#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (১০০)
স্বর্ণলতা রুমে এলো বিরক্তমুখে। স্বামীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
” এগুলো কী ধরনের আচরণ? দাদিজান কী ভাবল! ”
মুনছুর সাখাওয়াত তৎক্ষনাৎ জবাব দিল না। রুমের দরজা আটকাল প্রথমে। তারপরে আকস্মিক কোলে তুলে নিল স্ত্রীকে। বালিশহীন পরিপাটি বিছানার দিকে অগ্রসর হতে হতে অকপটে জানাল,
” বেহায়া, ধৈর্যহীন, বউপাগল স্বামী। ”
স্বর্ণলতা চরম বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল। স্বামীর দিকে বড় বড় চোখে চেয়ে থাকলে শুনতে পেল,
” হয়নি? এরচেয়েও বেশি কিছু ভাবা যায়? ”
উত্তরে চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে নিল। দীর্ঘশ্বাসটা ফেলতে টের পেল পিঠটা বিছানা ছুঁয়ে ফেলেছে। স্বর্ণলতা চোখ মেলল। দু’চোখ ভরে সময় নিয়ে দেখল কাঙ্ক্ষিত রুম ও রুমের ভেতরের প্রতিটি জিনিস। গভীর নিঃশ্বাসে গন্ধ টেনে নিতে বুকের ভেতরটায় প্রশান্তির হাওয়া বয়তে লাগল। চোখের তারা উপচে পড়া আনন্দের অশ্রুতে ডুবে যেতে শ্বাস রুদ্ধ করে ফেলল। এই রুম, এই বিছানা তার নামে ছিল। চাইতে হয়নি, তবুও পেয়েছিল। রুমের মালিক স্বেচ্ছায় দিয়েছিল। মানুষ সহজে পেয়ে যাওয়া জিনিসের মূল্য বুঝতে পারে না, কদর করতে জানে না। স্বর্ণলতাও মানুষ। তাই সেও মূল্য বুঝতে পারেনি, কদর করতে জানেনি। সেই শাস্তি পেতেই বোধহয় শয়তানের পাল্লায় পড়েছিল। নাহলে এত ভালো স্বামী, গুছানো স্বচ্ছল ঝামেলামুক্ত সংসার ফেলে ঢাকায় যাওয়ার জন্যে জেদ ধরে? নিজের জিনিস ফিরে পেতে এত কষ্ট করতে হয়?
স্বর্ণলতা একপাশ হলো। নরম স্পর্শে বিছানায় হাত বুলাচ্ছে। সহসায় শুনতে পেল,
” তোমাকে এই রুমে ডেকে এনেছে কে? ”
” আপনি। ”
” তাহলে আমাকে আদর না করে বিছানাকে করছ কেন? আমার জিনিস আমাকে পরিপূর্ণভাবে সরাসরি দিবে কবে? স্বর্ণলতা, তুমি কি আমাকে কখনই সবার প্রথমে রাখবে না? যেমন করে আমি তোমাকে রাখি। ”
শেষ বাক্যের গুরু অর্থটা বুঝে আসতে স্বর্ণলতার বুকের ভেতর চিড়িক দিয়ে ওঠল। মানুষটার কাছে সে এতটা গুরুত্বপূর্ণ! পরক্ষণে হেসে ফেলল। প্রাণহীন, অনুভূতিশূণ্য সামান্য বিছানাকেও কেউ নিজের সমকক্ষ ভাবে কীভাবে? এরকম ভয়ঙ্কর ঈর্ষাও কারও মধ্যে থাকতে পারে? স্বর্ণলতা হাসিটুকু প্রকাশ করল না। বিছানা থেকে হাত সরিয়ে স্বামীর দিকে চেয়ে বলল,
” আপনার হাবভাবে মনে হচ্ছে, আমি নতুন বউ। আজই বিয়ে করে ঘরে তুলেছেন। ”
” বিয়ে পুরোনো হতে পারে কিন্তু বউ নতুনই। আমাকে স্বামীর স্বীকৃতি দিয়ে এই ঘরের অধিকার নিয়ে পা রেখেছে আজই। স্বর্ণলতা, সংসার জীবনে আমাদের আজ প্রথম দিন। আমার কাছে এই দিনটা খুবই বিশেষ। স্মরণীয় হওয়ার মতো। তুমি যদি সম্মতি দাও তাহলে আমরা বিবাহ বার্ষিকী পালন করব এই দিনে। ”
মুনছুর সাখাওয়াতও বিছানায় শুয়ে আছে। স্ত্রীর দিকে মুখ ফেরানো। মধ্যকার দূরত্ব সামান্য। কোমল শরীরে স্পর্শ পড়েনি এখনও। হাত দুটো গুটিয়ে রেখেছে বুকের কাছে। স্বর্ণলতা সেই দূরত্ব ঘুচিয়ে স্বামীর কপালে অধর ছোঁয়াল গভীরভাবে। অতঃপর বলল,
” নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারাও এক ধরনের গুণ। যেটা সবার মধ্যে থাকে না। চাইলেও নিজের মধ্যে ধারণ করা যায় না। এই গুণ আল্লাহ প্রদত্ত। তিনি যাকে ভালোবাসেন তার হৃদয়ে এই গুণ এমনভাবে গেঁথে দেন যে, বান্দা নিজেও হৃদয় থেকে আলাদা করার সামর্থ্য রাখে না। ”
মুনছুর সাখাওয়াত ভ্রূ জোড়া কুঁচকে ফেলল। স্ত্রীর ঝুঁকে রাখা মুখটায় ক্ষণকাল চেয়ে থেকে বিরস কণ্ঠে সুধাল,
” তোমাকে কে বলল আমি নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারি? ”
” পারেন না? ”
” না। ”
” তাহলে বলুন আমাকে ভালোবাসার পেছনে আপনার স্বার্থ কী? ”
” শান্তি। ”
স্বর্ণলতার মাথাটা বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে পুনরায় বলল,
” তোমাকে ভালোবাসলে বুকের মধ্যে শান্তি লাগে। এই শান্তির লোভে আমি ভালোবাসতে বাধ্য হই। স্বার্থপরতা আমার রক্তের সাথে মিশে আছে। যেটা আলাদা করতে হলে আমার শরীর থেকে সবটুকু রক্ত ফেলে দিতে হবে। রক্ত ছাড়া মানুষ বাঁচে না। আমি এখনই মরতে চাই না। বুকের মধ্যে আরও একটু শান্তি জমাতে চাই। যাতে মারা যাওয়ার পরে আমার লাশ দেখতে আসা লোকজন ঈর্ষা নিয়ে বলে, মুনছুরের ভাগ্য দেখ, কী সুন্দর শান্তিতে মৃত্যবরণ করল! ”
স্বামীর সংস্পর্শে আসতে স্বর্ণলতার ভেতরে উষ্ণ চাহিদা প্রবলভাবে ফিরে এলো। মন সরিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করেও কাজ হচ্ছে না। মন ও মস্তিষ্ক মিলেও এক শরীরের সাথে পেরে উঠছে না। গোপন লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছে বুঝতে পেরে বুক থেকে মাথা তুলল। মুনছুর সাখাওয়াতের হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে আলগা করে উঠে বসল। মাথা নুয়িয়ে কাতর স্বরে বলল,
” শুনেছি আগে মেয়েরা এই সমস্যায় পড়লে স্বামীর সাথে ঘুমাত না। আলাদা ঘরে থাকত। যখন শুনেছিলাম তখন খুব খারাপ লেগেছিল কিন্তু এখন মনে হচ্ছে…”
মাঝপথে থেমে গেল। পরের কথাটুকু উচ্চারণ করতে ভয় লাগছে। অনুধাবনটা কতটুকু সত্য জানা নেই। নিজের স্বার্থের জন্য ভয়ঙ্কর সেই নিয়মকে সঠিক বলা কি আদৌ ঠিক হবে? এমনও তো হতে পারে মুনছুর সাখাওয়াতই ঠিক। রক্তস্রাবের সময়ে দৈহিক চাহিদা গুটি কয়েকজনের মধ্যে আসে। গুটি কয়েকেজনের জন্য একটি অশোভন নির্মম নিয়মকে সে ভালো হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। উচিতও না।
” থেমে গেলে কেন? কথাটা শেষ করো, স্বর্ণলতা। তোমার কী মনে হচ্ছে? ”
স্বর্ণলতা কেঁপে ওঠল। চকিতে স্বামীর দিকে চাইতে ভড়কে গেল ঠিকই কিন্তু প্রসঙ্গটাকে ধামাচাপা দিতে পারল না। বেফাঁসে বলে ফেলল,
” আজকের রাতটা দাদিজানের সাথে ঘুমাই? ”
” কেন? ”
” ইচ্ছে করছে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত প্রত্যুত্তরে নীরব থাকল। সেকেন্ড কয়েক একভাবে নিষ্পলকে স্ত্রীর কাঁচুমাচু মুখটায় চেয়ে থেকে অন্য পাশ ফিরল। স্বর্ণলতা এই নীরব প্রতিক্রিয়াকে অনুমতি ভেবে বসল। বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে হাঁটা ধরল। বন্ধ দরজার সিটকানি স্পর্শ করারও সুযোগ পেল না। পূর্বেই বদমেজাজি মানুষটার ক্রোধপূর্ণ কণ্ঠটা ভেসে এলো,
” তোমাকে বলেছিলাম না তোমার নাতবউ একদিন আমার হাতে মরবে? সেই দিনটা আজই। তুমি শুধু তোমার ঘরের দরজা বন্ধ রেখে আমাকে সাহায্য করো। নাতির জন্য এটুকু তো করতেই পার, তাই না? ”
স্বর্ণলতা এক মুহূর্তও দেরি করল না। বিছানার দিকে দৌড়ে গেল। স্বামীর পাশে শুয়ে চোখ, মুখ খিঁচে শ্বাসটা বন্ধ করে রাখল। প্রায় মিনিট পাঁচ পেরিয়ে যেতেও শয়ন সঙ্গীর দিক থেকে কোনো আওয়াজ বা নড়াচড়া না পেয়ে সে চোখ মেলল। পাশ ফিরে চাইতে দেখল মুনছুর সাখাওয়াত আগের মতোই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে আছে। মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। স্বর্ণলতা স্বস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে পুনরায় চোখ বুঝল তখনই প্রশ্নটা উড়ে এলো,
” তুমি সুস্থ হবে কবে? ”
” সুস্থ হলে জানাব। ”
মুনছুর সাখাওয়াত বউয়ের দিকে ফিরল। খানিক বিরক্ত ও রাগ মিশ্রিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” তারিখটা বলতে পারছ না? ”
কানের কাছে কণ্ঠস্বরটা এত জোরে ও তীক্ষ্ণ শোনাল যে স্বর্ণলতা চমকে কেঁপে ওঠল। রুমের মধ্যে সাদা ফকফকে আলোটা জ্বলছিল। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কেউই নেভায়নি। মুনছুর সাখাওয়াত সেই আলোর মধ্যে বউয়ের কেঁপে ওঠা দেখে ফেলল। মুহূর্তে কণ্ঠস্বর থেকে রাগ ও বিরক্তের ভাবটুকু জোর করেই সরিয়ে নিল। মৃদু হেসে নরম হয়ে বলল,
” নির্দিষ্ট তারিখটা বললে আমার ধৈর্য ধরতে সুবিধা হতো। তোমাকে জ্বালাতনও করতাম না। আমাদের দুজনেরই উপকার হতো। ”
স্বর্ণলতা এক মুহূর্ত ভাবল। তারপরে আচমকা জানাল,
