#মম_হৃদয়_বিহারিনী
#ঐশী_রানী_রক্তিমা
#সূচনা_পর্ব
১.
বিয়ের দিন বরের না আসায় যখন আমি প্রায় লগ্নভ্রষ্টা তখন আমার পুরো পরিবারের চোখেমুখে কালরাত্রির ঘোর অমাবস্যা!মা লজ্জায়,অপমানে মূর্ছা গেলেন বলে।বাবা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছেন সব। আমার দাদা মুখে হাত দিয়ে রাগ আর লজ্জা মিশ্রিত মুখশ্রী নিয়ে বসে আসে বারান্দার এককোণে।
হঠাৎ বাড়ির সকল মানুষ ও উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দিয়ে দাদার বন্ধু ধ্রুব বাবার কাছে প্রস্তাব রাখেন আমাকে বিয়ে করার।এই মুহুর্তে বাবা যেন হাতে আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতো খুশি হলেন।গম্ভীর,চাপা রাগ মিশে থাকা মুখশ্রীতে অকৃত্রিম হাসি ফুটে উঠলো অনাকাঙ্ক্ষিত প্রস্তাবটা পেয়ে।আমাকে এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করা হলো না।মেয়ে লগ্নভ্রষ্টা হওয়া থেকে বেঁচে যাচ্ছে এর চেয়ে বড় আর কি হতে পারে।
আমি তখন গায়ে লাল বসন জড়িয়ে,কপালে চন্দন মেখে,গায়ে গয়না পরে বসে আছি জবুথবু হয়ে।মা এসে যখন জানালেন দাদার বন্ধু আমাকে বিয়ে করতে চায় তখন একটু নড়েচড়ে বসলাম আমি।লোকটাকে দেখার তীব্র বাসনা জাগলো আমার মনে।কেননা একটু আগে যেই মা আমাকে অলক্ষ্মী,মুখপুরি বলে সম্মোধন করছিলো তিনি হঠাৎ গালে চুমু এঁকে দিয়ে গেলেন পরম আদরে!লোকটাকে দেখতে চাওয়ার ইচ্ছে মনে যাওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়?বরং ইচ্ছে না জাগাটাই অস্বাভাবিক ছিল।
যথারীতি পাত্রের জন্য রাখা ধুতি,পাঞ্জাবি পরানো হলো দাদার বন্ধু ধ্রুবকে।তারপর আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো ছাদনা তলায়।দাদার বন্ধু আদো বেকার,নাকি চাকরি করে তার আমার জানা নেই।বাড়িতে বাবা মা হয় জানেন।কিন্তু এই মুহুর্তে যেটা একদমই বড় কথা নয়।এসব তো মেয়ের জন্য পাত্র ঠিক করার সময় খোঁজ করা হয়।আমাকে তো এখন লগ্নভ্রষ্টা হওয়ার থেকে বাঁচাচ্ছেন উনি।এটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার।
শুভদৃষ্টির সময় আমি লজ্জা না পেয়ে ধ্রুবকে দেখতে লাগলাম।উজ্জ্বল শ্যামলা বরনের বলিষ্ঠ যুবক,চোখা নাক,গভীর চোখ বিশিষ্ট সুদর্শন লোকটাকে আমি আগেও দেখেছি।তবে এখন টুপুর পরে আমার সামনে স্বয়ং আমার বর বেশে থাকা পুরুষের দৃষ্টিতে নয়।
শুভদৃষ্টি,কন্যা সম্প্রদান শেষে এবার সাত পাকে বাধা পরার পালা।আমি আড়চোখে তাকালাম উনার দিকে।লোকটা গম্ভীর মুখে সামনের দিকে তাকিয়ে।আমি দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলাম।তারপর আমাদের সাত পাক পরিক্রমন সম্পন্ন হলো।এবার সেই দিব্যমুহুর্ত,সিঁদুরদান!একজন সনাতনী নারীর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্ত।
ধ্রুব আমাকে সিঁদুর পরালেন অতিযত্নে।কোন তাড়াহুড়ো নেই,বেশ সাবলীলভাবে আমার সিঁথি স্পর্শ করছিলো উনার হাত।আমি তখন চোখ খিঁচে বুঁজে রয়েছি।সিদুরের খানিকটা আমার নাকের গোড়ায় এসে পড়লো।লোকমুখে শুনেছি বর সিঁদুর পরানোর সময় নাকের মাথায় সিঁদুর পরলে নাকি স্বামী অনেক ভালোবাসে।কথাটা মনে পড়তেই আমি মনে মনে হেসে নিলাম।কেননা আমি বেশ ভালোভাবেই জানি বিয়েটা উনি কেবল একজন নারীর সম্মান রক্ষাহেতু করেছেন।
