মন সায়রের পাড়ে পর্ব-০২

0
24

#মন_সায়রের_পাড়ে
#Tahmina_Akther

২…

— আমি কখনোই মা হতে পারব না। আপনার আগেও কয়েকজন এসেছিলেন। আমার সম্পর্কে তারা যা জেনে এসেছিল কিন্তু এখানে আসার পর যখনি আমার কাছ থেকে তারা জানতে পারে আমি তাদের বাচ্চা দিতে পারব না। ঠিক তখনি তারা চলে যায়। অবশ্য তাদের অধিকার আছে তাদের জীবন নিয়ে ভালো কিছুর ভাববার। আমি চাইলে তাদের কাছ থেকে মিথ্যা আড়াল করতে পারি কিন্তু করব না। অন্তত বিয়ের মত সেনসেটিভ একটা ব্যাপারে তো নয়ই।

জায়িনের চোখমুখে বিস্ময় প্রকাশ। মেয়েটার এত প্রবল দৃঢ়তা এবং সত্যবাদিতা দেখে জায়িন মুগ্ধ হলো ঠিকই। কিন্তু, পরক্ষণেই মেয়েটার জন্য মনে করুনা জন্মায়। মেয়েটা হয়ত চমৎকার! কিন্তু বাচ্চা জন্ম দিতে পারবে না। মানুষের এই একজীবনে যদি বাচ্চার বাবা-মা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরন না হয়। তখন বিয়ের আগে অজান্তে হোক কিংবা বিয়ের পরে সমস্যার কথা জানা যায়। অনেকেই হয়ত তকদীর ভেবে মেনে নেয়। কিন্তু, বিয়ের আগে জেনেশুনে আর যাই হোক ভুল তো করা যাবে না।

জায়িন বিব্রত হয়ে হৃদিকে প্রশ্ন করল,,

— আপনার মুখটা…

— আপনি এই বিয়েতে রাজি??

জায়িন ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলল। জায়িনের নীরবতায় হৃদি উত্তর খুঁজে পেলো। হৃদি উঠে দাঁড়ালো। যেতে যেতে বৃদ্ধা মহিলাকে বলে গেল,,

— খালা, উনাকে ড্রইংরুম পর্যন্ত দিয়ে আসুন।

জায়িন লজ্জায় কুঁকড়ে যায়। মেয়েটা যে ওকে এভাবে লজ্জা দেবে ভাবেনি। তাই ওভাবে চেহারা দেখার কথা বলে ফেলেছে।

রহমান সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। জায়িনের নীরবতা দেখে যা বোঝার তা বুঝে ফেললেন। মেয়েকে গিয়ে আর প্রশ্ন করলেন না।

অফিসের কাজে ব্যস্ত সায়র। এমনসময় জায়িন এসে হাজির। সায়র জায়িনকে দেখে বলল,

— দোস্ত আর কিছুক্ষণ পর লাঞ্চটাইম। তখন শুনব তোর কথা।

জায়িন ক্যান্টিনে গিয়ে অপেক্ষা করছে। সায়র যথাসময়ে ক্যান্টিনে চলে এলো। জায়িনের পাশের চেয়ারটা টান দিয়ে বসল। জায়িন খানিকটা সময় চুপ থেকে সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলল। সবটা জানার পর সায়র কষ্ট পেলো। কারণ, এমন একটা মেয়ে যার রুপে কোনো খুঁত নেই। সেই মেয়েটার শরীরে সবচেয়ে বড় খুঁত রয়ে গেছে।

— আমি দোটানায় পরে গেছি। একবার মনে হচ্ছে বিয়ে করে ফেলি। কত মানুষই তো বাচ্চাকাচ্চা ছাড়া জীবন কাটিয়ে দেয়। আমি না হয় তাই করলাম। কিন্তু, পরক্ষণেই মা-বাবার কথা ভাবি। তারা কখনোই মানবে না।

— তোর বাবা-মা নিশ্চয় এই পাত্রীকে দেখেছে? তারা জানে না এই ব্যাপারটা?

— হয়তো ; না। জানলে আমাকে পাঠাতো না।

— মেয়েটাকে দেখেছিস?

