মম হৃদয় বিহারিনী পর্ব-১৩

0
1

#মম_হৃদয়_বিহারিনী
#ঐশী_রানী_রক্তিমা
১৩.
ধ্রুব চলে যাওয়ার পর দুটো দিন গত হয়েছে।আমার দিন কাটে অবহেলায়,আনমনে!চোখের তৃষ্ণা হৃদয়কেও গ্রাস করছে ধীরে ধীরে।মন মস্তিষ্কজুড়ে একটাই নাম বিরাজমান।ধ্রুব!ধ্রুব দেবনাথ!

প্রতিদিনের মতো আজকেও ঘুম থেকে উঠে আমি বিছানার কাছের বড় জানালাটা খুলে দিলাম।সাথে সাথে শীতল মৃদু বাতাসের আগমন ঘটলো কক্ষে।কালকে রাতে আবার ঝড় হয়েছিল।ঝড়ের পর সকালের আকাশটা আবার ঝলমলে হয়ে ধরা দিয়েছে।সারারাত ধরে বৃষ্টি হওয়ায় ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ নাকে এসে ঠেকছে।আমি গভীর একটা শ্বাস টেনে নিলাম।বেলা কত হলো জানা নেই।এ বাড়িতে একটাই ঘড়ি আর সেটাও বসার ঘরে টানানো।সময় দেখার জো নেই।তবুও ধারণা করছি ৭ টার বেশি বাজেনি।পরিবেশ অনেকটাই শীতল ঠেকায় সকালে স্নান করার সিদ্ধান্ত বাতিল করা হলো।স্নানঘর থেকে হাতমুখ ধুয়ে বের হলাম আমি।এলোমেলো হয়ে থাকা কেশে চিরুনি চালিয়ে বিন্যস্ত করে নিলাম।তারপর খোঁপা করে নিয়ে নতুন করে সিঁদুর লেপ্টে নিলাম সিঁথি জুড়ে।মুখে একটা মুচকি হাসি ফুটে উঠলো।দর্পনের সামনে থেকে সরে এসে ধ্রুবর পড়ার টেবিলের সামনে দাড়ালাম আমি।তারপর ওনার ইংরেজি বইয়ের ভেতর থেকে চিরকুট খানা বের করে একবার পরে নিলাম।ফের রেখে দিলাম যত্ন করে।পড়ার টেবিলে থাকা বইগুলো উচ্চ মাধ্যমিকের।ওনার এখানকার যে বইদুটো উনি সাথে নিয়ে এসেছিলেন, সেগুলো নিয়ে গেছেন সাথে করে।
আমি পড়ার টেবিল ছেড়ে এবার বুকশেলফের কাছে এসে দাড়ালাম।আমার ইচ্ছে থাকলেও কখনো এখান থেকে বই নিয়ে পড়িনি।আজও বেশ সময় নিয়ে বইগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিলাম।হাঁটা চলা করায় নুপুরের মৃদু আওয়াজে মুখরিত হচ্ছিল কক্ষটি।আমি বুকশেলফ থেকে একটা বই বের করে হাতে নিলাম।ধ্রুবকে এই বইটা পড়তে দেখেছিলাম।বইটা নিয়ে বিছানায় বাবু হয়ে বসলাম আমি।বইয়ের পাতা উল্টালাম মনোযোগ দিয়ে।সময় বোধয় খুব দ্রুত কাটলো! কিছু মুহুর্ত পরেই দরজায় কড়া নাড়লো কেউ।আমি বিছানা ছেড়ে নেমে বইটা টেবিলে রাখতে রাখতে চিৎকার করে শুধালাম,

“কে?”

“বউমনি আমি!”

