মম হৃদয় বিহারিনী পর্ব-০৮

0
379

#মম_হৃদয়_বিহারিনী
#ঐশী_রানী_রক্তিমা
৮.
“ধ্রুব আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেননি,আমার সম্মান বাঁচানোর জন্য বিয়েটা করেছেন।”

রাইয়ের হাতখানা থেমে গেল সহসা।অবাক চোখে আমার পানে দৃষ্টি দিলো সে।আমি থমথমে মুখশ্রীতে তখনো জ্বলন্ত প্রদীপ পানে তাকিয়ে।ক্ষনকাল বাদে রাইয়ের পানে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম সে বিস্ফোরক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।তার তাকানোর ভঙ্গিতে আন্দাজ করলাম আমার পতিদেব নিজ জিহ্বায় কতটা সত্য ধারণ করেন।
আমি একটা গাঢ় শ্বাস ফেললাম।রাই অবাক স্বরে বলে উঠলো,

“এটা তুমি কি বললে,নির্বানী?”

আমি রাইয়ের পানে চেয়ে একটা মলিন হাসি দিলাম।বললাম,

“সেটাই বলেছি যা শুনে তুমি এমন রসগোল্লার মতো চোখ করে আমার কি তাকিয়ে আছো।”

খানিক রসিকতা মিশিয়ে কথাটা বললাম আমি।এটা বোধহয় রাইয়ের পছন্দ হলো না।সে তার কাজ একপাশে ফেলে আমার পানে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে শুধালো,

“রসিকতা করছো তুমি?”

আমি তৎক্ষণাৎ মাথাটা নাড়িয়ে না বলে উঠলাম।রাই ফের বললো,

“ধ্রুব তোমায় ভালোবেসে বিয়ে করেনি,তোমার সম্মান বাঁচানোর জন্য করেছে!এসব কি বলছো তুমি?”

“যা সত্য তাই বলছি।”

আমি শান্ত চোখে তাকিয়ে উত্তর দিলাম।রাইয়ের চোখেমুখের বিস্ময় আমার হৃদয়কেও অবসন্ন করে দিয়েছিলো।এই মুহুর্তে দাড়িয়ে আমি স্বয়ং এটা ভাবতে পারছিলাম না যে ধ্রুব আমার সম্মান বাঁচানোর জন্য আমাকে বিয়ে করেছে।শুকনো একটা ঢোক গিলে রাইয়ের পানে তাকালাম।তার বিস্ময়ভরা দৃষ্টি আমার উপর নিবদ্ধ।হঠাৎ রাই বললো,

“ধ্রুব তবে মিথ্যে বলেছে আমাদের?কেন?”

“আমার থেকে আপনি হয়ত উনাকে বেশি জানেন।”

রাই ক্ষনকাল চুপ থেকে বললো,

“যদি ধ্রুব এই মিথ্যে বলে এই গুরুতর সত্যটা আড়াল করে থাকে তবে এটা নিশ্চয়ই তোমারও এটা গোপন রাখা উচিত ছিল।আমাকে কতটুকু জানো বা চিনো তুমি?এই কথাটা আমায় বলে দিলে?যদি আমি এখন এটা সকলকে বলে দিই।”

রাইয়ের কথায় আমি বোকার মতো তাকালাম।রাই ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে।আসলেই তো!আমি ঠিক কতটুকুই বা চিনি রাইকে?ধ্রুব যে মিথ্যের পর্দা বিছিয়ে দিয়েছিল সকলের চোখে শুধুমাত্র আমি যাতে অপমানিত না হই সে জন্য।আমি সেই মিথ্যাকে মিথ্যা বলে দিলাম রাইয়ের কাছে।ভুল করলাম?

আমি কাচুমাচু দৃষ্টিতে রাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম।একটা সুক্ষ চিন্তায় আমার ভেতরটাকে ঘিরে ধরছিলো ধীরে ধীরে।রাই হঠাৎ আমার হাতখানা নিজের মুঠোয় নিয়ে বললো,

“আমাকে বলেছো বলেছো।কিন্তু এই কথা যেন ভুলেও কেউ টের না পায়।ধ্রুবকেও এটা বলার দরকার নেই যে এটা আমাকে বলেছো ঠিকাছে?”

