#মম_হৃদয়_বিহারিনী
#ঐশী_রানী_রক্তিমা
৯.
আচমকা ধ্রুব আমার হাতখানা ধরে ফেলায় থমকে দাড়ালাম আমি।শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকালাম জানালার বাইরের নিকষ আঁধারের দিকে।ঢোক গিলে পেছনে তাকানোর চেষ্টা করলাম।সাথে সাথে উনি সাবধানী স্বরে বলে উঠলেন,
“উঁহু!নড়ে না।”
আমি স্তব্ধ হয়ে রইলাম এবার।আমার কব্জিতে ওনার গাঢ় অধিকার।শক্ত করে ধরে রয়েছেন সেথায়।বলিষ্ঠ হাতের চাপে বিষিয়ে উঠেছে সেখানটায়।তার উপর শাখায় চাপ পরায় ব্যথা পাচ্ছিলাম আমি।হঠাৎ আমার চুলে ওনার হাত ডুবালেন উনি।আমি চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলাম।থমকে রইল আমার শ্বাসপ্রশ্বাস।ধ্রুবর নিঃশ্বাস এসে পড়ছিলো আমার কাঁধের উন্মুক্ত স্থানে।হঠাৎ আমাকে আরেকটা হাত পাততে বললেন।আমি বাধ্য মেয়ের মতো সেটা মেলে ধরতেই একটা জলজ্যান্ত তেলাপোকা দিলেন আমার হাতে।তৎক্ষনাৎ আমার চোখদুটো রসগোল্লার ন্যায় বিশাল হয়ে গেল।গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে উনাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলাম ।আচমকা এমন হওয়ায় তাল সামলাতে গিয়ে দুপা পিছিয়ে গেলেন উনি।তারপর আমাকে আর নিজেকে সামলিয়ে দাঁড়ালেন কোন রকম।
এদিকে আমি চোখ খিঁচে ওনার বাহু আঁকড়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরে আছি।তেলাপোকায় আমার জন্মের ভয় আর উনি কিনা সেটায় আমার হাতে দিলেন!তাও আবার জীবিত!
আমার এমন কাজে ধ্রুব বোধয় নিজেও স্বল্প ভীত হয়ে পরেছেন।ওনার বক্ষদেশ তখন আমার দখলে।বাহুতে আমার হাতের চাপ।স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলেন উনি।ওনার বুকের ডানপাশে আমার মাথা এসে ঠেকায় হৃদপিণ্ডের অস্বাভাবিক সংকোচন-প্রসারণ স্পষ্ট শুনতে পেলাম।চট করে সরে এলাম ওনার থেকে।আশেপাশে তাকিয়ে আতংকিত স্বরে জিজ্ঞেস করলাম,
“তেলাপোকাটা চলে গেছে?”
ধ্রুব আমার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছেন।আমার বুক কাঁপছিলো খুব।হঠাৎ উনি অদ্ভুত স্বরে বলে উঠলেন,
“তুমি তেলাপোকা ভয় পাও?”
উনার প্রশ্ন শুনে মনে হলো মেয়েদের তেলাপোকা দেখে ভয় পাওয়াটা অস্বাভাবিক কোন আচরণ।আমি বোকা দৃষ্টি মেলে ওনার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগে উনি বললেন,
“আমাদের ডিপার্টমেন্টের মেয়েরা এসব নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে!আর তুমি তেলাপোকা দেখে এভাবে লাফাচ্ছো?”
কথাখান বলে হেসে উঠলেন উনি।আমি মুখটা থমথমে করে ফেললাম।পুরো মেয়েজাতির জন্য একটা আতংক এই তেলাপোকা।সেটা দেখে এভাবে লাফিয়েছি বলে এভাবে হাসবেন উনি?আমি গালটা ফুলিয়ে নিলাম।এতকিছুতে ভুলেই গিয়েছিলাম যে জানালাটা বন্ধই করা হয়নি।বাইরের ঝড়ো বাতাসের মাত্রা ততক্ষণে বেড়েছে আরো।কক্ষের ভেতর রীতিমতো ধুলো আসতে শুরু করেছে।জানালা বন্ধ করার শব্দে পেছন ফিরে তাকালাম আমি।ধ্রুবর ওষ্ঠকোণে এখনো মিটিমিটি হাসি লেপ্টে।আমার উপর হাসছেন উনি?সহ্য হলো না আমার।ওনার পুরু ঠোঁটের কোণে থাকা সুন্দর হাসিটার উপর বিদ্রোহ ঘোষণা করে আমি বলে উঠলাম,
“আপনি এভাবে আমার উপর হাসতে পারেন না।এসব তেলাপোকা দেখে সবাই ভয় পাই!”
