মন সায়রের পাড়ে পর্ব-০৩

0
20

#মন_সায়রের_পাড়ে
#Tahmina_Akther

৩…

— রহমান সাহেব আপনি অনুমতি দিলে আপনার মেয়েকে আমি বিয়ে করতে রাজি আছি।

এক নিঃশ্বাস কথাগুলো বলে শ্বাস ছাড়ল সায়র। রহমান সাহেব তখনও ঘোরের মাঝেই রইলেন। সামনে বসে থাকা এমন সূদর্শন যুবক আদৌও কি সত্যি কথা বলল নাকি নিছক ছলনা!

— আমি জায়িনের বন্ধু। জায়িন যেই কোম্পানিতে চাকরি করে আমি সেই কোম্পানির এমডি পদে আছি। আপনার মেয়ের কোনো প্রকার অর্থকষ্ট কষ্ট হবে না।

কথাগুলো কোনো এক ঘোরের মাঝে বলে শেষ করল সায়র। রহমান সাহেব বিস্মিত হলেন। পরক্ষণেই জায়িনের দেয়া ধোঁকার কথা মনে হলো। না এবার আবেগে ভেসে যাবেন না।

— আমার মেয়ে কখনোই মা হতে পারবে না। তুমি কি এটা জানো?

— জি। আমি জানি। যেদিন জায়িন আর আপনার মেয়ের দেখা হলো ঠিক সেদিনই আমাকে সেই ব্যাপারে জানিয়েছিল জায়িন।

— এত সব জানার পরও কি তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চাও?তোমার বন্ধুও তো রাজি হয়েছিল। কিন্তু.. আজ আমার মেয়েকে এই সমাজের সামনে অপদস্ত হেয় করেছে শুধুমাত্র ওর পরিবারের মানুষগুলোর জন্য।

— আমার পরিবার বলতে আমার একটি ছোটবোন আছে। আর আছে দাদাজান। আমার বিশ্বাস উনারা কিছু বলবেন না। আমার পছন্দকে উনারা নিজের পছন্দ হিসেবে গ্রহণ করবেন। সমাজ কি বলবে তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যাথা নেই।

রহমান সাহেব খুশি হতে পারলেন না। তবুও মনের এক কোনে আশার আলো জ্বলে উঠেছে। চোখের সামনে মেয়েটার একটি সুখের সংসারের সুঘ্রাণ পাচ্ছেন। হয়ত, সেই লোভের স্বাদ মেটানোর জন্য সায়রকে ড্রইংরুমে বসিয়ে মেয়ের রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন রহমান সাহেব।

সায়র একা বসে বসে ভাবছে সত্যি কি বিয়েটা হবে? আর এই মেয়ের মধ্যে এমন কিছু তো অবশ্যই আছে। নয়ত সায়র রাত বারোটা বাজে কেন এই বাড়িতে বসে আছে?

সায়র যখন নয় ছয় ভাবছে ঠিক সেই সময় দুজন মানুষের উপস্থিতি টের পেল। সায়র মাথা উঁচু করতেই দেখতে পেলো হৃদি এবং ওর বাবা এসেছে। হৃদির পুরো শরীর জিলবাব দ্বারা আবৃত। মুখখানাও দেখা যাচ্ছে না । সায়র মাথা নিচু করে ফেলল। রহমান সাহেব মেয়েকে বসিয়ে রেখে গেলেন।

— আপনার বন্ধুও কিন্তু আপনার মত আশ্বাসবাণী দিয়েছিল আমায়। কিন্তু, ফলাফল আজই পেলাম। জীবনের এমন কিছু সিদ্ধান্ত আছে যেগুলো বড় বড় নীতিবাক্য দ্বারা পরিচালিত করা যায় না। আজ ভাবলেন বাচ্চার দরকার নেই। পরে কিন্তু ঠিকই বাচ্চা লাগবে বলবেন। অথচ, আমি অক্ষম। চাইলেই দিতে পারব না।