” বলব না। ”
” কেন? ”
” গত ছয়মাস আপনাকে চেয়েও আমি পাইনি। অনেক কষ্ট দিয়েছেন। এখন সেটারই শোধ তুলব। অনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে থেকে আপনি ছটফট করুন। আমি কাছে থেকে চেয়ে চেয়ে দেখব। ”
মুনছুর সাখাওয়াত আশ্চর্য হয়ে সুধাল,
” এটা শোধ নেওয়ার সময়? ”
স্বর্ণলতা জবাব দিল না। মুখ ঘুরিয়ে পাশ বদলে চোখ বুজে নিল। এই শান্তি বেশিক্ষণ টিকল না। মুনছুর সাখাওয়াত ডেকে ওঠল,
” স্বর্ণলতা? ”
” হুম। ”
” তুমি আমার কী হও? ”
” বউ। ”
” স্বামীর প্রতি বউয়ের দায়িত্ব কী? ”
” সুখে-দুঃখে পাশে থাকা। ”
স্বর্ণলতা চোখ বুজে থেকে উত্তর দিচ্ছিল। সহসায় পাখির পালকের মতো নরম ও হালকা স্পর্শটা বিচরণ করতে লাগল পিঠে, কোমরে, পেটে। বুকের দিকে উঠে আসতে ধরতে স্বর্ণলতার বন্ধ চোখের কপাট খুলে গেল ঝটিতে। অবাদে বিচরণ করতে থাকা হাতটা খামচে ধরে মুখ ফেরাল। স্বামীর মুখের দিকে দৃষ্টি স্থির করে চমক লাগা কণ্ঠে সুধাল,
” কী করছেন! আপনি বলেছিলেন এই সময়ে আমার পাশে থাকবেন। কথার খেলাফ করছেন কেন? ”
” কথার খেলাফ করছি না। তোমার স্বামী দুঃখে আছে তাই তোমাকে পাশে চাইছে। ”
” মানে কী? ”
মুনছুর সাখাওয়াত সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না। স্ত্রীর ঠোঁটের মাঝে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। ছোট্ট নরম দেহটাও পুরোপুরি দখল নিয়ে আদর মাখা কণ্ঠে থেমে থেমে ধীরে ধীরে বলল,
” তুমি কাছে থেকে কষ্ট দিয়েছিলে, আমি দূরে থেকে কষ্ট দিয়েছি। শোধবোধ তো হয়েই গেছে, বউ। এখন যা হবে সমান সমান। আমি আদর করার তৃষ্ণায় ছটফট করলে তুমিও আদর পাওয়ার তৃষ্ণায় ছটফটাবে। ”
স্বর্ণলতা এই যন্ত্রণা বেশিক্ষণ সয়তে পারল না। মুক্তি পাওয়ার জন্য হাঁসফাঁস করতে লাগল। স্বামীর থেকে সহজে নিস্তার পাবে না বুঝে আসতেই হার স্বীকার করতে বাধ্য হলো। সেকেন্ডের জন্য পুরুষালি ঠোঁট জোড়া সরতে সে অন্যদিকে মুখ সরিয়ে নিল। তারপরে দ্রুত জানাল,
” গতকাল রাতে শুরু হয়েছে। ”
_______
বেহালা দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস রুটিন নিতে এসেছিল কলেজের লাইব্রেরিতে। কাজ শেষে কলেজ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। সহসায় জীপটা ঢুকল বড় ফটকটা দিয়ে। জীপ থেকে লাফিয়ে নামা মানুষটাকে চিনতে এক সেকেন্ডও দেরি হলো না। মুহূর্তে বেরিয়ে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিল। দ্রুত কদমে জীপের দিকে ছুটে গিয়ে দাঁড়াল দীর্ঘকায় দেহের রুক্ষমূর্তিটার সমুখে। সালাম প্রদর্শন করে সুধাল,
” দুলাভাই, ভালো আছেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত কপাল দলা করে মুখটা দেখে নিল। পরক্ষণে দৃষ্টি সরিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল,
” হুম। ”
তারপরে গটগটিয়ে হাঁটা ধরল কলেজের ভেতরের দিকে। পিছ ধরেছে বুঝতে পারল মিনিট খানেক সময় পরে। নিশ্চিত হতে এক ঝলক পেছন ফিরে দ্রুত জানাল,
” সুবর্ণও ভালো আছে। কিন্তু স্কুলে যাচ্ছে না। তুই মানা করেছিস নাকি? ”
বেহালা থতমত খেল যেন! চঞ্চল পা জোড়া থমকে গেল কয়েক সেকেন্ডের জন্যে। বিমূঢ়তা কাটিয়ে উঠে দৌড়ে এলো দুলাভাইয়ের পাশাপাশি। মুনছুর সাখাওয়াত ততক্ষণে ইন্টার ভবনের বারান্দায় উঠে গেছে। দোতলার সিঁড়িটা ধরতে শুনল,
” স্কুলে যেতে মানা করব কেন? ”
” তাহলে? ”
” আমি শুধু একা একা গ্রামে আসতে মানা করেছিলাম। ছোট বাচ্চা তো, যদি হারিয়ে যায়? ”
” ছোট বাচ্চা! ”
শব্দ দুটো উচ্চারণ করে মৃদু হাসল। বেহালা সেই হাসি দেখতে পেল না। সে পেছনে পড়ে গিয়েছে। দুটো সিঁড়ি একসাথে ডিঙিয়ে সমানে যেতে পারছে না। দূর হতে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” এখানে কী কাজে এসেছেন? ”
” তোর বান্ধুবীকে ভর্তি করাব। ”
” স্বর্ণা গ্রামে ফিরেছে নাকি? ”
মুনছুর সাখাওয়াত এই প্রশ্নের জবাব দিল না। কাঙ্ক্ষিত কক্ষটা দৃষ্টি সীমায় এসে গিয়েছে। দ্রুত পা চালিয়ে সেদিকেই যাচ্ছিল। মেয়েটা তখনও পিছু করছে বুঝতে পেরে থেমে গেল। ঘাড় ফিরে জিজ্ঞেস করল,
” কী চাই? ”
” আরেকটা প্রশ্ন ছিল। ”
মুনছুর সাখাওয়াত প্রশ্ন না শুনে বলল,
” সুবর্ণ আসেনি। আমার যাকে দরকার শুধু তাকে নিয়ে এসেছি। ”
বেহালা আরেকদফা অপ্রস্তুত হলো। কপাল দলা করে বিরক্ত ভঙ্গিতে যে প্রশ্নটা করতে চাইল, সেই প্রশ্নটা করা হলো না। মুনছুর সাখাওয়াত খুঁজে বের করা কক্ষটায় ঢুকে পড়েছে।
_______
বাইরের সকল কাজ শেষ করে সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে মুনছুর সাখাওয়াত বাড়ির দিকে ফিরছিল। জীপের গতি ধীরে আনতে প্রায় ডুবে যাওয়া সূর্যের নিস্তেজ ও ক্ষীণ আলোয় কিশোরী অবয়বটা চোখে পড়ল। বারংবার দেখা পাওয়ায় দূর হতেও মুখটা চিনে ফেলল। তার বাড়ির সামনে গেইটের বাহিরের কিশোরী ছায়াটা বেহালার। জীপের শব্দ পেয়ে আবুল ত্বরিত বেগে গেইট খুলে দাঁড়িয়েছিল। মুনছুর সাখাওয়াত ভেতরে ঢুকে গেল। জীপ থেকে নামতে দেখল আবুল দাঁড়িয়ে আছে। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি তাক করতে জানালা বেহালা ভেতরে ঢুকতে চায়। বাড়ির কর্তার থেকে অনুমতি পায়নি বিধায় ঢুকতে দেয়নি। তাড়াতেও পারেনি। মেয়েটা জেদ ধরে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় দুই ঘণ্টা হবে। মুনছুর সাখাওয়াত খোলা গেইট দিয়ে আরও একবার অপেক্ষারত কিশোরীকে দেখে বলল,
” পাঠিয়ে দে। ”
বেহালা ভেতরে এলো প্রায় দৌড়ে। মুনছুর সাখাওয়াত দাঁড়িয়ে ছিল। কাছাকাছি আসতে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
” তোকে বলেছি না, সুবর্ণ আসেনি? তারপরেও এই জেদ ধরা কেন? আমাকে বিশ্বাস হয় না? ”
সে একটু দমে গেল বোধহয়। মুখটা সন্ধ্যার মতো মলিন হয়ে গেল। দৃষ্টি নামিয়ে ম্লান স্বরে জানাল,
” আমি স্বর্ণার সাথে দেখা করতে এসেছি। ”
মুনছুর সাখাওয়াত এক মুহূর্ত দ্বিধা করে ছোট্ট শব্দে অনুমতি দিল,
” আয়। ”
________
স্বর্ণলতা রুমের জানালা বন্ধ করেছিল। সহসায় শুনতে পেল,
” তোমার বান্ধুবী বসার রুমে বসে আছে। যাও, দেখা করে এসো। ”
মুনছুর সাখাওয়াত গোসলখানায় ঢুকে পড়ল। স্বর্ণলতার সব জানালা বন্ধ করা শেষ। স্বামীর জন্যে ধোয়া পাঞ্জাবি, পায়জামা বিছানায় সাজিয়ে রাখতে সব কাজ ফুরিয়ে এলো। অবসর সময়টা সে বসে বসে আপন ভাবনাতে কাটাচ্ছিল। আকস্মিক কণ্ঠটা বাজল,
” তুমি এখনও রুমে কী করছ? বললাম যে, বেহালা এসেছে? ”
স্বর্ণলতা নির্লিপ্ত কণ্ঠে জানাল,
” আসুক। ”
” দেখা করবে না? ”
” না। ”
” কেন? ”
” ভয় লাগে, যদি আবার অপমানিত হয়? তারচেয়ে ভালো বিদায় করে দিন। ”
মুনছুর সাখাওয়াত সাজিয়ে রাখা পাঞ্জাবিটা পরছিল। হঠাৎ থেমে গেল। স্মরণে এলো, বেহালার প্রথম দিনের আগমনটা। থাপ্পড়টা কি কেউই ভুলতে পারেনি? তার নিজের কাছেও ঘটনাটা এত স্পষ্ট লাগছে যেন গতকালই ঘটেছে! সে পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে নিতে নিতে বলল,
” অপমানিত হবে না। তুমি একটু দূরে বসো, ও যেন তোমাকে স্পর্শ করতে না পারে। ”
” কথা দিচ্ছেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর মাথায় ঘোমটা তুলে দিতে দিতে বলল,
” দিলাম। ”
স্বর্ণলতা একছুটে বসার রুমে পৌঁছে গেল। অবাদ আনন্দ ও উত্তেজনায় বান্ধুবীকে প্রায় জড়িয়ে ধরেছিল। সেই সময়ে মুনছুর সাখাওয়াত দূর হতে গলা খাঁকারি দিল। স্বর্ণলতা তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলে ফেলল। তটস্থ হয়ে দ্রুত পদে সরে গিয়ে বসল একটি সোফাতে। দুজনের মধ্যে কুশল বিনিময় শেষ হতে বেহালা মাথাটা সামনে এগিয়ে আনল। ফিসফিসে বলল,
” তোর জামাইয়ের মনে কী চলে রে? আমাকে দেখলেই শুধু সুবর্ণের কথা বলে। ওর সাথে আমার পরিচয় হলো সেদিন। তেমন কথা-বার্তাও তো নেই। ”
স্বর্ণলতা অবাক হয় কিন্তু উত্তর দেয় না। ঘাড় ফিরে শুধু একবার দেখে স্বামীর অবস্থান কোথায়। আশপাশে নেই। রুমে ঢুকে গেল নাকি কে জানে!
