মম হৃদয় বিহারিনী পর্ব-০৭

0
1

#মম_হৃদয়_বিহারিনী
#ঐশী_রানী_রক্তিমা
৭.
“কি সমস্যা?আমার দিকে তাকাতে এত সংকোচ!”

ধ্রুবর কথা শুনে আমি চুপ করে রইলাম।উনি উত্তরের আশায় আমার পানে চেয়ে।ওনাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমি মাথার ঘোমটা টা একটু টেনে দিলাম।তারপর মৃদুস্বরে বললাম,

“কি সমস্যা হবে?কোন সমস্যা নেই।আপনার পরীক্ষা কেমন হলো?”

আমার কথায় উনার মুখশ্রী গম্ভীর হয়ে এলো।জানালা দিয়ে আসা পবনে হালকা উড়ল ওনার চুল।রেশমি ঝরঝরে চুল উনার।আমি গাঢ় চোখে দেখলাম তা।হঠাৎ নুপুরের ঝুনঝুন আওয়াজে পলক পড়লো আমার।ধ্রুব নুপুরটার দিকে ইশারা করে বললেন,

“পছন্দ হয়নি?”

“হয়েছে।কিন্তু এসবের কি দরকার ছিল?”

মৃদু আওয়াজে বলে উঠলাম আমি।হঠাৎ অনুভব করলাম একটু আগে শুভ নামের লোকটার সাথে কথা বলার ধরন আর এখন ধ্রুবর সাথে আমার কথা বলার ধরন সম্পূর্ণ আলাদা!শুভর সামনে আমি মোটেও সাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলাম না।কিন্তু ধ্রুব!উনি কাছাকাছি থাকলে নিজেকে প্রচন্ড নিরাপদ মনে হয়।যেন কোন অপশব্দ,অপমান আমাকে ছুঁতেও পারবে না।
নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আমি ওনার পানে চাইলাম।দেখলাম ওনার দৃষ্টি আমার উপর বিচরণ করছে।

আমি বিছানার একপ্রান্তে বসে আর উনি অপর প্রান্তে দাড়িয়ে ছিলেন।হঠাৎ ওপাশ থেকে ঘুরে আমার কাছাকাছি এসে দাঁড়ালেন উনি।আচমকা নিচে বসে পরলেন হাঁটু গেড়ে।আমি বড়বড় চোখে তাকালাম।তার চেয়েও আরেকটা আশ্চর্যের কাজ করে বসলেন উনি।আমি বিস্ময়ের সাগরে ডুবলাম।
আমার একটা পা নিজের হাঁটুর উপর নিয়েছেন উনি।আমি চমকে দ্রুত পা সরিয়ে নিলাম।আঁটকে উঠে বললাম,

“এটা কি করছেন আপনি?পাগল হয়েছেন?আমার পা স্পর্শ করছেন কেন?”

এবার ওনার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এসে পরলো আমার উপর।কালো ভ্রুযুগলে ঘেরা কৃষ্ণকায় গভীর চক্ষু ওনার।আমি ঢোক গিলে উঠলাম।ধ্রুব খানিক শক্ত কন্ঠে বললেন,

“তোমার পা স্পর্শ করলে পাপ হবে?”

আমি উত্তর দিতে পারলাম না।ধ্রুব কিছু না বলে আমার পা পুনরায় ওনার হাঁটুর উপর রাখলেন।আমার বুকের নিপীড়ন পুনরায় আরম্ভ হয়ে গেল।উনি ধীরে ধীরে অতিযত্নে আমার পায়ে নুপুর জোড়া পরিয়ে দিতে দিতে বললেন,

“এসবের কি দরকার বলছো?আমি তো দেখছি আরো অনেক কিছুর দরকার।”

আমি ওনার কথার ইঙ্গিত বুঝলাম না।ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলাম।উনি শান্ত চোখ তুলে আমার পানে তাকালেন।হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়লো কেউ।ধ্রুব আওয়াজ দিয়ে বললেন,

“কে?”

পরিচারিকার আওয়াজ ভেসে আসলো,

“মা ঠাকুরুন ডেকেছে আপনাকে।
আসুন,খাওয়া-দাওয়া করবেন দাদাবাবু।”

“আপনি যান।আমি আসছি।”

পরিচারিকা চলে যাওয়ার শব্দ আসলো।তা বিলীন হয়ে যেতেই আমি ধ্রুবকে জিজ্ঞেস করলাম,

“আপনার কথা আমার বোধগম্য হলো না।”

ধ্রুব একপলক আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

“নাকফুল ব্যতিত কোন অলংকার দেখছি না তোমার পরনে।তাই বললাম আরো অনেককিছুর প্রয়োজন।এ বাড়ির সকলেই বড় সাজগোছ করে থাকে।সেক্ষেত্রে তুমি খুব সাধারণভাবে আছো!”

