মম হৃদয় বিহারিনী পর্ব-২৭ এবং শেষ পর্ব

0
2

#মম_হৃদয়_বিহারিনী
#ঐশী_রানী_রক্তিমা
#অন্তিম_পর্ব(প্রথমাংশ)

পনেরো মিনিটের ব্যবধানে ছেলেটা আমাকে নিয়ে হাসপাতালের সামনে থামলো।আমি দ্রুত রিক্সা থেকে নেমে পড়লাম।শাড়ির আঁচল লুটোপুটি খেল ধুলোমাখা রাস্তায়।চোখের অশ্রু জমে টলমল করছে।আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করছি তাদের রোধ করার।আমি এবার ছেলেটাকে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠলাম,

“কো..থায় উনি?”

ছেলেটা কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেলো।আমার অতি চিন্তিত মুখশ্রী,কেঁপে উঠা কন্ঠে সে আস্তে করে জানালো,

“আসুন আমার সাথে।”

আমি কথামতো সাথে সাথে চললাম। শহরে এসে আজই প্রথম হাসপাতালে পা রাখলাম আমি।ছোটবেলায় একবার এসেছিলাম।হাসপাতালের কিরকম একটা গন্ধ বিরক্ত লেগেছিলো।তারপর আর এমন কোন প্রয়োজনও পরেনি এখানে আসার।

হাসপাতালের বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে খোঁপা করা চুল উম্মুক্ত হয়ে লুটিয়ে পরলো কোমড় বেয়ে।
ছেলেটা আমাকে নিয়ে একটা কক্ষের সামনে দাড়ালো।আমি দরজা দিয়ে উঁকি দিলাম ভেতরে।বুক প্রচন্ড গতিতে উঠানামা করতে লাগলো ঘন ঘন শ্বাসের ফলে।অক্ষিপটে ভেসে উঠলো বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে থাকা ধ্রুবর চিত্র ।ওনাকে ঘিরে আরো দুজন দাড়িয়ে আছেন।উনি ওদের সাথেই কি নিয়ে যেন কথা বলছিলেন।চেহারায় রুষ্ট ভাব।কি কথা হচ্ছে তা আমার পক্ষে শোনা সম্ভব হলেও আমার কর্ণগোচর হলো না কিছুই।আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে কথা বলতে থাকা ধ্রুবর পানে।হঠাৎ দাঁড়িয়ে থাকা দু’জনের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দরজার দিকে তাকালেন উনি।চোখাচোখি হলো আমাদের।আমি শুকনো ঢোক গিলে আঁকড়ে ধরলাম দরজার হাতল।

“দাদুর কি হয়েছিলো গো দিদা?”

আমার সামনে গোল করে বসে থাকা মেয়েদের মাঝে থেকে একজন প্রশ্ন করে উঠায় অতীত থেকে বাস্তবে ফিরলাম আমি।প্রশ্ন করা মেয়েটার দিকে তাকালাম আমি।নীল সাদার মিশ্রণে সেলোয়ার-কামিজ পরিহিতা রমনীর চোখেমুখে প্রবল কৌতুহল।আমি বর্তমানে বসে আছি একটা কলেজের নিচতলার বারান্দায়।আমার সামনেই খোলা মাঠে।সেখানের সবুজ ঘাসের উপর বসে আছে দশের অধিক রমনী।আমি তাকিয়ে দেখলাম সকলের চোখেমুখে বিশাল কৌতুহল।আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

যে কলেজটায় বসে আছি এটার প্রতিষ্ঠাতা আমার স্বামী,ধ্রুব।ওনার পড়াশোনা শেষ করে গ্রামে এসে একবছরের মাঝে এই কলেজখানা প্রতিষ্ঠা করার কাজে লেগে পরেন উনি।গ্রামে বিদ্যালয় থাকলেও কলেজ ছিল না।যার ফলে মাধ্যমিকে ভালো নম্বরে পাশ করার পরেও অনেক শিক্ষার্থী কলেজে পড়ার সুযোগ পেতো না।আর্থিক সমস্যা আর পরিবারের নিষেধাজ্ঞা ছিল ব্যাপক।তার উপর মেয়েদের শুধুমাত্র পড়াশোনার জন্য শহরে কোন বাবা-মা পাঠাতে রাজি নন।তাই গ্রামে আসার একবছরের মাঝে ধ্রুব সিদ্ধান্ত নেন উনি কলেজ প্রতিষ্ঠা করবেন।
সেই কলেজের প্রাঙ্গণেই বসে আজ অতীতে ডুব দিয়ে আমার বিয়ের ঘটনা থেকে শুরু করে সুখ ও দুঃখের মিশেলে স্মৃতিতে থাকা কিছু ঘটনা এই কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিকট ব্যক্ত করছি।পরনে নীল রঙা শাড়িটা আজও আটপৌরে পরা।আধুনিকতার খাতিরেও কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরা হয় না।যৌবনের প্রেমালাপ করতে করতে যেন কিছু সময়ের জন্য ভুলেই গিয়েছিলাম আমি এখন দুজন নাতি-নাতনির দিদা হই।মনে মনেই হাসলাম আমি।উঁহু!তেমন একটা বুড়িও কিন্তু হইনি।মাথায় এখনো গুনে দেখলে সাদা চুলও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

অতীতের সেইসব কাহিনি সকলের কাছে বলার পেছনে একটা কারণ আছে।কারণটা হলো কলেজের নাম।ধ্রুব কলেজের নামকরণ যে নামে করছেন তা হলো,
মম হৃদয় বিহারিণী মহাবিদ্যালয়।

এই কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন এই যে কেন কলেজের নাম এটা দেওয়া হলো?এত অর্থবোধক,সুন্দর নামের পেছনের কারণটা কি?ধ্রুব এই কলেজ সম্পূর্ণ নিজের পুঁজিতে বানিয়েছিলেন।তখন শুধুমাত্র একতলা একটা ভবন ছিল।বর্তমানে সেটা চারতলা বিশিষ্ট অনেক বড় ও সুখ্যাতি একটা কলেজ।
আচমকা এই কলেজেরই একজন মহিলা লেকচারার এসে উপস্থিত হন রমনীদের দলে।মেয়েরা তাকে দেখে একটু ভরকায়।শিক্ষিকা আবার বকা না দেয় ক্লাস না করে এখানে বসে কাহিনি শোনার জন্য।কিন্তু উপস্থিত রমনীদের অবাক করে দিয়ে শিক্ষিকা স্বয়ং নরম ঘাসের উপর আসন গ্রহণ করে বসেন।মেয়েরা অবাক হয় বটে।গম্ভীর,সিরিয়াস মিস তাদের সাথে এভাবে বসে পরলো!