দুই বান্ধবীর বেশ গল্প হচ্ছে। ঢাকার প্রসঙ্গ উঠতে বেহালা জিজ্ঞেস করল,
” আন্টিরা কি এখনও ঢাকায় থাকবে? ”
স্বর্ণলতা উত্তরটা দেওয়ার সুযোগই পেল না। ভূতের মতো আগমন ঘটল মুনছুর সাখাওয়াতের। ফোড়ন কেটে বলল,
” তোর আন্টিরা ঢাকায় থাকবে। কিন্তু তুই বললে সুবর্ণকে গ্রামে ফিরিয়ে আনতে পারি। ওর মন ওখানে বসছে কোথায়! ”
বেহালা চমকে ওঠল। পর মুহূর্তে বান্ধুবীর দিকে তাকাল। মুখে কোনো কথা নেই। চোখের চাহনি দ্বারাই নালিশটা দিয়ে ফেলল। স্বর্ণলতা পেছন ফিরতে দেখল স্বামীটি নেই। আবারও উধাও হয়ে গিয়েছে। ব্যর্থ মুখটা ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হলো। বেহালা অবস্থা বুঝে নতুন প্রসঙ্গে চলে গেল। গল্প করতে করতে আচমকা বলল,
” সামনের মাসে আমার ঢাকায় যাওয়ার কথা আছে। ঠিকানা দিস তো। আন্টিদের সাথে দেখা করে আসব। ”
এই সময়ে আবারও আকস্মিকভাবে মুনছুর সাখাওয়াত হাজির হলো। স্বর্ণলতা কথা বলার পূর্বে বলল,
” যাওয়ার আগের দিন আমার সাথে যোগাযোগ করিস। সুবর্ণ তো বাড়িতে থাকেই না। থাকবে কীভাবে? মনে তো শান্তি নেই! আমি ফোন করে বলে দিলে বাড়িতে থাকবে। নাহলে দেখা হবে না। ”
এই পর্যায়ে স্বর্ণলতা সোফা ছেড়ে উঠে পড়ল। ততক্ষণে মুনছুর সাখাওয়াত নিজের রুমে ঢুকে পড়েছে। সেও পিছ ধরল। রুমের দরজা আটকে স্বামীর মুখোমুখি হলো। সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
” আপনি আমাদের মাঝে কথা বলছেন কেন? ”
” তোমাকে সাহায্য করছি। তোমার বান্ধুবী যে প্রশ্নগুলো করছে না সেগুলোর উত্তর তুমি দিবে কী করে? তাই আমি দিয়ে দিচ্ছি। ”
” আপনি জানলেন কী করে ওর মনে এই প্রশ্ন ঘুরছে? ”
” ও তুমি বুঝবে না। ”
” বুঝিয়ে বলুন। ”
” এখন না, সময় হলে নিজেই বুঝে যাবে। ”
” আমি এখনই বুঝতে চাই। বেহালার সামনে বার বার সুবর্ণকে আনছেন কেন? ”
” সুবর্ণ আসতে পারছে না তাই আমি আনছি। বেচারা আমার জন্য অনেক করেছে। সেই বিয়ের দিন থেকে শুরু হয়েছিল। এখনও চলছে। আর আমি ওর জন্য এটুকু করতে পারব না? ”
স্বর্ণলতা এক মুহূর্তের জন্য চুপ থেকে বলল,
” কী বুঝালেন? কিছুই তো বুঝলাম না! ”
” বুঝবে কীভাবে? মাথায় কি বুদ্ধিসুদ্ধি কিছু রেখেছ? বইপত্রের সাথে ওটাও তো ঢাকার বাসায় ফেলে এসেছ। পড়ার রুমে যাও। নতুন বই এনেছি সেগুলো পড়া শুরু করো। আমি কাছে ছিলাম না বলে পরীক্ষায় ফেইল করেছিলে না? এবার কাছে আছি। পাশ করে দেখাও। ”
_______
রাতের বেলা। মুনছুর সাখাওয়াত ঠোঁটের আদরটায় ঠিকমতো করতে পারল না। স্বর্ণলতা ভারি বিরক্ত হয়ে বলল,
” ছাড়ুন তো! ভালো লাগছে না। শরীরে কী মেখে আসছেন? আমার পেট গুলিয়ে আসছে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত ছাড়ল না। শুধু মুখটা সরিয়ে নিল। নিজের শরীরে গন্ধ শুঁকে বলল,
” কোথায় গন্ধ? কিছুই তো মাখিনি। একটু আগে না গোসল করলাম? ”
স্বর্ণলতা নিজেকে পুরোপুরি ছাড়িয়ে নিল। এক হাত দূরে সরে নাক, চোখ কুঁচকে বলল,
” এখান থেকেও গন্ধ পাচ্ছি। নিশ্চয় সাবান মাখেননি! ”
” সাবান, শ্যাম্পু সবই মেখেছি। বিশ্বাস নাহয় শুঁকে দেখ। ”
মুনছুর সাখাওয়াত মাথা এগিয়ে নিল। স্বর্ণলতা গন্ধ শুঁকবে তো দূর স্প্রিংয়ের মতো আরও একহাত দূরে সরে গেল। হাত দিয়ে নাক চেপে ধরে সাবধান করল,
” কাছে আসবেন না। সত্যি বমি করে দিব। ”
হঠাৎ এই অদ্ভুত আচরণের সম্মুখীন হয়ে যেমন বিস্মিত হলো তেমন চিন্তিতও। গন্ধের ওজুহাতে দূরত্ব তৈরি করার মেয়ে স্বর্ণলতা না। অন্য কোনো কারণ হতে পারে। স্বামীর থেকে মন উঠে যায়নি তো? এত জলদি মনে উঠে গেলে সে বাঁচবে কীভাবে? মুনছুর সাখাওয়াত অসহায় চোখে বউয়ের দিকে তাকাল। ঠিক তখনই মনে অদৃশ্য বাড়ি পড়ল। দ্রুত প্রশ্নটা করল,
” পেটে সমস্যা বললে না? মেজাজটাও চড়া লাগছে। এগুলো তো পিরিয়ডের লক্ষণ। আবার শুরু হয়েছে নাকি? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” জানি না। ”
মুনছুর সাখাওয়াত আবারও ভাবনায় পড়ল। চিন্তা কমার বদলে বাড়ছে কেন? ভাবনার মধ্যে মনের মধ্যে অদৃশ্য বাড়িটা আবারও পড়ল। এবার আগের চেয়েও জোরে ও ভারী হয়ে। সে অজান্তেই বউয়ের কাছে চলে গেল। কুঁচকে থাকা মুখটা দুই হাতে আগলে ধরে সুধাল,
” তোমাদের ঐটা মাসে মাসে হয় না? ”
” হুম। ”
” তাহলে আর হলো না কেন? তুমি এখানে এসেছ আড়াই মাস হয়েছে। ”
তার কণ্ঠস্বরে প্রবল ভয়, সন্দেহ। স্বর্ণলতা এসবের ধারেও গেল না। সে সর্বশক্তিতে স্বামীর হাত সরিয়ে নিল। এবার আর দূরে সরল না। শোয়া থেকে উঠে বিছানা থেকেই নেমে গেল। তারপরে নির্ভাবনায় জানাল,
” নতুন বিয়ে হলে তারিখ পিছায়। ”
” তাই বলে এতদিন! ”
মুনছুর সাখাওয়াত চটপটে খুলে রাখা পাঞ্জাবিটা পরে নিল। দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে ধরলে স্বর্ণলতা পিছু ডাকল,
” কোথায় যান? ”
” ফার্মেসিতে। ”
” কেন? বললাম তো হয়নি। ”
কথাটা শুনল কী শুনল না বুঝা গেল না। মুনছুর সাখাওয়াত রাতের আঁধারে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
_____
স্বর্ণলতার হাতে প্রেগন্যান্সির কীটটা দিয়ে ব্যবহারবিধিও বুঝিয়ে দিল। গোসলখানার দরজা আটকানোর সময়ে মুনছুর সাখাওয়াত বাঁধা দিল। বউয়ের একটা হাত ধরে অসহায় কণ্ঠে বলল,
” স্বর্ণলতা, দোয়া করো আমার সন্দেহ যেন সত্যি না হয়। ”
কিছু মিনিট বাদে স্বর্ণলতা বেরিয়ে এলো। স্বামীর কাছে কীটটা দিয়ে কৌতূহলী বদনে চেয়ে রইল। মুনছুর সাখাওয়াত দৃষ্টি সেই যে কীটে পড়ল, আর সরল না। একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে শুকনো গলায় প্রশ্নটা করল,
” তোমার বয়স কি আঠারো হয়েছে? ”
” না। ”
” এখনও হয়নি কেন? সেই কবে শুনেছি সতেরো চলছে। এতদিনে তো উনিশ হয়ে যাওয়ার কথা। ”
স্বর্ণলতার প্রশ্ন করতে হলো না। যা বুঝার নিজ দায়িত্বে বুঝে নিল। নিজের মধ্যে ভালো-মন্দ কোনো অনুভূতি তৈরি হওয়ার পূর্বে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সামনের মানুষটাকে সামলাতে। মুনছুর সাখাওয়াতের মাথাটা বুকের কাছে চেপে ধরে প্রথমে বলল,
” আঠারো হতে এখনও একমাস তিনদিন বাকি। ”
তারপরে হাতের বাঁধন আরও গভীর করে আশ্বস্ত সুরে বলল,
” এত ভয় পাচ্ছেন কেন? আমার কিছু হবে না। আঠারো হলেই কি সবাই সবদিক দিয়ে প্রস্তুত হয়, বলুন? আমাদের গ্রামের যে নিলু? আমার সাথে জন্মেছিল। আমার আগে বিয়ে হয়, বাচ্চাও হয়েছে। তাতে কী হয়েছে বলুন? বাচ্চা নিয়ে দিব্যি সংসার করছে। ”
” ওর নিশ্চয় তোমার মতো পড়াশোনার স্বপ্ন নেই? ”
” পড়াশোনা এখন আমার স্বপ্ন না। আপনি ভর্তি করিয়েছেন তাই পড়ছি। আমার কাছে এখন সবার প্রথমে আপনি, তারপরে আপনাকে ঘিরে থাকা সবকিছু। ”
মুনছুর সাখাওয়াতকে প্রায় সামলে এনেছিল। ঠিক তখনই বলে ওঠল,
” এই খবর আমি দাদিজানকে দিতে পারব না। কিছুতেই না। ছয় মাস আগে বড় মুখ করে যে কথাগুলো বলেছিলাম সব তো মিথ্যা হয়ে গেল। উফ! আমি মুখ দেখাব কীভাবে? দেখ, কী অপমানটা করে! ”
স্বর্ণলতা জোর দিয়ে বলল,
” অপমান করবে না। উনি ওরকম না। খুশি হবেন। ”
” করবে, স্বর্ণলতা। যেই সুযোগ পেয়েছে সারাজীবনের শোধ তুলবে। তুমি দাদিজানকে চিনতেই পারনি! ”
স্বর্ণলতা কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। ছয়মাস আগের ঘটনা তারও স্পষ্ট মনে আছে। দাদিজান তাকে রুম থেকে বের করে দিয়েছিল। তারপরেও সব শুনেছে। শুধু স্বর্ণলতা না, বাড়ির অন্য ঝিরাও শুনেছে। আল্লাহ তো গলার জোর ভালো দিয়েছে, তন্মধ্যে রেগে গেলে কণ্ঠস্বর মনে হয় আকাশেও পৌঁছে যায়!