অন্তুত নরম সুরে কথাগুলো পেশ করল হৃদি। সায়র মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শ্রবণ করল কথাগুলো। সায়র মুচকি হেসে বলল,,

— আমি আপনার কাছে বাচ্চা চাইতে আসিনি। স্ত্রী হিসেবে আপনাকে চাইতে এসেছি। আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে আপনাকে চাইছি। কেন যেন আমার মনে হচ্ছে আপনার সাথে আমার কোনো কানেকশন আছে বা হতে পারে। আপনাকে দেখার পর থেকে আমার মনে হয় ইউ আর দ্যা কারেক্ট উমেন ফর মি। হয়ত, আমার কথাগুলো আপনার কাছে ছ্যাচড়াদের মত লাগতে পারে। কিন্তু, আমি আমার মনের কথাগুলো বলছি। বাকিটা আপনার ইচ্ছা। আপনি চাইলে আমাকে রিজেক্ট করতে পারেন। আপনার সেই রাইট আছে।

— কিন্তু, আমি একটা ব্যাপার জানতে পারলাম আপনার বন্ধুর কাছ থেকে। সেই ব্যাপারটা কি সত্যি?? আর সেদিন আমাকে দেখার পরই কি আপনি কিছু ভেবে ফেলেছেন।

হৃদি এক পলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলল। সায়র সেই দৃষ্টিতে তাকিয়ে থমকে গেলো। ওই দুচোখের অন্তরালে মায়াজাল বিছানো। সেই মায়াজাল সায়রকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলছে। যা থেকে বেরোনো এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সায়র খানিকটা গম্ভীরমুখে হৃদির দিকে তাকিয়ে বলল,,

— যা শুনেছেন সবটাই সত্যি। আমি পরকালে বিশ্বাস করি না। এখন আপনি বলুন আমি কি আপনাকে বিয়ে করতে পারব? কারণ আপনারর ধর্মে নিশ্চয়ই বলা আছে বির্ধমী কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ না করতে।

— আপনি আমাকে পছন্দ করেন?

— পছন্দ নয়। হয়ত ভালোবাসি। এবং এতে একফোঁটাও মিথ্যে নেই। যেদিন আপনাকে দেখেছি সেই মুহুর্ত থেকে এখনও আমার ভেতর আপনার জন্য সফট কর্ণার তৈরি হচ্ছে। হয়ত, আপনার কাছে পাপ মনে হতে পারে। কিন্তু আমার মত অবিশ্বাসী মানুষের জন্য এই ভালোবাসার ব্যাপারটা যাস্ট মিরাকেল। আমি ধর্মের কোনো বাঁধায় বাঁধতে চাইনি। কিন্তু, আপনাকে দেখার পর আমার নিজেকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে ইচ্ছে করছে।

সায়র উত্তর দিলো ঠিকই কিন্তু হৃদি তাকালো না সায়রের দিকে। মাথা নিচু করে কঠিন স্বরে বলল,

— তাহলে আমাকে ভুলে যান। কারণ, আমি এই দুনিয়ার সবকিছুর উর্দ্ধে আমার রবকে ভালোবাসি। আপনি আমার জন্য সঠিক নন।

হৃদি সায়রের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল না। ধীর পায়ে হেঁটে হলরুম ছেড়ে নিজের ঘরের দিকে রওনা হলো। সায়র তাকিয়ে রইল কালো কাপড়ে আবৃতে ঘেরা তার হৃদির দিকে।

— আর যদি আমি আপনার আল্লাহকে আমার ইশ্বর হিসেবে মেনে নেই?