“কি হয়েছিলো আপনার স্বামীর? বলা শুরু করুন তো মিসেস ধ্রুব দেবনাথ।”

আমি শাড়ি পরিহিতা অবিবাহিত রমনীর দিকে তাকালাম একদন্ড।তারপর একটা গাঢ় শ্বাস ফেলে পুনরায় ডুব দিলাম সেই সময়ে।

দরজায় আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধ্রব থমকালেন যেন।ওনার দৃষ্টি বুঝে আমার খেয়ালে আসলো মাথার কেশ উন্মুক্ত হয়ে আছে।আমি দ্রুত চুলের খোঁপা করে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম।আকস্মিক নুপুরের আওয়াজে দাড়িয়ে থাকা দুজন যুবক পেছন ফিরে তাকালো।ধ্রুব আমার দিকে তাকিয়েই ওদের উদ্দেশ্যে বললো,

“আমার স্ত্রী।”

আমি দুজনকে আড়চোখে দেখে ধ্রুবর নিকটে এসে দাড়ালাম।মাথায় সাদা পট্টি বেঁধে রাখা ওনার।খানিক রাঙা দেখাচ্ছে সেটা।আমি সেটা ছুঁয়ে দিয়ে অতি চিন্তিত স্বরে বলে উঠলাম,

“কি হয়েছে আপনার?ওই ছেলেটা বললো আপনার এক্সিডেন্ট হয়েছে!”

নরম মনের মানুষের হওয়ার দোষ বোধহয় একটাই।অল্পতেই চোখে জল চলে আসে।বিশেষত প্রিয় মানুষের ব্যাপারে অশুভ কোন সংবাদ পেলে।এতক্ষণ ধরে আঁটকে রাখা অশ্রুকে বাঁধা দেওয়ার ক্ষমতা আর হলো না আমার।বিশেষত ধ্রুবর সামনে আমি বড্ড নাজুক।অশ্রুরা বাঁধ মানে না।আমাকে চোখের জল ফেলতে দেখে বিচলিত হলেন ধ্রুব।চোখের ইশারায় যেন দুজনকে প্রস্থান করতে বললেন।ওরা চলে গেলে উনি আমার হাত নিজের মুঠোয় দিয়ে বললেন,

“তেমন কিছু হয়নি নির্বানী।জাস্ট একটা অটো সামনে চলে এসেছিলো।মাথায়,আর হাতে আঘাত পেয়েছি সামান্য।তুমি শান্ত হও।”

ধ্রুব রাগী কন্ঠ ব্যাতিত আমাকে শান্ত করার বিকল্প উপায় নেই।ওনার প্রেমময় স্বরে আমি আরো নাজুক হয়ে পরি।
আমাকে নিঃশব্দে অশ্রু ফেলতে দেখে এবার ধ্রুব দরজার দিকে তাকিয়ে ডেকে উঠলেন,

“অর্ণব?ভেতরে আসো।”

আমাকে ধ্রুবর খবর দেওয়া ও এখানে নিয়ে আসা ছেলেটা ধীরে ধীরে প্রবেশ করলো ভেতরে।আমাকে কাঁদতে দেখে দাঁত দিয়ে নখ খুটলো সে।ধ্রুব কড়া কন্ঠে বলে উঠলো,

“তুমি কি বলেছো ওকে?এভাবে কাঁদছে কেন সে?”

ধ্রুবর স্বরে ভয় পেলো যেন তারা।এই তিনজনই ধ্রুবর জুনিয়র।মেসে থাকাকালীন একইসাথে থাকতেন ওনারা।
ধ্রুবর কথার প্রতিত্তোরে ছেলেটা তড়িঘড়ি করে জানালো,

“বিশ্বাস করো ধ্রুবদা।আমি বৌদিকে শুধু বলেছি যে তোমার এক্সিডেন্ট হয়েছে।আর তাতেই উনি এত বিচলিত হয়ে পরেছেন।”

আমার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে কথাটা বললেন উনি।ছেলেটা এত ভয় পাচ্ছে কেন ধ্রুবকে?আমার স্বামী কি এতটাই রুঢ়?

“এজন্যই আমি তোমাদের বলেছিলাম বাড়িতে খবর দেওয়ার প্রয়োজন নেই।তোমরা তো শুনলে না।বললে বৌদিকে খবর দেওয়াটা জরুরি।আমি নাকি একা বাড়িতে যেতে পারবো না কারণ মাথায় চোট লেগেছে।হাত-পা তো ভাঙেনি।বাড়ির ঠিকানা আগে থেকেই জানতে।চলে গেলে তোমাদের বৌদিকে জানাতে।অতঃপর কাঁদিয়ে নিয়ে এলে।”

অর্ণব নামের ছেলেটা ধ্রুবর দিকে করুন চোখে তাকালো।বললোধ্রুব সরু চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।আমি চোখের জল মুছে বলে উঠলাম,

“ওনাকে ধমকানোর প্রয়োজন নেই।উনি সত্যিই বলছেন।”

আমাকে চোখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে তাকাতে দেখে শান্ত হলেন ধ্রুব।বিছানা থেকে উঠে পরলেন ফট করে।আমার হাতটা ধরে কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসতে বললেন,

“বাড়ি যাবো।তুমি আবার কাঁদবে আমি জানি।বললাম তো আমার কিছু হয়নি।”

.

সেদিন ধ্রুব এক্সিডেন্ট করেছে শুনে আমি সত্যিই বড় ভয় পেয়ে বসেছিলাম।ঈশ্বরের নিকট অসংখ্য কৃতজ্ঞতা তিনি ওনাকে সুস্থ রেখেছেন।তবে ধ্রুবর কপালের আঘাত আর হাতের চোট এখনো ঠিক হয়নি।সেইজন্য আজ ওনাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে দেইনি আমি।ওনাকে যেতে মানা করার পর উনি দুদন্ড আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন করুন চোখে।আমার চোখে তখন একরাশ রাগ।ওষুধপত্র খাওয়ায় ওনার বেশ অনীহা।কপালের ক্ষতটা একটু গভীর।ওষুধ না খেলে ঠিক হবে?

উনি আমার অসুখে যতই যত্নশীল নিজের বেলায় ততটায় অনীহা ওনার।বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে মানা করায় উনি ব্যাগট্যাগ রেখে এখন আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছেন।আমি আধশোয়া হয়ে বসে আর উনি আমার উদরে মাথা রেখে শুয়ে আছেন।হঠাৎ উনি বলে উঠলেন,

“ও কবে আমাদের পাশে শুয়ে থাকবে নির্বানী?

আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,

” কে?”

ধ্রুব আমার সামান্য ফুলে ওঠা পেটে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে উঠলেন,

“এখানের বাসিন্দা!”

আমি মিটিমিটি হেসে বলে উঠলাম,

“সকল সময় হবে।ভগবান যেদিন তাকে পৃথিবীতে পাঠাবেন তার চমৎকার বাবার সাথে দেখা করার জন্য।”

“আচ্ছা?”

“হুম।”

আমি মিটিমিটি হেসে উত্তর দিলাম।তারপর ওনার রেশমি কালো,ঘন চুলে হাত ডুবিয়ে ঝুঁকে আলতো করে চুমু খেলাম সেটায়।ধ্রুবকে হঠাৎ গম্ভীর দেখালো।আমি মৃদুস্বরে বলে উঠলাম,

“হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন যে?”

ধ্রুব ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে বলে উঠলো,

“কিছুদিনের মধ্যেই তোমার দেওয়া ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে।ভাবছি পুঁচকেটাকে নিয়ে তুমি পড়াশোনা করবে কিভাবে?”

আমিও পড়লাম চিন্তায়।আসলেই তো!আমি একটা শুকনো ঢোক গিললাম।ধ্রুব নিজেই বলে উঠলো,

“চিন্তা করো না বউ।আমি একটা কাজের লোক রেখে দিবো।দিনে সে তোমার কাজগুলো করে দিবে আর রাতে আমি।কেমন?”