রাইকে মুহুর্তের জন্য আমার নিজের আপন দিদির মতো মনে হলো।যে ছোটবোনের ভুলগুলো আড়াল করার চেষ্টা করে সর্বদা।
কিন্তু একটা বিষয়টা আমাদের দুজনেরই অগোচরে রয়ে গেল।আমরা কেউই খেয়াল করলাম না দরজার পাশ থেকে একটা ছায়া সরে গেল সন্তর্পণে।
আমি রাইয়ের কাছে আরো কিছুক্ষণ বসে রইলাম।আশ্চর্যজনকভাবে সে আমাকে এটা অবধি শুধালো না যে আমার বিয়ের দিন আসলে কি হয়েছিল।আমার সম্মান রক্ষার প্রশ্নই বা কেন আসলো?

রাইকে আমার অনেকটা অপ্রকাশিত রহস্যের ন্যায় মনে হয়।কিংবা সে সমুদ্র গহ্বরে থাকা কোন ঝিনুক!যার অন্তস্থলে মুক্তোর ন্যায় কোমলতা,উদারতা লুকিয়ে।
আমার ভাবনায় ছেদ ঘটে পরিচারিকার ডাকে।

“দিদি মনি?আপনাকে রাতের খাবারের জন্য নিচে ডেকেছে।”

রাই গলা উঁচিয়ে জানায়,

“ঠিক আছে। আসছি আমি।”

রাইয়ের কাজল বানানো প্রায় শেষ।সেটা সমাপ্ত করে সে রেখে দিল।তারপর আমরা বসার ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
বসার ঘরে মেঝেতে সকলে লাইনে বসে খাওয়াদাওয়া করে।পরিচারিকারা খাবার পরিবেশন করে দেন।আমার পাশে প্রতিদিন রাই বসে।কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আজকে আমার পাশে না বসে সে জায়গাটা খালি রেখে দিলো।আমি ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে শুধালাম,

“কি হলো?আজ তুমি আমার পাশে বসবে না?”

রাই কিছু না বলে মিটিমিটি হেসে নিলো।তার কিছুক্ষণ পরেই জায়গাটা দখল করে বসে পরলো ধ্রুব।আমি কাচুমাচু করে বসলাম।বাড়ির লোকজন একবার করে নজর বুলিয়ে নিজেদের খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।আমার হৃৎস্পন্দন গেল বেড়ে!মহা বিরক্ত হলাম আমি হৃদপিন্ডটার উপর।
সকলে আমাদের দিকে চোরা চোখে তাকিয়ে নিজেদের খাওয়ায় মনোযোগ দিলেও একজন তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ছিল।লোকটা হলো শুভ।
.
খাওয়া দাওয়া শেষ করে সকলে যার যার কক্ষে প্রস্থান করেছে।মিনু দি,এ বাড়ির পরিচারিকার শরীরটা হঠাৎ করে খারাপ হয়ে পরায় আমি তাকে টুকটাক সাহায্য করে দিচ্ছিলাম।রাইও ছিলো আমার সাথে।এতদিনে যতটুকু বুঝলাম।এ বাড়ির লোকেরা পরিচারিকাদের ব্যাপারে এত মাথা ঘামায় না।
রাত বাড়তেই কক্ষে প্রস্থানের সময় হলো।কিন্তু আজ আমি একটু বিলম্ব করছিলাম।কক্ষটায় আজ আমার সাথে ধ্রুবও থাকবেন।ভাবতেই লজ্জায় কপোল দুটো লাল আভায় ছেয়ে যাচ্ছিলো আমার।কিন্তু যখন সবাই নিজ নিজ কক্ষে চলে গেছে তাই আমি এখানে কোন অজুহাতেও থাকতে পারবো না।আমি ধীরে ধীরে তিনতলায় নিজ কক্ষ অর্থাৎ ধ্রুবর কক্ষের দিকে এগোচ্ছিলাম।একটা অস্থির অনুভূতি এসে ঘিরে ধরছিলো আমায়।ধ্রুব অনেক আগেই কক্ষে এসেছেন।

