মম হৃদয় বিহারিনী পর্ব-০৫

0
1

#মম_হৃদয়_বিহারিনী
#ঐশী_রানী_রক্তিমা
৫.
সাঁতার না জানা সত্বেও শশী পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে যে আত্নহত্যার প্রচেষ্টা করছে সেটা বোধগম্য হতেই আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।সাঁতার জানে না অথচ কাল রাতে মেয়েটা কি সাচ্ছন্দ্যে জলে পা ডুবিয়ে ছিল!ধ্রুবর মা ততক্ষণে কক্ষ থেকে বেরিয়ে মহলের উঠোনের দিকে গিয়েছেন।আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।ঘোর কাটতেই দৌড় লাগালাম।

শশীকে এ বাড়ির উঠোনে আনা হয়েছে।মহলের পশ্চিম দিকের পুকুরেই ঝাপ দিয়েছে সে।কাল রাতে আঁধারে ঠিকমতো বোঝা যায়নি পুকুরটির গভীরতা।তবে উপস্থিত লোকেদের কথাবার্তায় বুঝলাম পুকুরটি অনেকটাই গভীর।বাড়ির একজন পরিচালিকা পুকুর থেকে জল আনতে গিয়ে শশীকে জল খেয়ে ডুবে যাওয়া অবস্থায় দেখে।তারপর সেই চেঁচিয়ে লোক জোগাড় করে শশীকে উদ্ধার করে।

উঠোনে ছনের পাটি বিছিয়ে তাতে শশীকে শোয়ানো হয়েছে।ভিজে যাওয়ায় পরনের বস্ত্র আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে আছে দেহের সাথে।শরীরের ভাজ দৃশ্যমান।তাকে ঘিরে রয়েছে অনেকজন লোক।ধ্রুবর মা বাড়ির উঠোনে নামেন নি।মহলের সদর দরজায় দাড়িয়েই করুন চোখে তাকিয়ে আছেন ভীড়ের দিকে।এ বাড়ির কোন মেয়ে-বউই ভীড়ের মাঝে গিয়ে শশীকে দেখছে না।পুরুষ বলতে এ বাড়িতে রয়েছেন ধ্রুবর কাকামশাই, আর কয়েকজন চাকর।চাকরগুলো গ্রামের লোকেদের ভীড় সরে দাঁড়াতে বলছে।কিন্তু চাকরদের কথা শুনে কজন?

হঠাৎ আমি এক আশ্চর্য কাজ করে বসলাম।আমি ভীড় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলাম।আমার হৃদয় প্রচন্ড বিচলিত ছিল।সেই সাথে একটা অপরাধবোধের প্রাচীরও গ্রাস করে ছিল আমার মনকে।আমি তড়িঘড়ি করে শশীর হাতটা নিয়ে নাড়ি পরীক্ষা করে দেখলাম।ভীড়ের সকলের দৃষ্টি ছিল তখন আমার উপর।রাঙা শাড়ি পরনে মেয়েটি কে কেউ কেউ ধারণা করেছিল।কেননা ইতিমধ্যেই একথা প্রায় সারা গায়েই ছড়িয়ে গিয়েছিল যে জমিদার বাড়ির উত্তরাধিকারী ধ্রুব দেবনাথ শহর থেকে বিয়ে করে এনেছে।

আমি অস্থির চিত্তে শশীর নাড়ি পরিক্ষা করছি।আমার হৃৎস্পন্দন তখন মাত্রা ছাড়িয়েছে।দৌড়ে আসার দরুন মাথার ঘোমটা কখন পরে গেছে খেয়াল নেই।সেই সাথে খুলে গেছে হাত খোঁপাও।আমি তখন জনসম্মুখে উন্মুক্ত কেশে,মাথায় ঘোমটা বিহীন ধরা দিয়েছি।দৃশ্যটা আমার শশুরবাড়ির লোকের কাছে খুবই দৃষ্টিকটু দৃশ্যমান হলো।আমার শাশুড়ী থমথমে মুখশ্রীতে মাথার ঘোমটা ধরে আছেন।
আমি শশীর নাড়ি পরীক্ষা করে দেহে প্রাণ ফিরে পেলাম।ততক্ষণে চাকররা লোকেদের মারের ভয় দেখিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছে।আমি উঠে দাড়িয়ে আমার শাশুড়ীর সম্মুখে গিয়ে বললাম,