মুনছুর সাখাওয়াত আচমকা বলল,
” দাদিজানকে এখনই কিছু বলার দরকার নেই। তোমার আঠারো হোক তারপরে বলব। তাহলে আর অপমান করতে পারবে না। বেশিদিন তো না! মাত্র একমাস। আমার জন্যে এই কয়দিন লুকাতে পারবে না? ”
স্বর্ণলতা উত্তর দিতে পারল না। মুখভর্তি বমি এসে গেল! গোসলখানার দিকে ছুটলেও পৌঁছাতে পারল না। দরজার কাছে বমি করে দিল। মুনছুর সাখাওয়াত মগভর্তি করে পানি নিয়ে এসে বলল,
” দাদিজানের থেকে তোমাকে লুকানোর দায়িত্ব আমার। কিন্তু স্বর্ণলতা, পেটে বাচ্চা এলে যে স্বামীর গায়ের গন্ধ সহ্য হয় না এটা তো বাপের জন্মেও শুনিনি। এটা কি আমার বেলায় প্রথম? কোন পাপের শাস্তি এটা? আমি কিন্তু এই শাস্তি নিব না। আগেই বলে দিলাম। ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (১০১)
মুনছুর সাখাওয়াত নিজের হাতে স্ত্রীকে পরিষ্কার করে দিতে চাইল, সম্ভব হলো না। স্বর্ণলতা পানির মগটা প্রায় কেড়ে নিল। অতঃপর হাত দিয়ে স্বামীর পেট বরাবর ধাক্কা মারল। নরম হাত, তন্মধ্যে বমি হওয়ায় দেহের শক্তি অর্ধেকে নেমে এসেছে। তাই সবলের ভারী ধাক্কাটাও পাটকাঠির মতো হালকা হয়ে ঠেকল। শক্তপোক্ত দীর্ঘ দেহটা ঠিকমতো টেরই পেল না যেন! মুনছুর সাখাওয়াত পেছনে সরার পরিবর্তে আরও কাছে এগিয়ে গেল। স্ত্রীর হাতে থাকা মগটাতে হাত ডুবিয়ে নিল। ভেজা হাতে ঠোঁটের লালা মুছে দিল প্রথমে। পুনরায় মগে হাত ডুবাবে তখনই স্বর্ণলতা মগসহ বাতাসের বেগে অন্যদিকে ফিরে গেল। ঘন ঘন ঢোক গিলে গলাটা যথেষ্ট পরিষ্কার ও স্বাভাবিক করল। তারপরে অসহায় কণ্ঠে চেঁচাল,
” একটা মানুষের শরীরে এত গন্ধ হয় কী করে? আল্লাহ! রক্ষা করো। ”
স্বর্ণলতা মাথার তালুতে পানি দিল, মুখ ভেজাল। তারপরে গলা, বুকসহ দেহের প্রায় অর্ধেকাংশই ভিজিয়ে ফেলল। উল্টো বসা অবস্থায় মগটা ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল,
” বমি করিয়ে যদি মারতে না চান তাহলে দূরে থাকেন। খবরদার কাছে আসবেন না। বমির মতো জঘন্য অনুভূতি আমি দ্বিতীয়বার চাই না। পেটে কিছু নেই, এবার নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসবে। ”
কণ্ঠটা এত ক্লান্ত ও দুর্বল হয়ে বাজছিল যে, মুনছুর সাখাওয়াতের বুকে সূচ ফোড়ার মতো ব্যথা আরম্ভ হলো। মেয়েটা এত কষ্ট পাচ্ছে? যন্ত্রণায় সুস্থভাবে কথাও বলতে পারছে না। সে চট করে দূরে সরে গেল কয়েকপা। তারপরে চিন্তিত কণ্ঠে সুধাল,
” ডাক্তার নিয়ে আসব? ”
” না। ”
” কেন? ”
” ডাক্তার এলে ব্যাপারটা লুকানো আরও কঠিন হয়ে যাবে। কোনো পরীক্ষা করতে হবে না, মুখ দেখলেই সব বুঝে যাবে। ”
” তোমার কষ্ট হচ্ছে যে? আমাকেও কাছে যেতে দিচ্ছ না। একা একা সব করতে হবে। ”
” আপনি দূরে থাকুন তাহলেই কষ্ট কমে যাবে। ”
” শাস্তিটা তাহলে দিবেই? ”
স্বর্ণলতার মাথা ভার লাগলেও শ্বাস-প্রশ্বাসের অস্বাভাবিক গতিটা ঠিক হচ্ছে। বুকের মধ্যে অশান্তি, পেটের ভেতরের গুলিয়ে উঠা ভাবটাও চলে গিয়েছে। সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। স্বামীর দিকে ফিরে দূর হতে আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করল,
” আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, শাস্তিটা আমি ইচ্ছে করে দিচ্ছি! আপনার শরীরের গন্ধ পাওয়ার ব্যাপারটা মিথ্যা। আমি ইচ্ছে করে সাজিয়েছি। ”
” ইচ্ছা-অনিচ্ছা যেটায় হোক আমি এই শাস্তি নিতে পারব না। তোমার থেকে দূরে থাকা অসম্ভব। তোমার এই অবস্থায় আমাকে দূরে সরিয়ে দিলে দুশ্চিন্তায় মরে যাব। একটু তো বুঝার চেষ্টা করো, বউ! ”
” আমি বুঝলে কী হবে? শরীর তো বুঝছে না! কত দূরে আছেন তারপরেও গন্ধটা টের পাচ্ছি। ”
” কেমন গন্ধ? বুঝিয়ে বলো। ”
স্বর্ণলতা চোখ বুজে গাঢ় নিঃশ্বাস টানল কয়েকবার। ক্ষণকাল নীরব থেকে আচমকা বলল,
” আপনার ঐ আতরের গন্ধটা। বিয়ের দিন যেটা মেখে ছিলেন। ”
” বেলি ফুল? ”
” হ্যাঁ, খুব কড়া। এত বিশ্রী গন্ধের আতর কেউ ব্যবহার করে? ”
মুনছুর সাখাওয়াত চোখদুটো খিঁচে বন্ধ করে নিল। তারুণ্য বয়সের প্রথম ভালো লাগা ছিল এই বেলি ফুল। কী সুন্দর দেখতে, কী সুন্দর সুবাস ছড়ায়! সে যতদূর জানে এই ফুল মেয়েদেরকেই অধিক আকৃষ্ট করে। অথচ তার বউয়ের বেলায় হলো উল্টো! এতটায় অপছন্দ হলো যে, গলা চিঁড়ে বমি হচ্ছে। নিজের দুঃখ ভুলে বউকে খুশি করতে উঠেপড়ে লাগল,
” করে না তো। আমি ভুল করে ব্যবহার করেছিলাম। আমার বউয়ের যে এত অপছন্দ হবে বুঝতে পারিনি। যখন বুঝেছি তখন থেকে আর ব্যবহার করিনি। বিশ্বাস করো, গত দুই বছরে বেলি ফুলের আতর তো দূর কোনো প্রকার আতরই ব্যবহার করিনি। ”
” তাহলে গন্ধটা পাচ্ছি কেন? ”
” জানি না। হতে পারে তোমার মনের ভুল। ”
স্বর্ণলতার গলাটা ভীষণ শুকনো লাগছে। বুকের ভেতরটায় খরা লেগেছে যেন! মরুভূমির মতো উত্তপ্ত ও শুষ্ক হয়ে আছে। এক ফোঁটা পানি না ঢাললেই নয়। সে পানির দিকে এগিয়ে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত বউয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে প্রয়োজনটা ধরে ফেলল। একটু আগের সাবধানতা, অনুরোধ সব ভুলে গেল নিমিষে। দ্রুত কদমে পৌঁছাল পানির কাছে। গ্লাসে পানি ভরে স্বর্ণলতার কাছে এলো। হাতে দেওয়ার ধৈর্যটুকুও দেখাতে পারল না। সরাসরি ঠোঁটের কাছে গ্লাসটা ধরে বলল,
” অল্প অল্প করে খাও নাহলে বিষম খাবে। ”
স্বামীর এই অসামান্য যত্ন, আদুরে বুলিতে স্বর্ণলতাও নিজের নতুন সৃষ্ট হওয়া সমস্যাটা ভুলে গেল। এক মুহূর্তের জন্য অসতর্ক হয়ে নির্দ্বিধায় পানি পান করতে লাগল। অল্প করে, ঘন ঘন চুমুক দিয়ে। গলাটা ঠিকমতো ভিজল না। বেলি ফুলের গন্ধটা অজান্তেই নিঃশ্বাসের সাথে মিশে গেল। পেট গুলিয়ে ওঠল সাথে সাথেই। যতক্ষণে দুজনের বুঝে এলো ততক্ষণে স্বর্ণলতা আরও একবার নোংরা করে ফেলল রুমের চকচকে মেঝেটা।
______
স্বর্ণলতা দ্বিতীয়বারের মতো বমি করে সোজা গোসলখানায় ঢুকল। দরজা আটকানোর সময়ে স্বামীর দিকে চেয়ে মিনতি স্বরে বলল,
” দয়া করে বাইরে থেকে ঘুরে আসুন। অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও এই জঘন্য গন্ধটা থেকে আমাকে মুক্ত রাখুন। ”
মুনছুর সাখাওয়াত অবোধের মতো নিষ্পলকে চেয়ে রইল। সেই দৃষ্টিকে কাঁপিয়ে দিল দরজা আটকানোর শব্দটা। আরও কিছু সেকেন্ড মূর্তির মতো স্থির থেকে বন্ধ দরজায় টোকা মারল। অতঃপর অসহায় কণ্ঠে সুধাল,
” এতরাতে কোথায় যাব? ”
” খুব বেশি রাত হয়নি। বাড়ির বাইরে যাওয়ারও দরকার নেই। শুধু এই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেই চলবে। আপনি দাদিজানের ঘরে যান। উনি জেগে আছে মনে হয়। কিছুক্ষণ গল্প করে আসুন। ”
” যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পরেই ফিরে আসব কিন্তু। ”
” আচ্ছা। ”
মুনছুর সাখাওয়াত দরজাটার কাছ থেকে সরে এলো। রুম থেকে প্রায় বেরিয়েই যাচ্ছিল সহসা কী যেন মনে পড়ল! দৌড়ে ফিরে এলো গোসলখানার কাছে। আবারও দরজায় টোকা মেরে সুধাল,
” আমাকে বাইরে বের করে দরজা আটকে দেওয়ার বুদ্ধি করছ না তো? তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হবে, স্বর্ণলতা। ”
” কোনো বুদ্ধি করিনি। ”
” ঠিক তো? ”
” হ্যাঁ। আপনি যান না! আমার গোসল প্রায় শেষ। বের হব। ”
_____
স্বর্ণলতা গোসল শেষে কাপড় বদলাচ্ছিল। সহসায় বাড়ি কেঁপে ওঠল কারও অট্টরবে। চরম বিস্ময়ে শাড়ি পরা বন্ধ হয়ে গেল। কানখাড়া করতে শব্দটা আবারও বন্ধ দরজা টপকে কানে প্রবেশ করল। হাসির মতো ঠেকছে। এত উচ্চ শব্দে হাসছে কে? এই বাড়িতে এমনটা কখনও ঘটেনি। অদম্য কৌতূহল ও উৎকণ্ঠায় ভারি অস্থির হয়ে ওঠল। কুটিরের মতো ভেজা ঘরটায় আটকে থাকতে পারছিল না। এত হাঁসফাঁস লাগছে!
স্বর্ণলতা পটু হাতে ঝটপট শাড়ি জড়িয়ে গোসলখানা থেকে বের হলো। সোজা ছুটে এলো রুমের বাইরে। বসার রুমটা নজরে আসতে চোখ কপালে উঠার উপক্রম হলো। মুনছুর সাখাওয়াত দাদিজানকে ঘাড়ে তুলে চড়কির মতো ঘুরছে। চোখে, মুখে সে কী উচ্ছ্বাস! পৃথিবীর সবটা আনন্দ এসে জমেছে ঠোঁটদুটিতে। অট্টহাসিতে বাড়ি কাঁপিয়ে তুলছে এই মানুষটা? এক সেকেন্ডের জন্য থামছে না। হাসিটাও বন্ধ হচ্ছে না। সে ঘন ঘন পায়ে আরও খানিক এগিয়ে চেঁচাল,
” আল্লাহ! কী করেন? থামেন। দাদিজান এই ঝক্কি সহ্য করতে পারবে না। উনি যে অসুস্থ এই কথা ভুলে গেছেন? ”
স্বর্ণলতার চিৎকার, শঙ্কিত ভাবনার তোপে পড়ে মুনছুর সাখাওয়াত থামল। দাদিজানকে নিচে নামিয়ে দিল। অসুস্থ বৃদ্ধা এক সেকেন্ডও স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। পড়ে যেতে নিলে স্বর্ণলতা দৌড়ে এসে ধরল। তারপরে চোখ পাঁকিয়ে ধমকে ওঠল,
” বটগাছের মতো দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন? দাদিজান পড়ে যাচ্ছে দেখতে পারছেন না? ধরেন। রুমে নিয়ে যেতে হবে এখনই। ”
খাইরুন নিসাকে রুমে আনা হলো। বিছানায় শুয়িয়ে দেওয়া মাত্র বমি করলেন। ময়না ও কলি বিছানা পরিষ্কার কাজে লেগে পড়ল। স্বর্ণলতা পানি ও তেল মিশিয়ে দাদিজানের মাথায় দিতে দিতে স্বামীর দিকে তাকাল। সে একহাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে, মুখে ভয় বা আতঙ্কের ছাপ নেই। উল্টো মিটিমিটি হাসছে। স্বর্ণলতা এত আশ্চর্য হলো! জিজ্ঞেস করল,
” হঠাৎ পোলাপান হয়ে গেলেন কেন? কী হয়েছে আপনার? ”
এই প্রশ্নের উত্তর এলো না। অপেক্ষা করারও সুযোগ পেল না। দাদিজান তার মাথা টেনে নিয়ে কপালে চুমু খেলেন। তারপরে হাসিখুশি বদনে বললেন,
” এই সুসংবাদটা শোনানোর জন্যই মনে হয় আল্লাহ আমাকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছেন। নাহলে এই বয়সেও এত অসুস্থতা সহ্য করে টিকে থাকি? ”
” কী সুসংবাদ, দাদিজান? ”
খাইরুন নিসা জবাব দিলেন না। ঠোঁটে হাসি ধরে রেখে তাকালেন নাতির দিকে। স্বর্ণলতা খেয়াল করে স্বামীর কাছে গেল। ফিসফিসে জিজ্ঞেস করল,
” আপনারা এমন অদ্ভুত আচরণ করছেন কেন? কী সংবাদ পেয়েছেন? কে দিয়েছে? বলেন না কেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দেওয়ার বদলে কেশে ওঠল। সহসা অস্বাভাবিক রকমের চিন্তিত ভাব ফুটে ওঠল মুখটায়। দাদিজানের দিকে চেয়ে বলল,
” অবস্থা বেশি ভালো না। তুমি দাদিজানের কাছে থাকো। আমি ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসছি। ”
সে ঝটপটে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লেও বেশিদূর এগুতে পারল না। স্বর্ণলতা পেছন থেকে গলা ছাড়ল,
” দাঁড়ান। ”
এই ডাক অগ্রাহ্য করার সাহসে কুলাল না। মুনছুর সাখাওয়াত বাধ্য হলো থেমে যেতে। স্বর্ণলতা পাশে এসে বলল,
” আপনাকে একটা বকা দিব। দয়া করে মনে নিবেন না। ”
সে চকিতে পাশে ফিরতে স্বর্ণলতা চোখ, মুখ খিঁচে মুক্তস্বরে উচ্চারণ করল,
” বেইমান! দুমুখো! ”
মুনছুর সাখাওয়াত হতভম্ব হয়ে সুধাল,
” একটা দিবে বললে না? ”
” একটাতে মন ভরছিল না। তাই দুটো দিলাম। রাগ করবেন না, বকা দুটো হলেও একই অর্থে ব্যবহার করেছি। ছোটবেলা বাংলা বইয়ে সমার্থক শব্দ পড়েছেন না? মনে করুন এগুলোও সমার্থক শব্দ। ”
স্বর্ণলতা দাদিজানের কাছে বসল না। তার শরীরের অবস্থাও খুব একটা ভালো না। হাঁটলে বা দাঁড়িয়ে থাকলে মাথা ঘুরাচ্ছে। গোসল করে আসায় খানিক শীতও করছে। সে ধীর পদক্ষেপে নিজের রুমে ঢুকল। মুনছুর সাখাওয়াতও স্ত্রীর পিছ ধরল। ডাক্তার আনার কথা তো পালানোর জন্যে বাহানা ছিল মাত্র!
