মম হৃদয় বিহারিনী পর্ব-১২

0
1

#মম_হৃদয়_বিহারিনী
#ঐশী_রানী_রক্তিমা
১২.
“আবার কবে আসবেন?”

ধ্রুবর ব্যাগ গোছাতে গোছাতে প্রশ্ন করলাম আমি।উনি তখন শার্ট-প্যান্ট পরে আয়নায় নিজেকে দেখে চলেছেন।দু এক ঘন্টা পর্বে বৌভাতের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে।দুঃখজনক হলেও আজকেই শহরে ফিরছেন ধ্রুব।লোকজন মহল ত্যাগ করার পরেই নিজ কক্ষে এসে আমি ওনাকে সাহায্য করতে ব্যস্ত হয়ে পরেছি।আমার বাড়ি যেতে চাওয়ার কথা আর মুখ ফুটে বলা হয়নি।

আমি প্রশ্নটা করে ফের ব্যস্ত হয়ে পরলাম আলমারি থেকে প্রয়োজনীয় কাপড় এনে ব্যাগে ভরতে।ধ্রুব দর্পন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে থাকালেন আমার দিকে।চোখজোড়ায় লালচে আভা।আমি খেয়াল করলাম না।বারবার আলমারি আর বিছানায় রাখা ব্যাগের নিকট আসা যাওয়া করায় কক্ষে আমার নুপুরের সুক্ষ্ম আওয়াজ ও শাঁখার সংঘর্ষে উৎপন্ন হওয়া শব্দে একটা মৃদু সুরের তাল।ধ্রুব বিছানায় বসে পরলেন নিস্তেজভাবে।ওনার শূন্য দৃষ্টি বর্তালো ব্যস্ত আমার ওপর।চোখ তুলে আমি একবার ওনার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললাম,

“বললেন না যে?নাকি আর আসার ইচ্ছে নেই?”

ধ্রুব এবার আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকালেন।গভীর একটা শ্বাস টেনে ওষ্ঠ কামড়ে ধরে মাথা নত করে চোখ বুঁজে নিলেন।আমি অনিমেষ তাকিয়ে রইলাম শার্ট-প্যান্ট পরিহিত আমার অধিকারস্ত পুরুষটির দিকে।শার্টের হাতা গুটানো থাকায় ওনার লোমশ হাতদুটো ফুটে উঠেছে।যা প্রদীপের শিখায় বড্ড আকর্ষণীয় ঠেকছে।
আমি এবার হাতের কাজ থামিয়ে ফের প্রশ্ন করে ফেললাম,

“শুনছেন?”

প্রশ্নটা করে আমি থামতেই কক্ষজুড়ে গাঢ় নিস্তব্ধতা।দুটো মনুষ্যের নিরব শ্বাস-প্রশ্বাসের অতিসূক্ষ্ম আওয়াজ ব্যতিত আর কোন শব্দ নেই।ওনার এমন নিরবতায় আমি হতাশ হলাম।কেমন করে উঠলো আমার হৃদয়।উনি কি আমার আচরণে বিরক্ত হচ্ছেন?আমি কি বিরক্তিকর প্রশ্ন করছি?
আমার অভিমানের স্তর বেশ পুরু।আমি আর কোন প্রশ্ন করলাম না উনাকে।চুপচাপ হাতের কাজটা শেষ করে ব্যাগের চেইনটা লাগিয়ে দিলাম।
দেহে থাকা আভূষণগুলো হঠাৎ বিরক্ত লাগতে শুরু করলো আমার।থমথমে মুখশ্রীতে আমি আড়চোখে ধ্রুবর দিকে তাকালাম।ভদ্রলোক মাথা নিচু করে চোখ বুঁজে আছেন।হাতদুটো বিছানায় ভর দিয়ে রেখেছেন।আমি গাল ফুলিয়ে আয়নার সামনে এসে দাড়ালাম।গা থেকে একে একে সমস্ত অলংকার খুলে রেখে দিলাম।শুধু রয়ে গেল ওনার পরিয়ে দেওয়া নুপুর।