“শশী জীবিত আছে।দ্রুত বৈদ্যকে ডাকুন।”

তৎক্ষণাৎ বৈদ্যকে তলব করা হলো।শশীর পেট থেকে পানি বের করতেই কেশে উঠলো সে।ততক্ষণে যেন এ বাড়ির লোকেদের দেহে প্রাণের সঞ্চার হলো।আর আমি এটাও বুঝলাম বৈদ্য তারা আমার কথা শুনে ডাকেনি!তাদের বৈদ্য ডাকার নিয়ত ছিল আগেভাগেই।
শশীর এই অবস্থা শুনে কাঁদতে কাঁদতে এখানে উপস্থিত হয়েছেন শশীর মা।কাল রাত থেকে শশীকে বাড়িতে মা দেখে ওনারা দুঃশ্চিতায় ছিলেন এমনিতেই।তার উপর মেয়ের এমন কাজ!শশীর মা প্রায় মূর্ছা যাওয়ার পর্যায়ে।
ধ্রুবর মা ওনাকে সান্ত্বনা দিলেন যে ওনার মেয়ের কিছু হয়নি।আমি ভয়ে ছিলাম!মহিলা আমাকে দেখে আবার দুর্ব্যবহার না করে বসেন।

শশীকে ঘিরে যখন সকলে দুঃশ্চিন্তায় মগ্ন আমি তখন ধীরে ধীরে সেখান থেকে সরে আসলাম।সিঁড়ি বেয়ে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে তিনতলার বদলে দোতলায় চলে আসলাম আমি।তখনও আমার খেয়ালে আসলো না কিছু।আমি দোতলার শেষের কক্ষটায় পৌঁছে ভেতরে ঢুকতেই অবাক হলাম।কক্ষটার বিন্যাস ছিল আলাদা।আমি পুরো কক্ষে চোখ বুলালাম।আমার দৃষ্টি আটকালো আরশির সামনে শৃঙ্গার রত রাইকে দেখে।আমার পায়ের শব্দ পেয়ে ঘুরে তাকিয়েছে রাই।আমাকে দেখে তার ওষ্ঠকোণে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।কিন্তু আমি ছিলাম ভ্রু কুঁচকে।এত কিছু ঘটে গেল অথচ রাই তার কক্ষে বসে সাজগোছ করছে!
আমাকে হঠাৎ নিজের কক্ষে দেখে রাই বলে উঠলো,

“আরে তুমি যে!হঠাৎ কি মনে করে এখানে?”

আমি ভুল করে এখানে এসে পড়ার বিষয়টা চেপে গেলাম।গম্ভীর স্বরে শুধালাম,

“আপনি এখানে নিশ্চিতে বসে আছেন?নিচে শশীর কি অবস্থা জানেন না?”
আমার কথা শুনে অদ্ভুতভাবে শশীর হাসি একটু প্রসারিত হলো।আমার প্রশ্নের উত্তর ছিল ধনাত্মক।অর্থাৎ সে জানে শশী আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।কিন্তু এটা জানার পরেও তাকে নিজ কক্ষে এভাবে সাজগোজে মগ্ন অবস্থায় পেয়ে আমি চরম বিস্মিত হলাম।অবাক কন্ঠে শুধালাম,

“জানেন!অথচ এখানে নিশ্চিতে বসে আছেন!”

