মম_হৃদয়_বিহারিনী পর্ব-০৩

0
1

#মম_হৃদয়_বিহারিনী
#ঐশী_রানী_রক্তিমা
৩.
“আপনি কি ওই মেয়েটাকে ভালোবাসেন?”

প্রশ্নটা করে শ্বাসরোধ করে রইলাম আমি।বক্ষে হৃৎস্পন্দনের সংখ্যা বেড়েছিল বেশ।ধ্রুব জানালার বাইরে থাকিয়ে ছিলেন।আমি গভীর আগ্রহে ওনার মুখনিশ্রিত উত্তর শোনার অপেক্ষায়।কিন্তু কোন শব্দ উচ্চারণের পূর্বে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন উনি।তারপর আমার পানে না তাকিয়েই গম্ভীর স্বরে বললেন,

“একজনকে ভালোবেসে অন্য কাউকে বিয়ে করবো,আমি এতটাও মহৎ নই বোধয়!”

ওনার মানস্পটে আমার করা প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর থাকলেও উনি আমাকে তা পরিষ্কার করে বললেন না।আমার হৃদয়ে এই প্রশ্নখানার ভার রেখে দিলেন বোধয় ইচ্ছে করে।আমি আবার শুধালাম,

“তবে মেয়েটা আপনাকে জড়িয়ে ধরার সাহস পায় কিভাবে?সংকোচহীন ছিল সেই আলিঙ্গন!”

এবার আমার পানে তাকালেন ধ্রুব।আমার কন্ঠে তার প্রতি জন্মানো সুক্ষ্ম অধিকারবোধ ফুটে উঠেছিলো।সেটা টের পেয়ে আর ওনার এমন চাহনিতে আমি অস্বস্তিতে পরলাম।উনি আমার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে ওভাবেই তাকিয়ে রইলেন।ওনার তাকানোতে আমি আড়ষ্ট হচ্ছিলাম।সেটা বুঝতে পেরেও ধ্রব দৃষ্টি সরালেন না।তবে ধীর স্বরে বললেন,

“আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম।শশী যে এভাবে আমায় জড়িয়ে ধরবে এটা আমারও অপ্রত্যাশিত ছিল।”

এতটুকুই কথা হয়েছে আমার ওনার সাথে।কথাটুকু বলে নিঃশব্দে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান উনি।বসার ঘরে এখন কি পরিস্থিতি চলছে আমার জানা নেই।আমি সারাটা সকাল কক্ষে বসেই কাটিয়ে দিলাম।বুকশেলফে থাকা বইগুলোর নামগুলোতে চোখ বুলিয়ে দেখলাম।ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে বিষন্ন মনে জাগল না।

মধ্যান্নে দরজায় একজন কড়া নাড়লো।আমি বিছানায় চুপচাপ বসে আমার হাতের দিকে নজর দিয়ে ছিলাম।দরজায় খটখট শব্দের পরপরই একটা মেয়েলি স্বর ভেসে আসলো,

“ভেতরে আসার অনুমতি আছে?”

আমি গলা ঝেড়ে নিলাম।তারপর মৃদু আওয়াজে উত্তর দিলাম,

“আসুন,অনুমতি আছে।”

সকালে সেই গোলাপি শাড়ি পরিহিতা রমনীটি ভেতরে প্রবেশ করলো।তার পরনে এখন লাল টুকটুকে একটা শাড়ি।কানে স্বর্ণের দুল,কপালে লাল টিপ আর চুলগুলো খোঁপা করে বাঁধা। দেখতে বেশ বউ বউ লাগছিলো।আমি ডাগর চোখে তাকিয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম।
তার হাতে খাবারের থালা ছিল।সেটা ঘরে থাকা কাঠের একটা টেবিলে রাখতে রাখতে মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো,

“স্নান করেছো?

মেয়েটার প্রশ্নে আমার স্নান করার কথা খেয়ালে আসলো।দুশ্চিন্তায় আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।কপালে আলতো আঘাত করে আমি নিচুস্বরে বললাম,

” নাহ।ভুলে গিয়েছি।”

মেয়েটা আলতো হাসলো।তাকে এভাবে সম্মোধন করতে আমার ভালো লাগছিলো না।তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম,

“আপনার নাম কি?”