পরিচারিকার পরিচিত স্বর ভেসে আসলো।আমার প্রশ্নের অপেক্ষা না করেই সে পুনরায় বলে উঠলো,

“সকালের নাস্তা পরিবেশন করা হয়েছে।সকলে আপনার প্রতিক্ষায়। আপনি আজ এখনো আসছেন না তাই মা ঠাকরুন আপনাকে ডাকতে পাঠিয়েছে।”

দরজা খুলে মাথায় লম্বা করে ঘোমটা টেনে নিলাম আমি।তারপর আমি বসার ঘরের উদ্দেশ্য পা বাড়ালে আমার পিছু পিছু আসতে লাগলো পরিচারিকাটি।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব সমাপ্ত করে আমি রাইয়ের পিছু পিছু ওর কক্ষের উদ্দেশ্যে আসলাম।ইতিমধ্যে বেলা গড়িয়ে গেছে অনেকটাই।রাই ওর পেছন পেছন আমাকে যেতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো,

“কি ব্যাপার?এভাবে আমার পিছন পিছন কোথায় যাচ্ছো?”

“আপনি যেখানে যাচ্ছেন।একা একা ভালো লাগছে না আজকাল।”

আমার কথা শুনে প্রকাশ্যে মুচকি হেসে রাই বললো,

“আমার ভাই যে নেই বাড়িতে!”

ওর বলা কথায় লজ্জা পেলাম আমি।কিছু না বলে মাথা নত করে চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম।হঠাৎ থেমে দাড়ালাম আমি।একটা দরজা পেরিয়ে এসেছি।কক্ষটা প্রভা ও আভার।কি মনে করে আমি দু কদম পিছিয়ে দরজার সামনে আসলাম।দরজাটা চাপানো ছিল।একটু ফাঁক হয়ে থাকা দরজাটায় উঁকি দিতেই দৃষ্টি বড় বড় হয়ে এলো আমার।ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলাম আমি।কক্ষে উপস্থিত দুজন চমকে উঠলো তাতে।

আভা ও প্রভার মা স্বর্ণালি দেবী প্রভার কেশ নিজের মুষ্টিতে নিয়ে আছেন।বেচারা প্রভার চোখেমুখে ফুঠে উঠেছে ব্যথার চিহ্ন।চোখদুটো তার অশ্রুতে পূর্ণ।এমন পরিস্থিতিতে আমাকে দেখে দুজনেই চমকে উঠেছে।আমি ওদের দিকে এগোতে এগোতে ব্যস্ত স্বরে বলে উঠলাম,

“এসব কি করছেন কাকি মা?ওকে ব্যথা কেন দিচ্ছেন?”

কথাটা শেষ করে আমি ওনার দখল থেকে প্রভাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসলাম।নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন করছে প্রভা।পরনের শাড়ির দশা বেহাল!বোঝায় যাচ্ছে স্বর্ণালি দেবীর হাতের কয়েক ঘা পরেছে তার দেহে।আমি গাঢ় চোখে একবার প্রভার মুখশ্রীতে নজর দিলাম।গৌর বর্ণ গালে মারের ছাপ ফুটে উঠেছে।একবার চোখ তুলে নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে আমার পেছনে কাচুমাচু করে দাড়ালো প্রভা।
এবার আমি তাকালাম স্বর্নালি দেবীর পানে।বিধবা হওয়া জন্য ওনার পরনে সাদা থান।স্বাস্থ্যবান মহিলা রাগে গজগজ করছেন।আমি হঠাৎ উপস্থিত হওয়ায় বোধহয় উনি আরো ক্রুদ্ধ হয়েছেন।চোখের তীক্ষ্ণতা বেড়েছে বেশ,যা উনি লুকানোর চেষ্টায়!

“এভাবে মেয়েকে মারছেন কি জন্যে?”

কথাটা বলতে বলতে আমার ভ্রু যুগল বেকে এলো।তখনই দরজার সামনে এসে দাড়িয়েছে রাই।আমাদের দিকে তাকিয়ে সে ঘটনা আন্দাজ করার চেষ্টা করছে।

“কি হয়েছে ছোট মামি?”

কথাটা বলে যেই সে কক্ষে পা রাখতে যাবে ওমনি গর্জে উঠলেন স্বর্নালি দেবী।রাইয়ের দিকে আঙুল তাক করে একপ্রকার চিৎকার করে বলে উঠলেন,

“খবরদার!ভিতরে আইবি না তুই।”

রাইয়ের সাথে সাথে আমিও হন্তভম্ব হয়ে তাকালাম।রাইয়ের ওষ্ঠযুগল আপনা আপনি আলগা হয়ে গেল বিস্ময়ে।নিজের ছোট মামির এমন আচরণের কারণ বুঝতে পারলো না সে।স্বর্নালি দেবী নিজে থেকেই ফের বললেন,

“তোর লগে থাইক্কাই আমার মাইয়ার মাথা খারাপ হইছে।ভুত ঢুকছে মনের ভিতরে!”