রাই একটু আলতা বাটিতে ঢেলে নিয়ে তাতে তুলি ভেজাতে ভেজাতে স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো,

“হ্যা।”

আমার বিস্ময়ের মাত্রা বাড়লো।রাই আপন মনে পায়ে আলতা পরছে।অতিযত্নে পদযুগল রাঙিয়ে তুলতে তুলতে বললো,

“আমার কথা তোমাকে খুব অবাক করছে তাইতো?শশী পুকুরে পরে আত্মহত্যার চেষ্টা করলো আর তার প্রাক্তন সহপাঠী হয়ে আমি নিজ কক্ষে চুপচাপ বসে আছি।”

কথাটুকু বলে থামলো রাই।হতবিহ্বল হয়ে থাকা আমার দিকে দেখলো একনজর।হঠাৎ সামনের দর্পনে নিজের প্রতিবিম্ব দেখলাম আমি।উন্মুক্ত কেশ ঘোমটা বিহীন নিজেকে দেখে থমকালাম আমি।এতক্ষণে ধ্রুবর মার অসন্তুষ্ট মুখশ্রীর কারণ বোধগম্য হলো।আমি দ্রুত চুলগুলো হাত খোঁপা করে নিলাম।রাই বলে উঠলো,

“খোলা চুলে তোমাকে আরো সুন্দর লাগে।চুলগুলো ছাড়াই থাক।”

রাইয়ের কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আমি মাথায় ঘোমটা টেনে দিলাম।রাই সেটা দেখে মুচকি হাসলো।

“আমি সবকিছু শোনার অপেক্ষায় আছি।”

কথাটা শেষ করে আমি রাইয়ের দিকে মনোযোগ দিলাম।রাই বিধবাদের প্রচলিত প্রথা না মেনে অঙ্গে রঙিন বস্ত্র জড়িয়েছে।শশী,যে তার সহপাঠী ও বন্ধু ছিল,তার এমন অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়ার পরেও এখানে দিব্যি নিশ্চিন্তে বসে আছে।এই স্বল্প পরিচিতা রমনীকে আগাগোড়া রহস্যময় মনে হলো।আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম এই আশায় যে সে কিছু বলবে।আমার প্রতিক্ষা সমাপ্ত করে রাই বললো,

“শশী খুবই অধিকারপরায়ণ একজন মেয়ে।অধিকারপরায়ণ মানে বোঝ?”

প্রশ্নটুকু করে একটু থামলো রাই।তারপর আবার আমার উত্তর না শুনেই নিজে নিজেই বলে উঠলো,

“যদি কেউ খুব বেশি নিজের করে রাখতে চায় বা  অন্যের উপর দখল রাখতে চায় তখন তাকে বলে
অধিকার-পরায়ণ।শশী মানুষটা এমন ছিল,আছে।কাউকে নিজের মনে করলে সে ব্যতিত আর কাউকে তার পাশে সহ্য করতে পারতো না।হোক সেটা বন্ধুত্ব কিংবা.. ভালোবাসা।তখন আমরা ক্লাস নাইনে পড়ছি।ধ্রুবর সাথে ছিল শশীর তীব্র বন্ধুত্ব।আমি সে সময়ই বুঝেছিলাম ধ্রুবর প্রতি শশীর অনুভূতি বন্ধুত্বে সীমাবদ্ধ নেই।সেই সীমা লঙ্ঘন করে শশী ধ্রুবকে প্রেমিকের নজরে দেখা শুরু করেছে।কিন্তু ধ্রুবর দৃষ্টিতে কিংবা মনে এমন কিছু ছিল না।সে শশীকে কেবল বন্ধুই মনে করতো।ধ্রুব আর শশীর আরেকজন বন্ধু ছিল,সেটা হলাম আমি।শশীর আমার প্রতি একটা চাপা ক্ষোভ ছিল।যদিও আমি আর ধ্রুব ছিলাম ভাইবোন।শশী সেটা বুঝতো না। বোন হিসেবে ধ্রুবর থেকে একটু বেশি গুরুত্ব পেতাম আমি।আমার বিপদে আপদে এগিয়ে আসতো ধ্রুব।এটা শশীর চোখে বাজতো।ওর আর একটা হিংসে কাজ করতো আমার উপর।আমি এই বাড়িতে থেকে ধ্রুবর পাশাপাশি থাকছি,আমাদের বন্ধুত্ব গাঢ় হচ্ছে।এতে শশী হিংসেই মরতো।”

