#মম_হৃদয়_বিহারিনী
#ঐশী_রানী_রক্তিমা
৪.
“এসেছো?জানলাম তুমি না এসে পারবে না।”
কথাখান বলে আমার দিকে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো সে।পূর্নিমার চাঁদের আলোয় তার মুখশ্রী দৃশ্যমান হলো আমার কাছে।আমি শক্ত করে হারিকেন টুকু ধরে একটা ঢোক গিললাম।এই মাঝরাত্রে পুকুরপাড়ে চুল ছেড়ে অদ্ভুতভাবে বসে থাকা রমনীটি শশী।আমি ধীরে ধীরে তার পাশে এসে দাঁড়ালাম।রুদ্ধ কন্ঠে শুধালাম,
“আপনার ভয় করছে না এভাবে এখানে বসে আছেন?তাও এই রাত্রে!আশ্চর্য মানুষ আপনি!আর আমাকে এভাবে এখানে ডেকে আনার মানে কি?”
একটানা বেশ কয়েকটা প্রশ্ন করে বসলাম আমি।শশী পুকুরের জল থেকে একটা পা সিঁড়িতে তুলে নিলো।আরেকটা ওভাবেই ডুবে রইলো জলে।এবার আরেকটা বিষয় আমার চোখে বাজলো।এ বাড়ির প্রায় সকলকেই আমি আটপৌরে শাড়ি পরতে দেখলেও শশী সেই নিয়ম ভঙ্গ করে কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরা।বাহুতে থাকা স্বর্ণের বাজু চন্দ্রালোয় চকচক করে দৃষ্টি কাড়ছিল।আমি ভালো করে তাকে লক্ষ্য করতে থাকলাম এবার।প্রায় কোমড় ছুঁই ছুঁই দীঘল কেশ,দুধে-আলতা গায়ের রঙ।কানে নাকে পায়ে অলংকারের ভর্তি।চেহারা বেশ সুশ্রী!প্রথম সাক্ষাৎে হৃদয় কেঁড়ে নেওয়ার মতো।কিন্তু এমন অপরুপা রমনীকে এই মুহুর্তে ভয়াবহ লাগছিলো আমার।মনে হচ্ছিল কোন এক পিশাচিনী এমন অপরুপ চেহারা ধারণ করে আমাকে ছলনায় এখানে ডেকে এনেছে।আমার দেহে শিহরণের মাত্রা বেড়েই চলেছিলো।কিন্তু আমার ধারণা নিছক ভয়ে উৎপন্ন ভুলভাল চিন্তা ছিল।আমার সামনে বসে থাকা রমনী মনুষ্য কন্যা শশীই।
এবার শশী বোধহয় সামান্য হেসে উঠলো।আমার ঘোর কেটে গেল মুহুর্তেই।আমি হারিকেনটা পাশে রেখে ঘাটে বসলাম।পুকুরের জল থেকে দুরত্ব রেখেই,যেন আমার বস্ত্র তাদের নাগালের বাহিরে থাকে।
শশী পুকুরের জলে তার দৃষ্টি স্থির করে বলে,
“এটা নিশ্চয়ই শুনেছো যে অতিশোকে মানুষ পাথর হয়ে যায়।পাথরের আবার ভয় কিসের?”
এতটুকু বলে আমার পানে তাকালো সে।আমি তার রক্তজবার ন্যায় নেত্রখানা হারিকেনের ক্ষীণ আলো আর পূর্নিমার চাঁদের আলোয় ভালোভাবেই দেখতে পেলাম।বুঝলাম এ অতিমাত্রায় অশ্রুপাতের ফল।ভ্রু যুগল খানিক কুঁচকে সে আমায় শুধালো,
“তুমি এখানে কিভাবে আসলে?ভয় পাওয়া উচিত ছিল তোমার!”
আমি গোপন একটা শ্বাস ফেলে বললাম,
“কৌতুহল ভয়কে মৃত করে ফেলে।”
একটু থেমে আমি ফের প্রশ্ন করলাম,
“আপনি জানতেন আমি ভয় পাবো।আবার নিশ্চিতও ছিলেন আমি আসব!কিভাবে?”