তিনতলায় বরাদ্দ কক্ষটার সামনে এসে আমি ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করলাম।নিঃশব্দে প্রবেশের ইচ্ছে থাকলেও ধ্রুবর পরিয়ে দেওয়া নুপুরের দরুন তা হলো না।কক্ষে প্রবেশ করতে করতে দেখলাম ধ্রুব বিছানার পাশের বিশাল জানলাটার সামনে দাড়িয়ে।হাতদুটো পেছনে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।দীর্ঘদেহী লোকটার কেবল পেছনটায় দেখা যাচ্ছে।জানালাটা বদ্ধ থাকে সবসময়।আমি খোলার সাহস পাই না।
নুপুরের আওয়াজ পেয়ে বাইরে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দরজার পনে তাকান উনি।দৃষ্টিতে গাম্ভীর্যতা মিশে।আমি মাথার ঘোমটা টা টেনে কপালের কাছে এনে বিছানার পাশে এসে দাড়ায়।জানালা গলে শীতল বাতাস মৃদুভাবে প্রবেশ করছে কক্ষে।জানলার বাইরে বিশাল আকাশটায় দৃষ্টি দিয়ে দেখলাম সরু কাঁচির ন্যায় একফালি চাঁদ আর অসংখ্য তারার মেলা সেথায়।সেই অপরুপ দৃশ্য থেকে চোখ সরিয়ে আমি ধ্রুবর পানে তাকালাম। ওনার স্বচ্ছ দাড়ি বিহীন গালটায় খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে।হয়ত পড়ার চাপে এই অবস্থা।

আমি সময় নিয়ে উনাকে দেখতে লাগলাম।উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ পুরুষ,মাথায় ঘন রেশমি চুল,কালো ভ্রু আর গভীর চোখ।সবমিলিয়ে সুদর্শন একজন যুবক ধ্রুব।আচ্ছা উনার কি কোন প্রকার আফসোস হয়?আমাকে বিয়ে করে?প্রশ্নটা আমার অন্তস্থলেই রয়ে গেল।কাঁটা ফুটার পর তা বের না করলে যেমন ব্যথা দেয় সেটা,সেরকম সুক্ষ্ম ব্যথা দিলো প্রশ্নটা।আমি বোধহয় ওনার প্রতি আসক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম!

হঠাৎ উনি বাইরে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শান্ত চোখে আমার দিকে তাকালেন।আমি দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকালাম।আমাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে উনি ভ্রু কুঁচকে বলল উঠলেন,

“এভাবে দাড়িয়ে আছো কেন?ঘুম ধরছে না?”

আমি একটা শুকনো ঢোক গিলে বললাম,

“আপনি কোন পাশে শুবেন?”

প্রশ্নটা করে নিজেই অস্বস্তিতে পরে গেলাম আমি।চোখ খিঁচে বদ্ধ করে নিলাম।তরতর কেঁপে উঠলো আমার চোখের পাতা।উনার দৃষ্টি ছুঁয়ে দিলো সেখানটায়।যা আমি দেখতে পারলাম না চোখ বুঁজে থাকার দরুন।উনার ওষ্ঠে একটা সুক্ষ হাসির রেখা দেখা দিলো। যা মিলিয়ে গেল অচিরেই।

“তোমার যেপাশে ইচ্ছে শুয়ে পর।”