এতটুকু বলে রাই থেমে গেল।সেই সাথে থামলো সন্তপর্ণে আলতা আঁকা হাতদুটোও।আমি ততক্ষণে রাইয়ের পাশে বসে গেছি কাহিনি শোনার জন্য।মিষ্ঠভাষী,হাস্যজ্জ্বল,রুপন্তি মেয়েটা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল।তীক্ষ্ণ হয়ে এলো দৃষ্টি।আমি অবাক হয়ে তাকে অবলোকন করছিলাম।একটা গাঢ় দীর্ঘশ্বাস নির্গত হলে রাইয়ের ভেতর থেকে।তারপর হাতের তুলিটা আবার আলতায় ডুবিয়ে পায়ে মাখতে মাখতে বললো,

“একদিন স্কুল থেকে এসে শুনি আমার জন্য প্রস্তাব এসেছে।আমি বাড়ি আসা মাত্রই আমাকে শাড়ি-টারি পড়িয়ে নেওয়া হলো পাত্রপক্ষের সামনে।পাত্র ছিল মধ্যবয়স্ক লোক।মাথার চুলে পাক ধরা শুরু করেছে ইতোমধ্যেই।ওনারা আমাকে পছন্দ করলেন।আমি রাগ করে ঘরে এসে শাড়ি খুলে ফেললাম।জেত ধরলাম বিয়ে করবো না বলে।হঠাৎ একটা শক্ত হাতের চড় পরলো আমার গালে।চড়টা মা ই মেরেছিলো।মামি মা এসে থামালেন নয়ত আরো ছিল কপালে।মা হঠাৎ বেশ রাগী কন্ঠে বলে উঠলেন,

” বিয়ে করবি না?তাহলে কি রঙ্গ করে করে পাড়ায় আমার নাম নষ্ট করবি।লোকে তোর নামে কি কি বলছে সেখবর আছে?কোন কথা শুনবো না আমি এই লোকের সাথেই তোর বিয়ে হবে অতিশীঘ্র।”

আমি সেদিন বুঝলাম না আমার দোষটা কোথায়।কি বলাবলি করছে লোকে আমার নামে।কিন্তু আমি বিয়েতে মত না দেওয়াই মায়ের আচরণ খারাপ হতে লাগলো।মা ছিলেন বিধবা মানুষ।সন্তান বলতে এক আমিই ছিলাম।তাও আবার মেয়ে মানুষ!দাদার বাড়িতে বিধবা হয়ে মেয়ে নিয়ে পরে আছেন।মামী মা কিছু না বললেও বলার লোকের অভাব ছিল না।আমি ধ্রুবকে বললাম আমি বিয়ে করব না।সেও চেষ্টা করলো বিয়েটা ঠেকানোর।কিন্তু হলো না।ছোট ছিল বলে তার কথাও কেউ শুনলো না।জোর করে বিয়ে দেওয়া হলো আমাকে।আমার বিয়ের দিন ব্যর্থতায় ধ্রুবর মুখের হাল খারাপ হলেও শশী সেজেগুজে বিয়েতে এসেছিল।মুখে ছিল বিরাট বড় হাসি।হঠাৎ আমি বিয়ের আসরে থাকতে সে বাঁকা একটা হাসি দিল আমাকে দেখে।সেদিন তার প্ররোচনা আন্দাজ করেছিলাম সামান্য।তবে বিয়ের পরে আসল সত্য কানে আসলো।শশী মায়ের কান ভাঙিয়ে এসব করেছিলো।গায়েও আমার নামে কিছু মিথ্যে বদনাম ছড়িয়েছিল। ”

কথাগুলো শেষ করে আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো রাই।আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম।মেয়েটার কথায় বেদনা ঝরে ঝরে পড়ছিলো।শশীর প্রতি ছিল রাইয়ের চাপা রাগ।এতটাই বেশি এর মাত্রা যে শশীর মৃত্যুর খবর শুনলেও বোধহয় সে নিশ্চিতেই থাকতো!