_______
স্বর্ণলতা রুমে ঢুকে চুলে জড়ানো তোয়ালেটা খুলল। পিঠময় ভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে পড়তে শুনল,
” চুল ভেজানোর দরকার ছিল না। এমনিতেই অসুস্থতায় পড়েছ! এখন যদি আরও বাড়ে? ”
মুনছুর সাখাওয়াত বউকে টেনে নিয়ে এলো ড্রেসিং টেবিলের কাছে। হেয়ার ড্রায়ারটা এখানেই রাখা ছিল। সে চুল শুকিয়ে দিতে দিতে তরল গলায় সুধাল,
” রাগ করেছ? ”
” কোন ব্যাপারে? ”
” এই যে তোমাকে লুকাতে বলে আমিই ফাঁস করে দিলাম! সেটাও আজই। ”
” না। প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। আপনাকে কখনও এত খুশি হতে দেখিনি তো তাই। পরে খুশি লেগেছে এই ভেবে যে, প্রেগন্যান্সির ব্যাপারটা নিয়ে আপনার মধ্যে যে ভয় ছিল, দ্বিধা ছিল সবটায় খুব দ্রুত কেটে গেছে। মন থেকে খুশি হতে পেরেছেন। দাদিজানও সহজে মেনে নিয়েছে। ”
” এত খুশিই যদি হবে তাহলে বকা এলো কেন? আবার নাকি একটাতে মনও ভরেনি! ”
স্বর্ণলতা ভীষণ লজ্জা পেল। মানুষটা তার স্বামী হয়, বয়সেও কত বড়! প্রকাশ্যে এভাবে বকাগুলো দিল কীভাবে? মুখে একটুও তো বাঁধল না! পর মুহূর্তে হাসি পেল এই ভেবে যে, সময়ে সময়ে তাদের মধ্যকার লজ্জা, দ্বিধা পুরোটায় মুছে যাচ্ছে। দাদিজানের ভাষ্যমতে, ভালোবাসার গভীরতা এটাই তো। স্বর্ণলতা হাসি চেপে রেখে জবাব দিল,
” ধরে নিন, সুযোগ পেয়ে শোধ নিয়েছি। ”
” কিসের? ”
” একদিন আমাকে গিরগিটি বলেছিলেন না? সেটারই শোধ তুলেছি। ”
মুনছুর সাখাওয়াত চট করে সংশোধন করে দিল,
” আমি তোমাকে গিরগিটি বলিনি, গিরগিটিকে স্বর্ণলতা বলেছিলাম। ভালো করে মনে করো। ”
” মনে করার দরকার নেই। ভুলভাল বুঝালেই আমি বুঝে যাব না। এখন তো আবারও পড়াশোনা করছি, তাই মাথাতে বুদ্ধিও এসেছে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত কী বলবে বুঝতে পারল না। হেয়ার ড্রায়ারটা রেখে চুপচাপ স্ত্রীর পেছনে দাঁড়িয়ে রইল। স্বর্ণলতা আয়নায় ক্ষণকাল নীরবে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
” বিয়ের দিন আপনাকে যতটা লম্বা লেগেছিল, আপনি আসলে ততটাও লম্বা নন। ”
” তখন যতটা লম্বা ছিলাম এখনও ততটায় লম্বা আছি। এক ইঞ্চি কমেনি, বাড়েনিও। কিন্তু আমার বউ বেড়েছে। আড়াই বছরে পাঁচ ইঞ্চি লম্বা হয়ে মাথাটা আমার গলা অবধি চলে এসেছে। ”
স্বর্ণলতা মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে পুনরায় মন্তব্য করল,
” লম্বা হননি কিন্তু অনেক শুকিয়েছেন। ”
” হ্যাঁ। বউকে কাছে না পাওয়ার শোকে দশ কেজি ওজন কমে আশিতে ঠেকেছে। যদিও উচ্চতা অনুযায়ী ওজনটা এখনও মানানসই আছে। তারপরেও তুমি যদি ভারটা সামলাতে পার তাহলে বিশ কেজি বাড়াতেও আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি যেমন খেতে পছন্দ করি তেমন অভুক্তও থাকতে পারি। ”
মুনছুর সাখাওয়াত আরও কাছে এগিয়ে এলো। মাত্রই শুকানো চুলগুলো আলতো হাতে পিঠ থেকে সরিয়ে কাঁধের একপাশে রাখল। কোমল গ্রীবাদেশ, পেটিকোট ও ব্লাউজের মধ্যকার উন্মুক্ত পিঠের অংশটুকু গলিত সোনার মতো ঝিলিক দিয়ে ওঠল সাথে সাথে। ঘণ্টা কয়েক আগে যে উষ্ণ চাহিদা পূরণে বাঁধা পেয়েছিল সেটাই নতুনভাবে আরও প্রবল হয়ে ফিরে এলো যেন। দিনদুনিয়া ভুলে গেল নিমিষে। দীর্ঘদিন অনাবৃষ্টিতে থাকা রুক্ষ, খরখরে মাটি যেমন করে বৃষ্টির পানিকে টেনে নেয় তেমন করে নিজের মধ্যে বউটাকে টেনে নিতে ব্যাকুল হয়ে পড়ল। জড়িয়ে ধরা হলো, গোটা কয়েক চুমুও খাওয়া হলো। এর বেশি আগাতেই পারল না। স্বর্ণলতা বাঁধন ছিঁড়ে এমনভাবে ফসকে গেল যে, স্বামীর হাত নয় দুটো সাপ প্যাঁচিয়ে ধরেছে। আরেকটু হলেই কামড়ে দিত! দূরে সরে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
” আপনি আবারও আমার কাছে এসেছেন? ”
” আসব না? ”
” না। ”
” কেন? ”
” জানেন না? নতুন করে বলতে হবে? ”
মুনছুর সাখাওয়াতের এতক্ষণে হুঁশ এলো। নতুন করে সবকিছু স্মৃতিতে ধরা পড়তে ভীষণ অসহায় বোধ করতে লাগল। করুণ স্বরে সুধাল,
” দূরে থাকলে আদর করব কীভাবে? স্বর্ণলতা, আমার সন্ধ্যা থেকেই খুব ইচ্ছে করছিল। তুমি পড়ছিলে বলে বিরক্ত করিনি। তারপরে তো হয়েও হলো না! এখন এত বড় একটা সংবাদ পেলাম। খুশিটা উপভোগ করার জন্য তোমাকে লাগবেই। নাহলে আমার খুব খারাপ লাগবে। ”
” আপনি আমার সমস্যাটা বুঝছেন না! ”
” গন্ধের সমস্যা তো? দাঁড়াও, আমিও গোসল করে আসছি। তাহলেই গন্ধটা থাকবে না। ”
______
মুনছুর সাখাওয়াত গোসল করল বেশ সময় নিয়ে। বেরিয়ে এসে বউয়ের নাকের সামনে একটা হাত বাড়িয়ে ধরল। দারুন আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
” দেখ, কোনে গন্ধ নেই। ”
স্বর্ণলতা হালকাভাবে শুঁকে হাতটা সরিয়ে দিল। মুখ চেপে ধরে অস্ফুটে বলল,
” এখন তো আরও বেশি লাগছে। দূরে যান। উফ! আজকে মনে হয় বমি করতে করতে আমার জান বেরিয়ে যাবে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত ঝট করে একহাত দূরে সরে গেল। চোখ, মুখে বেদনা ফুটে ওঠল। চরম হতাশার কণ্ঠে বলল,
” এমন এক খবর পেলাম যে, সুখে ভাসছি, দুঃখেও ভাসছি। ”
তারপরে জানালার কাছে ছুটে গেল। আকাশের দিকে চেয়ে আকুল স্বরে উচ্চারণ করল,
” হে আল্লাহ, তোমার এই পাপী বান্দার প্রতি একটু সদয় হয়। কথা দিচ্ছি, বউকে নিয়ে রোজ তাহাজ্জুদ পড়ব। ”
স্বর্ণলতা বিছানায় শুয়ে ডাকল,
” শুনছেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত আকাশ থেকে মুখ নামিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকাল। সাথে সাথে শুনল,
” আপনি কি এই ঘরেই ঘুমাবেন? ”
সে ভারি আশ্চর্য হয়ে সুধাল,
” আমার কি অন্য ঘরে ঘুমানোর কথা? ”
” না। কিন্তু আজ রাতে যদি অন্য ঘরে শুতেন ভালো হতো। মনে হচ্ছে, ভালো একটা ঘুম হলে সমস্যাটা কেটে যাবে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত বিপরীতে কিছু বলল না। চুপচাপ কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। স্বর্ণলতা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। মানুষটা বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রুমের আবহাওয়া বদলে গিয়েছে। বেলি ফুলের গন্ধটা ছিটেফোঁটাও টের পাচ্ছে না। স্বর্ণলতা দারুন উদ্যমে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিল। চোখ দুটি বুজতে মনে পড়ল, এই বাড়িতে পুরোপুরিভাবে ফিরে আসার পরে স্বামীর বুক ছাড়া কোথাও মাথা রাখেনি। আজই প্রথম বিছানায় মাথা রাখল। এখন ঘুমটা আসলে বাঁচে।
______
রাতে বেশ কিছুক্ষণ ছটফট করলেও এক সময়ে স্বর্ণলতা ঘুমিয়ে পড়েছিল। শরীর এত দুর্বল ছিল! তন্মধ্যে রাতের গোসলটাও ভালো কাজে দিয়েছে। সেই ঘুম ভাঙল ফজরের আজান শুনে। আড়মোড়া ভাঙতে বুঝল, পা দুটো কারও অধীনে চলে গিয়েছে। সেই মানুষটা আর কেউ নয়, তার একমাত্র প্রাণপ্রিয় স্বামী। যাকে একসময় দৈত্য, দানব, রাক্ষস, জন্তুজানোয়ারসহ আরও অসংখ্য নামে আখ্যা দিয়েছিল। যার উপস্থিতিতে ভয়ে কাঁপত, কাঁদত, বিরক্ত হতো। কখনও চোখ মেলে দেখতে ইচ্ছে হতো না। অথচ আজ দু’চোখ মেলে ভারি মায়া নিয়ে চেয়ে আছে। এত ভালোবাসা পাচ্ছে! স্বর্ণলতা সাবধানে উঠে বসল। প্রথমে হাত দিয়ে চুলের মাঝে আদর করল। তারপরে ঠোঁটজোড়া এগিয়ে আনল কপালে। গালে, নাকে, ঠোঁটে ছোট ছোট আদর দিয়ে সরে এলো। তখনই শুনতে পেল,
” বউ, সমস্যাটা কি কেটে গেছে? ”
” না। ”
” আদর করলে যে? ”
স্বর্ণলতা পা দুটি টেনে ছাড়িয়ে নিল। বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল,
” নিঃশ্বাস আটকে ছিলাম। এরচেয়ে বেশি সময় নিঃশ্বাস আটকে রাখলে মরে যাব। বউকে জীবিত রাখতে চাইলে এটুকুতে কাজ চালিয়ে নেন। ”
পা জোড়া মেঝে স্পর্শও করতে পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত খপ করে হাতটা ধরল। অপূর্ণ ঘুমে লাল হয়ে আসা চোখদুটিতে চেয়ে কঠোর গলায় বলল,
” কাল থেকে অনেকবার মৃত্যুর কথা বলেছ। আমি কিছু বলিনি বলে ভেব না আর কখনওই বলব না। একটু আগে যে বললে? ওটাই যেন শেষ হয়। আমার কাছে তুমি জীবন-মরণেরও উর্ধ্বে। ”
হাতটা ছেড়ে দিয়ে বিছানায় নিজের শোয়ার স্থানে গেল। ঠিকভাবে শুয়ে চোখ বুজে পুনরায় বলল,