মেয়েটা মৃদুস্বরে জবাব দিলো,

“রাই।”

আমি মনে মনে নামটা একবার আওড়ালাম।এরইমাঝে সে অদ্ভুতস্বরে বলে উঠলো,

“আমার মনে তুমি রহস্য সৃষ্টি করেছো।গভীর রহস্য!ধ্রুবর উঁচু গলা আমরা কখনো কেউ শুনিনি।আজ সে প্রথমবার এমন উঁচু আওয়াজে কথা বললো সকলের সাথে,তোমার জন্য।”

রাইয়ের কথা শুনে আমি চুপ করে রইলাম।রাই ধ্রুবর পিসির মেয়ে এটা পরে জেনেছিলাম।বয়সে ধ্রুবর সমবয়সী।তার কথা প্রথমবার শুনেই আমি বুঝেছিলাম সে শিক্ষিত।এখানকার অন্যদের মত আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে না সে।এখন অবধি তিনজনকে আমি শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে শুনেছি।আমার শাশুড়ী,রাই আর শশী।

রাই এবার আমার নিকটে এসে বসলো।আমার মৌনতা তাকে আরো ভাবিয়ে তুলছিলো।এবার সে অনুরোধের স্বরে বললো,

“আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে?”

আমি এবার চোখ তুলে রাইয়ের চোখে চোখ রাখলাম।আমি জানতাম আমাকে কি প্রশ্ন করা হবে।আমি এড়িয়ে যেতে চাইলাম সেটা।তাই মৃদু আওয়াজে বলে উঠলাম,

“উনি সকলের সামনে আমার পাশে দাড়িয়ে কি খুব ভুল করেছেন?সেসময় চুপ থাকাটাই কি শ্রেয় ছিল?আমার অপমানে আপনাদের সাথে রুষ্ট আচরণ কি ওনাকে কাপুরষ বানিয়ে দিয়েছে?”

আমার কথা ও প্রশ্ন শুনে হা করে রইলেন রাই।এমন প্রশ্ন যে আমার মুখ থেকে নিসৃত হবে এটা বোধহয় ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি সে।আমি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম।মৃদু আওয়াজে রাইয়ের উদ্দেশ্যে বললাম,

“দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে।আমি স্নান ছেড়ে আসছি।”

আমি রাইকে ঘরে বসিয়েই স্নান ঘরে আসলাম।এমনটা করার কারণ তার প্রশ্নগুলো আমাকে বেশ বিব্রত করছিলো।ধ্রুব সকলের সামনে যে মিথ্যের পর্দা টাঙিয়ে দিয়েছিলেন,এখন সেই বুলি আমাকেও আওড়াতে হবে।কিন্তু ওনার প্রতি আমার একবিন্দু অভিযোগ করার সুযোগ নেই।বরং কৃতজ্ঞতায় মানুষটার প্রতি মাথা নুইয়ে আসছে আমার।
আমি স্নান ছেড়ে ভেজা চুলে গামছা পেছিয়ে বেরুলাম।রাই তখনো বিছানায় বসে ছিল।আমি আশা করেছিলাম সে চলে যাবে।কিন্তু না!

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার নিকট আসলাম।আমার ভয় ছিল রাই আবার প্রশ্ন না করে বসে।আমি তড়িঘড়ি করে প্রশ্ন করলাম,

“আপনি ওনাকে নাম ধরে সম্মোধন করেন?”

“আমার কিছুদিনের ছোট ও,তাই।”

আমি অবাক নয়নে এবার রাইয়ের পানে তাকালাম।মেয়েটার এখনো বিয়ে হইনি?আমার মনে জাগা প্রশ্ন বোধহয় আমার চোখেমুখেও ফুটে উঠলো।রাই কোমল হেসে বলে উঠলো,

“তুমি কি ভাবছো আমি জানি।”

তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে।মাথা নুইয়ে নিজ হাতের দিকে মনোযোগ দিয়ে বললো,

“বিয়ে হয়েছিল আমার।উনি গত হয়েছেন বছর তিনেক হবে।”

আমার বিস্ময় এবার আকাশ ছুঁলো যেন।রাই বিধবা?অথচ তথাকথিত বিধবাদের কোন চিহ্ন তার শরীরে,বস্ত্রে নেই!কুমারী মেয়েদের মতো সাজসজ্জা তার।আমাকে বিস্ময়ে রেখেই কক্ষ ত্যাগ করলেন রাই।যাবার আগে বলে গেলেন প্রয়োজন পরলে তলব করতে।
.