শশী যে কতটা অধিকার পরায়ণ স্বভাবের ছিল সেটা আমি প্রথমে না বুঝলেও পরে বুঝেছিলাম।রাইয়ের বলা প্রতিটি বাক্য মন থেকে শুদ্ধ বলে মেনে নিলাম আমি।কেন যেন মেয়েটাকে আমার বড্ড ভালো লেগে গেল।বিধবা হওয়ার পরেও কুমারীর ন্যায় জীবনযাপন করার সাহস পেল এই গল্প কবে বলবে সেই অপেক্ষায় রইলাম।
নিজ কক্ষে চলে আসলাম আমি।অবসন্ন,অস্থির চিত্ত নিয়ে।আমার দুপুরের খাবার কক্ষে দিয়ে যাওয়া হয়।কিন্তু আজ আমি দ্রুত স্নান ছেড়ে বসার ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

বসার ঘরে আমার দর্শন পেয়ে অনেকেই অবাক হয়েছিল।আমি তাদের অবাকের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে তাদের সাথে মেঝেতে বসে গেলাম আহারের জন্য।সবার দৃষ্টি ঘুরেফিরে আমার উপর নিবদ্ধ হচ্ছিলো।আমি চুপচাপ বসে ছিলাম।অনেকের চোখে ছিল তীব্র রাগ।কারণটা আন্দাজ করাই যাই।শশীর এমন সিদ্ধান্তের জন্য সমস্ত দোষ আমার উপর চাপানো আর তারপর?রক্তচক্ষু বর্ষন!
এ বাড়ির লোক ঠিক কতজন তা আমি জানতাম না তখন।চোখ বুলিয়ে যে সংখ্যাটা বের করবো সেই উপায়ও ছিল না।আড়ষ্টতাই কাটেনি খুব একটা।
আমাকে বসার ঘরে সকলের সাথে দেখে খুশি হলেন দুজন ব্যাক্তি।এক আমার শাশুড়ী, আরেকজন রাই।
আমার শাশুড়ী খুশিমনে সকলের সামনেই বললেন,

“ধীরে ধীরে এ বাড়িতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছো দেখে ভালো লাগলো।”

আমি আগেই ধারণা করেছিলাম ধ্রুবর মা শিক্ষিতা কিংবা অল্প শিক্ষিতা হবেন।কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম না।আবার ওনাকেও সেভাবে জিজ্ঞেস করা যায় না।তাই এই কৌতুহল মনেই চেপে রাখলাম।কৌতুহল হওয়ার কারণও ছিল কেননা এখানের কেউই এভাবে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন না।
.
এক সপ্তাহের ন্যায় কেটে গেল।নিয়মমাফিক সকালে সূর্য উঠে আবার বিকালের শেষে অস্ত যায়।আমি ধীরে ধীরে নিজ কক্ষ অর্থাৎ ধ্রুবর সূত্রে পাওয়া কক্ষ থেকে বেরিয়ে মহলে বিচরণ করতে লাগলাম।বাড়ির লোকেদের তীর্যক দৃষ্টিও ধীরে ধীরে সয়ে আসতে শুরু করলো।নাকি তারা সেভাবে তাকানো বন্ধ করে দিয়েছিল বুঝতে বেগ পেতে হলো।অনেকগুলো পরিচিত মুখ থাকলেও আমি ভালো করে চিনতাম তিন-চার জনকে।ধ্রুবর বাবা অর্থাৎ আমার স্বর্গীয় শশুর মশাইরা তিন ভাই ছিলেন।শশুর মশাই ছিলেন সবার বড়।তাই জমিদারিটা উনিই পেয়েছেন।এখন ওনার সূত্রে পাবে ধ্রুব।একমাঝে সবার ছোট যে ভাই তিনি মারা গিয়েছেন কিছু বছর পূর্বে।যেদিন প্রথম এ বাড়িতে আসলাম,রাইয়ের সাথে যে দুজন অল্পবয়স্কা রমনী আমাকে দেখতে এসেছিল ওনার মেয়ে তারা।জীবিত আছেন শুধু ধ্রুবর মেজ কাকা।উনার একজন পুত্র যে ধ্রুবর মতোই শহরে পড়তে গিয়েছে সেটা আমার অজানা ছিল।আপাতত জমিদারি দেখফাল করছেন মেজ কাকা মশাই।
বিয়ের সপ্তাহ খানিকের মধ্যে মা-বাবার সাথে কথা হয়নি।বাড়ির কথা মনে পরছিলো খুব।বিশেষ করে মার কথা।বিকেল হলেই আমার লম্বা চুলে তেল দিতে বসে যেতেন তিনি।বেশ যত্ন করে তেল দিয়ে দিতেন চুলে।আমি তো এ কদিন কোনরকম তেল দিয়েছি মাথায়।ওসব ধৈর্যের কাজ আমার দ্বারা হয় না।আজ মায়ের কথা খুব মনে পড়ায় কি মনে করে ধ্রুবর মায়ের ঘরে উঁকি দিলাম আমি।মেয়েদের বিয়ের পরে শাশুড়ীই নাকি মায়ের স্থান দখল করে!