কথাটি বলেই সায়র চোরাচাহনিতে তাকালো জায়িনের দিকে। জায়িন হতাশার সুরে বলল,

— না।

“না” শব্দটা শোনার পর সায়রের মনের কোনে ভালো লাগার এক ফিলিংস হলো। সায়র মুচকি হেসে দুটো কফি অর্ডার করে বলল,

— বাদ দে। তোর টাইপের কোনো মেয়ে দেখ। পেয়ে যাবি।

সেদিনের মত দুই বন্ধু কথোপকথন শেষ হলো। সায়র বাসায় ফিরল। বাসায় আসতেই দেখল ওর দাদাজান এসেছে। দাদাকে দেখার পর সায়রের মাঝে কোনো উচ্ছাস কিংবা আনন্দের দেখা মিলল না। নায়েব আলী সাহেব নাতির কান্ড দেখে মনে মনে কষ্ট পেলেন ঠিকই তবে প্রকাশ করলেন না। সায়র নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল কিন্তু নায়েব আলী সাহেব সায়রকে ডাক দিলেন। অগত্যা, সায়রকে যেতে হলো।

—একজন মুসলিমের অন্য মুসলিমের সঙ্গে দেখা হলে সালাম দেয়ার কথা বলেছে। যে যত অহংকার মুক্ত সে ততই সালাম প্রদানকারী। সালামের অর্থ কি জানিস না?

সায়র ওর দাদার দিকে তাকিয়ে বলল,

— কেন জানব না? আপনি তো ছোটবেলায় শিখিয়েছেন।

— তাহলে সালাম বিনিময় করিস না কেন?

— সালাম এর অর্থ হলো, ” আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক”। কিন্তু, আদৌও কি কাউকে এমন দোয়া করে শান্তি দিতে পেরেছে? তাহলে আমি কেন অহেতুক একটি বাক্য…

—সায়র??

নায়েব আলী সাহেব বিস্মিত হয়ে গেলেন। লোক মুখে শুনেছে কিন্তু আজ প্রমান পেলেন। সায়র আর আগের সায়র নেই। যে কিনা নামাজ পড়ত, রোজা রাখত৷ সে এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা মানুষে পরিণত হয়েছে। যার মনের মাঝে সৃষ্টিকর্তার জন্য ভয় নেই৷ আছে কেবল শয়তানের প্রবৃত্তি।

— এতটা অধঃপতন হয়েছে কবে?

— যেদিন থেকে আমি এতিম হয়েছি ঠিক সেদিন থেকে। আপনি খাওয়াদাওয়া করুন। আমি আসছি।

— আমি এখানে থাকব না। যেখানে আমার রবকে কেউ মানতে চায় না। তার আয় রোজগারের খাবার আমার জন্য বিষের চেয়ে অধিক বিষপ্রয়োগের মত। চললাম।

সায়র জানত ওর দাদাজান এখানে থাকবেন না। তবুও মনের এক কোণায় আশা ছিল হয়ত আজ একসাথে বসে খাওয়াদাওয়া হবে দাদা নাতির। কিন্তু…
সায়র গোসল সেরে রান্নাবান্না করল। কারণ, আজ পূর্ণা বাড়িতে নেই। বাহিরের খাবার খেতে পারে না। তাই বাধ্য হয়ে প্রায়ই সায়রকে রান্নাবান্না করতে হয়। খাওয়াদাওয়া শেষ করার পর অফিস একটা অসম্পূর্ণ ফাইল নিয়ে বসল। ফাইল যখন সম্পূর্ণ হলো তখন সময় প্রায় বারোটা। সায়র ফাইলটা ড্রয়ারে রাখল। তারপর, শুয়ে পরল। চোখটা লেগেই আসছিল। ঠিক সেই সময় সেই মেয়েটার চেহারা ভেসে ওঠল চোখের সামনে। ব্যস, ঘুম গায়েব। সারারাত এপাশ ওপাশ করার পরও ঘুম হয়নি। মেয়েটার জন্য অজানা এক ব্যথা অনুভব করছিল।

শুক্রবার জুম্মার নামাজের জন্য মসজিদের ইমাম সাহেব মসজিদে আসার জন্য আহ্বান করছেন। আশেপাশের প্রাশ অনেকগুলো মসজিদে আযান শুরু হয়েছে। সায়রের ঘুম ভাঙল আযানের শব্দে। বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হলো। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের সামনে যেতেই পূর্ণাকে দেখতে পেলো সায়র। পূর্ণা ভাইকে দেখে মুচকি হেসে বলল,