ধ্রুব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন।দাদার ক্লাসমেট ও খুব ভালো বন্ধু।শহরে মেসে থাকেন। তবে আমাদের পরিবার শহরেরই স্থায়ী বাসিন্দা।বাবা স্কুল শিক্ষক আর মা গৃহিণী।আমরা দুই ভাইবোন বেশ আধুনিকতার মাঝেই মানুষ হয়েছি।তবে আমি বেশিদুর পড়তে পারিনি।উচ্চ মাধ্যমিকের পরই বাবা বিয়ের জন্য পাত্র দেখা শুরু করেছিলেন।দাদা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষে পড়ে।আমার সদ্য বিবাহিত স্বামীও একই বর্ষে।
ভোর রাতে উনি আমার হাত ধরে ট্রেন থেকে নামলেন।আমার একহাত উনার হাতের মুঠোয়,উনার অন্যহাত দখল করে আছে আমার কাপড় আর জিনিসপত্র ভর্তি ব্যাগখানা।উনি আমাকে নিয়ে উনার গ্রামের বাড়িতে এসেছেন।ট্রেন থেকে নেমে একটা ভ্যানে করে আমরা উনার বাড়িতে এসে পৌঁছালাম।ভ্যানটা গ্রামের আঁকা-বাকা মেঠেপথ পথ পেরিয়ে একটা বিশাল জমিদার বাড়ির সামনে থামলো।ভাড়া মিটিয়ে উনি আমাকে নিয়ে ভ্যানা থেকে নামলেন।আমি তখন অবাক হয়ে উনার বাড়ি দেখছি।হাতে টান পরায় হুশ ফিরলো।দেখলাম উনি আমার হাত ধরে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করছেন।
উনি এই অসময়ে না বলে কয়ে বাড়িতে ফেরায় সকলে অনেক খুশি হলেও সেই খুশি নিমিষেই যেন ম্নান হয়ে গেল।যখন উনার হাতের ভাঁজে আমার হাত,আমার সিঁথি ভর্তি সিঁদুর আর লাল বসন সকলের নজরে আসলো।একজন প্রৌঢ়া বিস্ময় নিয়ে এগিয়ে এসে দাড়ালেন উনার সামনে।পরনের সফেদ বস্ত্র,অলংকার বিহীন কায়া বলে দিচ্ছিলেন উনি বিধবা মানুষ।আমি আন্দাজ করলাম ইনিই উনার মা।আমার সন্দেহ সত্যি হলো যখন ধ্রুব বলে উঠলেন,
“নির্বানী,মাকে প্রণাম কর।”
আমি উনার কথা শুনে তড়িঘড়ি করে প্রণাম করলাম উনার মাকে।ভদ্রমহিলা সিমেনার শাশুড়িদের মতো আমি এসব মানি না এমন মনোভাব নিয়ে পা সরিয়ে নেননি।আমি প্রনাম করার পর ধ্রুব প্রণাম করলেন।বাকিরা তখন আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখছিলো।জমিদার বাড়ি,জয়েন্ট ফ্যামিলি,মানুষের সংখ্যা অনেক।বসার ঘরে উপস্থিত সকলের নজরই ছিলো আমাের উপর।বিশেষত আমার উপর!অস্বস্তি আর লজ্জায় চুপছে যাচ্ছিলাম আমি।আমার শাশুড়ী বোধহয় সেটা বুঝলেন।ধ্রুবকে আদেশের স্বরে বলে উঠলেন,
“ওকে নিয়ে ঘরে যাও।বাকিটা পরে শুনছি।”
উনার এমন কথাতে আমি বেশ অবাক হলাম।আমার মন নাটকীয় কিছু আশা করছিলো।কিন্তু তেমন কিছু ঘটলো না।আমি আড়চোখে ধ্রুবর দিকে তাকালাম।উনার মুখশ্রী স্বাভাবিক।অর্থাৎ উনি কি ঘটবে না ঘটবে তা সবই জানতেন।
ধ্রুবদের বাড়িটা তিনতলা বিশিষ্ট।উনি আমাকে নিয়ে তিনতলার একটা কক্ষে এসে পৌঁছালেন।আমার দৃষ্টি তখন বিস্ময় নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরছিলো।এত বিশাল জমিদার বাড়ি কখনো সচক্ষে দেখার কথাও আমি ভাবিনি, সেখানে আজ আমার ভাগ্য আমাকে এমন একটা জমিদার বাড়ির বউ করে এনে দাঁড় করিয়েছে।আমি সবটা ভেবে একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম।দরজা খোলার আওয়াজে আমার ঘোর কাটে।আমি বিস্ময় নিয়েই কক্ষে প্রবেশ করি।অনেকদিন বন্ধ থাকা ভ্যাপসা একটা গন্ধ এসে নাকের গোড়ায় ঠেকছে।
কক্ষটা বেশ বড়সড়।একটা বিশাল খাটা পাতানো,তার বা পাশে বুকশেলফে সারি সারি বই সাজানো।বিছানাটার ঠিক ডান দিকেই বড় একটা জানালা।উনি গিয়ে এতদিন বদ্ধ হয়ে থাকা জানালাটা খুলে দিতেই সকালের আলো এসে পুরো কক্ষটাতে অনেকটাই আলোকিত করে ফেললো।হঠাৎ উনি মৃদুস্বরে বলে উঠলেন,
“নির্বানী?”
“হু?”