আমার চোখ ভরে উঠলো হঠাৎ।অন্যসব স্বামী হলে হয়ত বলতো আর পড়াশোনার প্রয়োজন নেই।বাচ্চার মা হয়েছে যথেষ্ট হয়েছে।আমার এক দিদি বাচ্চার হওয়ার পরে আর পড়তেই পারেনি।জামাইবাবুর কড়া নিষেধ ছিল বাচ্চা যেহেতু গর্ভে এসেছে দিদির পড়ার কোন প্রয়োজন নেই।যদিও জামাইবাবু পেশায় ডাক্তার ছিলেন।
পেশায় কি যায় আসে?বাস্তবে মানুষের পেশা নয়,তাদের চিন্তাধারা ও মনমানসিকতায় মানুষকে বড় করে।

কিন্তু আমার পোড়া কপালে ধ্রুবর মতো একজন স্বামী ঈশ্বর লিখে দিয়েছিলেন।যিনি শুরু থেকেই আমার সম্মান রক্ষা করে আসছেন।একফোঁটা আঁচও লাগতে দিচ্ছেন না আমার গায়ে।আমার পড়াশোনার তীব্র ইচ্ছের কথা আমি ওনাকে বলিওনি পর্যন্ত।উনি যেন কিভাবে সেটা জেনে গিয়েছিলেন।আমাকে শহরে নিয়ে এলেন।তারপর ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ালেন নিজ দায়িত্বে।এখন উনি চিন্তা করছেন বউ তার বাচ্চাসহ কিভাবে পড়াশোনা করবে।নাজুক আমি এত ভালোবাসা সহ্য করতে না পেরে কেঁদে ফেললাম।ধ্রুব ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে আগলে নিলেন আমাকে।

আমি ওনার বুকে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলাম।আজ চোখের অশ্রুতে ওনার প্রেমের প্রশংসা মিশে।ধ্রুব নামক আমার দেখা শ্রেষ্ঠ মানবের ভালোবাসা মিশে।
মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ধ্রুব বলে উঠলেন,

“হুঁশ!একদম কাঁদবে না নির্বানী।কান্না থামাও বলছি।নয়তো…”

ধ্রুব জানেন আমি এরকম করে বললে কান্না থামাতে পারি না।তবে আজ আমি চোখ মুছে মাথা উঁচিয়ে ওনার দিকে ভেজা চোখে তাকালাম।উনি কি কোন কারণে ব্যাথিত হলেন?

আমার নিকট ওনার মুখশ্রী এনে ফিসফিসয়ে বললেন,

“আজ বড় লক্ষী মেয়ে হয়ে গেলে যে?”

আমি ভেজা চোখেই হালকা করে হাসলাম।আমার কান্না থামানোর পদ্ধতিতে একটু গরমিল হলো আজ।ওনার গাঢ় চুম্বনের কপালে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিলাম যে আমি।
ধ্রুব আমাকে বুকের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন,

“তুমি আজ অনিয়ম করলে বউ।কিন্তু তোমার স্বামী ন্যায় বিচারে বিশ্বাসী।সবসময়ের মতো আজকেও ভালোবেসে কান্না থামাবো তোমার।”

কথাট বলই ধ্রুব আমার গলায় মুখ গুঁজলেন।আমি একপ্রকার চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,

“সরুন!সে কিন্তু দেখছে।”

“কে?”

“আপনার অনাগত সন্তান।”

ধ্রুব মুচকি হেসে বলে উঠলেন,

“সে এখনো তোমার অভ্যন্তরে মিসেস।তাই আমাকে আমার কাজ করতে দিন।”

চলবে….

#মম_হৃদয়_বিহারনী
#ঐশী_রানী_রক্তিমা
#অন্তিম_পর্ব(শেষাংশ)
ভোরের প্রথম আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পরতেই অন্ধকারে ডুবে থাকা বিচিত্র ধরিত্রী আলোয় ভরে উঠতে লাগলো।আঁধার ঘুচে যেতে লাগলো কর্পূরের ন্যায়।প্রকৃতি সবসময় আমাদের শিক্ষা দিয়ে চলে।তারমধ্যে একটি এই রাতের পর দিন হওয়া আর দিনের পর রাত।রাত্রি যত গভীর হয় প্রভাত তত নিকটে আছে।এটি একটি প্রচলিত বাক্য।যার মর্মার্থ গভীর!

ভোরের আলো বারান্দার শুভ্র বর্ণের পর্দায় পরতেই উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে পরলো আমাদের শোয়ার কক্ষটা।সেই দীপ্তি চোখে এসে পরতেই ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে আমার।ঘুম পাতলা হওয়ায় সহজেই ঘুম ভেঙে যায়।দিবসের প্রতিদিনই ধ্রুবর আগেই আমার ঘুম ভাঙে।কিন্তু এখন মাসখানেক যাবত ধ্রুবর আগে ঘুম ভাঙলেও বিছানা ছেড়ে একা একা স্নানঘরে যাওয়ার অনুমতি নেই আমার।আমি উঁচু পেটটা নিয়ে ধীরে ধীরে আধশোয়া হয়ে বসলাম।সামনে তাকাতেই সূর্যালোকের প্রকোপে বেশ উজ্জ্বল হয়ে থাকা সাদা পর্দাটা চোখে পরে।চোখে খানিকটা ব্যথা দেয় সেটা।ধ্রুবকে বলে পর্দাটা পরিবর্তন করে গাঢ় রঙের পর্দা নিয়ে আসতে বলতে হবে।
ঘুম ভাঙতেই এখন আমার সর্বপ্রথম কাজ হলো ঘুমন্ত পতিকে জাগিয়ে তোলা।আমি উপুড় হয়ে থাকা ধ্রুবর গায়ে হাত দিয়ে মৃদুস্বরে ডেকে উঠলাম ওনাকে।মিনিট পরে ঘুমে জড়ানো কন্ঠে ধ্রুব আওয়াজ দিয়ে উঠেন,

“ঘুম ভেঙে গেছে?”

“হ্যা।স্নানঘরে যাবো।উঠুন।”

আধামিনিটের মতো সময় নিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসে ধ্রুব।দৃষ্টি পরিষ্কার করে তাকায় আমার দিকে।মাথার এলোমেলো হয়ে থাকা চুলে হাত বুলিয়ে দেন স্বযত্নে।তারপর কানের পিঠে একগুচ্ছ চুলে গুঁজে দিয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেন।আমি ওনার হাতে ধরি শক্ত করে।পেটটা বেশ খানি বেড়েছে।আটমাস চলছে তো।পেটের ভেতর থাকা প্রাণের আসার সময় হলো বলে।আজকাল ধ্রুবর যত্ন বেড়েছে অনেক খানি।লোকটাকে দেখে আমি প্রতিনিয়ত অবাক হই।রাতে ঘুমাতে পারি না ঠিকমতো।হঠাৎ করে পেটে ব্যথা বাড়ে।প্রবল কান্নায় ভেঙে পরলে ধ্রুবর বক্ষস্থল ব্যতীত দ্বিতীয় আশ্রয় নেই আমার।মাঝ রাতে উঠে হুটহাট কেঁদে উঠা আমিকে উনি সামলান অতি যত্নে।বুকে জড়িয়ে ধরে পিঠে আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন অনেকক্ষণ ধরে।যতক্ষণ না আমি ব্যথা ভুলে ঘুমিয়ে পরি।সেই সাথে হুটহাট মন খারাপের তো আজকাল লাইসেন্স হয়ে গেছে।যখন তখন এসে মনে ভীড় জমায়।আর সেই মন খারাপ ভালো করতেই ধ্রুব লেগে পরেন।