কথাখানা শেষ করে আমার পেছনে থাকা প্রভাকে টেনে নিলেন উনি।বললেন,

“তুই এগুলাই শিখাইছোস ওরে তাই না?ইস্কুলে যাইয়া পড়ালেখার নামে এইসব করার গেয়ান দিছোস ওরে?”

রাই কিছু বুঝতে না পেরে বলে,

“তুমি এসব কি বলছো ছোট মামি?কি করেছি আমি?”

রাইয়ের মতো সব আমারও মাথা উপর দিয়ে যাচ্ছে।স্বর্নালি দেবী ফের গর্জে উঠে বলেন,

“তুই কি করস নাই এইডা ক?”

এটা বলে উঠে আশেপাশে কিছু একটা খুঁজতে লাগলেন।তারপর বিছানায় পরে থাকা কাগজের টুকরো এনে সেটা রাইয়ের মুখে ছুঁড়ে মারলেন আচমকা!বিকট চোখে তাকালাম আমি।স্বর্নালি দেবী বলে উঠলেন,

“নাগর জুটাইছে নাগর!ঠিক তোর মতো!”

আচমকা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো প্রভা।সাথে সাথে মায়ের শক্ত থাবা পড়লো চুলে।কান্না থামিয়ে গুঙিয়ে উঠলো প্রভা।আমি চটজলদি ওনার কবল থেকে প্রভাকে ছাড়িয়ে নিতে যেতেই উনি হাত উঁচিয়ে বলে উঠলেন,

“থাক!তোমারে আর আমার উপকার করা লাগবো না। আমার মাইয়ার ব্যপার আমি বুইঝা নিমু।”

ওনার কথা অমান্য করে আমি প্রভাকে ছাড়িয়ে আনলাম ওনার কবল থেকে।এবার উনি নিজেই বেরিয়ে গেলেন কক্ষ থেকে।আমি রাইয়ের দিকে তাকালাম।সে কান্নারত প্রভার দিকে তাকিয়ে প্রস্থান করলো।আমি প্রভাকে ধরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম।
.
প্রাতঃকালের সমাপ্তি ঘটে মধ্যান্নের আরম্ভ হয়েছে।আমি স্নান ছেড়ে মাথার চুল শুকিয়ে কক্ষ থেকে বেরুলাম।উদ্দেশ্য রাইয়ের কক্ষ।সকালের ঘটনার জন্য নিশ্চয়ই মেয়েটার মন খারাপ হয়ে আছে।এটা ভাবতে ভাবতে আমার মনও বিষন্ন হয়ে আসলো।শশী নিজের কাজে খুবই সাফল্য অর্জন করেছে।তার বানানো মিথ্যে বানোয়াট কথা এখনো সত্য হয়ে মানুষের হৃদয়ে আছে!তাও আবার এই বাড়ির মানুষের মনেই।আমি তাচ্ছিল্য করে হাসলাম।রাইকে তো ওর মা স্বয়ং বিশ্বাস করেনি।সমাজ তো কোন ছাড়!

আমি দোতলায় পৌঁছে রাইয়ের কক্ষে উঁকি দিলাম।কিন্তু তাতে রাইয়ের কোন অস্তিত্ব নেই।ভ্রু কুঁচকে কয়েকবার ওকে ডাকলাম আমি।কিন্তু তারপরও তার সাড়াশব্দ না পেয়ে নিশ্চিত হলাম সে তার কক্ষে নেই।এবার দোতলা থেকে নেমে বসার ঘরে আসতেই রাইয়ের দেখা পেলাম।কলসি নিয়ে কোথাও যাচ্ছে সে।বসার ঘরে এখন তেমন কেউ নেই।আমি রাইকে দেখতে পেয়েই ডেকে উঠলাম।রাই ঘুরে তাকিয়ে মুচকি হাসি উপহার দিলো আমাকে।আমি দ্রুতপায়ে হেঁটে এসে তার মুখোমুখি দাড়ালাম।কোমড়ে কলসি দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,

“কোথায় যাচ্ছেন?”