” ঐটুকু আদরের জন্যও যদি নিঃশ্বাস আটকে রাখতে হয় তাহলে দরকার নেই। শাস্তিটা আমি গ্রহণ করলাম। এখন দেখি, কতদিন চলে। শুধু অনুরোধ করব, আমার কোনো আচরণে কষ্ট পেও না। পুরুষ তো, যেকোনো সময় ধৈর্যহারা হতে পারি। কিন্তু কথা দিচ্ছি, অমানুষ হব না। ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (১০২)
মুনছুর সাখাওয়াতের ঘুম ভাঙল বেলা বারোটায়। চোখের পাতা মেলেনি তখনও। বুকের উপরে স্ত্রীর মাথাটা না পেয়ে হাত বাড়াল পাশে। যতদূর হাত পৌঁছায় ততদূর সন্ধান চালাল। কোথাও নরম দেহের স্পর্শ না পেয়ে আদুরে গলায় ডাকল,
” বউ? এই বউ, কোথায় তুমি? পাচ্ছি না কেন? ”
পরক্ষণে কণ্ঠে অভিমানের ছোঁয়া পড়ল,
” বিছানায় আমাকে একা রেখে উঠে যাওনি তো? খুব খারাপ হবে কিন্তু! তুমি কথা দিয়েছিলে, আমাকে ঘুমে রেখে কোথাও যাবে না। ”
ডাকাডাকি চলছে চোখ বন্ধ অবস্থায়। দুইহাতে দুইপাশে আবারও খানিক্ষণ তল্লাশি চালাল। স্বর্ণলতার শরীরের খোঁজ নেই, কণ্ঠও পাওয়া যাচ্ছে না। মুনছুর সাখাওয়াত হাত দুটো গুটিয়ে নিয়ে খানিক কড়া স্বরে বিরক্ত প্রকাশ করল,
” স্বর্ণলতা, আমি ডাকছি। শুনতে পাচ্ছ না? চোখ মেলে যদি দেখেছি তুমি বিছানায় নেই তাহলে ঘরের বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিব। দরজায় দাঁড়িয়ে বাইরে উঁকিও মারতে পারবে না। ”
চাপা স্বরের কঠিন সতর্কবার্তা দিয়েও কাজ হলো না। কাছে বা দূরে কোথাও থেকে স্বর্ণলতার গলার স্বর ভেসে এলো না। ভিন্ন কোনো আওয়াজও হচ্ছে না। রুমের ভেতরটা বড্ড ফাঁকা ও নিস্তব্ধ হয়ে আছে যেন! লম্বা সময়ের গভীর ঘুম উপভোগের ফলে মুনছুর সাখাওয়াত সময়ের হিসাব থেকে ছুটে গিয়েছে। ঘুমানোর পূর্বে তার সাথে কী কী ঘটেছিল সেসবও বেমালুম ভুলে গিয়েছে। নীরবে অপেক্ষা করতে করতে সন্দেহে পতিত হলো। ভাবল, স্বর্ণলতা নামাজ পড়ছে তাই জবাব দিতে পারছে না। নাহলে এই মেয়ে স্বামীর ডাককে সহজে উপেক্ষা করে না। রাগ বা অভিমানে থাকলেও চুপচাপ থাকে না। কথা বলে, কথা শুনেও। শুধু চোখে, মুখে প্রাণবন্ত ভাবটা থাকে না। বিষণ্নতার সুক্ষ্ম রঙটা ধরতে হলে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হয়।
মুনছুর সাখাওয়াত আরও মিনিট পাঁচেক শুয়ে থাকল। চোখ খুলল না একবারের জন্যও। যথেষ্ট পরিমাণে ধৈর্য সহকারে শান্তভাবে অপেক্ষা করছিল। সহসায় অস্থির হয়ে উঠল দেহমন। সালাম ফেরাতে এত সময় লাগে? মেয়েটা সত্যি নামাজ পড়ছে তো? মনের মধ্যে প্রশ্নটা উদ্রেক হতে চোখের পলক জোড়া আলগা হয়ে গেল। সরাসরি তাকাল নিচে, নামাজ পড়ার স্থানটায়। নেই! পুরো রুমে স্বর্ণলতার অস্তিত্ব নেই। মেয়েটা না বলে কোথায় চলে গেল? ভালো অবাধ্য হয়েছে তো! ক্ষণে ক্ষণে কথা ভাঙছে।
মুনছুর সাখাওয়াত বিছানা থেকে নামল। আরও একবার শূণ্য রুমটায় চোখ বুলানোর সময়ে চোখ পড়ে গেল দেয়াল ঘড়িটায়। ঘণ্টার কাঁটার অবস্থানটা দেখতে ভ্রূ জোড়া কুঁচকে ফেলল। সময়ের হিসাবকে অবিশ্বাস্য ঠেকছে। প্রথমে ভাবল ঘড়ি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ভাবনাটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। ঘুমটা সম্পূর্ণ ছুটে যেতে গতকাল রাতের ঘটনাগুলো একে একে মনে পড়তে লাগল। যত মনে পড়ছিল ততই বুকের মধ্যে ব্যথা বাড়ছিল। এ কেমন দূরত্ব, কেমন বিচ্ছেদ? সহ্য হয় না আবার উপেক্ষাও করা যায় না!
_____
মুনছুর সাখাওয়াত গোসল করে রুমের বাইরে পা রাখল। কলি ও ময়না দুপুরের রান্না গোছাচ্ছিল। সহসায় শুনতে পেল,
” তোদের রানিসাহেবা কোথায়? ”
বেজায় সহজ, স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর। তারপরেও হস্তকর্মে ব্যস্ত মেয়ে দুজন চমকে কেঁপে ওঠল। একজনে গরম খুন্তি অনায়াসে চেপে ধরে ফেলল। আরেকজন সবজি কাটতে গিয়ে আঙুল কে টে ফেলল। র ক্ত ঝরার যন্ত্রণা ভুলে কলি ত্বরিত উঠে দাঁড়াল। প্রত্যুত্তরে চটপটে বলল,
” রানিসাহেবা আপনের নাস্তা টেবিলে সাজাইয়া রাখছিল। এত বেলায় ঠান্ডা হইয়া গেছে মনে অয়। গরম কইরা দিমু, ছার? ”
জবাবে মুনছুর সাখাওয়াত নিরুত্তর থাকে। চোখের সামনে শান্ত, নরম দৃষ্টি তীক্ষ্ম ও রক্ত বর্ণ হয়ে ওঠল। কলির আসল ব্যাপারটা ধরতে বেশি সময় লাগল না। ভীত ও শুষ্ক কণ্ঠে দ্রুত বলল,
” মনে হয় আম্মাজানের রুমে। আমি ডাইকা দিতাছি, ছার। ”
কলিকে যেতে হলো না। মুনছুর সাখাওয়াতই দাদিজানের রুমের দিকে পা বাড়াল। সেকেন্ড কয়েক লাগল কাঙ্ক্ষিত রুমের সামনে আসতে। দরজাটা ভেজানো। সে ধীরে নীঃশব্দে হালকা ঠেলা দিতে সামান্য ফাঁক দৃষ্টি হলো। সেই ফাঁকে দৃষ্টি রাখতে দেখল, স্বর্ণলতা বিছানায় পা তুলে বসে আছে। দাদিজানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ঝিমুচ্ছে। মুনছুর সাখাওয়াত নীঃশব্দ ভেঙে ডেকে ওঠল,
” স্বর্ণলতা? ”
স্বর্ণলতার ঝিমানি ভাব কেটে গেল। চকিতে দরজার দিকে তাকাল। মুনছুর সাখাওয়াত দৃষ্টি আকর্ষণ পেয়ে জিজ্ঞেস করল,
” তোমার আজ ক্লাস নেই? ”
” আছে। ”
” তাহলে আমাকে ডাকোনি কেন? কয়টা বাজে দেখেছ? ”
স্বর্ণলতা এই প্রশ্নের জবাব দিতে চেয়েও থেমে গেল। হঠাৎই মনে পড়ল, সে দাদিজানকে ঘুম পাড়াচ্ছিল। চট করে বৃদ্ধার মুখটা দেখে নিল। চোখের পাতা বন্ধ, ভারি নিঃশ্বাস ছাড়ছে। মানুষটা তাহলে সত্যি ঘুমাচ্ছে! ফজরের নামাজ এই ঘরে পড়েছিল, দাদিজানের সাথে। তারপরে নিজের রুমে ফিরেনি। কথা বলতে বলতে শুনেছে, মানুষটা রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি। দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গিয়েছে বারবার। অথচ তিনি গতরাতে ভীষণ খুশি ছিলেন। বার বার স্বীকারোক্তি দিচ্ছিলেন, এই গ্রামে পা রাখার পর এত সুখ বোধ করেননি কখনও। সেই সুখী মানুষটা ঘুমের ঘোরে ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে জ্বর বাঁধিয়ে ফেলেছে। যদিও সংবাদটা স্বর্ণলতা কাউকে জানায়নি। ভেবেছিল, ভয় থেকে এমনটা হয়েছে। ঘুমালেই ঠিক হয়ে যাবে।
স্বর্ণলতা আলতোভাবে কপাল স্পর্শ করল। সাথে সাথে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল। তাপটা স্বাভাবিক লাগছে। এই সময়ে মুনছুর সাখাওয়াত আবারও ডেকে ওঠল,
” স্বর্ণলতা? আমার প্রশ্নের…”
কথার মাঝে স্বর্ণলতা ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ হতে বলল। তারপরে অতি সাবধানে আস্তেধীরে বিছানা থেকে নামল। স্বামীকে পাশ কাটিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে বলল,
” চেঁচাচ্ছেন কেন? দেখছেন না, দাদিজান ঘুমাচ্ছে? ”
স্বর্ণলতা বাইরে থেকে দরজাটা টেনে দিল। স্বামীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” খেয়েছেন? ”
” না। ”
” কেন? পেটে বাচ্চা তো আমার এসেছে। আপনার খেতে কী সমস্যা? ”
সে কথার মাঝে দেড় হাত দূরত্ব বাড়িয়ে নিয়েছিল। এখন হাঁটা ধরল। খাবার টেবিলের দিকে অগ্রসর হতে হতে পাক্কা গিন্নির মতো বলল,
” আগে খাওয়ার ঝামেলা শেষ করেন। তারপরে আপনার কথা শুনব। ”
মুনছুর সাখাওয়াত বাধ্য ছেলের মতো খেতে বসল। তিন চেয়ার ছেড়ে বসা স্ত্রীর দিয়ে চেয়ে সুধাল,
” তুমি খেয়েছ? ”
স্বর্ণলতা দূর হতে মাথা নেড়ে হালকা স্বরে উত্তর দিল,
” হ্যাঁ। ”
প্রথম লোকমাটা ঠোঁট পর্যন্ত গিয়েও ফিরে এলো প্লেটে। মুনছুর সাখাওয়াত খাবারসহ প্লেটে পানি ঢেলে হাত ধুয়ে নিল। স্বর্ণলতা যারপরনাই বিস্মিত হলো। ঝটিতে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে সুধাল,
” আরে! খাবারটা নষ্ট করলেন কেন? ”
এই প্রশ্নের জবাবটা প্রকাশ্যে এলো না। আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ যে বউ একা একা ঘুমাতে পারে, একা একা খেয়ে নিতে পারে সেই বউয়ের দেওয়া খাবার মুনছুর খায় না। ‘ পানিশুদ্ধ প্লেটটা দূরে ঠেলে দিয়ে মুনছুর সাখাওয়াত পূর্বের কথায় ফেরত গেল,
” কলেজে যাওনি কেন? ”
কণ্ঠস্বর, চাহনি, মুখো ভঙ্গির ধরণটা স্বর্ণলতার সুবিধার লাগল না। তাই কথা বাড়াল না। সরাসরি জানাল,
” দাদিজান মানা করেছিল। ”
” কেন? ”
” বলছিল, হাসপাতালে গিয়ে একবার টেস্ট করে আসতে। প্রেগন্যান্সির কীট নাকি সবসময় সত্যিটা ধরতে পারে না। ডাক্তারের কাছে গেলে এই ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে। সাথে পরামর্শও পাওয়া যাবে। পরামর্শগুলো আপনাকে ভালো করে শুনতে বলেছে। আপনাকে নিয়ে দাদিজানের অনেক ভয়। ”
মুনছুর সাখাওয়াত একমুহূর্ত চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল,
” এতগুলো কথা দাদিজান তোমাকে বলতে বলেছে? ”