ধরিত্রীর সমস্ত দ্যুতি নিভে গিয়ে অনামিশায় ছেঁয়ে উঠলো চারপাশ।সন্ধ্যা হতে না হতেই পুরো বাড়ি জুড়ে প্রদীপ,লন্ঠনের আলো চলে উঠলো।গ্রামে এখনো বিদ্যুৎের খবর নেই।মধ্যান্নের পর থেকে এ কক্ষে কেউ আসলো না।একজন পরিচালিকা এসে দুপুরের এঁটো থালা নিয়ে গেছে শুধু।ধ্রুবর ঘরটা তিনতলার একদম কোনার দিকে।আমি বিছানায় বসে জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।কিছুক্ষণ আগে এই জানালা দিয়ে সূর্যাস্ত দেখেছি আমি।জানালার ঠিক সোজাসুজি বিষন্ন মনে বসে ছিলাম আমি।আকস্মিক কিছু একটা এসে আমার উপর পরে।চমকে উঠি আমি!মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে চিৎকার নিসৃত হয়।একটু পরে খেয়াল করি মেঝেতে একটা কাগজের টুকরো পরে আছে।সেটাকেই দুমড়ে-মুছড়ে জানালা গলে ছুড়ে মেরেছে কেউ। এমন বেয়াদবির কারণে আমার মনে মনে রাগ হলো খানিকটা।আমি বিছানা ছেড়ে উঠে কাগজটা হাতে নিলাম।সেটা জানলা দিয়ে ছুড়ে ফেলতে গিয়ে কি মনে করে বেহাল হয়ে থাকা কাগজটা খুললাম।কাগজটায় খুব এলোমেলো অক্ষরে কিছু লেখা।আমার বুঝতে একটু সময় লাগলো।

আমি আস্তে আস্তে লেখাগুলো পড়লাম,

“উত্তর খুঁজছো?পাওনি তাই না?এত সহজে রহস্য কাটে নাকি?যাকে বিয়ে করেছো সেই তো রহস্যের ভান্ডার।উত্তর চাইলে মহলের পেছনে পুকুরপাড়ে চলে এসো।মাঝ রাত্তিরে!ভয় পেলে আসার দরকার নেই।”

আমি তড়িঘড়ি করে জানালা গলে মাথা বের করে নিচে আশেপাশে তাকালাম।কোন মনুষ্যের চিহ্ন অবধি চোখে পড়লো না।বাইরে তখন আবছা অন্ধকার।মহলের আবছা আলোয় খানিকটা আলোকিত বাড়ির পেছনের দিকটা।আমি তাতেই ভালো করে দেখার চেষ্টা করতে লাগলাম।তখনি কক্ষের ভেতরে কারো প্রবেশের আওয়াজ কর্ণগোচর হলো।আমি দরজার দিকে তাকালাম।ঘরে থাকা প্রদীপ,হারিকেনের আলোয়একটা পুরুষালি অবয়ব ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হলো।ধ্রুব দেবনাথ!

আমি দ্রুত কাগজটা পেছনে লুকিয়ে ফেললাম।ধ্রুব এসে বিছানায় বসে আমার পানে তাকালো।আমি একটা শুকনো ঢোক গিলে ওনাকে দেখলাম।লোকটা আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।কক্ষটা তেমনিভাবে নিস্তব্ধতায় ছেঁয়ে রইলো।ধ্রুব কিছুক্ষণ বসে থেকে আলমারির দিকে এগোলেন।কাঠের আলমারি খোলার আওয়াজে নিস্তব্ধ কক্ষ সরব হয়ে উঠলো ক্ষনকালের জন্য।উনি আলমারি থেকে শার্ট-প্যান্ট বের করে বাথরুমে ঢুকলেন।উনি বাথরুমে ঢোকা মাত্র আমি হাতের কাগজখানা ছিঁড়ে কুঁচি কুঁচি করে জানালা দিয়ে ফেলে দিলাম।আমার বুকখানা দুরুদুরু কাঁপছিলো।এমন মনে হচ্ছিল যেন আমি কিছু চুরি করতে এসেছি।
ধ্রুব কাপড় পাল্টে বেরিয়ে যান কক্ষ থেকে।আমি পরে রই বদ্ধ,অল্প আলোয় আলোকিত কক্ষটায়।