— আমাকে পাওয়ার জন্য আমার আল্লাহকে ইশ্বর বলে গ্রহণ করবেন। এটা তো আমার ধর্মে নেই। কেবল আল্লাহকে ভালোবেসে আপনি ধর্ম গ্রহন করতে পারেন। অন্যথায় আমি আপনাকে ফোর্স করব না যে, আমার জন্য আপনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করুন।

হৃদি চলে গেল। ড্রইংরুমে তখন সায়র সম্পূর্ণ একা। বারান্দা দিয়ে তখনও হু হু বাতাস ঢুকছে। কোথা থেকে বুনোফুলের গন্ধ আসছে। এমনসময় রহমান সাহেব এলেন। সায়র উনাকে দেখে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে তবুও যেন কোথাও এই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা ফিকে হয়ে যাচ্ছে।

রহমান সাহেব ফিরে এলেন। মেয়ের কাছ থেকে জেনে ফেললেন ছেলের সবচেয়ে বড় কমতিটা। রহমান সাহেবকে দেখেই সায়র মাথা নীচু করে ফেলল।

— তুমি আমার কথাগুলো কিভাবে নিবে আমি জানি না। তবুও বলতে হবে কথাগুলো।

— বলুন। আমি শুনছি।

— তোমার বাবা-মা মুসলিম না?

— জি।

— আমি জিজ্ঞেস করব না যে তুমি কেন নাস্তিকতায় জড়িয়ে আছো? তোমার কাছে শুধু এটাই জানতে চাই, তুমি কি সত্যি আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চাও?

— অবশ্যই । বিয়ে করতে চাই। নয়ত এত রাতে এই বাড়িতে এত শীতের মধ্যে বসে থাকতাম না।

— কিন্তু, আমার মেয়েকে বিয়ে করতে হলে যে তোমাকে তওবা করতে হবে এবং পুনরায় ইসলাম ধর্ম গ্রহন করতে হবে।

সায়র চমকে তাকালো। রহমান সাহেবকে দেখেই মনে হচ্ছে এটাই উনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।

— আপনি যা বলছেন তা কি হৃদি আপনাকে জানিয়েছে?

— না। এইগুলো হচ্ছে আমার কথা । হৃদি তোমাকে কি বলেছে সবই আমাকে ও বলেছে। বাবা সায়র? একটি মানুষের আল্লাহর সান্নিধ্যে যাওয়ার উপায় হচ্ছে কি জানো? হেদায়াত। হয়ত আমার মেয়েকে বিয়ে করার মাধ্যমে তুমি তোমার শান্তি ধর্ম ফিরে পাবে। ফিরে পাবে হেদায়াত। বাবা সায়র, আমাদের জীবনে যা কিছু ঘটে সবই আমাদের তাকদীরে আগে থেকেই লেখা আছে। তুমি আল্লাহকে জানার জন্য যখন চেষ্টা করবে তখনি তোমাকে আল্লাহ তাআ’লা আলোর পথ দেখাবেন। সরল পথে পরিচালিত করবেন। আমার বিশ্বাস তুমি আমার মেয়েকে ভালোবাসবে তবে আমার রবের জন্য । হয়ত এমনও একদিন আসবে যেদিন তুমি আমার রবের উর্ধে আর কাউকে ভালবাসবে না। ইনশাআল্লাহ।

************

ভোরের আকাশ। পাখিদের ডাক। সকালের শীতল হাওয়া। হৃদি বিশাল জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হাতের ওপর ভাজ করে রাখা জায়নামাজ। অদূর আকাশে তাকিয়ে আনমনে বলল,,

— ইয়া রব, আপনার শুকরিয়া আদায় করব নাকি ভাবছি। ভাবতে গিয়ে শয়তানের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছি।আল্লাহুম্মাগফিরলি। আমি সবসময় আপনার ওপর তওয়াক্কুল ছিলাম এবং আছি। কিন্তু, বিয়ের মত এমন একটা ব্যাপার নিয়ে এবার আমি ভীষণ সন্দিহান। আমি জানি না আদৌও এই সিদ্ধান্ত সঠিক কিনা। আমি সবসময় আমার জন্য আপনার কাছে নেককার বান্দা চেয়েছি। যে কিনা আমার অর্ধেক দ্বীন পূরণ করবে। অথচ,

কথাগুলো বলতে বলতে হৃদি বিশাল বিছানার উপর দৃষ্টি রাখল। সাদা চাদরের ওপর শুয়ে থাকা সুদর্শন যুবকের ওপর। যার সঙ্গে হুট করেই তার সম্পর্ক বদলে গেছে।