ওনার সম্মুখে এসে আমি কাপড়ের ব্যাগটা ওনার নিকটে রেখে দিলাম।মুখশ্রীতে তখন রাজ্যের অভিমান এসে বিরাজ করেছে।টু-শব্দও করলাম না আমি।
যেই ঘুরে দাড়ালাম ওমনি হাতে টান পরলো।চেনা স্পর্শ পেয়ে চুপ করে দাড়িয়ে রইলাম আমি। ফের আচমকা টান দিয়ে আমাকে ওনার দিকে ঘোরালেন উনি।আমি খানিক আটকে উঠে ওনার দিকে তাকালাম।
উনি আশ্চর্য এক কাজ করে ফেললেন।দীর্ঘদেহী মানুষটা হঠাৎ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো আমাকে।স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি।চোখ বড় বড় হয়ে গেল তৎক্ষনাৎ।
সমগ্র কায়ায় ওনার নিবিড় স্পর্শে কম্পিত হলাম আমি।হৃদপিণ্ডের কথা অবর্ণনীয়ই থাক!সেটার হাল তো ততটাও খারাপ ছিল না যতক্ষণ অবধি উনি গাঢ় স্বরে ডেকে না উঠলেন,

“নির্বানী?”

জবাব দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই আমি।এমনকি শুকনো একটা ঢোক অবধি গলধকরণ হচ্ছে না আমার।ওনার এইভাবে আমার নাম ধরে সম্মোধনে যে আমার হৃদপিণ্ডের কি হাল হয়!সেটা আদো উনি যানেন?

উনি আমাকে আরো চেপে ধরে মৃদুস্বরে বলে উঠেন,

“দুঃখিত এভাবে জরিয়ে ধরার জন্য!”

ওনার গাঢ় নিশ্বাস ছুঁয়ে দিচ্ছে আমার কাধের উন্মুক্ত অংশ।শিউরে উঠছি আমি বারবার।উনি রুদ্ধশ্বাস ফেলে বললেন,

“কেন আমার এমন সর্বনাশ করলে?”

সহসা ভ্রু কুঁচকে গেল আমার।আমি ওনার সর্বনাশ করেছি?এসব কি বলছেন উনি?”
ধ্রুব হেসে গভীর একটা শ্বাস টেনে ফের বললেন,

“বুকের মাঝে কি এক তোলপাড় শুরু হয়েছে!কান পেতে একটু শোন তো নির্বানী।হৃদপিণ্ডটাকে একটু শান্ত হতে বলো।এ দায়িত্ব তোমার নয় কি?কালকে সকালে উঠে তোমার স্নিগ্ধ মুখশ্রী দেখবে না বলে আমার উপর কেমন অত্যাচার চালাচ্ছে!ওকে একটু বকে দাও তো।তোমার স্বামীকে যেন একটু শান্তি দেয়।আর আমাকে কৈফিয়ত দাও।কেন আমার এরুপ সর্বনাশ করলে?”

আমার মাথা ঘুরে পরে যাওয়ার উপক্রম হলো।একে তো আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছেন তার উপর কিসব বলছেন!মারার ফন্দি এঁটেছে নাকি লোকটা?
আমি আর চোখ মেলে তাকানোর সাহস পেলাম না।ওনার বুকের কাছটায় আমার মাথা থাকার সেখানের টিপটিপ শব্দে অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম আমি।আমার অবস্থা আরো শোচনীয় করতে উনি হঠাৎ সাংঘাতিক এক বাক্য বলে ফেলললেন,

“আমি কি তোমায় ভালোবাসি,নির্বানী?”

কথাটা কর্ণগোচর হতেই আমার শ্বাস-প্রশ্বাস যেন থেমে গেল।আমি কি স্বপ্ন দেখছি?সম্ভবই না।লোকটার স্পর্শ,কথাবার্তা সবই তো গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

হঠাৎ আমাকে ছেড়ে দিয়ে আমার দুগালে হাত রাখলেন ধ্রুব।আমি চোখ বুঁজে ফেললাম।চোখের পাপড়িগুলো কাঁপছে অনবরত।
আচমকা চোখেমুখে ধ্রুবের নিঃশ্বাস পরতেই শাড়ি খামচে হাত মুঠো করে নিলাম আমি।অপ্রত্যাশিতভাবে আমার কপাল ছুঁয়ে দিলো ধ্রুবের পুরু ওষ্ঠ।মুহূর্তেই থমকে গেলাম আমি।উনি এবার ধীরস্বরে বললেন,

“উত্তর আমি জানি!তোমার জানা আছে নির্বানী?”

আমি চোখ বুঁজে সেভাবেই স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে।এমন অনুভুত হচ্ছে যেন এক্ষুনি মাথা ঘুরে পরে যাবো!
দ্বিতীয়বার আমার কপালে ওষ্ঠ ছোঁয়ালেন ধ্রুব।আমার হাত এবার খামচে ধরলো ওনার বুকের শার্ট।ধ্রুব মৃদুস্বরে প্রশ্ন করলেন,

“জানো?”

ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালাম আমি।সরাসরি তাকালাম ধ্রুবের চোখে দুই-তিন সেকেন্ডের বেশি তাকিয়ে থাকার সাধ্য হলো না ওই গাঢ় চোখে।দৃষ্টি নত করে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে উঠলাম,

“বা..বাসেন?”

কানের কাছে ধ্রুবর সম্মতিসূচক ফিসফিসিয়ে বলা,

“বাসি!”

আমার চোখ টলমলিয়ে উঠলো হঠাৎ।সেটা আনন্দে নাকি অন্য কারণ বুঝলাম না।অযথাই বোধহয় অশ্রু গড়ালো।সেই অশ্রু ধ্রুবের হাতে পরলেই সে হকচকিয়ে বলে উঠলো,

“এই,তুমি কাঁদছো কেন?ভালোবাসি বললাম তো।”

বোঝদার লোকটা বুঝলো না তার ভালোবাসা পেয়েই আমি কাঁদছি।আমি উত্তর না দিয়ে ওনার থেকে সরে এসে বললাম,

“আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

উনি গাঢ় দৃষ্টিতেই আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,

“তাড়িয়ে দিচ্ছ?

” ছিঃ ছিঃ কিসব বলছেন আপনি!”

ধ্রুব আলতো হেসে আমার গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো,

“চলো আমায় এগিয়ে দিয়ে আসবে।”

একহাতে ওনার ব্যাগ,আরেকহাতে আমার হাত ধরে কক্ষ থেকে বের হলেন উনি।সপ্তাহ দুই আগের মধ্যে আর আজকের মধ্যে কত পার্থক্য তাই না?সেদিন আমি জানতামও না লোকটা শহরে যাবে আর আজ আমাকে উনি নিয়ে যাচ্ছেন ওনাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য।বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম আমি।

প্রথমে আমরা এলাম শাশুড়ী মার কক্ষে।ভেতরে প্রবেশের অনুমতি নিয়ে আমরা দুজন প্রবেশ করলাম।শাশুড়ী মাকে দেখেই আমি ধ্রুবর মুঠোয় থাকা হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে দিলাম।অনেকটাই ঘোমটা টানলাম কেননা এই মুহুর্তে আমার গায়ে কোন আভূষণ নেই।ওনার চোখে সেটা পড়ুক তা চাইছি না।
শাশুড়ী মা তখন বসে বসে সুপারি কাটছিলেন।ধ্রুবর আগমন টের পেতেই চোখ তুলে তাকিয়ে বললেন,

“চলে যাচ্ছো তাহলে?”

“যেতে হচ্ছে মা।”

কথাখানা বলে ধ্রুব শাশুড়ী মার পা ছুঁয়ে দিলেন।মাথা স্পর্শ করে আশীর্বাদ করলেন শাশুড়ী মা।পরপরই ওনার চরণ ছুলাম আমি।আমাকে ধ্রুবর সাথে দেখে ওনার কি মনে হলো জানা নেই আমার।তবে উনি পরম স্নেহে আমার মাথায় হাত রাখলেন।
তারপর আমাকে আদেশের স্বরে বললেন,

“যাও,নিজের বরকে এগিয়ে দিয়ে এসো।”

আমি আলতো করে মাথা নাড়লাম।তারপর ধ্রুব ওনাকে আসি বলে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে আসলেন কক্ষ থেকে।

বসার ঘর তখন নিস্তব্ধ।দু-তিনটে মশালের আলোয় আবছা আলোকিত জায়গাটা পরিচিত হওয়ায় অনায়াসেই পার করে উঠোনে এসে পরলাম আমরা।
উনি উঠোনে এসে দাড়ালেও আমি অবস্থান করছি মহলের সিঁড়ির উপর।
আমি মৃদুস্বরে বলে উঠলাম,

“এবার আসুন তবে।আর তাড়াতাড়ি ফিরবেন।”

“ঠিক আছে।”

কথাটা বলে উনি পিছন ফিরলেন।কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করে বললেন,
“আমার ইংরেজি বইয়ের ভাঁজে তোমার জন্য কিছু একটা আছে।মনে করে পরে নিও।”