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়।এই কক্ষের অধিশ্বরের দেখা নেই।আমি অপেক্ষায় থাকতে থাকতে নিদ্রাচ্ছন্ন হলাম কখন টের পেলাম না।মাঝরাত্তিরে হঠাৎ ঘুম ভাগে আমার।তড়িঘড়ি করে উঠে বসলাম আমি।মাথার চুলগুলো হাত খোঁপা করে বেধে নিলাম।কক্ষে হারিকেনের আবছা আলো জ্বলছে।আমি বিছানায় নজর বুলালাম। ধ্রুব নেই,এমনকি সারাঘরেও তার অস্তিত্ব নেই।হঠাৎ সন্ধ্যার ঘটনার কথা স্মরণে এলো আমার।আমি দোটানায় ভুগতে লাগলাম।কাগজটা কে ছুঁড়ে মেরেছিলো আমার জানা নেই।আমি যাবো না বলে ঠিক করলাম কিন্তু এতরাতেও কক্ষে ধ্রুবের অনুপস্থিতি আমাকে ভাবতে বাধ্য করলো।আমি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম।তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হারিকেন নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে।উদ্দেশ্য মহলের পশ্চিমের পুকুরপাড়।

একে তো জায়গাটা আমার অচেনা,তার উপর মাঝ রাত্রি।আমার ঘাম ছুটে গেল ভয়ে।আমি ক্রমশ ঢোক গিলছিলাম।নিস্তব্ধ আঁধার ঘেরা পরিবেশ।ঘা ছমছম করছিলো আমার।আমি পশ্চিম দিকে হেঁটে চলেছি কিন্তু পুকুরের কোন হদিস পাচ্ছিলাম না।মাঝে মাঝে ঝোপঝাড় থেকে ঝিঁঝি পোকার অসহ্যকর আওয়াজ ভেসে আসছিলো।আমি মন স্থির করলাম আর এগোব না।যেপথে এসেছিলাম সেপথে ফিরে যাবো।সেই আমি ফিরে যাওয়ার হেতু পেছন ঘুরলাম ওমনি কানে এসে বাজলো জলের আওয়াজ।মনে হচ্ছে পুকুরের জলে কেউ পা ডুবিয়ে এমন আওয়াজ করছে।

আমি থমকে দাড়ালাম।হৃদপিণ্ডের তখন বেহাল দশা।সমগ্র দেহ একটু পরপর কেঁপে উঠছে আমার।আমি ধীরে ধীরে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে শব্দের উৎসের খোঁজে তাকালাম।আমার থেকে কদম দশেক ব্যবধানে একটা পুকুর।তার শান বাধানো ঘাটে জলেতে পা ডুবিয়ে বসে আছে এক রমনী।মাথার কোমড় সমান কেশ উন্মুক্ত!

আমার হঠাৎ খেয়াল হলো আকাশে আজ পূর্ণচন্দ্র উঠেছে।তার নূর ছড়িয়েছে পুরো ভুবনজুড়ে।সেই চন্দ্রালোয় চকচক করছে রমনীটির বাঁহুর বাজু।আমি আরেকটু এগিয়ে গেলাম।হঠাৎ রমনীটি বলে উঠলো,
“এসেছো?জানলাম তুমি না এসে পারবে না।”

কথাখান বলে আমার দিকে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো সে।পূর্নিমার চাঁদের আলোয় তার মুখশ্রী দৃশ্যমান হলে আমার কাছে।আমি শক্ত করে হারিকেন টুকু ধরে একটা ঢোক গিললাম।

চলবে…