সে আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।আমার গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা থেকে একটু উন্নত ছিলো।আটপৌরে শাড়ি পরিহিতা আমি,অলংকার বলতে কেবল নাকে থাকা নাকফুল সবই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো শশী।হিংসায় তার হৃদয় পুড়ছিলো বোধহয়!আমার থেকে বেশি অপরুপা হওয়ার পরেও প্রিয়জনকে পাওয়া হলো না যে তার।
একসময় তার দৃষ্টি ঘুরে এসে আমার হাতের শাখায় থামলো।আমি বুঝতে পেরে হাতটা একটু নাড়িয়ে উঠলাম।নিস্তব্ধ পরিবেশে প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই আওয়াজ হলো তাতে।পরিশেষে আমার সিঁথিতে থাকা সিঁদুরে চোখ বুলালো সে।তাতে এখনো ধ্রুবর হাতের সিঁদুরের অস্তিত্ব লেপ্টে।স্নানের সময় সেগুলো পরিপূর্ণ ধুয়ে যায়নি।
আমাকে ভালো করে লক্ষ্য করে ভেজা ঢোক গিললো শশী।হয়ত কান্নারা জ্বালাতন করছিলো।শশী আমার দিকে তাকিয়ে এবার বলে উঠলো,
“এ গ্রামের সবচেয়ে রূপবতী মেয়ে নাকি আমি।গুনবতীও!ধ্রবর মা নিজে আমাকে ওনার পুত্রবধূ রুপে বেছে নিয়েছিলেন।আমি কত খুশি ছিলাম জানো?আজ যখন শুনলাম ধ্রুব এসেছে,আমি ছুটে চলে এলাম।কিন্তু এমন কিছু দেখবো অপ্রত্যাশিত ছিল।তা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো?”
তখন যে রমনী আমার দিকে চোখ তুলে তাকাতেও দ্বিধা করছিলো সে এখন আমার সাথে বসে তার জীবনের দুঃখের আলাপ সাড়ছে।আমি ক্রমশ অবাক হচ্ছিলাম।আমি শশীর পানে তাকিয়ে বললাম,
“আপনি বুঝি খুব ভালোবাসতেন উনাকে?”
শশী সাথে সাথে উত্তর দিল,
“যতটা ভালেবাসা যায় তার থেকেও বেশি।”
“আর উনি?উনিও ততটাই ভালোবাসতেন আপনাকে?”
পর পর কয়েকটা ঢোক গিলে প্রশ্ন করলাম আমি।শশী কেমন আনমনে হয়ে গেল।আর চোখেমুখে বিষাদ ফুটে উঠছিলো।বেশ সময় নিয়ে শশী বললো,
“জানি না।কখনো জিজ্ঞেস করিনি আমি।”
“কেন?”
“ধ্রুব মিথ্যে বলে না।যদি বলতো ভালেবাসি না।সহ্য করতে পারতাম না।”
আমি থম মেরে রইলাম।রাত বাড়ছিলো!আমি এখন থেকে উঠে যাওয়ার তাড়া অনুভব করলাম।মহলে কেউ এব্যাপারে জানতে আরেক কান্ড ঘটবে।তারউপর ধ্রুব,উনি এসে যদি আমায় কক্ষে না পান তবে!আমি আর ভাবতে পারলাম না।শশীকে তাড়া দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“আপনি কোন রহস্যের কথা বলছিলেন।দ্রুত বলুন।”
“জানি না।”
শশীর মুখে এমন কথা শুনে ভ্রু যুগল আপনাআপনি কুঁচকে এলো আমার।আমি অস্ফুটস্বরে বললাম,
“জানেন না।”
“তবে এমন চিরকুট দেওয়ার মানে কী?”
“এমনটা বা বললে তুমি এখানে আসতে না।”
শশীর কথা শুনে আমি বোকা বনে রইলাম।অবাকের চরম সীমায় পৌঁছাতেই আমার ওষ্ঠদ্বয় আপনা থেকে আলগা হয়ে এলো।এইসব রহস্যের কথা শশীর অতিরঞ্জিত ছিল?
শশী জলভরা নেত্র তুলে আমার পানে তাকালো।হারিকেনের সোনালি আলোয় চিকচিক করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিলো তারা।শশী কাতর স্বরে প্রশ্ন করে উঠলো,
“সত্যিই কি তোমার সাথে ওর বহুদিনের প্রেম ছিল?ভা..ভালোবাসে সে তোমায়?”
আমি শশীর কান্ডে রুষ্ট হলাম।কেবল এই কিছু কথা বলা ও কিছু প্রশ্ন করার জন্য আমাকে এভাবে ডেকে আনলো?এতো ছলনা!
আমি বসা থেকে উঠে পড়লাম।আমার ভেতরের রাগ বাড়ছিলো।রুষ্ট স্বরে বললাম,
“আমি আপনাকে কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত নই।এই সামান্য প্রশ্নগুলো করার জন্য আপনি এভাবে আমায় তলব করলেন!ছলনা করে?”