“পুকুর থেকে পানি আনতে।”

সহাস্যে উত্তর দিলো রাই।আমি আশ্চর্য হলাম!মেয়েটাকে কি দুঃখ ছুঁয়ে দেখে না নাকি?ভাবতেই রাইয়ের বলা একটা কথা মনে পরে গেলো আমার।কিছুদিন আগে সে বলেছিল।মৃত হৃদয়ে কোন অনুভূতি ধরা দেয় না!
রাই আমাকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে দৃষ্টি নত করে বললো,

“এতটা তো বোধহয় নিজের বরের দিকেও তাকাও না।যতটা আমার দিকে তাকিয়ে থাকো!”

রাইয়ের কন্ঠে রসিকতা উপচে পরছে।আমি চোখের পলক ফেলে রাইয়ের সাথে সাথে হাঁটতে লাগলাম।সে আমাকে তার পেছন পেছন যেতে দেখে পেছন না ফিরেই বললো,

“আমি কিন্তু পুকুর পাড়ে যাচ্ছি।”

“তো?আমার কি সেখানে যেতে মানা?”

কিছু না বলে এবার চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম আমরা।মহল থেকে বেরিয়ে পশ্চিম দিকে হাঁটতে লাগলাম আমরা।কিছুদূর হাঁটতেই একটা বাগানের মধ্যে চলে আসলাম আমরা।বাগানটা মূলত আমের।চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বুঝলাম এটা অন্য রাস্তা।আমি হাঁটতে হাঁটতে রাইয়ের উদ্দেশ্য বলে উঠলাম,

“আপনাকে কিছু প্রশ্ন করার ছিলো।”

রাই প্রতিত্তোরে বললো,

“তার আগে তুমি আপনি থেকে তুমিতে আসো।সখীদের মাঝে আপনি সম্মোধন কেমন পর পর লাগে।”

আমি রাইয়ের পানে তাকালাম।তার মুখে সবসময়ই একটা হাসির আভা লেপ্টে থাকে।অন্তত আমার সামনে!
হাস্যজ্জ্বল রুপসীর পানে তাকিয়েই আমি বলে উঠলাম,

“তুমি সবসময় এমন হাসিখুশি কিভাবে থাকো?”

“আমার কোন দুঃখ নেই তাই!”

“মিথ্যে বলছো?আমি দেখছি বাড়ির লোক তোমাকে সুযোগ পেলেই কথা শোনাচ্ছে।কখনো শশীর ছড়ানো মিথ্যে বদনামের জন্য তো কখনো তোমার এই কুমারীর ন্যায় জীবনযাপনের জন্য।”

কথা বলতে বলতে আমরা পুকুর পাড়ে চলে আসলাম।রাই শান বাঁধানো ঘাটে বসতে বসতে আমার পানে তাকালো।মুচকি হাসি মুখে বজায় রেখেই বলে উঠলো,

“বাহ,বাহ!ননদিনীর প্রতি খেয়াল আছে দেখছি তোমার!”

আমি রসিকতা করার অবস্থায় নেই।তাই গম্ভীর হয়ে বললাম,

“রসিকতা করো না।সত্যি করে বলো তো তোমার এসব খারাপ লাগে না?”

রাই আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পুকুরের জলে স্থির করলো।আমি খেয়াল করলাম সে ধীরে ধীরে গম্ভীর হয়ে আসছে।দাঁত দিয়ে ওষ্ঠ কামড়ে সে বলে উঠলো,

“তুমি আমাকে এসব কেন জিজ্ঞেস করছো?আমাকে এসব জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই!”