আলনারিতে শার্ট খুঁজতে থাকা ধ্রুব ফিরে তাকালেন আমার দিকে।ঠোঁটে সেই হাসি রেখেই উনি বলে উঠলেন,
“কই আমি তো ভয় পাই না!”
“সেটা আমি জানি না।কিন্তু আপনি এভাবে আমার উপর হাসতে পারেন না।হাসিটা সরান ঠোঁট থেকে।”
ক্ষ্যাপাস্বরে বিদ্রোহ করে উঠলাম আমি।উনি আমার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“যথা আজ্ঞা!”
কথাখান বলে শার্ট-প্যান্ট নিয়ে শৌচাগারে প্রবেশ করে ধ্রুব।উনি চোখের আড়াল হতেই দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরলাম।একটু আগে আমি কি করেছি ভাবতেই কেমন করে উঠলো মনটা।একটা শিরশিরে বাতাস ঘিরে ধরলো আমাকে।লজ্জায় যেন কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছিলো।আমি ওনাকে ওভাবে জড়িয়ে ধরেছি!ইশ..কি একটা কান্ড করে ফেলেছি।তবে এখানে আমার দোষটাই বা কি ছিল?যে জিনিসে আমার জন্মের ভয় সেটা যদি কেউ আমার হাতের মুঠোয় এনে দেয়, তবে চেঁচাবোই তো নাকি?কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে চোখের সামনে যাকে পাবো তাকে জড়িয়ে ধরবো তাই তো?
আমার ভাবনার মাঝেই ধ্রুব কাপড় পাল্টে বেরিয়ে এলেন।আমি আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম।গাঢ় নীল রঙা শার্ট ওনার পরনে।শার্ট প্যান্টে বেশ সুদর্শন লাগে ওনাকে।ওনার গালে গজিয়ে উঠা দাড়িগুলো ওনার সৌন্দর্য বাড়িয়েছেন আরো।আমার মন চাইলো তাকিয়ে থাকতে।কিন্তু উনি কি ভাববেন ভেবে তাকাতে পারছি না।বুকশেলফের পাশেই একটা একটা পড়ার টেবিল রাখা।উনি সেখানে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলেন,
“নির্বানী,আর পড়াশোনা করবে না?”
সাথে সাথে মুখ ভার হলো আমার।উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করতে না করতেই বাবা বিয়ের পেছনে পরলেন।আমাকে একবার জিজ্ঞেসও করার প্রয়োজন বোধ করেননি যে আমি পড়তে চাই কিনা।আমি এসব ভাবতে ভাবতে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি গম্ভীর হয়ে আমার পানে তাকিয়ে আছে।আমি মিনমিনে কন্ঠে বললাম,
“পড়াশোনা করাবে কে?বাবা করাবেন না বলেই তো বিয়ে দিয়ে দিলেন।”
আমার কথার বিপরীতে শান্ত দৃষ্টিতে চাইলেন উনি।শান্ত আওয়াজে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি করতে চাও কি না সেটা বলো।”
“আমি চাইলেই বা কি?”