হাতের জায়নামাজ ডিভানে ওপর রেখে ধীরপায়ে বের হয়ে গেলো রান্নাঘরের দিকে। রান্নাঘরের ভেতরে ঢুকে চারপাশটা সুন্দর করে ঘুরে ঘুরে দেখলো। তারপর, কাঙ্ক্ষিত জিনিসপত্রগুলো নিয়ে নেমে পরল সকালের নাশতা বানানোর জন্য।

সায়রের ঘুম ভাঙল একটা শালিক পাখির কিচিরমিচির ডাকে। খানিকটা বিরক্তি নিয়ে উঠে বসল। বিছানা থেকে নামতেই চোখ পরল ডিভানের ওপরে। জায়নামাজের দিকে তাকাতেই হৃদির কথা মনে পরল সায়রের। সায়র ওহ সীট বলেই মাথায় হাত রাখল। তারপর, চটজলদি গোসল সেরে ব্লু রঙের শার্ট ও কালো জিন্স পরে রেডি হয়ে সোজা নীচে চলে এলো। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় রান্নাঘর থেকে শব্দ পাচ্ছিল। মনে মনে আন্দাজ করল হৃদি রান্নাঘরেই আছে। রান্নাঘরের সামনে যেতেই সম্পূর্ণ অচেনা এবং নতুন এক অনুভূতির সঙ্গে পরিচয় হলো সায়রের। সাদা চুড়িদার, সাদা পায়জামা, মাথায় ঘোমটা দিয়ে রান্না সামলানো মেয়েটাকে দেখে কিছু সময়ের জন্য মনে হলো, জীবনের এই একটা স্বাদের অপেক্ষায় সে না থাকলেও তার অন্তর-আত্মা এমন সুকুন পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় ছিল। এই যে মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে কপালের চুলগুলো কানের পিছে গুজে ঘোমটা টেনে ঠিক করছে। দারণ লাগছে দেখতে!

হৃদির সালামের মাধ্যমে সায়রের মুগ্ধতা কাটল। সায়র হৃদির তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

— কিছু বললেন আমায়?

— সালাম জানিয়েছি। সালামের উত্তর কিভাবে দিতে হয় জানেন তো?

সায়র খানিকটা অপমানিতবোধ করল হৃদির প্রশ্নে। কিন্তু, প্রকাশ করল না । কারণ ওর পরিচয়, ওর অস্তিত্ব গতকালও ভিন্ন ছিল। কিন্তু সময়ের পালাবদলে আজ সেই অস্তিত্ব পূর্ণতা পাবার পথে।

সায়র ধীরপায়ে হেঁটে হৃদির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। হৃদি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দূরে সরে যেতে চাইল। কিন্তু, সায়র হৃদির ডানহাতটি বন্দি করে ফেলল। তারপর, মুচি হেসে বলল,

— ওয়ালাইকুম আসসালাম আমার বিবিজান। আপনার ওপর পৃথিবীর সকল শান্তি বর্ষিত হোক এবং আমার মোহাব্বত যেন আপনার সকল না পাওয়া সকল সুখকে পরিপূর্ণতায় ভরিয়ে দেয়। বিবাহিত জীবনের প্রথম সকালে আপনাকে জানাই মোবারকবাদ।

সায়র হাসতে হাসতে হৃদির হাত ছেড়ে দিলো আর হৃদি ঠায় তখনও দাঁড়িয়ে রইল। কারণ, তার শরীর কাঁপছে। জীবনে প্রথমবার কোনো পুরুষ তাকে স্পর্শ করেছে। প্রথম স্পর্শ বুঝি এতটাই অস্থিরতা তৈরি করে! মানুষটা এত সুন্দর করে কথা বলল! এত চমৎকার কন্ঠে তাকে সালাম জানালো! তার মনে উদয় হওয়া সংশয় কি তবে মিছে মিছে?

#চলবে