” না। উনি ঘুমাচ্ছেন, তাই আমি বলে দিলাম। অসুস্থ মানুষটা আমাদের নিয়ে চিন্তা করে এটাই তো অনেক। একই কথা বার বার বলিয়ে কষ্ট দেওয়ার দরকারটা কী? উনি যেমন আমাদের ভালোবাসেন, আমরাও তো উনাকে ভালোবাসি, তাই না? আমাদেরও উচিত উনাকে নিয়ে চিন্তা করা। ”
” তৈরি হয়ে এসো। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। ”
টেবিল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে আবারও বলল,
” আজ অনেক কথা বলছ! তোমাকে এমন অপ্রয়োজনীয় কথা বলতে দেখিনি। এই পরিবর্তনটা ভালো। আমার পছন্দ হয়েছে। যাও, মাফ করে দিলাম। ”
স্বর্ণলতা অবাক হয়ে চটপটে সুধাল,
” কিসের জন্য মাফ করলেন? আমি তো কোনো মাফ চাইনি! ”
এই প্রশ্নের কোনো জবাব এলো না। মুনছুর সাখাওয়াত পানিতে ডুবে থাকা পরোটা তুলে নিল। রোলের মতো বানিয়ে কামড়ে খেতে খেতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
_______
টেস্টের রিপোর্টে ভিন্ন কোনো তথ্য এলো না। স্বর্ণলতার চাপা দুশ্চিন্তাটা কেটে যেতে স্মরণে এলো, এই হাসপাতালে এসে প্রীতুলের অন্তঃসত্ত্বার খবর পেয়েছিল। তারপরে অনেকগুলো মাস কেটে গিয়েছে। হিসেবমতে, এতদিনে বাচ্চাটার পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার কথা। স্বর্ণলতা আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ প্রীতুলবু সুন্দর, হাদিভাইও সুন্দর। বাবুটাও না জানি কত সুন্দর হয়েছে! একবার যদি দেখতে পারতাম! ‘ হঠাৎ করে বাচ্চাটার প্রতি এত কৌতূহল ও স্নেহ এসে পড়ল যে স্বর্ণলতা বেজায় আনমনা হয়ে পড়ল। তার মতো যে অসংখ্য মানুষ হাসপাতালে ঢুকছে-বেরুচ্ছে সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। অবিরাম হেঁটে চলেছে। মুনছুর সাখাওয়াত কতদূরে আছে খেয়ালও নেই। এই বেখেয়ালে এক মহিলার সাথে ধাক্কা খেল। ছিটকে বেসামালে পড়ে যাচ্ছিল প্রায় তখনই বলিষ্ঠ, পরিচ্ছন্ন পুরুষ হাতদুটো দৃঢ়ভাবে আটকে নিল। সোজাভাবে দাঁড় করিয়ে বলল,
” অন্ধও তো এভাবে হাঁটে না, স্বর্ণা! কী সমস্যা? মনোযোগ কোথায়? আরেকটু হলেই তো…”
কথাটা শেষ করতে পারল না। পূর্বেই মুনছুর সাখাওয়াত পেছন থেকে শার্টের কলারটা খামচে ধরল। সেভাবে টেনে কয়েক হাত দূরত্ব বানাল। তারপরে ক্রোধে ফেটে পড়ে চেঁচাল,
” ডাক্তারের বাচ্চা! তোর সাহস কী করে হলো আমার বউয়ের কোমরে হাত রাখার? ”
ডাক্তার হাদি সামান্যতম ভয় পেল না। উল্টো হেসে ফেলল। কলারটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
” শুনেছিলাম মারামারি ছেড়ে দিয়েছেন। আজ বিশ্বাস হলো। কিন্তু যার জন্য এত পরিবর্তন হলো তাকে এখনও সামলে রাখতে শিখেননি। ”
একটু থেমে স্বর্ণলতার দিকে তাকাল। মেয়েটাকে যেখানে দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছে একদম। একটা ভারী নিঃশ্বাস ফেলে দৃষ্টি সরিয়ে এনে পুনরায় বলল,
” ভালো করে খেয়াল করুন। ধাক্কাটা কোথায় গিয়ে খেয়েছে দেখতে পাচ্ছেন? সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে একেবারে নিচে পড়ত। তখন বাচ্চা আর বাচ্চার মা দুজনেই প্রাণ সংকটে পড়ত। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের সংযমী রাগটা বিস্ময়ে বদলে গেল। এই ছেলে জানল কীভাবে তার বউ অন্তঃসত্ত্বা? নজরে রাখছে না তো? পেছনে লোক লাগায়নি তো? নাকি স্বর্ণলতা নিজেই বলেছে? এদের কি এখনও একে-অপরের প্রতি দুর্বলতা আছে? লুকিয়ে-চুরিয়ে যোগাযোগ হচ্ছে না তো? পুরোনো সন্দেহ, পুরোনো ক্ষতটা নতুনভাবে জেগে উঠছিল প্রায় তখনই আল হাদি বলল,
” স্বর্ণার অন্যমনস্ক হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু আপনারটা অস্বাভাবিক। ”
মন্তব্য ছুঁড়ে দিয়ে হাতের রিপোর্ট ফাইলটা মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
” এটা আপনাদের দরকার। ডাক্তারের না। আপনাকে ও আমাকে চিনে বলে ফেরত পেলেন নাহলে কোথায় পড়ে থাকত ডাক্তার নিজেও বলতে পারত না! মারলে-কাটলেও না। পুনরায় টেস্ট করতে হতো। বাচ্চা মেয়েটার প্রতি একটু তো সদয় হোন। ও এসবে অভ্যস্ত না। ”
প্রতিটি কথার পেছনে সূক্ষ্ম খোঁচাটা টের পেলেও মুনছুর সাখাওয়াত কিছুই বলল না। শুধু রাগে চোখ, মুখ লাল হয়ে ওঠছিল। তপ্ত শ্বাস ফেলতে ফেলতে রিপোর্ট কার্ডটা ছিনিয়ে নিল। তখনই আবারও শুনল,
” যেভাবে আমার কলার চেপে ধরেছিলেন সেভাবে ফাইলটা খামচে ধরে থাকবেন। দশ মাসের যাত্রা। মাত্র তো শুরু! ”
সে কথা বলার সময়ে আরও একবার তাকাল স্বর্ণলতার দিকে। তারপরে উদ্বিগ্ন গলায় দ্রুত বলল,
” ওর কাছে যান। জলদি। ভয়ে প্রেশার নেমে গেলে আজকে আর বাড়ি ফিরতে হবে না। হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। ”
মুনছুর সাখাওয়াতও এতক্ষণে ব্যাপারটা ধরতে পারল। এক মুহূর্তও দেরি না করে সেদিকে পা বাড়াল। না চাইতেও কান দুটো শুনে ফেলল, ‘ কত করে বুঝালাম, ও আমাকে ভালোবাসে না। তারপরেও বিশ্বাস করলেন না! জোরজবরদস্তিতে বিয়ে করেও শান্তি হয়নি, জোর করে বাচ্চাও দিতে হলো। জীবনের প্রতিটি ঘটনার সাথে বয়সের একটা গুরুত্বপূর্ণ সামঞ্জস্য থাকে এটা কি শিখিয়েপড়িয়ে দিতে হবে? সেই বয়সটাও আপনি পেরিয়ে এসেছেন! মানুষ এত অজ্ঞ, এত নিষ্ঠুরও হয়? ‘
_______
বাসায় ফিরে মুনছুর সাখাওয়াত তেমন কোনো কথা বলল না। স্বর্ণলতাও স্বামীর দিকে মনোযোগ দিতে পারল না। তার শরীরের বাইরেটা স্বাভাবিক দেখালেও ভেতরটা এখনও কাঁপছে। মন ও মস্তিষ্কে সেই ধাক্কা খাওয়ার ঘটনাটা এমনভাবে গেঁথে গিয়েছে যে, কিছুতেই ছুটাতে পারছে না। যতবার মনে পড়ছে ততবারই গা শিউরে ওঠছে। কে বাঁচিয়েছিল, তাকে নিয়ে মুনছুর সাখাওয়াতের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব হয়েছে কি না এই নিয়েও কোনো মাথাব্যথা নেই।
এই ভয় থেকে বেরুতে স্বর্ণলতার প্রায় এক সপ্তাহ লাগল। তখনই টের পেল তার স্বামী সামনে আসে না। দূর থেকেও খেয়াল রাখে না। কথা-বার্তা একেবারেই হচ্ছে না। এই নীরব চালের কারণ কি রাগ? সে কি কোনো অপরাধ করেছে? স্বর্ণলতার আসল ঘটনা খুঁজে পেতে সময় লাগল কিন্তু সফল হলো।
সন্ধ্যার দিকে মুনছুর সাখাওয়াতকে বাড়ি ফিরতে দেখে স্বর্ণলতাও পেছন পেছন রুমে ঢুকল। কথা বলার সুযোগ পেল না। মুনছুর সাখাওয়াত সোজা গোসলখানায় ঢুকে পড়েছে। স্বর্ণলতা অভ্যস্ত হাতে স্বামীর জন্য ধোয়া পাঞ্জাবি বের করে অপেক্ষা করতে লাগল।
মুনছুর সাখাওয়াত বউয়ের বের করা পাঞ্জাবিটা পরল ঠিকই কিন্তু বাক্য বিনিময় করল না। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে ধরলে স্বর্ণলতা বলল,
” ভুল হয়েছে, মাফ করে দিন। আমার ওরকম একা একা হাঁটা উচিত হয়নি। ”
সে থামল। ঘাড় ফিরে চেয়ে থাকল কতক্ষণ। তারপরে সম্পূর্ণ দেহটা ফিরিয়ে নিস্তেজ কণ্ঠে বলল,
” ভুলটা আমার। আমিই তোমার প্রতি খেয়াল রাখতে পারিনি। মাত্র একদিন তোমার সাথে মিশতে পারিনি তাতেই তুমি এত গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছ। না জানি আরও কতদিন মিশতে পারব না! তখন তোমার অবস্থান কোথায় হবে বুঝতে পারছ? স্বর্ণলতা, আমি শুধু টাকার লোভী না শরীরেরও লোভী। তোমার প্রতি আমার যত পাগলামি দেখেছ, সব তোমার ঐ শরীরের জন্যই। আমাকে যত ফিরিয়েছ তত দাম বেড়েছে। তোমার না, তোমার শরীরের। আমারও লোভ বেড়েই চলেছে। তারপরে যখন পেয়ে গেলাম তখনই দামটা কমে গেল। এখন আমাকে কাছে টানলে গুরুত্ব পাবে নাহলে পাবে না। হিসাবটা এই পর্যায়ে চলে এসেছে। ”
স্বর্ণলতা প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে পারল না। শুধু টের পেল তার চোখের কোল পানিতে থইথই করছে। এই জড়তা কাটিয়ে উঠে মুনছুর সাখাওয়াতের কাছে চলে এলো। তারপরে অশ্রুসিক্ত চোখে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলতে লাগল,
” এসব কী বলছেন! আপনি হঠাৎ এত পাগল হলেন কেন? ঐদিন আমিই আপনার থেকে দূরে সরে হাঁটছিলাম। আপনি তো আমার হাতও ধরতে চাইলেন। আমিই দিইনি। ”
” আমি তো জোর করে ধরতে পারতাম। আগে যেমন ধরতাম। ”
” ভয়ে ছিলেন, যদি বমি করি? অসুস্থ হয়ে যাই? তাই জোর করতে পারেননি। ঐদিন যা হয়েছে সম্পূর্ণ দোষ আমার। ”
” নিজের ঘাড়ে দোষ টেনে আমাকে বাঁচিয়ে দিচ্ছ কেন, স্বর্ণলতা? ”
” আমি বিশ্বাস করি, আপনি সজ্ঞানে ইচ্ছা করে আমার কোনো ক্ষতি করতে পারেন না। ”