ধ্রুব এবার বুকে হাত গুঁজে আমার পানে তাকালেন।একটু রাগ বোধহয় মেশানো ছিল সেই দৃষ্টিতে।আমি আবারও মিনমিন করে বললাম,
“আমার চাওয়াতে কিছু যায় আসে না।”
এবার আচমকা বসা থেকে উঠে পরলেন ধ্রুব।সামান্য শব্দ হলো তাতে।ওনার কপালে তিনটে সুক্ষ রেখা ফুটে উঠলো।সরু নাকটা লাল হতে শুরু করলো যেন।আমি শুকনো ঢোক গিলে বললাম,
“আছে,আছে।”
আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফের বসে পড়লেন উনি।পড়ার টেবিল থেকে একটা বই নিয়ে সেটা মেলে ধরলেন।
অনেকক্ষণ যাবত কিছু না বলে চুপচাপ পড়তে লাগলেন উনি।তার সমস্ত মনোযোগ বইের পাতায়, দৃষ্টি সেই বইয়ের পাতার কালো কালো অক্ষরগুলোয়।পড়ায় টেবিলেই একটা হারিকেন রাখা।তার আভায় আলোকিত ওনার মুখশ্রী।ভ্রুযুগল হালকা কুঁচকানো,ওষ্ঠদ্বয় মৃদুস্বরে বইয়ের অক্ষরগুলো পড়তে ব্যস্ত।একটু পরপর কলম দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলো দাগাচ্ছেন উনি।কপাল চুলকে খাতার শুভ্র পৃষ্ঠা ভরাচ্ছেন লিখে লিখে।আমার দৃষ্টিতে মুগ্ধতা ভর করলো।মানুষটার পড়ার ধরনও কত সুন্দর,আকর্ষণীয়!
হঠাৎ পড়তে পড়তে উনি আমার দিকে তাকালেন,পূর্ণদৃষ্টিতে।আমি দ্রুত চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকানোর অভিনয় করতে লাগলাম।আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ফের বইয়ে ডুবলেন উনি।আমি আঁড়চোখে সেটা লক্ষ্য করে পুনরায় নজর স্থির রাখলাম ওনাতে।
.
রাতের ভোজন শেষ করে কক্ষে এসেছি আমি।ধ্রুবকে কাকামশাই ডেকেছেন কোন ব্যাপার নিয়ে আলাপ করতে।বাইরে তখন প্রচুর বৃষ্টি।ঘরে থাকা প্রদীপের শিখাগুলোও স্থির নয়।আমি চুল আঁচড়ানোর জন্য মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে নিলাম।তারপর চুলের খোঁপা আলগা করে উন্মুক্ত করে নিলাম।বাহিরে তখন ঝড়ের তান্ডব।তার ছোঁয়া কক্ষের মধ্যিখানেও পাওয়া যাচ্ছে।শীতল হয়ে উঠেছে পুরো কক্ষটায়।গায়ে কাঁপন ধরিয়ে দেওয়ার মতো শীতলতা!
চুলে চিরুনি চালাতেই দরজায় আওয়াজ হলো।ফিরে তাকালাম সেদিক।এ কক্ষের অধিশ্বরের আগমন ঘটেছে।দরজাটা আটকে বিছানার কাছটায় এসে দাড়ালেন ধ্রুব।লোকটা বোধহয় রেগে ছিলো।আমার দিকে তাকালেন না তেমন।চুপচাপ শুয়ে পড়লেন বিছানায়।হাতটা মাথায় ঠেকিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে আছেন উনি।আমি একবার ওনাকে ভালো করে দেখলাম।গাঢ় নীল রঙ শার্টখানা উনার দেহে বেশ ফুটেছে।হাতাটা কনুই অব্দি এনে ভাঁজ করা।পরনে কালো প্যান্ট।শার্ট প্যান্টে ওনাকে একদম শহরে বাবু লাগে।হঠাৎ উনি পাশ ফিরে শুলেন।ওনার মুখশ্রী আমার দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল।আমি এবার নজর সরিয়ে নিজেতে মনোযোগ দিলাম।
হারিকেনের আলোয় নিজেকে দর্পনে দেখে তৈরি হয়ে চুলে বেনি করে নিলাম।চুলে ভালো করে তেল দেওয়া হয় না প্রায় অনেকদিন হয়ে গেল।এত লম্বা আর ঘন কেশে প্রয়োজন মতো তেল দেওয়ার ধৈর্য নেই আমার।তাই চুলগুলো এতদিনের অভুক্ত!