“সাবধানে পা রাখো।”

মেঝেতে পা রাখার পূর্বে ধ্রুবর নির্দেশে ওনার দিকে চোখ তুলে তাকালাম আমি।সজাগ চোখজোড়ার ঘুমের রেশকে জোর করে বহুদূরে পাঠিয়েছেন উনি।এখন সে দুটোতে কেবল সচেতনতা।
মেঝেতে পা রাখতেই আমাকে ধরে ধরে স্নানঘরে ভেতরে নিয়ে এলেন ধ্রুব। পাশে দাঁড়িয়ে থেকে বললেন,

“হাত-মুখ ধুয়ে নাও শুধু।আমি দুপুরে আসার পর স্নান করবে।এখন পরিবেশ শীতল।ঠান্ডা লাগবে।”

আমি যতক্ষণ না হাতমুখ ধুয়ে নিই ততক্ষণ অবধি আমার পাশেই দাড়িয়ে থাকবেন উনি।তারপর আমাকে বারান্দায় এসে বসিয়ে রেখে স্বয়ং হাত-মুখ ধুতে স্নানঘরে যাবেন।এটাই এখন নিত্যদিনের প্রাতঃকালের কাজ ওনার।
বারান্দায় বসতেই আমি চোখজোড়া বদ্ধ করে নিলাম।সকালের স্নিগ্ধ বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে কায়া।আমি গাঢ় একটা শ্বাস টেনে নিলাম।কানে এসে ঠেকতে শুরু করলো রিক্সার হর্ণের টুংটাং আওয়াজ।গ্রামের সতেজ,নিঃশব্দ সকালগুলো বড্ড মনে পরে আমার।শাশুড়ী মা চিঠি পাঠিয়ে বলেছিলেন আমাকে গ্রামে রেখে আসতে।ধ্রুবর পড়াশোনায় সমস্যা হবে নয়তো।একা একা বউয়ের খেয়াল রাখতেও হোঁচট খেতে হবে।তবে ওনার এই প্রস্তাবকে উনি সুন্দরভাবে প্রত্যাখান করেছেন।স্ত্রীর অর্থাৎ আমার এই অবস্থায় উনি আমার সাথেই থাকবেন।শহরেই রাখবেন আমাকে।কেননা গ্রামে গিয়ে মাসের পর মাস কাটানো ওনার পক্ষে সম্ভব নয়।আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির সবকিছু দুমাস আগেই সম্পন্ন করেছেন উনি।আমার পক্ষে যদিও এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস করা সম্ভব নয়।এই নিয়ে কিছু বলেননিও উনি।

স্নানঘরের দরজার আওয়াজ হতেই নিজ ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলাম আমি।ধ্রুব গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে এদিকেই আসছেন।হাতে একটা চিরুনি আর সরু কালো খোঁপা।
উনি বারান্দায় পা রাখতেই আমি হাসিমুখে জানালাম,

“দেখুন,দুরের ওই শাপলার বিলে কত সুন্দর ফুল ফুটেছে!”

আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে উনি সম্মুখ পানে তাকালেন।আমরা যেই বাড়িতে থাকছি সেই বাড়ির সামনে কিছুটা জায়গা এখনো ফাঁকা আছে।অদূরেই ছোট একখানা পুকুরে লাল টকটকে শাপলা ফোঁটে।আমাদের বারান্দা থেকেই সেটা দেখা যায়।
ধ্রুব আমার ঠোঁটে লেগে থাকা হাসির দিকে তাকালেন মোলায়েম ভাবে।তারপর শান্তস্বরে বললেন,

“একটু পরেই সেগুলো নেতিয়ে যাবে।”

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আস্তে করে বললাম,

“হুম!”

হঠাৎ মাথায় চুলে ধ্রুবর স্পর্শ।এলোমেলো হয়ে থাকা চুলে চিরুনি চালাচ্ছেন উনি।আমি উদাস হয়ে বসে রইলাম দুরের সেই শাপলা পুকুরের দিকে তাকিয়ে।
ধ্রুব আমার চুলে লম্বা করে বেনি করে নিয়ে বললেন,

“কিছু খাবে?

আমি দুপাশে মাথা নেড়ে না বোঝালাম।ধ্রুব এবার স্নানে ঢুকলেন।আমি গালে হাত দিয়ে বসে রইলাম সকালের মিষ্টি রোদের মাঝে।কাল রাতে বোধহয় ঝুম বৃষ্টি এসেছিলো।আশেপাশের গাছগুলোতে পানির ফোঁটা লেগে আসে।আচ্ছা বৃষ্টিতে স্নান করা ওই লাল শাপলাগুলোকে কাছ থেকে এখন কেমন দেখতে লাগছে?পুষ্পের উপর জমে থাকা বৃষ্টি কণার উপর সূর্যের আলো পরতেই মুক্তোর ন্যায় চমকাচ্ছে বোধয় সেগুলো।আমার ভাবনার মাঝেই দরজায় কড়া পরলো।কাজের মাসি এসেছে বোধহয়।সকালে কাজে এসে সন্ধ্যা বেলা রাতের রান্না করে যান তিনি।ধ্রুব স্নানে থাকায় আমিই ধীরে ধীরে উঠে দরজা খুলে দিলাম।মিনতি মাসি চলে গেলেন রান্নাঘরে আর আমি ফের ধীরে ধীরে চলতে চলতে শোয়ার ঘরে পৌঁছালাম।

শোয়ার ঘরের পর্দা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই সদ্য গোসল করে আসা ধ্রুবকে নজরে আসলো।উন্মুক্ত বক্ষে বিন্দু বিন্দু জলের কণা।ভেজা রেশমি চুল কপালের কাছটায় এসে ঠেকেছে।সবসময় সেগুলোকে পেছন দিকে ঠেলে রাখেন উনি।আমি নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে।

আলমারি থেকে শার্ট বের করে ওনার দিকে বাড়িয়ে দিলাম আমি।আমার হাতে থাকা হালকা গোলাপি শার্টটায় দিকে তাকিয়ে ঈষৎ হাসলেন উনি।তারপর আমার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললেন,

“এই কাজগুলো আপাতত তোমাকে করতে হবে না।ছুটি উপভোগ করো।”

আমি ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে বললাম,

“আপনি আমার প্রায় সমস্ত কাজ করে দেন।আমি কোন কাজ করতে পারি না।আমার ভালো লাগে না শুধু শুধু বসে থাকতে।”

ধ্রুব ভেজা চুল মোছা থামিয়ে আমার দিকে তাকান সরু চোখে।আমি ওনার দিকে তাকিয়ে আছি।ধ্রুব খানিক নিকটে এসে দাঁড়ান এবার।আমার দিকে ঝুঁকে গাঢ় চোখে তাকান।আমি দৃষ্টি নামিয়ে নেই।আমাকে চুপ করানোর জন্য এটা ওনার মোক্ষম চাল।কথা না বলে চোখের দৃষ্টি চালান তীরের মতো।

হঠাৎ কোমড়ে ওনার হাতের ছোঁয়া।আমি আরেকটু মিইয়ে গেলাম।হাতের আধভেজা গামছাটা বিছানায় ছুঁড়ে মেরে আরেকহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেন,

“আচ্ছা?তবে কি ভালো লাগে শুনি।”

আমি ওনার থেকে সরে আসতে চাইলে উনি হাতের জোর বাড়ান।মুখশ্রী আমার আরো নিকটে এনে তাকান গাঢ় ভাবে।আমি চোখ খিঁচে বুজে নেই।নিঃশব্দে হাসেন উনি।বলেন,

“বলুন মিসেস!”

“আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে ছাড়ুন।রেডি হয়ে নিন।”

আমার লজ্জায় মিহি স্বরে বলা কথাটার উত্তরে উনি শান্তস্বরে জবাব দেন,

“এখনো দেড়ঘন্টা সময় আছে হাতে।একটুও দেরি হচ্ছে না।”

আমি এবার দুহাতে মুখ ঢেকে নিলাম।বলে উঠলাম,

“আমার লজ্জা করছে ধ্রুব।”

ধ্রুব খানিক আওয়াজ করে হেসে উঠেন।সেই হাসির সুর কর্ণগোচরে প্রবেশ করে হৃদয়ে শিহরণ জাগায়।লোকটা হাসে মৃদুভাবে।বক্ষদেশ কাঁপিয়ে তোলার মতো করে।আমি মুখ ঢেকে রাখা হাতের আঙুলটা একটু ফাঁক করে ওনার হাসি দেখি।ধ্রুব ওনার ওষ্ঠ ছোঁয়ান হাতের পিঠে।
বলেন,

“এখনও এত লজ্জা!”

হঠাৎ পায়ের শব্দের আওয়াজে আমাকে ছেড়ে দিয়ে দর্পনের সামনে এসে দাঁড়ান ধ্রুব।আমি ঠোঁটে আলতো কামড় বসিয়ে দরজার দিকে তাকাই।আড়চোখে দেখি ধ্রুব ভেজা চুলে চিরুনি চালাচ্ছেন।সেকেন্ড দশেক পরেই পর্দা সরিয়ে ভেতরে উঁকি দেন মিনতি মাসি।মাঝ বয়সী মিনতি মাসি কোন কথাবার্তা ছাড়াই শোয়ার ঘরে ঢুকে পরেন।বেশ কিছুবার এজন্য লজ্জায়ও পরতে হয়েছে আমাদের।তাই এখন আমরা দুজনেই সতর্ক থাকি।কান খাঁড়া করে রাখি সবসময়।
মিনতি মাসি সেভাবেই পর্দা দিয়ে উঁকি দিয়ে বলে উঠলেন,

“কি রাঁধবো আজকে?”

ধ্রুব পাশ ফিরে তাকালেন এবার।আমার দিকে চেয়ে বলে উঠলেন,

“কি খাবে জানাও!”
.

বাড়ির উঠোনে অনেকগুলো কবুতরের আনাগোনা চলছে।রান্নাঘরে চা বসিয়ে রেখে তাদেরকে ধান খেতে দিচ্ছে রাই।পরনে বাসন্তী রাঙা শাড়ি।আধ ভেজা চুলটা ছেড়ে রাখা।মৃদু বাতাসে উড়ছে সেগুলো।কপালে লেপ্টানো গাঢ় লাল সিঁদুর মুখের শ্রী বাড়িয়েছে কয়েকগুন।মুখশ্রী জুড়ে একরাশ স্নিগ্ধতার সাথে সাথে ওষ্ঠকোণে হাসির রেশ।রাই উঠোনে পা রাখতে রাখতে কবুতরগুলোকে ডেকে উঠে,

“আয়,আয়,আয়!”

বলার সাথে সাথে ফিটফিটে উঠোনে একমুঠো ধান ছিটিয়ে দেয় সে।উড়তে থাকা কবুতরগুলো মাটিতে নেমে ভাগ বসায় খাবারের উপর।শব্দ করতে করতে ভোজন ছাড়ে তারা।
হঠাৎ ভেতর থেকে একটা বয়স্ক স্বর ভেসে আসে।

“বউমা?চা কদ্দূর হলো?”

রাই চটজলদি রান্নাঘরে ঢোকে।রান্নাঘরে ঢুকতে ঢুকতে চুল খোঁপা করে নেয়।হয়ে আসা চা টা তিনটে কাপে ঢেলে নিয়ে মাথায় ঘোমটা দেয় সে।তারপর রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরের দিকে যায় সে।

পূর্ণদের বাড়িটা একতলা বিশিষ্ট।মোটামুটি বড় বসার ঘর,রান্নাঘর আর তিনটে শোয়ার ঘর নিয়ে ভদ্রলোকের বাড়িটা গ্রামের সবথেকে সুন্দর বাড়ি।
রাই চায়ের কাপগুলো একটা ট্রেতে করে নিয়ে শশুর শাশুড়িকে পরিবেশন করে।পূর্ণ বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান।পূর্ণ ওর বাবা মাকে কি বলেছে রাইয়ের অজানা তবে এখন অবধি তার শশুর-শাশুড়ি তার অতীত নিয়ে কোন প্রকার কথা জিজ্ঞেস করেননি।তার উপর পূর্ণের বাবা সুশীল সরকার রাইকে বেশ স্নেহ করেন।
সুশীল সরকার চায়ে চুমুক দিতেই রাই প্রশ্ন করে,

“বাবা,চা কেমন হয়েছে?”

রাইয়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই ভদ্রলোক আরেকটা চুমুক বসায়।তারপর রাইয়ের পানে তাকিয়ে হাসি মুখে জানান,

“বরাবরের মতো দারুণ হয়েছে মা।”

রাইয়ের শশুরের প্রশংসায় মিষ্টি করে হাসে।তার শাশুড়ী চায়ে চুমুক দিতে দিতে তাকে লক্ষ্য করে।যখন তিনি জানতে পেরেছিলেন মেয়েটার আগেও বিয়ে হয়েছিল এবং স্বামী মারা গিয়েছে তখন একপ্রকার দ্বিমত করে বসেছিলেন তিনি।অসম্ভব!এমন মেয়েকে ছেলের বউ করে আনবেন তিনি?কক্ষনো না!

মেয়ের কি অভাব পরেছে তার ছেলের জন্য?শিক্ষিত,সুদর্শন ও স্কুলের মাস্টার।মেয়ের বাপেরা তো ওঁৎ পেতে আসে মেয়ের সমন্ধ করার জন্য।
কিন্তু ওনার ছেলে যে প্রচুর জেদি।সে বিয়ে করলে একমাত্র রাইকেই করবে।নয়তো সারাজীবন কুমারই রয়ে যাবে।দুদিন ধরে মা-ছেলের মন-মালিন্য।পূর্ণ খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।তিনদিনের মাথায় মায়ের মন নরম হয়।ছেলের নিকটে আসেন ভালো করে বোঝাতে।কিন্তু পূর্ণ তার সিদ্ধান্তে অটল,যেমন রাইয়ের প্রতি তার প্রেম।চতুর্থ দিন বীনা দেবী হাল ছাড়েন।ঠিক আছে করো বিয়ে।থাকতে হবে না তোমায় চিরকুমার হয়ে।সমাজে মুখ ডুবাও আমাদের!