কন্ঠে গাঢ় অভিমানের রেশ রাইয়ের।বুঝলাম এ অভিমান তার জীবনের প্রতি।আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম।ক্ষণকাল বাদে সে নিজে থেকেই বলে উঠলো,

“যখন দুঃখ পেতে পেতে মানুষের সহ্যের সীমা পার হয়ে যায় তখন মানুষ আর দুঃখ পায় না।”

আমি গাঢ় চোখে তাকালাম এবার রাইয়ের পানে।সে এবার তাকালো সরাসরি আমার চোখের।কাজল রেখা পদ্ম আঁখির কোণে অশ্রুর অস্তিত্ব খুঁজলো আমার দৃষ্টি।তবে আমি ব্যর্থ হলাম।সামনে উপবিষ্ট নারীটি বেশ শক্ত ধাঁচের।সমাজ তাকে এমন পর্যায়ে পৌছে দিয়েছে যে তাকে দুঃখ দেওয়া কঠিন!আদোতে কি তাই?নাকি সে নিজের দুঃখ আড়াল করে চলে সবসময়?

“কিন্তু তোমার এমন কুমারীর মতো জীবনযাপনের কারণ কি?”

প্রশ্নটা কোনরকম করে আমি চুপ করে রইলাম।আশা করলাম আজও এর উত্তর পাবো না।কিন্তু আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে রাই বলে উঠলো,

“স্বামী মরলে সাধারণত বাঙালি মেয়েরা কষ্টে পাগল প্রায় হয়ে যায়।কিন্তু আমি লোকটার মৃত্যুর দিন এতটা খুশি হয়েছিলাম।যতটা খুশি আমি কখনো হইনি!”

কথা বলতে বলতে রাই সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে পিতলের কলসিতে জল ভরতে আরম্ভ করলো।আমি তার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে তাকালাম।জল ভরতে ভরতে আমার পানে তাকালো রাই।আমার বিস্ময় ঘেরা দৃষ্টি দেখে যেন মনে মনে তৃপ্ত হলো সে।জল ভরা শেষে কলসি কোমড় নিয়ে এবার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ফিসফিসয়ে বলার মতো করে বলে উঠলো,

“যার মৃত্যুতে আনন্দ হয়,তার জন্য কিসের বৈধব্য জীবন?”

রাইয়ের চোখেমুখে আলাদাই এক ঝলক ফুটে উঠলো।আমি শুকনো ঢোক গিললাম।আমাকে এভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে হঠাৎ খিলখিলয়ে হেসে উঠলো।বললো,

“এটা শুধুমাত্র একটা কারণ।এতেই তুমি এমন করে তাকাচ্ছো?জিজ্ঞেস করছে না কেন খুশি হয়েছি?তোমার না অনেক কিছু প্রশ্ন করার ছিল?”

আমি রাইয়ের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আশেপাশে তাকালাম।একটা গভীর শ্বাস নিয়ে চোখ বুঁজে বললাম,

“আমি এখনো পরিষ্কার উত্তর পাইনি।”

“আমি দিচ্ছিও না।”

চোখ মেলে তাকালাম আমি।রাই কেমন করে যেন তাকালো আমার দিকে।তার দৃষ্টি ছুঁয়ে দিলো আমার কায়া।সেইসব জিনিসে সে গাঢ় দৃষ্টি বুলানো যা আমার বৈবাহিক জীবনের চিহ্ন বহন করে।তারপর বলে উঠলো,

“তুমি অনেক ভাগ্যবতী নির্বানী!যে ধ্রুবর মতো একজন পুরুষ তোমার স্বামী হয়েছে।তোমার বিয়েতে তোমার হবু বর না আসাটা তোমার জীবনের সবচেয়ে লাভবান বিষয় ধরে নিতে পারো তুমি।ধ্রুবর মতো ছেলেরাই প্রকৃত স্বামী হয়,নয়ত এই জগৎ সংসারে স্বামী রুপী অমানুষের তো অভাব নেই।”

একটু থেমে বের রাই বললো,

“আমাকেই দেখো!আমি তো ভুক্তভোগী!”