আমি ওনার কথায় আলতো করে মাথা নাড়লাম।উনি একটা গাঢ় শ্বাস ফেলে আমাকে দেখলেন।আবছা আলোয় ওনার কাছে কতটুকু দৃশ্যমান হলাম জানা নেই।তবে উনি কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললেন,

“আসি।ছুটি পেলেই আবার ফিরবো।”

আমি আবারো মাথা নাড়লাম।উনি চলে যেতে লাগলেন আমাদের মাঝে বাহ্যিক দূরত্ব তৈরি করে।আমি দুহাত একত্র করে তাকিয়ে রইলাম ওনার যাওয়ার পানে।ধীরে ধীরে বিষিয়ে উঠলো আমার মন।মন খারাপে ছেঁয়ে গেল সেটা।জানা ছিল না উনার প্রস্থানের পরপরই আমার কপালে শনির লেগে যাবে!

উনি দৃষ্টির আড়াল হওয়ার কিছুক্ষণ পরও আমি সেভাবেই দাড়িয়ে রইলাম।তারপর হঠাৎ মনে পড়লো উনি বলেছিলেন ইংরেজি বইয়ে আমার জন্য কিছু রেখেছেন উনি।সেটা খেয়ালে আসতেই আমি দ্রুত তিনতলায় আমার কক্ষের উদ্দেশ্য রওনা হলাম।কক্ষে পৌঁছে দরজা আটকে ওনার পড়ার টেবিলের সামনে এসে দাড়ালাম।ইংরেজি বইটা বের করে পাতা উল্টাতেই চিরকুটের ন্যায় একটা কাগজ চোখে পড়লো। সেটা নিয়ে বই বন্ধ করে চেয়ারে বসে পরলাম আমি।কাগজটা মেলে ধরার সময় অস্বাভাবিকভাবে হাত কাঁপছিলো আমার।বুকের ভেতর কি উচাটন!কি লেখা আছে সেটা ভাবতেই আমার হাত ঘেমে উঠছিলো।আমি ধীরে ধীরে কাগজের পৃষ্ঠাটা খুললাম।
গোটা গোটা অক্ষরে ধ্রুবের লেখা শব্দগুলো চোখের পাতায় ভেসে উঠলো।আমি মনে মনে পড়া শুরু করলাম সেটা।

❝মাধবী লতা,
জানোই তো নরম পুষ্পের স্থান যেমন সবচেয়ে সুন্দর স্থানে হয়,তেমনি লোক তাদের কোমলতার সুযোগ পেয়ে পায়ে পিষে ফেলতেও দুবার ভাবে না।
অথচ দৃঢ়,সুক্ষ্ম কাঁটার ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে না।তার সুক্ষ্মতা ও বিষাক্ততার দরুন তাকে পিষে ফেলার সাহস লোকেরা করে না।
পদ্ম,একটু কঠিন হও!একটু দৃঢ় হও ওই সুক্ষ্ম কাঁটার ন্যায়।
ইতি
তোমার অর্ধাঙ্গ❞

ধ্রুবর লেখা প্রতিটি অক্ষর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলাম আমি।এ কথা তো উনি আমাকে নিজেও বলতে পারতেন।কিন্তু সেটা এভাবে আমার নিকট পৌঁছে দিয়ে উনি আমার বড় উপকার করলেন।ওনার কথাগুলো শব্দ হয়ে বন্দি হয়ে রইলো আমার কাছে।উনি ঠিক কি কারণে আমাকে দৃঢ় হওয়ার কথা বললেন সেটা এই মুহুর্তে আমার ভাবনায় আসছে না।আমি চিরকুটখানা বুকের কাছে চেপে ধরে দীর্ঘ একটা শ্বাস টানলাম।চোখ বুঁজতেই তাতে ভেসে উঠলো ধ্রুবর সুদর্শন মুখখানা।মনে হলো যেন উনি আমার নিকটে বসে আমায় মাধবী লতা বলে সম্মোধন করছেন।সেই স্বর আমার কর্ণকুহরে নৃত্য করছে।একটু পরেই পদ্ম বলে ডেকে আমার হৃদয়ে প্রেমের সুর হয়ে বেজে উঠছেন।
আমি চিরকুটটা চোখের সামনে ফের মেলে ধরলান।ওনার তরফ থেকে পাওয়া দ্বিতীয় উপহার এটা।এটা অতিযত্নে থাকবে আমার নিকট।শুধু পারব না বক্ষ চিড়ে তাতে লুকিয়ে রাখতে!

চলবে…