কিন্তু রাইয়ের এ বাড়িতে আসার পর উনিও কেমন যেন বদলে গেলেন।রাইয়ের মিষ্টি,স্নিগ্ধ মুখশ্রীতে যেন শুদ্ধতা মেশানো।বীনা দেবী খারাপ ব্যবহার করতেই পারলেন না।
মেয়েটা সবসময় হাসিখুশি থাকে।ওই মুখে বিষাদ বাজে লাগবে বলে ঠাউর করলেন উনি।ধীরে ধীরে রাইকে এড়িয়ে চলাও কমিয়ে দিলেন উনি।

“মা?চা আপনার কাছে ভালো লেগেছে তো?”

রাইয়ের প্রশ্নে চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসেন বীনা দেবী।কাঠের চেয়ারটায় ভালো করে বসতে বসতে মাথা নাড়িয়ে উত্তর জানান।রাই আবার সামান্য মুচকি হাসে।মৃদুস্বরে জানায়,

“আমি ওনাকে চা টা দিয়ে আসি।”

কথাটা বলে নিজেদের শোয়ার কক্ষে প্রবেশ করে রাই।পূর্ণ ঘুম থেকে উঠেছে কিছুক্ষণ পূর্বে।চোখের সামনে খাতা পত্র।পড়ার টেবিলে বসে আছেন তিনি।

রাই ভেতরে প্রবেশ করলো নুপুরের ছন্দের সাথে।পূর্ণ ফিরে তাকালো তার দিকে।চোখে চশমা থাকায় লোকটাকে ত্রিশোর্ধ লাগে দেখতে।আদোতে তা নয়!
রাই পড়ার টেবিলের এক পাশে চায়ের কাপটা রাখতে রাখতে বলে,

“আপনার চা!”

কথাটা বলে ঘুরে দাড়াতেই হাতে টান পরে তার।ভ্রু কুঁচকে পূর্ণের দিকে চায় সে।রাইয়ের মাথার ঘোমটা পরে গেছে কোনক্ষণে।রাইয়ের চোখে ভেসে ওঠা প্রশ্ন দেখে হালকা হাসে পূর্ণ।রাই দৃষ্টি নত করে।পূর্ণ এবার তার কোমল থুতনিতে হাত রেখে মাথা উঁচু করে।সিঁথির সিঁদুর স্পর্শ করে কপালে ছুঁইয়ে বলে,

“এবার আরো সুন্দর লাগছে।”

রাই সরে আসে পূর্ণের থেকে।কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে যেতে জানায়,

“আমার অনেক কাজ পরে আসে।আপনার এসব শোনার সময় নেই!”

পেছন থেকে পূর্ণ হতাশার স্বরে বলে উঠে,

“আপনি শুধু কাজকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন রাই।এদিকে আমার স্বামী যে ভালোবাসার অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে সেটা বুঝছেন না।”

রাই কক্ষের বাইরেই দাড়িয়ে ছিলো।পূর্ণর আফসোসের স্বরে বলা কথাখানা তার কানে আসে।রাই ঠোঁট টিপে হেসে রান্নাঘরে প্রবেশ করে।কি মনে করে কিছুক্ষণ পরে ফের আসে শোয়ার ঘরে।জানালার পর্দাগুলো টেনে দেয়।কক্ষটায় প্রবেশ করে নির্মল আলো।পূর্ণ জানায়,

“এত আলো চোখে লাগে বউ।”

“লাগুক।আলো-বাতাসে থাকলে মন-দেহ সুস্থ থাকে।ঘরটা শুধু আপনার একার না,আমারও।”

কথাটা বলে রাই তৎক্ষনাৎ রান্নাঘরে চলে আসে।জলদি নাস্তা বানাতে হবে পূর্ণ স্কুলে আর তার শশুর নিজ কাজে যাবে।

বিয়ের আগে রাই রান্নাঘরে খুব একটা না গেলেও একেবারে যে রান্না পারে না তা না।বিয়ের পরে কয়েকদিন অতি সর্তকতার সাথে রান্না করেছে সে।শাশুড়ীর থেকে বিভিন্ন রান্নার নিয়ম-কানুন জেনে রেঁধেছে।প্রথম প্রথম শাশুড়ী তার গম্ভীরমুখে সব বললেও এখন নিজে থেকেই সাহায্য করে।তবে রাই এখন একাই রান্নাটা সামলায়।

রান্না করতে করতে রাই ভাবনায় ডুব দেয়।পূর্ণ স্বামী হিসেবে ভালো,আদর্শ।সপ্তাহের একদিন তার পছন্দের খাবার নিয়ে আসা,দুমুঠো কাঁচের চুড়ি এনে নিজ হাতে পড়িয়ে দেওয়া।এসব প্রেমের চিহ্ন বহন করে।
রাইয়ের মরু হয়ে আসা বুকে আবার বৃষ্টি নেমেছে।সে এখন স্বামীর ভালোবাসায় বাঁচা এক প্রানবন্ত গৃহিণী।
হঠাৎ তার মনে পরে নির্বানীর সাথে তার আলাপ হয় না বহুদিন।দেখাও হয়না অনেক মাস হলো।একটা চিঠি পাঠাতে হবে শীঘ্রই।নিশ্চয়ই তার পিসি হওয়ার সময় অতি নিকটে!
.

বৈশাখ পেরিয়ে জৈষ্ঠ্যমাসের আরম্ভ হয়েছে।তীব্র গরমের সাথে সাথে বিনা নোটিশে আকাশ কালো করে কালবৈশাখি ঝড়ের আগমন তো আসেই।ভোররাত তখন।প্রকৃতিতে তখনও আলো ফুটেনি।আচমকা মেঘের গর্জনে ঘুম ভাঙে আমার।বদ্ধ চোখেই পাশ হাতলে ধ্রুবর সন্ধান চালাই আমি।লোকটাকে হাতের নাগালে না পেয়ে ফট করে চোখ খুলে ফেলি আমি।আধশোয়া হয়ে ধ্রুবর শোয়ার জায়গাটা হাতরে দেখতেই বুক দুরুদুরু কেঁপে উঠে আমার।ধ্রুব নেই পাশে।