আমার চোখ খুলে তাকালাম।এতদিন জানালার পাশটায় শুতাম আমি।তাই উনাকে এখানটায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে বোকার মত প্রশ্নটা করে ফেললাম।সম্মতি পেয়ে আমি জানালার পাশটায় শুয়ে পরলাম।শাড়িটা ঠিকঠাক করে নিয়ে শুলাম যাতে লজ্জায় পরতে না হয়।উনি কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে নিজেও এসে আমার পাশটায় শুয়ে পরলেন।বেশ খানিকটা দুরত্ব বজায় রেখেই শুয়েছেন উনি।কিন্তু তবুও আমার বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যেতে শুরু করলো।আমি হাত মুঠো করে চোখ খিঁচে পরে রইলাম মৃতের ন্যায়।গল্প উপন্যাসে পরেছিলাম অনুকূল পরিস্থিতিতে নায়িকাদের নাকি বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যায়।কথাটা বেশ অবাস্তব আর অতিরঞ্জিত মনে হয়েছিল আমার।কিন্তু আজ বুঝলাম বুকের ভেতর ঝড় সত্যই বয়ে যায়!
কিছুসময় অতিবাহিত হলো।আমরা চুপচাপ একে অপরের পাশে পরে রইলাম মৃত্যের ন্যায়।শুধু শ্বাস চলছিল আমাদের।আমি চেষ্টা করছিলাম দ্রুত ঘুমিয়ে যেতে।বক্ষদেশের এই নিপীড়ন থেকে বাঁচার এই একটাই উপায়,দ্রুত ঘুমিয়ে যাওয়া।কিন্তু ঘুমটাও আজ বড্ড বেইমানি করছিল।হাতছানি দিয়ে ডাকছি অথচ পালিয়ে যাচ্ছে!
.
রাতটা গেল কেটে গেল সেভাবেই।ধ্রুবর ঘুম ভাঙল আমার আগেই।আমি তখন ঘুমে বিভোর।মাথার কেশ এলোমেলো হয়ে লেপ্টে আসে মুখে।পেটের কাছের শাড়ি আঁচল সরে বেরিয়ে রয়েছে দেহের নিষি*দ্ধ অংশ।ঘুমে বিভোর আমার বক্ষদেশ উঠানামা করছে ধীর গতিতে।আমার মুখশ্রী ছিল ধ্রুবর দিকে ফিরানো।স্বাভাবিকভাবেই ওনার ঘুম ভাঙার পরপরই আমার দিকে নজর আসলো উনার।ঘুম ঘুম চোখে আমার মুখশ্রীতে দৃষ্টি দিলেন উনি।ওনার ঘোলা দৃষ্টি বিচরণ করতে লাগলো আমার মুখশ্রীজুড়ে।হঠাৎ দৃষ্টি নত করে তাকাতেই ওনার দৃষ্টি এসে ঠেকলো আমার পেটের উপর।দ্রুত চোখ সরিয়ে অন্যপাশে তাকালেন উনি।এখন সম্পূর্ণ সজাগ উনার মস্তিষ্ক।

কিছু মুহুর্ত বাদে পিটপিট করে চোখ খুললাম আমি।তখন উনি শৌচাগার থেকে বেরিয়ে আসলেন।আমি দ্রুত উঠে বসলাম।দুঃখিত মুখশ্রীতে তাকিয়ে বললাম,

“দুঃখিত এতটা দেরি হওয়ার জন্য।আমি বুঝতে..”

আমার কথার মাঝেই উনি বুকে হাত গুঁজে বলে উঠলেন,

“এসব বললে চলবে না।এ অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য নয়।”

ওনাড গম্ভীর স্বর শুনে মাথা নত করে রইলাম আমি।ধীরে ধীরে মাথা তুলে ওনার পানে তাকাতেই দেখলাম ওনার ওষ্ঠকোণে মিটিমিটি হাসি।আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললাম,

“আপনি হাসছেন?”

“ওহ নির্বানী!তোমাকে কি আমার এতটাই খারাপ মনে হয়?যে বউ একটু দেরিতে ঘুম থেকে উঠলেই আমি লঙ্কাকান্ড করে ফেলবো!”

“তবে আপনি যে বললেন..”

কথাটা বলার মাঝেই আমার মনে পরলো উনি আসলে ঠিক কি বলেছেন।ফিক করে হেসে ফেললাম আমি।হাসি হাসি মুখে উনার দিকে তাকিয়ে বিছানা থেকে নামলাম।
তারপর হাতমুখ ধুয়ে এলাম।ধ্রুব ততক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছেন।আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এলোমেলো হয়ে থাকা চুলে হাত দিলাম।ধ্রুবর ঘরে থাকা আয়নাটা অনেকটাই বড়।অনেক জিনিস পত্রেও রাজকীয় ছোঁয়া।
কোমড় সমান দীঘল কেশ বেনি করে নিলাম।তারপর মাথায় ঘোমটা দিতেই দরজায় কেউ কড়া নেড়ে উঠলো।আমি গলা উঁচিয়ে শুধালাম,

“কে?”

