে আছে অভিজাত একটি বাড়ির ড্রইংরুমে। বাড়ির প্রত্যেকটা কোণায় যত্নের ছাপ। নিশ্চয়ই এই বাড়ির মানুষগুলো শৌখিন। এবার সায়র জায়িনকে চেপে ধরল। এখানে কেন এসেছে জানার জন্য?
— আমার জন্য পাত্রী দেখতে এসেছি।
— হোয়াট??
— ইয়েস ব্রো। মেয়েটার সম্পর্কে আমি জানার পর থেকে পাগল হয়ে গেছি।
— মেয়ে কি সুন্দরী?
— আই ডোন্ট নো!
— মেয়ের ছবি দেখেছিস?
— না।
— তাহলে? কি দেখে? কি শুনে পাগল হয়ে গেছিস?
— মেয়েটা পর্দাশীন।
জায়িনের কথা শুনে এবার সায়র হু হু করে হেসে ফেলে। সায়রের হাসি দেখে জায়িন মুখ কালো করে বলল,,
— এভাবে হাসছিস কেন হাসার মত কি বলেছি আমি?
— মেয়ে পর্দাশীন শুনেই ফিদা হয়ে গেছিস। যদি দেখিস মেয়ে কালো তখন কি করবি?
— রিজেক্ট করে দেব। এই জন্যই তো দেখতে এলাম। বিয়ের জন্য পাত্রী দেখা জায়েজ আছে। তাই দেখে নেই। যদি সুন্দর হয় তো ভালোই আর না হলে বাদ।
— শা*লা।
সায়র জায়িনকে গালি দিয়ে চুপ করে বসে রইল। এমনসময় জায়িনের মোবাইলে কল এলো। জায়িন সায়রের পাশ থেকে উঠে চলে যায়। সায়র একা বসে আছে ড্রইংরুমে এমনসময় একজন বয়স্কা মহিলা এসে সায়রকে বলল,,
— চলুন ভেতরে।
সায়র ভাবল হয়ত জায়িনও ভেতরে আছে। তাই মহিলার সাথে সেও ভেতরে যায়। ঘরে ঢোকার পর দেখতে পেলো একটি মেয়ে বসে আছে। মহিলাটি সায়রকে ইশারা করল মেয়েটার মুখোমুখি গিয়ে বসতে। সায়র অবাক হয়ে যায়। কারন, এখানে একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেছে। বয়স্কা মহিলাটি ওকেই বিয়ের পাত্র ভেবে বসে আছে । যার কারণে মেয়ের রুম অব্দি নিয়ে এসেছে। সায়র কিছু বলতে যাবে এমন সময় মেয়েটি ঘুরে দাঁড়ালো। মাথা নীচু করে সালাম জানালো। সায়র সালামের উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা সালামের উত্তর না পেয়ে মাথা উঁচু করে তাকাতেই শিউরে উঠল। কারণ লোকটাকে সে গতকাল রেস্টুরেন্টে দেখেছে। এই লোকটার বোন ছিল বোধহয়। যে কিনা হৃদিকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছিল। যদিও পরে উচিত শিক্ষা দিয়েছে মেয়েটাকে।
— দেরি করে ফেলেছি বোধহয় আমি।
জায়িন রহমন সাহবকে সঙ্গে নিয়ে কথা বলতে বলতে রুমের ভেতরে ঢুকল। এদিকে সায়র আর হৃদি দু’জনেই অবাক হয়ে তাকালো জায়িনের দিকে । হৃদির মাথায় এই পরিস্থিতি বোঝার জন্য কিছু আসবার আগেই নিজেকে আড়াল করে ফেললো পর্দার আড়ালে। হৃদির পুরো শরীর কাঁপছে কারণ আজ তার পর্দা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। যা কিনা এতদিন আড়াল করে রেখেছিল তার হবু স্বামীর জন্য। তার ইবাদতে কি কিছুটা খুঁত রয়ে গিয়েছিল যার কারণে আজ এই পরিস্থিতিতে হলো?
সায়র ঘোরের মাঝে আছে। কাকে দেখল সে? মেয়েটাকে কি এই পৃথিবীর নাকি অন্য গ্রহের! ছিহ ছিহ কি ভাবছে সে? জায়িন তার বন্ধু। বন্ধুর হবু স্ত্রীকে নিয়ে এমন কল্পনা করাও যায় না। সায়রের কি হলো আজ?
গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করতেই মেয়েটার মুখটা ভেসে ওঠল সায়রের চোখের দৃশ্যপটে। সায়র উফফ বলে চোখ খুলে তাকালো কিন্তু সেই দৃশ্য আবারও হানা দেয়। এই কোন জ্বালায় পরল সায়র? এমন অনুভূতিতে কখনো কি কাবু হয়েছিল সায়র?
“চলবে”