আমি গলা ছেড়ে ওনাকে ডেকে উঠি।কোন সাড়াশব্দ নেই।বিচলিত হৃদয়ে বহুকষ্টে বিছানা থেকে নামি আমি।কক্ষজুড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার।অন্যদিন এই সময়ে একটু একটু আলো ফুটলেও ঝড়ের কারণে আজ কক্ষটা ঘুটঘুটে কালো।আমি আন্দাজে বাতির সুইচের দিকে এগিয়ে আলো জ্বলে ঘরটা আলোকিত করলাম।ভাগ্যিস বিদ্যুৎ আছে।একে একে ধীরে ধীরে সমগ্র ঘরে চোখ বুলিয়েও যখন ধ্রুবকে পেলাম না তখন আমি ঘামতে শুরু করলাম।একে তো আমার নয়মাসের উঁচু পেট তার উপর ধ্রুব ঘরের কোথাও নেই।আমি ভয়ে,বিচলিত মনে কেঁদে উঠলাম।হঠাৎ দরজা খুলে গেল।ঝড়ের আওয়াজে সেটা কানে পৌঁছালোই না আমার।আচমকা আরেক কান্ড ঘটলো।তীব্র আওয়াজে বাজ পড়ার সাথে সাথে ইলেকট্রিসিটি চলে গেলো।আমি পরলাম মহা বিপদে।প্রিয় নাম খানা জপে নিঃশব্দে কেঁদে উঠতেই কারো পায়ের আওয়াজ কানে বাজলো।তৎক্ষনাৎ পেছন ঘুরে তাকালাম আমি।বিদ্যুৎ চমকানো আবারও।তাতে দৃশ্যমান হলো অতি কাঙ্ক্ষিত মুখখানা।আমি এগিয়ে গিয়ে লুটিয়ে পরলাম ওনার বুকে।ঠাউর করলাম ওনার পরনের বস্ত্র ভিজে দেহের সাথে লেপ্টে আছে।ধ্রুব পড়ার টেবিলের ড্রয়ার থেকে ম্যাচকাঠি আর মোমবাতি বের করে ঘরটা আলোকিত করলেন।আমি ওনার বাহু আঁকড়ে সাথে সাথে রইলাম।মোমবাতির আলোতে যখন কক্ষটা আধো আলোকিত তখন ধ্রুব আমার দিকে তাকিয়ে চমকানো স্বরে বলে উঠলেন,

“তুমি কাঁদছিলো নির্বানী?”

আমি ভেজা আঁখিযুগলে সুক্ষ্ম রাগ ও অভিমান ঢেলে বলে উঠলাম,

“আপনি কোথায় গিয়েছিলেন আমাকে রেখে?এই ঝড়ের দিনে আমি একলা ভয় পাবো জানেন না?”

ধ্রুব করুন চোখে তাকালো যেন।আমার নিকটে এসে বললো,

“সরি..!আমি যখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম তখন ঝড় ছিলো না।হালকা বাতাস ছিলো শুধু।”

“কোথায় গিয়েছিলেন?”

আমার প্রশ্নের উত্তরে উনি পেছন থেকে একগুচ্ছ লাল শাপলা আমার সম্মুখে এনে ধরলেন।বাতাসের তোড়ে হেলেদুলে আলো দেওয়া মোমবাতির সোনালি আভায় লাল শাপলা নিয়ে দাড়িয়ে থাকা ধ্রুব দৃষ্টির ক্ষতি করতে যথেষ্ট।পরনের শুভ্র শার্টটা ভিজে লেপ্টে আসে দেহের সাথে।আমার স্ত্রী হৃদয় শিহরিত হলো।দুফোঁটা জল গড়ালো চোখ বেয়ে।কোন একদিন বলেছিলাম দুরের ওই শাপলা ফুলগুলো অনেক সুন্দর লাগছে।আজ উনি কি করলেন? ঝড়-বাদলা দিন না মেনে ছোট পুকুরটা থেকে একগুচ্ছ শাপলা এনে দাঁড়িয়েছেন আমার সম্মুখে!

আমি হাতের মুঠোয় শাপলা নিয়ে ওনার দিকে তাকালাম।ওনার দৃষ্টিতে ক্ষমাপ্রার্থনা।মুখে বললেন,

“আর এমন হবে না বউ।এমন দিনে আপনাকে রেখে কোথাও যাবো না।কথা দিচ্ছি।শুধুই আপনাকে আগলে রাখবো।”

আমি লাজুক হেসে ধ্রুবর পানে তাকিয়ে ফুলগুলো নিজ হাতের মুঠোয় নিলাম।আচমকা প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করলাম আমি।কেঁদে উঠলাম শব্দ করে।ধ্রুব বোধহয় ভয় পেলেন।পেটের ব্যথায় গুঁজো হয়ে পরা আমিকে আগলে নিলেন অতিযত্নে।ওনার ভেজা শার্টের শীতলতা এসে গ্রাস করলো আমাকে।বুঝলাম সেই সময় আসন্ন।আমি শার্টে আঁকড়ে ধরে বললাম,

” আমাকে হাসপাতালে নিয়ে চলুন দ্রুত।”

সেদিন কিভাবে ঝড়-বৃষ্টির মাঝে ধ্রুব আমাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলেন জানা নেই আমার।প্রচন্ড ব্যথায় নাজুক আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম।যখন চোখ খুলি তখন নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় অনুভব করি।আমাকে ঘিরে কয়েকজন ডাক্তার আসেন।আমাকে জ্ঞান ফিরতে দেখে যেন সকলের মুখে স্বস্তি ফিরে এসেছিলো।আমি সর্বপ্রথমেই জানতে চাইলাম ধ্রুবর কথা।ডাক্তাররা জানালেন আমার স্বামী বাইরেই আছেন।

সেই দিন আমার কোল আলো করে একটা ফুটফুটে মেয়ে সন্তানের জন্ম হলো।জন্মের পর তাকে আমার কাছে দেওয়া হলো।সময় যেতেই কক্ষটায় প্রবেশ করলেন ধ্রুব।আমি দুর্বল ক্লান্ত দৃষ্টি মেলে দেখলাম ধ্রুবকে।পরনের সেই শুভ্র শার্টখানা।এখন শুকিয়ে গেছে বায়ুপ্রবাহে।মাথার চুল এলোমেলো।জিভ দ্বারা ওষ্ঠ ভিজিয়ে আমার নিকটে এসে দাড়ালেন উনি।পরপর তাকালেন আমার পাশে শুয়ে রাখা সদ্যজাত শিশুটির দিকে।আমি দুর্বল চোখে একবার ধ্রুব তো একবার পাশে শুয়ে রাখা নবজাত কন্যাটির তাকাচ্ছিলাম।আচমকা ধ্রুব হেঁটে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন।আমার মাথায় যেন বাজ ভেঙে পরলো।দুর্বল দৃষ্টি সতেজ হলো হঠাৎ।উনি কি অসন্তুষ্ট?মেয়ে হওয়ায়?

নিজের মনে প্রশ্ন করেই প্রচন্ড দুঃখ পেলাম আমি।নিজের উপর সমস্ত রাগ এসে বর্তালো।ওনাকে খুশি অবধি করতে পারলাম না আমি!
কেঁদে উঠলাম শব্দ করে।তৎক্ষনাৎ কক্ষে প্রবেশ করলেন ধ্রুব।উনি দরজার বাইরেই ছিলেন?

বিচলিত হয়ে এগিয়ে এলেন আমার দিকে।ব্যস্ত কন্ঠ জিজ্ঞেস করলেন,

“কি হয়েছে?নির্বানী?তুমি এভাবে কাঁদছো কেন?ব্যথা করছে?”

ওনার কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমি পাল্টা প্রশ্ন করে বসলাম,

“মেয়ে হওয়াতে আপনি খুশি হন নি তাই না?ছেলে কাম্য ছিল আপনার?আর আমি তা দিতে ব্যর্থ?”

ধ্রুব এবার গম্ভীর চোখে তাকালেন আমার দিকে।পাশে শুয়ে থাকা শিশুটি কেঁদে উঠলো শব্দ করে।ধ্রুব তড়িঘড়ি করে তাকে কোলে নিলেন তাকে।আমার দিকে সুক্ষ্ম রাগ নিয়ে তাকিয়ে বলে উঠলেন,

“স্টুপিড।”

আমি দৃষ্টি নত করে রইলাম।তাকালে বোধহয় নজরে আসতো ধ্রুব আমার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছেন প্রবল স্নেহ নিয়ে।ওনার হাতটা সুক্ষভাবে কাঁপছে তাকে কোলে নিয়ে।

“তোমার কোন ধারণা আছে আমি কত খুশি হয়েছি?”