মেয়েলি একটা স্বর ভেসে আসলো,

“আমি প্রভা।জেঠিমা তোমাকে নিচে ডেকেছেন।”

হঠাৎ শাশুড়ীর তলব পেয়ে আমি মনে মনে একটু ভয় পেলাম।প্রভা,ধ্রুবর ছোটকাকার মেয়েটা তখনো দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে।আমি কক্ষ থেকে বেরিয়ে বললাম,

“চলো যাই।”

শাশুড়ীর ঘরে ঢুকতেই ধুপের সুগন্ধি এসে নাকে ঠেকলো।একটা পবিত্র পবিত্র ঘ্রাণ!আমি গভীর একটা শ্বাস টেনে নিলাম।শাশুড়ী মা এলেন কক্ষের বাইরে থেকেই।আমাকে দেখে বললেন,

“এসো আমার সাথে।”

আমি কথামতো উনার পিছন পিছন আসলাম।উনি আমাকে নিয়ে বাড়ির সামনে উপস্থিত হলেন।আশ্চর্যজনক ভাবে উঠোনে বাড়ির সকলেই উপস্থিত ছিলেন।আমি ঘটনা বোঝার জন্য আশেপাশে তাকালাম।শাশুড়ী মা আমাকে ভীড় ঠেলে ভেতরে নিয়ে গেলেন।বাড়ির সকলে মিলে কিছু নিয়ে আলোচনা করছেন।বিষয়টা ছিল আমার আর ধ্রুবর বিয়ে।ধ্রুবর মেজো কাকা নিজে বর্তমানে জমিদারির দায়িত্বে আছেন। তিনি একটা চেয়ারে বসে আছেন।চোখেমুখে রাজকীয় ছাপ ফুটে উঠেছে।লোকটাকে আমি আগে এক দুবার দেখলেও তেমন খেয়াল করা হয়নি।পরনে ঘিয়ে রঙের ফতুয়া আর ধুতি।পায়ের উপর পা তুলে গাম্ভীর্য ধরে বসে আছেন তিনি।উনার সামনেই মুখোমুখি আরেকটা চেয়ারে বসে আছেন ধ্রুব।দীর্ঘদেহী সুঠাম লোকটার পেছনে এনে আমাকে দাড় করালেন শাশুড়ী মা।আমি দৃষ্টি নত করে দাড়িয়ে রইলাম।মেজো কাকামশাই সুবোধ দেবনাথ আমার দিকে একবার তাকিয়ে বলে উঠলেন,

“তোমাদের বিয়ের ব্যাপারে তো কিছুই জানে না এ বাড়ির কেউ।কিভাবে বিয়ে করেছো!সেটাই জানার জন্য এই বৈঠক।”

উনার কথা শুনে দুহাত বুকে গুঁজে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালেন ধ্রুব।আমি লজ্জায় শির নত করে রয়েছি।সুবোধ দেবনাথ ফের বললেন,

“এতদিন তোমার বউকে কেউ প্রশ্ন করেনি কেননা যদি সে অপমানিত বোধ করে!”

“তো এখন কি সে খুব সম্মানিত বোধ করছে?”

সাথে সাথে প্রশ্ন করে বসলেন ধ্রুব।সুবোধ দেবনাথ তড়িঘড়ি করে বললেন,

“অসম্মান কে করেছে তাকে?আমরা তো কেবল নিজেদের কৌতুহল মেটাতে চেয়েছি।কিভাবে কি হলো!তোমরা বিয়ে কিভাবে করেছ,নিয়ম মেনে নাকি পালিয়ে এটাও তো অজানা।”

“নির্বানীকে আমি সমস্ত নিয়ম মেনে আর পরিবারের সম্মতি নিয়ে বিয়ে করেছি।”

শক্ত কাঠকাঠ কন্ঠে জবাব দিলো ধ্রুব।তারপর কাকা মশাইয়ের পানে চেয়ে বলে উঠলো,

“এই প্রশ্ন আমাকে একান্তও করা যেত।এভাবে বাড়ির উঠোনে সকলের সামনে
আমাকে,আমার স্ত্রীকে তলব করে এনে বলার কোন প্রয়োজনীয়তা দেখছি না।যাইহোক!”

কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছো স্থানজুড়ে।আমি তখনো দৃষ্টি নত করে দাড়িয়ে।বাড়ির মেয়ে-বউরা ঘিরে আছে আমাদের।এখন অবধি আমি সকলকে ভালোভাবে চিনি না অবধি।এ বাড়ির লোকেরা আমাকে যে মেনে নিতে পারিনি তা তাদের চোখা দৃষ্টিতেই প্রকাশ পায়।তবে ধ্রুবর জন্য এখন অবধি কেউ কিছু বলেনি আমাকে।

আরো কিছু কথা বলে বৈঠক শেষ করলেন।আমি নিজের কক্ষের দিকে রওনা দিলাম।কিন্তু বসার ঘরে আসতেই শুভ বলে উঠলো,

“আরে মাসি তুমি?কেমন আছো?”

কথাটা আমাকে বলেনি তবুও কৌতুহল বশত ঘুরে তাকালাম আমি।শশীর মা এসেছেন।হয়ত বৈঠকে ভীড়ের মাঝেও ছিলেন।আমি খেয়াল করিনি।
শশীর মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে যেন উনার ভেতরে পরিস্থিতি বোঝালেন।তারপর বললেন,

“তুই কেমন আছিস?”

শশীর মা শুভর মায়ের দুরের বোন হন।শুভ উত্তর দিয়ে ফের জিজ্ঞেস করলো,

“শশীদিকে এবাড়িতে দেখলাম না একবারো।”

কথাটা বলে আড়চোখে আমার পানে চাইলো সে।আমি তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম তাই তার তাকানোটা সহজেই ধরে ফেললাম।
শুভর কথা শেষ হতে না হতেই শশীর মা দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন,

“আসবে কিভাবে?কতকিছু হয়ে গেল জানিস না বুঝি বাপু।”

আমি আর দাড়ালাম না সেখানে।সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে কক্ষে এসে চুপচাপ বসে রইলাম।শুভ লোকটার প্রতি একটা চাপা রাগ তৈরি হলো আমার।সে ইচ্ছে করেই যেন আমার সামনে শশীর প্রসঙ্গ তুলছে।
.
সন্ধ্যা বেলা কৃত্রিম আলো জ্বলে উঠলো ঘরে ঘরে।আলোকিত হয়ে উঠলো জমিদার বাড়ি।ধ্রুব কাকা মশাইয়ের সাথে জমি দেখতে গিয়েছিলেন।সেখান থেকে ফিরলেন মাত্র।আমি বসে বসে গুনগুন করছিলাম।নিজেতে এতটাই মগ্ন ছিলাম যে কখন ধ্রুব কক্ষে প্রবেশ করেছে সেটাও টের পাইনি।আমি ছিলাম আয়নার সামনে বসে।সামনে কাজলের কৌটো।বাড়ি থেকে এসবই নিয়ে এসেছিলাম আমি।কিন্তু ব্যবহার করা হয়নি।আজ কি মনে করে কাজলের কৌটোটা খুলে চোখে একটু কাজল পরে নিলাম।হঠাৎ পাশে তাকাতেই দেওয়ালে একটা ছায়া দেখতে পেলাম।ঠিক আমার পেছনে।শুকনো একটা ঢোক গিলে দর্পনে তাকাতেই দেখলাম গম্ভীর একজোড়া চোখ আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে।দ্রুত পিছন ঘুরতেই ধাক্কা খেলাম ধ্রুবর সাথে।আমার নাকটা স্পর্শ করলো ওনার বুকটা।পেছনে একটু সরে এসে পিটপিট করে তাকালাম আমি।ধ্রু লব পলকহীন দৃষ্টি তখন আমার মুখশ্রীতে।জানালাটা বন্ধ করা হয়নি আজ।সেটা গলে ঝড়ো হাওয়া প্রবেশ করতে লাগলো।আমি সেদিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,

“ঝড় উঠবে মনে হয়।জানালাটা তো বন্ধ করা হয়নি।”

ধ্রুব আমার কথা শুনলেন কি না বুঝতে পারছিলাম না।উনি স্তব্ধ হয়ে পলকহীন আমার পানে তাকিয়ে রইলেন।হঠাৎ অস্ফুটস্বরে বলে উঠে,

“ঝড় আসলে ক্ষতি কি?”

ওনার কথা ঠিকমতো বোধগম্য হলো না আমার।আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম।তারপর জানালার দিকে হাঁটতেই হঠাৎ আমার হাতখানায় টান বসালেন ধ্রুব।

চলবে…