আমি কিছু না বলে উঁকি-ঝুকি মারছিলাম শুধু।ভদ্রমহিলা আজকাল বেশ গম্ভীর রুপ বজায় রেখে চলছেন তাই সাহস পাচ্ছিলাম না কথা বলার।
উনি কক্ষে বসে সুপারি কাটছিলেন।হঠাৎ ভ্রু কুঁচকে দরজার পানে তাকালেন।আজকে উনার অভিযোগের সুযোগ রাখিনি আমি।মাঝখানে সিঁথি করে চুলটা সুন্দর করে খোঁপা করে নিয়েছি।সিঁথিতে লেপ্টানো লাল টকটকে সিঁদুর।মাথায় ঘোমটা থাকার ফলে অর্ধেকটাই ঢেকে আছে।
আমাকে পরখ করে উনি মৃদুস্বরে বললেন,

“এসো!”

আমি অনুমতি পেয়ে ওনার সামনে গেলাম।সুপারি কাটায় মনোযোগ দিয়ে তিনি শুধালেন,

“কিছু বলবে।”

কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না আমি।চুপ করে রইলাম।শাশুড়ী নিজ থেকেই বললেন,

“বাড়ির কথা মনে পড়ছে?”

কথাখান বলে আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন তিনি।মনের কথাটা এভাবে উনি বুঝে যাবেন ভাবিনি।আমি নিঃশব্দে মাথা উপর নিচ করলাম।

“ধ্রুব আসলে বাড়িতে ঘুরে এসো।”

আমি তৎক্ষনাৎ প্রশ্ন করে বসলাম,

“কবে আসবেন উনি?”

আমার কৌতুহল ভরা কন্ঠশুনে আমায় দেখলেন ধ্রুবর মা।আমি কাচুমাচু করে উঠলাম।উনি বললেন,

“আসলেই দেখতে পাবে।”

বুঝলাম ছেলে মায়ের বৈশিষ্ট্য ভালোভাবেই পেয়েছে।প্রশ্নের উত্তর জানা সত্ত্বেও তা পরিষ্কার করে না বলে দিয়ে মানুষের মনে কৌতুহল রেখে দিতে ভালেবাসে দুজনে।আমি কিছু না বলে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলাম।পরখ করলাম শাশুড়ীকে।উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণা গায়ের রঙ ওনার।সেই দেহে শুভ্র থান বিধবার চিহ্ন বহন করছে। ঠিক কত বছর ধরে?প্রশ্নটা আমার মাথায় খেলে গেল হঠাৎ।আমি রাখঢাক ভুলে প্রশ্ন করেই ফেললাম।

“একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে উনি বললেন,

“কর।”

“উনি কবে গত হয়েছেন?”

সুপারি কাটতে থাকা হস্তখানা থেমে গেল সহসা।একটু সময় নিয়ে উত্তর দিলেন,

“তোমার পতি ছোট থাকতেই।”

বুঝলাম অনেকবছর যাবত এই শুভ্র থান ওনার সঙ্গী হয়ে আছে।হঠাৎ একজন পরিচালিকা এসে দাড়ালো দরজায়।প্রসন্ন মনে শুভ শুভ একটা সংবাদ দিলো,

“ধ্রুব সাহেব শহর থেকে ফিরেছেন,মা ঠাকরুন!

চলবে…