চুলে বেনি শেষে আমি হারিকেনের আলো একটু কমিয়ে দিয়ে ওনার পাশে এসে শুয়ে পড়লাম।আগের রাতের ন্যায় দমবন্ধ অনুভূতিটা ফের ঘিরে ধরলো আমায়।আমি চুপচাপ বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর প্রাণপন চেষ্টা করছি।আমার পাশেই টানটান হয়ে শুয়ে আছেন ধ্রুব।আজকে বোধহয় মাঝের দুরত্ব বেশ খানিকটা কমেছে!যদিও আমি একদম বিছানার কিনারায় চেপে শুয়েছি।আজ ওনার শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পারছি আমি।আচমকা ওনার হাত আমার বাহুতে স্পর্শ করলো।হয়ত ঘুমের মাঝে উনি হাত নাড়ানোর দরুন এমনটা হয়েছে।আমি আরেকটু কিনারায় চেপে এলাম।তখনি হ্যাচকা একটা টান পড়লো আমার বাহুতে।সবকিছু আচমকাই হওয়ায় বরফের ন্যায় জমে গেলাম আমি।বাইরের ঝড়ো পরিবেশ স্থান পরিবর্তন করে আমার হৃদয়ে এসে পৌঁছালো।আমাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে একটু সরে গেলেন ধ্রুব।ফের পিনপতন নিরবতা বয়ে গেল কক্ষ জুড়ে।প্রদীপের শিখা কয়েকটা নিভে গেছে বাতাসে।খুবই অল্প আলো কক্ষজুড়ে।হঠাৎ গাঢ় স্বরে ধ্রুব বলে উঠলেন,
“নির্বানী!”
ওনার কন্ঠে ঘুমের ছোঁয়া।আমার বক্ষ কেঁপে উঠলো ওনার এমন ডাকে।সময় নিয়ে আমি বলে উঠলাম,
“হু!”
উত্তর দিতে সময় নিলাম আমি।ক্ষণকাল বাদে উনি বলে উঠলেন,
“ঘুমাও।”
চট করে ঘাড় ঘুড়িয়ে ওনার দিকে তাকালাম আমি।উনি আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন।আমি বললাম,
“এটা বলার জন্য এভাবে ডাকলেন?”
“তুমি অন্য কিছু আশা করেছিলে?করলে বলো।সেই বাক্যটা উচ্চারণ করছি আমি।”
ধ্রুবর কন্ঠে রসিকতার ছাপ।আমি চোখ পাকিয়ে সম্মুখে তাকালাম ফের।একটা গভীর শ্বাস টেনে ঘুমানোর প্রাণপন চেষ্টায় মত্ত হলাম।
.
সারারাত তুমুল ঝড়ের পর সকালবেলা আকাশ পরিষ্কার হলো।দিবাকর উদিত হলেন নিজ কর্তব্যে পৃথিবীকে আলোকিত করতে।আজকে ধ্রুবের আগেই ঘুম ভাঙলো আমার।ঘুম থেকে উঠেই স্নান ছেড়ে নিলাম আমি।আজ জল তোলা হয়নি।কালকের ঠান্ডা পানিতে স্নান করার ফলে সারাদেহে কাঁপন শুরু হলো আমার।কাঁপতে কাঁপতে একটা গাঢ় খয়েরী রঙের শাড়ি পরে বেরুলাম আমি।মাথায় গামছা দিয়ে ভেজা চুল পেছানো।জানালা গুলো বদ্ধ থাকায় কক্ষটা বেশ অন্ধকার ঠেকছিলো।ঘুমন্ত ধ্রুবের পানে একবার তাকিয়ে জানালা খুলে দিলাম আমি।বিছানার সোজাসুজি থাকা বড় জানালাটা খুলে দিতেই কক্ষটা পুরোপুরি আলোকিত হয়ে উঠলো।বাইরে পরিবেশ দেখার জন্য জানালা গলে বাইরে থাকালাম আমি।সারারাত ঝড়ের পর এখন স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে আকাশ।সূর্যের আলোয় ঝকমকে একটা সকাল।তবে পরিবেশের শীতলতা ছিল বেশ!তার উপর এত সকালে গোসল করার জন্য আমি একটু পর পর থমকে থমকে কাঁপছিলাম।
হঠাৎ পুরুষালি স্বরে পেছন ফিরে তাকালাম আমি।
“এভাবে কাঁপছো কেন?”