— নামাজ পড়ে এসো ভাইয়া। একসঙ্গে আজ খাব আমরা। আজ সব তোমার পছন্দের খাবার..।

— হ্যাভ ইউ লস্ট ইউর মাইন্ড পূর্ণা? হাউ মেনি টাইমস আই টেইল ইউ আ’ম নট ইন্টারেস্ট নামাজ এন্ড রোজা! বারবার একই কথা বলতে বলতে আমি ক্লান্ত।

পূর্ণা হতবিহ্বল হয়ে পরেছে। গতকাল রাতে ওর দাদাজান ওকে গতকাল বিকালের ঘটনা জানিয়েছিল। পূর্ণা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু, এখন যা শুনতে পাচ্ছে… পূর্ণার চোখে জল চলে আসে। হয়ত, সেভাবে ধর্মকর্ম পালন করে না তাই বলে নিজের ধর্মকে এভাব অস্বীকার করতেও তো পারে না। চোখের পানি মুছল পূর্ণা। মনে মনে কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। এক দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে এলো। সায়র তখনও রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। পূর্ণার হাতে ব্যাগ দেখে অবাক হয়ে তাকালো।

পূর্ণা সায়রের অসহায় চাহনিকে উপেক্ষা করেই বলল,,

— তোমার সঙ্গে আমি থাকব না ভাইয়া। আমি দাদাজানের কাছে ফিরে যাচ্ছি।

— এটাই কি তোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত?

— হ্যা৷

পূর্ণা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জবাব দিলো। সায়র দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর, এগিয়ে গিয়ে পূর্ণার ব্যাগ নিয়ে সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলো। পূর্ণা দরজা লাগিয়ে পিছু পিছু আসছে। পূর্ণাকে রিকশায় উঠিয়ে দিলো। সায়র কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। এত আদরের বোনটাও ওকে ফেলে চলে যাচ্ছে শুধুমাত্র ধর্মের মায়ায়? তাহলে কি পৃথিবীতে সকল বন্ধনের চেয়ে অদৃশ্য এক বন্ধন আছে! যেই বন্ধনের ডোরে মানুষ আটকে আছে বহুবছর ধরে!

পূর্ণা চলে যায়। এত বড় বাড়িতে শুধু একা পড়ে থাকে সায়র। পূর্ণা চলে যাওয়ার পর সায়রের মন খানিকটা দূর্বল হয়ে পড়ে। ধর্ম না মানার যে একটা কনফিডেন্স ওর ভেতরে উদয় হয়েছিল সেটা কেমন মিইয়ে যাচ্ছে!আবার হুট করে চাড়া দিয়ে উঠছে।

সেদিনের পর অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেছে। এতকিছুর মধ্যে হুট করে খবর এলো জায়িন বিয়ে করছে তাও আবার সেদিনের সেই চমৎকার মেয়েটাকে।

যথারীতি সোমবার রাতে কনের বাড়িতে উপস্থিত হলো বরপক্ষের লোকজন। মেয়ের কথামত সব কিছুই করা হয়েছে। বাইরের কোনো পরপুরুষ কনেকে দেখতে পারবে না। জায়িন কয়েকবার কল করল সায়রকে।কিন্তু, সায়রের নাম্বার বন্ধ। কাজিসাহেব বিয়ে পড়ানোর জন্য তাড়া দিচ্ছেন। জায়িনের বাবা এবং হৃদির বাবা এবং হৃদির দুই মামা উঠে চলে গেলেন হৃদির ঘরের দিকে। কাজিসাহেব হৃদিকে কবুল বলার জন্য অনুরোধ করবে ঠিক সেই সময় জায়িনের মা অগ্নিমূর্তি হয়ে ঘরে ঢুকে পরে। হৃদির খাটের সামনে গিয়ে হৃদির গালে ঠাসস করে থাপ্পড় মারে। আকস্মিক ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে যায় হৃদির বাবা এবং মামারা। জায়িনের বাবা একপ্রকার রাগান্বিত হয়ে বললেন,

— এইটা কেমন সভ্যতা রিনা? মেয়েটার সঙ্গে তুমি এমন আচরণ করতে পারলে?