“এত সাজগোছ আমার পছন্দ নয়।”

আমার কথা শুনে উনি কিছু বললেন না।শান্তস্বরে বললেন,

“মা ডাকছেন।আমি দেখে আসি।”

আমি ঘাড় কাত করে ঠিক আছে বোঝালাম।আমার সম্মতি পেয়ে উনি প্রস্থান করলেন।উনি চলে যেতেই আমি পায়ের নুপুরের দিকে নজর দিলাম।ঠোঁট ফুড়ে অকৃত্রিম এক হাসির আভা ছড়িয়ে পড়লো ওষ্ঠজুড়ে।বিকালের সোনালি আলো নুপুরের উপর পরতেই চিকচিক করে উঠলো তারা।আমি বাচ্চাদের মতো পা দুটো দুলিয়ে উঠলাম।
.
গোধূলি পেরিয়ে সন্ধ্যালগ্ন আরম্ভ হতেই সবটুকু আলো নিশ্চিহ্ন হয়ে ঘোর আঁধারে ঢেকে গেল প্রকৃতি।ঘরে ঘরপ জ্বলে উঠলো কৃত্রিম আলো।গ্রামে রাতের বেলা সবথেকে বেশি আলোকিত থাকে জমিদার বাড়ি।জমিদার বাড়ি বলে কথা।সন্ধ্যা হতেই ঠাকুরঘরে সন্ধ্যাপূজো শুরু হয়ে গেল।সন্ধ্যাপূজো করেন ধ্রুবর পা পার্বতী দেবী।আমি সাধারণত এই সময়টায় কক্ষে চুপচাপ বসে থাকি।প্রদীপ,হারিকেনের আলো মিলে প্রায় আলোকিত হয়ে উঠে ধ্রুবর বিশাল কক্ষখানা।তবে বহু প্রদীপের প্রয়োজন হয় এতে।দু-দুটো হারিকেন এই ঘরে।বাড়ির অন্য কক্ষগুলো এতটা বড় বলে মনে হয় না।

আজ কি মনে করে সন্ধ্যা বেলায় বসার ঘরে এসে উপস্থিত হলাম আমি।এখন এখানে কেউ নেই।সকলে হয়ত নিজ নিজ কক্ষে অথবা রান্নাঘরে।আমি সদর দরজা পেরিয়ে বাইরে বেরুলাম।বাইরে বেশ অন্ধকার!
উঠোনের ডানদিকে মন্দিরে আমার শাশুড়ী পূজো করছেন।আমি চপল পায়ে সেদিকে ছুটলাম।নুপুরের আওয়াজ ছন্দ তুললো তাতে।আমার উদ্দেশ্য ছিল চুপচাপ মন্দিরে গিয়ে ধ্রুবর মার পূজোটা দেখা।বাড়িতে থাকলে সন্ধ্যাপূজোয় মা পাশে বসে থাকতাম আমি।কিন্তু এ বাড়িতে আসার পর সেটা হয়ে উঠেনি।
চুপচাপ উপস্থিত হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও আমার পায়ে থাকা নুপুর তা হতে দিলো না।ঝনঝনিয়ে বেজে উঠে আমাড অস্তিত্ব বুঝিয়ে দিলো।শাশুড়ী মার সাথে ছোট কাকামশাইয়ের মেয়ে দুজন বসে ছিল।আওয়াজে ওরা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলো।আমি ইতস্তত করে উঠলাম।তবে আশ্চর্যজনকভাবে একটু সরে ওরা বসার জায়গা করে দিলো আমাকে।
পাঁচ মিনিট পরে পূজো শেষ হতেই আমার দিকে ফিরে তাকালেন ধ্রুবর মা।ওনার দৃষ্টি ছিল বেশ স্বাভাবিক।পুজো শেষে আমি বেরিয়ে আসলাম।দোতলায় পৌঁছাতেই একটা ছায়া মুর্তি আচমকা পথ আগলে দাঁড়ালো আমার।থমকে দাঁড়ালাম আমি।আবছা আলোয় তাকাতেই দেখলাম লোকটা শুভ।আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে বুকে হাত গুঁজে তাকিয়ে।সে দেওয়ালে হাত দিতে দিতে আমাকে প্রশ্ন করলো,

“ঘটনা কি বলুন তো বৌদি মনি?দাদা হঠাৎ তোমাকে বিয়ে করলো কেন?”

তার প্রশ্ন শুনে আমি কোন উত্তর না দিয়েই শুভকে পাশ কাটিয়ে চলে এলাম।লোকটার কথাবার্তায় কেমন একটা ঠোঁটকাটা স্বভাবের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়।আমি নিজ কক্ষে পৌঁছাতেই থমকে দাড়ালাম।বিছানায় বসে আছেন ধ্রুব।আবছা লালটে আলোয় উনার মাথার চুল চকচকে করছে।পরনে ধুতি আর পাঞ্জাবি।সেই বিয়ের দিনকার মতো সুদর্শন,সুপুরুষ লাগছে উনাকে।
নুপুরের আওয়াজ পেয়ে চোখ তুলে তাকান উনি।উনার হাতে একটা মোটা বই।আমি মৃদু পায়ে ভেতরে প্রবেশ করে।আমাকে দেখে উনি প্রশ্ন করেন,

“কোথায় গিয়েছিলে?”

আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম,

“মা..মার কাছে।”

ধ্রুবর মাকে এর আগে মা বলে সম্মোধন করিনি আমি।উনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,

“এ বাড়ির কেউ কিছু বলেছে তোমায়?কোন বাজে কথা শুনিয়েছে?”

আমি সজোরে মাথা ঝাঁকিয়ে না বোঝালাম।সাথে সাথে আমার মাথায় থাকা ঘোমটা নিচে গেল।হঠাৎ আমি একটা বিষয় অনুভব করলাম ধ্রুবর সামনে আসলে আমার হৃদয় অস্বাভাবিক ভাবে কেঁপে উঠে।হাত পা ঠান্ডা হয়ে পরে ক্রমশ।আমি মিইয়ে যাই খুব করে।এই আবছা আলোকিত ঘরে কেবল আমি আর উনি ভাবতেই অজানা শিহরণ বয়ে গেল আমার মনে।অথচ সামনে উপবিষ্ট লোকটা স্থির,নিরেট।আমি মৃদুপায়ে হেটে বিছানার একপাশে বসলাম।আস্তে করে বুকের উপর হাতখানা রাখলাম।হৃদপিণ্ডটাকে শাঁসালাম একটু কম জ্বালাতন করতে।কিন্তু তার নিপীড়ন ক্রমাগত বেড়েই চলেছে দেখে আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম।একপ্রকার দৌড়ে কক্ষ থেকে বেরোতে বেরোতে বললাম,

“আমি রাইদির ওখানে যাচ্ছি।”

উনি বোধহয় বুঝলেন আমার শোচনীয় অবস্থা।আমাকে এভাবে দৌড়ে প্রস্থান করতে দেখে ঠোঁট টিপে হেসে উঠলেন উনি।পরপরই একটা গাঢ় শ্বাস ফেলে বইয়ের পাতায় মনোযোগ দিলেন।
তিনতলা থেকে নেমে আমি সোজা রাইয়ের কক্ষের সামনে এসে দাড়ালাম।দরজা একটু চাপানো ছিল।আমি কড়া নেড়ে মৃদুস্বরে অনুমতি চাইলাম,

“আসব?”

“আরে..হ!এ বাড়ির কর্তী আমার কাছে থেকে অনুমতি চেয়ে লজ্জায় ফেলছে কেন?ভেতরে আসো।”

কথাখানা বলে মিষ্টিসুরে হেসে উঠে রাই।আমি ধীরে ধীরে তার কক্ষে প্রবেশ করি।আমাকে দেখেই রাই মশকরার স্বরে বলে উঠে,

“স্বামী ঘরে থাকতে তুমি ননদিনীর ঘরে কি করছো?”

লজ্জা থেকে বাঁচতে এসে পুনরায় লজ্জায় পরলাম আমি।হঠাৎ আমার পায়ের দিকে খেয়াল করে রাই অভিভূত হয়ে বলে উঠলো,

“ধ্রুব এনেছে এটা?”

আমি বিস্ময় নিয়ে বললাম,

“আপনি কি করে জানলেন?”

মুচকি হেসে রাই বলে উঠলো,

“আজকেই তোমার পতিদেবের আগমন আর পায়ে নুপুর।বলতে হবে ধ্রুব তোমাকে খুব ভালোবাসে!”

আমি গম্ভীর হয়ে গেলাম হঠাৎ।রাই মেঝে বসে প্রদীপের শিখায় কাজল তৈরি করছিলো।আমি তার পাশে বসে পড়লাম।একটা দীর্ঘশ্বাস আপনা-আপনি নির্গত হলো।
আমি রাইয়ের পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম।প্রদীপের শিখায় শুভ্র ত্বক সোনালি মনে হচ্ছে।চোখে গাঢ় কাজল লেপ্টানো,কানে সোনার ঝুমকো,কপালে ছোট লাল টিপ আর হাতে দুটো বালা।সবমিলিয়ে স্বর্গীয় কোন দেবীর ন্যায় মনমোহিনী রুপ রাইয়ের।কিন্তু সুন্দর মন ও রুপের অধিকারী মেয়েটার কপালটা ভীষণ পোড়া।

রাইয়ের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এবার জ্বলন্ত অগ্নিশিখার দিকে দৃষ্টি দিলাম আমি।অক্ষিপটে সোনালি-লাল মিশেলের বহ্নিশিখা দৃশ্যমান হলো।আমি ধীরস্বরে বলে উঠলাম,

“ধ্রুব আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেননি,আমার সম্মান বাঁচানোর জন্য বিয়েটা করেছেন।”

রাইয়ের হাতখানা থেমে গেল সহসা।অবাক চোখে আমার পানে দৃষ্টি দিলো সে।আমি থমথমে মুখশ্রীতে তখনো জ্বলন্ত প্রদীপ পানে তাকিয়ে।

চলবে….