“তাহলে আপনি ওকে দেখা মাত্রই বাইরে চলে গেলেন কেন?”

অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলাম আমি।ধ্রুবর কোলে থাকা ওনার মেয়ে তখন শান্ত হয়ে তাকিয়ে আছে ওনার দিকে।ধ্রুব অনিমেষ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,

“মা হওয়ার আনন্দ কতটা নির্বানী?বাবা হওয়ার আনন্দ বোধহয় তার চেয়েও বহুগুন!আমি যখন ওকে দেখলাম তখন আমার হৃদয়ের কম্পন যদি তুমি শুনতে।কতটা ভালোবাসা ও প্রশান্তি মনে আন্দোলিত হচ্ছিলো তা যদি তুমি জানতে।”

খানিক থামলেন উনি।ওনার আঁখি যুগল আমাদের মেয়ের দিকে।আমি গাঢ় চোখে তাকিয়ে দেখলাম ওই নক্ষত্র তুল্য চোখে যেন মেঘের আনাগোনা।এই প্রথম লোকটার চোখে অশ্রু জমতে দেখলাম আমি। প্রথমবারের মতো!বড়ই আশ্চর্য হলাম আমি।

“বাইরে গিয়েছিলাম চোখের জল লুকাতে।পাগলি!”

আমি নিঃশব্দে কেঁদে উঠলাম।ওনার প্রতি ভালোবাসা আর সম্মান সুখের অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পরলো।

ধ্রুবর চোখ থেকে আচমকা একফোঁটা জল পরলো।কাঁপা কাঁপা ওষ্ঠে তিনি চুমু খেলেন সদ্যজাত কন্যাটির কপালের উপর।সে এতই সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছিলো যে স্বয়ং আমার স্বামীর কন্যারুপে পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হয়েছে।সেই সাথে বুঝলাম আমার ভালোবাসায় ভাগ বসানোর মানুষ চলে এসেছে।

এতটুকু বলে থেমে গেলাম আমি।চোখের সামনে সেই সময়কার স্মৃতি বাস্তব হয়ে ধরা দিচ্ছে আজ।সেই মেয়েকে প্রথম দর্শনে প্রথমবার কেঁদে উঠা বাবা,একজন আদর্শ স্বামীর যৌবনের মনমোহন সেই রুপ ভেসে উঠলো চোখের সামনে।আমি আপনা আপনি হেসে উঠলাম মুগ্ধ হয়ে।

“আপনাদের মেয়ের কি নাম রাখা হয়েছিল দিদা?”

একজনের প্রশ্নে ঘোর থেকে বেরিয়ে তার দিকে তাকালাম আমি।চোখে এঁটে থাকা চশমাটা একটু ঢেলে দিয়ে মেয়েগুলোর মাঝে এসে বসা শিক্ষিকার দিকে তাকালাম।শাখা-সিঁদুর পরিহিতা বিবাহিতা রমনী চোখের চোখ লুকাতে ব্যস্ত ছিলো সন্তর্পণে।আমি তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হলো।আমি বলে উঠলাম,

“নম্রতা দেবনাথ।”

সকলের দৃষ্টি তখন সেই শিক্ষিকার উপর এসে পরলো।আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম তার থেকে।এই আমার মেয়ে!
বাবার পুরো গুন নিয়ে জন্মানো ধ্রুব দেবনাথের প্রথম কন্যা নম্রতা দেবনাথ।নম্রর বিয়ের পর বিদায়ের দিন দ্বিতীয়বার ধ্রুবকে কাঁদতে দেখেছি আমি।

“চলো এবার যাওয়া যাক।”

পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনে পেছন ফিরে তাকালাম আমি।বাসন্তী রঙের ফতুয়া পরিহিত বৃদ্ধ এক পুরুষ সিঁড়ি বেয়ে নামছেন সর্তকভাবে।শেষ সিঁড়িতে পা রেখে আমার দিকে তাকালেন উনি।সামনে এতগুলো মেয়েদের বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন।আমি বসা থেকে উঠে বললাম,

“চলুন।”

“ওয়েট ওয়েট।আপনারা একটু একসাথে বসবেন?একটা ফটো তুলে রাখি আপনাদের।”

অনুরোধের স্বরে একজন মেয়ে বলে উঠলো।ধ্রুবর চোখেমুখে তখনো কৌতুহল।কুঁচকে আসা গভীর চোখ প্রায় অকেজো হয়ে পরায় পাওয়ারে চশমা পরতে হয়েছে ওনাকে।তবুও দুজন বুড়ো-বুড়ি যেন সেই কাঁচের টুকরোকে ভেদ করে চোখে চোখে কথা বলতে সক্ষম আমরা।আমি চোখের ইশারায় বললাম,

“চলুন।ওদের অনুরোধ রাখা যাক।”

ধ্রুব ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে মাথা নাড়ে সম্মতি জানালেন।মেয়েগুলো আমাদের বারান্দায় পরে থাকা দুটো সিঁড়িতে বসতে বললেন।আমরা দুজন বসলাম কাছাকাছি।

“দিদা,দাদুর কাঁধে মাথা রাখো তো একটু।”

কথামতো ধ্রুবর বাহুতে মাথা রাখলাম আমি।দীর্ঘদেহী পুরুষটা কাঁধ ছোঁয়ার সাধ্য আমার ছোট কায়ায় নেই।

আমি আজ ধ্রুবর বাহুতে মাথা রাখতে অনুভব করলাম আমাদের এই অমর প্রেমের পিছনে একজনের অবদান ব্যাপক।লোকটা হলো আমায় বিয়ে করতে না আসা সেই মানুষটা।যার জন্য আমার গায়ে লগ্নভ্রষ্টার ট্যাগ লাগতে যাচ্ছিলো।তার বদৌলতেই আমার ধ্রুব প্রাপ্তি।লোকটা কেন আসেনি সেদিন কি জানি!আমাকে একজন শ্রেষ্ঠ স্বামীর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য বোধহয়।

“দাদু?তোমার মতো হাসবেন্ড কি করে পাবো বলো তো?”

ধ্রুব আমার দিকে তাকিয়ে থেকে জানালেন,

“তাহলে নির্বানী হয়ে উঠো।শুদ্ধ,স্নিগ্ধ,সুন্দর!”

এবার আমরা একসঙ্গে তাকালাম সামনের ক্যামেরার দিকে।এই যন্ত্র নাকি মুহুর্ত বন্দি করতে পারে।আমাদের হৃদয়ে থাকা প্রেম কি বন্দি করতে পারলো সে?
সে সাধ্য কার?আমরা মুক্ত বিহঙ্গ!প্রেম সায়রে পাড়ি দিই পালকে ভালোবাসা মেখে!

(সমাপ্ত)

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সমাপ্ত শব্দটা লিখলাম।
সমাপ্তি কেমন লাগবে জানি না।ভুল-ত্রুটি ক্ষমা প্রার্থী।
হ্যাপি রিডিং 🥰🤗