“তুমি একটু বসো।আমি মার সাথে দেখা করে আসছি।”
আমি ঘাড় কাত করে সায় দিতেই উনি বাইরে চলে গেলেন।বিশাল কক্ষটাতে তখন আমি একা।আমি ঠোঁটের কোণ কামড়ে এদিক ওদিক চোখ বুলালাম।তারপর কি মনে করে জানালা করে মাথা বের করে নিচে থাকালাম।নিচ থেকে কয়েকজোড়া চোখ এদিকেই তাকিয়ে!তৎক্ষনাৎ মাথা ভেতরে ঢুকিয়ে নিলাম আমি।আমার হৃদয় অজানা কারণে কেঁপে উঠলো।আমি গিয়ে বিছানায়র এককোণে বসলাম।
তখনি হুড়মুড় করে তিনজন রমনী ঢুকে পরলো কক্ষটাতে।আকস্মিকভাবে ঘটনাটা ঘটায় আর আমি নিচদিক তাকিয়ে নিজধ্যানে মগ্ন থাকায় চমকে উঠলাম বেশ।তাতে খিলখিলয়ে হেসে উঠলো তারা।
তাদের মাঝে গোলাপি শাড়ি আটপৌরে পরা মেয়েটা বলে উঠলো,
“ধ্রুবর বউ ভয়ও পায় দেখছি।”
সম্মোধনেই বুঝলাম মেয়েটা ধ্রুবর চেয়ে বড়।গায়ের রং কাঁচা হলদের মতো চকচকে,হাসার সময় টানা টানা আখিঁ যুগল কুঞ্চিত হচ্ছে খানিকটা।
“মাইয়ার গায়ের রঙ তো দেখি ময়লা!”
চোখ মুখ কুঁচকে নীল শাড়ি পরে থাকা মেয়েটা বলে উঠলো।আমি আশ্চর্য হয়ে থাকালাম। নিজের সম্মন্ধে এমন মন্তব্য আমি আগে শুনিনি।হঠাৎ মেয়েটার মাথায় গোলাপি শাড়ি পরা মেয়েটা চাটি মেরে বসলো।রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইশারায় শাসিয়ে উঠলো।সাথেই থাকা আরেকজন রমনী বলে উঠলো,
“তাতে কি হইছে?মাইয়ার চেহারা ম্যালা সুন্দর লাগতাছে।ধ্রুবদার লাল টুকটুকে বউ।”
মেয়েটার শেষ কথায় আমি লজ্জা পেয়ে মাথা নুয়ালাম।আমার চেহারা নিয়ে মন্তব্য করা মেয়েদুটো দেখতে সমবয়সী।বয়স ১৫-১৬ হবে মনে হয়।গোলাপি শাড়ি পরা মেয়েটা তাদের থেকে অনেকটা বড়।
হঠাৎ পায়ের শব্দ পেয়ে তিনজন চমকে উঠলো বেশ।আমি হেসে উঠলাম।আমার মৃদু হাসির শব্দ তাদের কানে পৌঁছালো কি না জানা নেই।তিনজনের চেহারায় ভীষণ ভয়!ক্ষন বাদেই ধ্রুব এসে উপস্থিত হলেন রুমে।তিনজন আড়ষ্ট হয়ে তাকালো।তারপর হঠাৎ তিনজনই দৌড়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে তাদের যাওয়া দেখলেন।তারপর সামনে ফিরে সোজা তাকালেন আমার দিকে।আমি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম।
“কিছু বলছিলো ওরা তোমায়?”
উনি জিজ্ঞেস করতেই আমি মাথা নাড়িয়ে না বললাম।ধ্রুব বলে উঠলো,
“মিথ্যে বলছো।”
চমকে উঠলাম আমি।দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ করে নিলাম বিনা বাক্যে।হঠাৎ ধ্রুব বলে উঠলো,
“শাড়ি পাল্টে নাও।ওদিকে বাথরুম আছে।”
হাতের ইশারায় বাথরুমটা আমাকে দেখিয়ে দিলেন ধ্রুব।
“এতদিনে তোমার আসার সময় হলো শহুরে বাবু?”
হঠাৎ কক্ষে এক রমনীর আগমন।সে আসতে না আসতেই এক কান্ড করে বসলো।ধ্রুবকে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো।আমি বড় বড় চোখ নিয়ে তাদের দিকে তাকালাম।মেয়েটা চোখ বুঁজে আমারই সামনে আমার বিবাহিত স্বামীকে জড়িয়ে ধরেছে।উপন্যাসে পরা একটা বাক্য তখন যেন আমার সাথেও ঘটলো,মাথার উপর আকাশ ভেঙে পরা।
মেয়েটার এই আলিঙ্গন বোধহয় ধ্রুবরও অপ্রত্যাশিত ছিল।চোখ বুঁজে একটা গাঢ় শ্বাস ফেলে মেয়েটাকে নিজ থেকে আলাদা করলেন উনি।মেয়েটার দৃষ্টি এবার আমার উপর পড়লো।আমরা একে অপরের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।আমাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে হঠাৎ মেয়েটা ধ্রুবর বুকে অচেতন হয়ে পড়লো।
চলবে?