ঘুমজড়ানো কন্ঠে প্রশ্ন করেছেন ধ্রুব।বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে আমার দিকে তাকালেন উত্তরের অপেক্ষায়।আমি মৃদুস্বরে বললাম,
“স্নান করেছি তাই।”
“এই ঠান্ডা আবহাওয়ায় এত সকালে স্নান করা খুব প্রয়োজন ছিল?”
স্বাভাবিক কন্ঠে কথাটা বলতে বলতে উনি শৌচাগারের দিকে পা বাড়ালেন।পেছন থেকে আমি বলে উঠলাম,
“ছিল।আমি সকালে গোসল করিনি বলে কালকে কাকিমনি আমাকে কথা শুনিয়েছেন।”
“কি বলেছে তোমাকে শুনি।”
মুহুর্তে উনার গলার স্বর পাল্টে গম্ভীর হয়ে উঠলো।আমি মিনমিনে স্বরে অভিযোগ জানানোর মতো বলে উঠলাম,
“কাল যখন আমি দুপুরে স্নান করে ছাদে কাপড় শুকাতে দিতে গিয়েছিলাম তখন উনি আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন যে আমি সকালে স্নান না করে এখন কেন করছি।আমি যখন জবাব দিলাম যে সকালে স্নান করলে ঠান্ডা লাগে তখন উনি চোখমুখ কুঁচকে বলে উঠলেন,
‘ছিঃ মাইয়ার কোন আক্কেল-জ্ঞান নাই।বর বাড়ি ফিরছে কালকে আর এই মাইয়া সকাল বেলা স্নান না করে দুপুরে স্নান করে।মাথায় বুদ্ধিসুন্ধি কিছুই নেই!কোথা থেকে কি যে বিয়ে করে আনলো ধ্রুব!’
তাই আমি আজ সকাল সকাল স্নান করেছি।”
কাকিমনির কথাখান ওনার মতো করেই বর্ণনা করলাম আমি।শেষোক্ত কথা বলার পর গাল ফুলিয়ে ধ্রুবর দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি ঠোঁট টিপে হাসি রোধ করার চেষ্টা করছে।ওমনি চোখ বড় বড় চেয়ে আমি বলে উঠলাম,
“আপনি হাসছেন এটা শুনি?কেন?আমি কি কোন হাসির কথা বলেছি?”
ধ্রুব আমার মুখশ্রীতে স্বল্প সময় গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।তারপর ঠোঁট এলিয়ে হেসে বলে উঠলেন,
“তুমি একটা বাচ্চা মেয়ে নির্বানী!”
কথাখান বলে উনি ফের ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে শৌচাগারে প্রবেশ করলেন।পেছনে বোকা বনে তাকিয়ে রইলাম।উনার কথার মানে বোধগম্য হলো না।
ভেজা কাপড়গুলো নিয়ে আমি সিঁড়ি বেয়ে ছাদে এলাম।বাড়িটার মতো ছাদাটাও বিশাল।আকাশে তখন মৃদু রোদ।হালকা শীতল পবনও গায়ে এসে লাগছে।আমি গুটি গুটি পায়ে ছাঁদে পৌছেই থমকে দাড়ালাম।শুভের পাশে শাড়ি পরিহিতা এক রমনী দাড়িয়ে আছে।সবুজ রঙের শাড়ি কুঁচি দিয়ে পরা,হাতের বাহুতে থাকা বাজু দেখেই আমি ঢোক গিললাম।রমনীটি কে সেটা মস্তিষ্কের বোধগম্য হতেই মুখখানা থমথমে হয়ে আসলো আমার।আমি তাদেরকে দেখেও না দেখার ভান করে ভেজা শাড়ি মেলে দিতে লাগলাম।হঠাৎ পায়ের শব্দে পেছন ফিরে তাকালাম আমি।শশী এদিকেই আসছে।মুখে লেপ্টানো বড়সড় একটা হাসি।হাসিটা কি উপহাসের ছিল?
“কেমন আছো নির্বানী?ভালো আছো তো?”