ভারী একটা কথা অথচ মেয়েটার মুখে মলিন হাসি লেপ্টে।তার দৃষ্টিই যেন বলে দিল মেয়েটার একটা কালো অতীত আছে।তার চোখের ওই কাজলের থেকেও কালো!
.
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার পর প্রতিদিনের মতো আজকেও পুরো জমিদার বাড়ি আগুনের শিখায় আলোকিত হয়ে উঠলো।সময় গড়ালো!রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে সকলে চলে গেল নিজেদের কক্ষে।আমিও সকলের মতো খাওয়া দাওয়া সেরে নিজ কক্ষের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।তিনতলায় পৌঁছাতেই আচমকা এটা পুরুষালি অবয়ব সামনে এসে পরে আমার।চমকে দু এক পা পিছিয়ে যাই আমি।লোকটা আর কেউ নয় শুভ।আমার দিকে হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রীতে তাকিয়ে আছে সে।তবে আমি তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম।

“কেমন আছেন,বৌদি?”

“ভালো।”

শক্ত কন্ঠে জবাব দিলাম আমি।শুভর ওপর আমার চাপা একটা রাগ আছে।মূলত শশীর বিষয়টা নিয়ে!

“সেকি!আপনি রাগ করছেন কেন?দেবররা বৌদির সাথে একটু আধটু দুষ্টমি তো করবেই!”

“এসব দুষ্টমি আমার মোটেও পছন্দ নয়।”

স্পষ্টভাবে কথাটা বলে শুভকে পাশ কাটিয়ে নিজ কন্ঠ চলে আসলাম আমি।তখনো অবধি আমার অজানা ছিল আজ আমার সাথে কি ঘটতে চলেছে!
দরজায় খিল এঁটে সরাসরি বিছানায় এসে বসলাম আমি।যেখানটায় ধ্রুব বসে!কক্ষজুড়ে মৃদু আলো।আজ কম প্রদীপ জ্বালানো হয়েছে।যতটুকু আলোকিত হয়েছে কক্ষটা তার প্রায় পুরোটাই হারিকেনের গুনে।

আমি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে লাগলাম।কানে থাকা ছোট স্বর্ণের ঝুমকোটা খুলে রাখার পরই একটা উটকো গন্ধ এসে নাকে ঠেকলো।কিছু পুড়লে যেমন শব্দ হয় ঠিক তেমন শব্দ এসে কানে বাজলো।আমি চট জলদি পেছন ফিরে তাকালাম।দৃষ্টি বড় বড় হয়ে এলো আমার।শাড়ির আঁচলে আগুন!
দাউদাউ করে আগুনের মাত্রা বাড়ছে ক্রমশ।ভয় পেয়ে শাড়ি খুলে ফেললাম আমি।বুঝতে পারছিলাম না আগুন লাগলো কিভাবে?
তখনি সবকিছু ঠিক ছিলো।কিন্তু এর পরেই আমার ভাগ্যে নেমে এলো ঘোর আঁধার।আচমকা বিছানার নিচ থেকে একজন বেরিয়ে আসলেন!আমার পরনে তখন কেবল ব্রাউজ আর পেটিকোট!বদ্ধ ঘরে হঠাৎ বিছানার নিচ থেকে একজন পুরুষকে বেরিয়ে আসতে দেখে আমার অক্কা যাওয়ার পালা।লোকটা বেরিয়ে আসতেই প্রায় পুড়ে যাওয়া শাড়িটা বুকে জড়িয়ে নিলাম আমি।আমি শক্ত বাক্য বলতে গিয়ে অনুভব করলাম আমার গলার স্বর অতি দুর্বল শুনাচ্ছে।

“কে আপনি?এই ঘরে এলেন কি করে?”

লোকটা উত্তর না দিয়ে কুৎসিত ভাবে হেসে উঠলো।আমি ভয়ে পিছাচ্ছিলাম একটু একটু করে।পালোয়ানের ন্যায় গড়নের লোকটা আচমকা আমার দিকে এগোতে লাগলো।হঠাৎ দরজায় অনেকগুলো থাবা পরলো।চমকে সেদিক পানে দৃষ্টি দিলাম আমি।বাইরে থেকে তখন অনেকজনের স্বর ভেসে আসছে।প্রয়াস চলছে দরজা ভাঙার!

চলবে…