কথাটুকু বলে আমি ঘাটে রাখা হারিকেনটা তুলে নিলাম।কক্ষে পৌঁছে যদি ধ্রুব আমায় না পায় তবে কি ভাববেন ভাবতেই আমার বুক দুরুদুরু কেঁপে উঠলো।আমি একপলক শশীর দিকে তাকিয়ে মহলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।দিবসের প্রথম প্রহর শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই।আমি কয়েক কদম হেঁটে সামনে চলে যেতেই শশী আনমনে বলে উঠলো,
“এসব তোমার জন্য সামান্য প্রশ্ন হতে পারে নির্বানী।শুধুই তোমার জন্য!”
কিন্তু দ্রুত মহলের উদ্দেশ্যে হেঁটে চলা আমার কানে শশীর এই কথা পৌঁছালো না।আমি মনে ক্ষোভ নিয়ে তখন একেকটা পদক্ষেপ ফেলছি।এখানে আসার সময় যে ভয়টা হৃদয়কে আছন্ন করে ছিলো,সেটা কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে।রাগ ভয়কে ম্নান করে দেয়!
আমি দ্রুত মহলে পৌঁছে কক্ষে ভয়ে ভয়ে এসে উপস্থিত হলাম।কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ধ্রুব তখনি কক্ষ ছিল না।এতে আমার স্বস্তি ও চিন্তা মিশ্রিত মিশ্র অনুভূতি হলো।এভাবেই সেদিন সকাল হলো।
.
সকাল হতে না হতেই আমার তলব করলেন ধ্রুবর মা অর্থাৎ আমার শাশুড়ী।আমি বাড়িতে প্রায় সবসময় খোলা চুলে থাকলাম।তাই আজকেও সেভাবেই মুক্ত কেশে দুরুদুরু মনে উপস্থিত হলাম উনার কক্ষে।আমি উনার কক্ষে প্রবেশের পূর্বে উনার অনুমতি নিয়ে নিলাম।ধ্রুবর মার কক্ষটি ছিল নিচতলায়।আমি যখন সেখানে যাচ্ছিলাম বাড়ির লোকেদের তির্যক দৃষ্টি বর্ষিত হচ্ছি আমার উপর।শাশুড়ীর কক্ষে পৌঁছে আমি মৃদুস্বরে বললাম,
“আমায় ডেকেছিলেন?”
ঘরের কিছু টুকটাক কাজ করছিলেন উনি।আমার কথায় মাথা তুলে চাইলেন আমার পানে।ভ্রুটা একটু কুঁচকালেন।তারপর হাতের অবশিষ্ট কাজটা করতে করতে বললেন,
“বাড়ির বউদের এভাবে চুল ছেড়ে,মাথায় ঘোমটা না দিয়ে থাকতে নেই।”
আমি তড়িঘড়ি করে হাত খোঁপা করে মাথায় ঘোমটা দিলাম।আমি ছিলাম দরজায় দাঁড়িয়ে,উনি ভেতরে আসতে বললে ধীর পায়ে ভেতরে প্রবেশ করি আমি।এবার নরম কন্ঠে তিনি আমাকে শুধালেন,
“ধ্রুব কোথায়?”
মাথা নুয়ালাম আমি।আমার জানা ছিল না।আমাকে একবার দেখে উনি নিজেই বললেন,
“শহরে গেছে ও।পরীক্ষা আরম্ভ হবে আজকে থেকে তাই।”
এবার আমার খেয়ালে আসলো দাদা বলেছিলো আমার বিয়ের পরে পরেই তার পরীক্ষা।হঠাৎ আমার মনকোণে অভিমানের মতো কিছু একটা অনুভূতি অনুভব করলাম।ধ্রুব শহরে যাচ্ছেন এটা আমাকে বলে যেতে পারতেন না?
নিজেকে কেমন আগাছা মনে হলো।আমার নুয়ানো মাথা আরো নত হলো যখন ধ্রুবর মা বললেন,
“ধ্রুব আমাকে বলেছে তোমাদের বিয়েটা কিভাবে হয়েছে।”
উনার কথা শেষ হতে না হতেই বিচলিত একটা কন্ঠস্বর আমাদের দুজনের কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো,
“জেঠী মা,শশী পুকুরে ঝাপ দিয়েছে।”
তৎক্ষনাৎ আমার শাশুড়ীর চোখেমুখে ভয় ফুটে উঠলো।তিনি বলে উঠলেন,
“সেকি বলছো!শশী তো সাঁতার জানে না!”
চলবে….