আমার নিকটে এসে দাড়িয়ে প্রশ্ন করলো শশী।আমাকে তাকাতে দেখে মুখের হাসিখানা চওড়া হলো একটু।এতকিছু হওয়ার পরেও তাকে আমি এ বাড়িতে আশা করিনি।আমি কাপড় মেলে দিতে দিতে উত্তর দিলাম,
“ভালো না থাকার তো কথা নয়!”
রিনরিনিয়ে হেসে উঠলো শশী।মেয়েটা অপরুপা এটা যেমন তীব্র সত্য তেমনি সত্য হলো এই যে,ওর হাসি এই মুহুর্তে আমাকে সহ্য হলো না।শশীর চোখেমুখে আজ অন্যরকম এক ঝলক দেখিচ্ছো।হারিয়ে যাওয়া কিছু খুঁজে পেলে যেমন আপ্লুত হয় হৃদয় তেমনি।আমি দুরে তাকিয়ে থাকা শুভর দিকে তাকালাম।আমাকে তাকাতে দেখে চোখের চশমাটা একটু ঠেলে দিলো সে।আমি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলাম।দৃষ্টি হটলো শশীর তাচ্ছিল্য মিশ্রিত স্বরে,
“জমিদারের গিন্নি পদবিটার নাম ডুবাচ্ছো তুমি!”
আমার হাতে থাকা বালতিটার দিকে ইশারা করে কথাটা বললো শশী।তার কথার অর্থ বুঝলাম আমি।সাধারণত এ বাড়ির এই টুকটাক কাজকর্মগুলো পরিচারিকাই করে থাকে।প্রথম দুদিন আমার ভেজা কাপড়গুলো পরিচারিকারাই ছাদে শুকাতে দিয়ে গেছে।তিনদিনের মাথায় আমি এসেছি নিজে।এসব কাজ অন্যকে দিয়ে করানোর পক্ষে আমি নই।সেটাও আমার মালকিন হিসেবে।
আমাকে কিছু বলতে না দেখে বোধহয় শশী ভেতর ভেতর মজা পেলো।আস্তে করে বললো,
“কিন্তু কতদিন এই পদ ধরে রাখতে পারো দেখি।প্রতিযোগী কিন্তু সবদিক দিয়েই টেক্কা দিবে তোমাকে।”
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললাম,
“কি বোঝাতে চাইছেন আপনি?”
শশীর বদলে শুভ উত্তর দিলো।
“তুমিও না বৌদি!রসিকতাও বুঝো না।”
কথাটা বলে দুজনেই হেসে উঠলো।আমি দুজনের দিকে শক্ত দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে ছাঁদ থেকে চলে এলাম।
আমার প্রস্থানের পরই শুভ কোমড়ে হাত রেখে শশীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
“কাজে লেগে পরো দি।নিজের প্রাপ্য বুঝে না।”
বাঁকা হেসে উঠলো শশী।চোখের অভ্যন্তরে জ্বলে উঠলো হিংসার প্রদীপ।
তড়িঘড়ি করে সিড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে ধাক্কা খেলাম আমি।প্রায় পরেই যাচ্ছিলাম একটা হাত এসে ধরলো আমাকে।ভয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিয়েছি আমি।মেয়েলি চিন্তিত স্বর শুনে পিটপিট করে তাকালাম।
“এভাবে নামছো কেন তুমি?একটু হলেই তো পরে যেতে।”
কথাগুলো বলে রাই আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।আমার হাতের কব্জি তার জাতের মুঠোয়।আমি রাইয়ের মুখশ্রীতে একবার চোখ বুলিয়ে বললাম,
“শশী কখন এসেছে এ বাড়িতে?”
আমার কথা শুনে রাই অবাক হয়ে বললো,
“শশী এসেছে এ বাড়িতে?আশা করিনি!”
আমার হাতটা আলতো করে ছেড়ে দিলো সে।বললো,
“কিছু বলেছে ও তোমায়?”
আমি একটু ভেবে বললাম,
“জমিদার গিন্নি হওয়ার জন্য কি কি যোগ্যতা লাগে বলুন তো রাইদি।”
রাই সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে।খুটিয়ে দেখলো আমাকে।আমার মুখশ্রীতে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম তাকে জানান দিলো শশীর কোন কথায় আমি বড্ড বিচলিত।
চলবে….