হৃদি মাথার কাপড় আর টান দিয়ে মুখের সামনে ছড়িয়ে দিলো। কারণ আর যাই হোক বিয়েটা আর হচ্ছে না। যদি ওর অতএব,জায়িনের বাবা তার গায়েরে মারহাম।

— এই মেয়ে জীবনেও মা হতে পারবে না। এত বড় একটা ব্যাপার আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে এমন বাজা একটা মেয়েকে আমার ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দিতে চেয়েছিল! এজন্যই কিছু লোকে বলে ঘোমটার তলে শয়তানের বাসা।

— কিন্তু, আপনার ছেলেকে সবটা জানানো হয়েছে। আমার মেয়ে জানিয়েছে।

বহু কষ্টে কথাগুলো বলল রহমান সাহেব। মেয়ে যে ঘোমটার আড়ালে কত অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে তা তিনি টের পাচ্ছেন।

চিৎকার চেঁচামেচি শুনে জায়িন সহ আরও অনেকে চলে আসে। জায়িনকে দেখে ওর মা ওকে চেপে ধরে ঘটনা যা শুনেছেন তা সত্যি কি না জানার জন্য ? জায়িন হ্যা বলল। ঘটনা সত্যি। হৃদি তাকে সব বলেছে। জায়িন ইচ্ছে করেই এই বিষয়টা ওর বাবা-মায়ের কাছে চেপে গেছে। জায়িনের মা অবাক হয়ে জায়িনের বাবাকে বলল,

— এই ছেলে মেয়ের রুপ দেখে পাগল হয়ে গেছে। তাই ভুলভাল বকছে। বিয়ের কয়েকমাস পর ঘোর কেটে যাবে। তখন বাচ্চার ভূত মাথায় চড়বে। কোথায় পাবি তখন বাচ্চা? এই আঁটকুড়া নারী তোরে বাচ্চা দিবে কোত্থেকে?

হৃদি “আঁটকুড়া” শব্দ শুনে কেঁপে উঠল। চোখের জল অনবরত পড়ছে। মনে মনে তখন আওড়াচ্ছে “আল্লাহুম্মাগফিরলি”। আল্লাহ যেন এই তিক্ত সময়টা দ্রুত কাটিয়ে দেয়।

জায়িন পারল না ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে। জায়িনের বাবা-মা বিয়েটা ভেঙে দিলেন। মানুষে টইটুম্বুর বাড়িটা হুট করে শুনশান নীরবতায় ঢেকে গেল। জায়িনরা চলে যাওয়ার মিনিট পনেরো পর সদর দরজা দিয়ে কেউ প্রবেশ করল। দারোয়ান গিয়ে জিজ্ঞেস করল,

— কে ভাই আফনে?

— আজ তো এই বাড়ির মেয়ের বিয়ে। আমি সেই মেয়ের হবু স্বামীর বন্ধু। আমার নাম সায়র।

— এই বিয়া তো ভাইঙ্গা গেছে। বরযাত্রী গেছে গা। আপার নাকি পোলাপান হইব না এই খবর হুইন্না । হবু দুলাভাইরে নাকি আপা যেদিন দেখতে আইছিল হেইদিনই কইছিল। কিন্তু, দুলাভাই ব্যাপারটা হের বাপ-মার কাছে গোপন রাখছে। আর আপা আর রহমান কাকার লগে কইছে হের বাপ-মায় ব্যাপারটা হুনছে এবং রাজিও হইছে। হেই আশাতেই তো বিয়ার দিনতারিখ ঠিক হইল। কিন্তু, কি থেইকা কি হইল। তয় একটা কথা ভাইজান? আপনে সবার লগে না আইয়া এত দেরিতে কোত্থেইকা আইলেন?

— তোমার রহমান কাকারে গিয়ে বলো একজন আপনার দেখা করতে চায়।

সায়রের হুট করে কষ্ট অনুভব হচ্ছে। কেন হচ্ছে জানা নেই? কিন্তু, কষ্টটা যার কারণে পাচ্ছে সো তো সায়রের কেউ না? সায়রের ভীষণ পরমানুষ।

#চলবে