মুনছুর সাখাওয়াত চোখ সরিয়ে নিল। মুখটা অন্যদিকে সরিয়ে ভারি ব্যথিত গলায় বলল,
” সামলাতেও পারি না! ”
” কে বলেছে এ কথা? আপনার মতো করে আমাকে কেউ সামলাতে পারত না। এই কথাটা আপনার আর আমার চেয়েও আল্লাহ ভালো জানত। তাই তো বিবাহ সূত্রে আমাদের বেঁধে দিয়েছেন। ”
এই কথার বিপরীতে কোনো কথা আসে না। স্বর্ণলতা অধৈর্য হয়ে পড়ে। মুনছুর সাখাওয়াতের মুখটা সামনে ফিরিয়ে ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করে,
” বলুন, কে বলেছে এ কথা? হাদি ভাই? ”
” হ্যাঁ। ”
উত্তরটা দেওয়ার সাথে সাথে তার চোখ, মুখে বেদনার ছায়া পড়ল। অভিমানে ঠোঁটদুটি এমনভাবে ফুলে কাঁপতে লাগল যেন, কোনো অবুঝ বাচ্চা তার সবচেয়ে নির্ভরশীল মানুষটার কাছে অভিযোগ করছে! তার বিশ্বাস এই মানুষটা ঠিক এর বিচার করবে। স্বর্ণলতার হৃদয়েও মায়া উপচে পড়তে লাগল। পা উঁচিয়ে অভিমানে টসটসে ঠোঁটটায় গাঢ় চুমু খেয়ে বলল,
” এই কথা আগে বলবেন না? ”
স্ত্রীর থেকে নির্ভেজাল আদর পেয়ে মুনছুর সাখাওয়াতের সকল বেদনা দূর হয়ে গেল। অনুতপ্তের আগুনটাও ধপ করে নিবে গেল। মন ও শরীর এমন চনমনে হয়ে উঠল যেন, বহু দিনের ক্লান্তি দূর হয়ে গিয়েছে। স্বর্ণলতার কোমর জড়িয়ে ধরে চোখে চোখ রেখে পাল্টা প্রশ্ন করল,
” বললে কী করতে? ”
” বকা দিতাম। ”
” তাই নাকি? ”
” বিশ্বাস হচ্ছে না? ”
” না। ”
” কেন? ”
” কাউকে বকতে হলে হৃদয় শক্ত হতে হয়। তোমার হৃদয় তো তুলোর চেয়েও নরম। ”
” আপনার জন্য নাহয় একবেলা শক্ত করতাম! ”
” দরকার নেই। তুমি শুধু আমাকে তোমার এই এতটুকু কাছে আসার ব্যবস্থা করে দেও, তাহলেই চলবে। তোমার খেয়াল রাখার জন্য এতটুকু কাছে আসা জরুরি। এটা বুঝছ না কেন? ”
স্বর্ণলতা চোখ বুজে ফেলল। শ্বাস রুদ্ধ করে স্বামীর হাত দুটো সরিয়ে দিল কোমর থেকে। তারপরে কয়েকপা দূরে সরে বলল,
” আমি বুঝেছি কিন্তু আমার শরীর তো বুঝে না। আপনার শরীরের গন্ধটা দিন দিন শুধু বেড়েই যাচ্ছে। এরকম চললে তো এক বাড়িতেও থাকা কষ্ট হয়ে যাবে। ”
মুহূর্তেই মুনছুর সাখাওয়াতের চোয়ালদ্বয় শক্ত হয়ে এলো। চোখের দৃষ্টি ও মুখের রঙ বদলে গেল নিমিষে। প্রচণ্ড বিরক্ত নিয়ে বলল,
” একটু আগেই তো ঠিক ছিলে এখন আবার গন্ধ এলো কীভাবে? ”
” একটু আগে আমি গন্ধের বিষয়টায় বেখেয়াল ছিলাম। আপনি আমার চিন্তাভাবনার পুরোটায় দখল করে ছিলেন, তাই গন্ধটা পাইনি। এখন তো আপনি নিজেই মনে করিয়ে দিলেন। এই দোষটা কিন্তু আপনার। ”
” বেশ, তাহলে আমি তোমার হাদি ভাইয়ের থেকে কষ্ট নিয়ে আসি। তুমি মায়া করে হলেও কিছুক্ষণ কাছে থাকবে। ”
স্বর্ণলতা হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল,
” আল্লাহ আপনাকে ধৈর্য দিক। ”
” হ্যাঁ, দুনিয়ার যত ধৈর্য আছে সব আমাকেই দিক। আমি বউয়ের জন্য পাগল, বউ তো আমার জন্য পাগল না। তাই তার ধৈর্য বা অধৈর্য কোনোটারই দরকার পড়ে না। ”
_________
আরও কিছুদিন পেরুতে দেখা গেল স্বর্ণলতার শুধু স্বামীর শরীরের গন্ধ না খাবারের মশলার গন্ধেও বমি হচ্ছে। খাওয়া-দাওয়ায় এলো প্রবল অনীহা। চোখ, মুখ শুকিয়ে যেতে লাগল। শরীরের ওজন কমতে লাগল। মাথাব্যথার যন্ত্রণায় দিনরাত কাতরাতে লাগল। ডাক্তার দেখিয়েও কোনো উন্নতি হচ্ছিল না। মুনছুর সাখাওয়াত এসব সহ্যই করতে পারছিল না। যে শান্তির জন্য বউকে ঘরে তুলল সেই শান্তির এক ফোঁটাও বুঝি বেঁচে রইল না। এক মাসেই এত অসহণীয় হয়ে ওঠল যে, সে দাদিজানকে সমানে বকতে লাগল। বৃদ্ধা তখন পুরোপুরি শয্যাশায়ী! স্বর্ণলতা কিছুতেই স্বামীর মুখ বন্ধ করতে পারে না। সরিয়েও আনতে পারে না। উল্টো মুনছুর সাখাওয়াত তাকে রুম থেকে বের করে দরজা আটকে দিল। তারপরে দাদিজানের পা ধরে কেঁদে ফেলল। যতক্ষণ না মন শান্ত হলো ততক্ষণ কাঁদল। কান্না শেষে কাতর স্বরে বলল,
” দাদিজান, আমাকে বলোনি কেন পেটে বাচ্চা এলে ওর এত কষ্ট হবে? ”
খাইরুন নিসা ম্লান হেসে সুধাল,
” বললে বুঝি বাচ্চা নিতি না। ”
” না। ”
” পাগল একটা! ”
দুজনের কেউ আর কোনো কথা বলে না। অনেকটা সময় নীরব থাকার পরে খাইরুন নিসা ডাকলেন,
” নাতভাই? পা ছাড়। মুখের কাছে আয়। তোকে একটু মন ভরে দেখি। ”
মুনছুর সাখাওয়াত মুখের কাছে আসে। একহাত ধরে বসে থাকে। দাদিজান অন্যহাতে আদরের নাতির মাথা হাতান, মুখ হাতান। অতঃপর বুক হাতিয়ে বললেন,
” এখানে যে এত ভালোবাসা আছে একটুও আঁচ পাইনি! কার থেকে পেয়েছিস? ”
” জানি না। ”
” জানিস। বল না! ও কে নিয়ে গল্প করতে আমার খুব ভালো লাগে। ”
বৃদ্ধের চাওয়া পূরণ হয় না। মুনছুর সাখাওয়াত চুপ করে থাকে। অন্যমনস্ক হতে শুনল,
” তোর মাকেও এমন পাগলের মতোই ভালোবাসতি, তাই না রে? ”
” না। ”
” মেয়েটা তো বেঁচে নেই, তারপরেও স্বীকার করতে পারছিস না? ঐটুকু বয়সে এত কঠিন অভিমানও কারও হয়? ”
” আমার তো হলো। ”
” ভাঙার মানুষটাও তো নেই, নিজেই ভাঙ না! ”
” ভেঙে কী হবে? মা কি ফিরে আসবে? আমার কথা শুনবে? ”
বৃদ্ধার কথা বলার শক্তি বুঝি এতটুকুই ছিল। কাঁপতে থাকা, অস্পষ্ট ও ক্লান্ত কণ্ঠস্বরটা আর বাজল না।
_______
স্বর্ণলতার মাথাব্যথার সমস্যাটা খানিক কমেছিল। আজকে একেবারেই নেই। সন্ধ্যায় খুব ক্ষিধা পাওয়ায় দুই প্লেটের মতো ভাত খেল। একটুও বমির ভাব এলো না। প্রায় দেড় মাস পরে পেট ভরে খেল। এতেই বুঝি তার মন ও শরীর উভয়ই ফুরফুরে হয়ে ওঠল। প্রথম দুই সপ্তাহের মতো মুনছুর সাখাওয়াতের রুমে ঘুমিয়েছিল। তারপরে জোর করেও থাকতে পারেনি। অসুস্থতা বেড়ে গিয়েছিল। দেখাশোনা করবে কে? আসল মানুষটা তো কাছে দাঁড়াতেও পারে না! শুধু মাঝরাত্রিতে পা জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকে। স্বর্ণলতা ঘুম ভাঙলেই পা সরিয়ে নেয়। তাই দাদিজানই নিজের রুমে টেনে নিয়েছিলেন। তিনি চোখে চোখে রাখতেন, সেই সাথে কলি ও ময়নাও ছিল দেখাশোনার জন্যে।
স্বর্ণলতা ভেবেছিল খেতে পেরেছে মানে স্বামীর সাথে থাকতেও পারবে। তাই সন্ধ্যার পরে সে নিজেদের রুমে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত তখনও ফিরেনি। স্বর্ণলতা এই সুযোগে নতুন শাড়ি পরল, খানিক সাজলও। কিন্তু অপেক্ষা ফুরাচ্ছিল না। তাই বই-খাতা নিয়ে পড়তে বসল। পড়াশোনাও তো ঠিকমতো হচ্ছে না। এদিকে পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসছে। এই সুযোগে একটু পড়া এগিয়ে রাখা যাবে।
বই মেলেছে পাঁচ মিনিটও হয়নি। সবে পড়ায় মন বসছিল তখনই জীপের শব্দটা পেল। মুহূর্তেই আনন্দে উত্তেজিত হয়ে হাত-পা কাঁপতে লাগল। কতদিন পরে মানুষটার কাছাকাছি আসবে! বই-খাতা বন্ধ করে প্রবল আগ্রহে চেয়ে রইল দরজার সামনে। চেয়ে থাকতে থাকতেই শ্বাস ঘন হয়ে গেল। যত নিঃশ্বাস টানছিল ততই যেন বেলির গন্ধটা তীব্র হচ্ছিল। দরজার কাছে মানুষটার ছায়া দেখতেই তার পেটের ভেতর গুলিয়ে ওঠল। চোখ বুজে, মনকে নানানভাবে বুঝিয়েও কোনো কাজ হলো না!
মুনছুর সাখাওয়াত রুমে ঢুকতেই স্বর্ণলতা দুই আঙুল দিয়ে নিজের নাক চেপে ধরল। মুখ হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, ছাড়ছে। দৃশ্যটা মুনছুর সাখাওয়াত একেবারে সহ্য করতে পারল না। প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে শরীর থেকে পাঞ্জাবি খুলে মেঝেতে ঢিল মারল। তারপরে চেঁচাল,
” তোমার নাক না ধরে আমার নাক ধরো। মুখসহ এমনভাবে চেপে ধরবে যাতে নিঃশ্বাস নিতে না পারি। ”
স্বর্ণলতা ভারি আশ্চর্য হয়ে সুধাল,
” আপনিও কি বিশ্রী গন্ধটা পাচ্ছেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াতের রাগ এবার চরম হতাশায় রুপান্তর হলো। বউয়ের কাছে দুইপা এগিয়ে এসে বলল,
” তোমার যে হাত! নাক-মুখ একসাথে চেপে ধরলেও কাজ হবে না। তার চেয়ে সহজ হবে ফ্যানে শাড়ি বেঁধে আঁচলটা গলায় প্যাঁচিয়ে ঝুলে পড়লে। তোমার পরনের শাড়িটা ভালোই শক্ত মনে হচ্ছে। স্বর্ণলতা, শাড়ি খুলো। ”
স্বর্ণলতা ভেবেছিল এক রকম, ঘটছে আরেক রকম। ভাবনা ও বাস্তবের মধ্যে পড়ে সে অনেকটায় ঘেটে গেল। কী করবে বা বলবে বুঝতে পারছিল না। সহসা স্বামীর কণ্ঠ থেকে নির্গত আদেশ পালনেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শাড়ি প্রায় খুলেই ফেলেছিল তখনই মুনছুর সাখাওয়াত দ্বিতীয় বারের মতো আদেশ দিল,
” আমার রুম থেকে বেরিয়ে যাও। এখনই। স্বর্ণলতা, এক সেকেন্ডও দেরি করবে না। ”
চলবে