মরুর বুকে বৃষ্টি পর্ব-৩২

0
1215

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-৩২

★ভোরের দিকেই আদিত্য নূরের রুম থেকে চলে গেল। যাওয়ার আগে নূরের কপালে ভালোবাসার পরশ দিতে ভোলেনি।

সকালের মিষ্টি রোদ ঘরে ঢুকতেই নূরের ঘুমটা হালকা হয়ে এলো। নূর আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। আজ এতো সকাল সকাল নিজের ঘুম ভাঙা দেখে নূর নিজেই খানিকটা অবাক হলো। মনে হচ্ছে কাল রাতের ঘুমটা অন্য দিনের তুলনায় অনেক ভালো হয়েছে। হঠাৎ নূরের নাকে একটা ঘ্রাণ আসলো। নূর এদিক ওদিক তাকিয়ে নাক টেনে ঘ্রাণের উৎস খোঁজার চেষ্টা করছে। নূর নিজের জামার গলাটা ধরে নাকের কাছে নিতেই বুঝতে পারলো ঘ্রাণ টা ওর জামা থেকেই আসছে।ঘ্রাণ টা কেমন যেন খুব পরিচিত মনে হলো নূরের। নূর ভ্রু কুঁচকে ভাবলো, এমন ঘ্রাণ কোথাথেকে আসলো? আমি তো এমন কোন পারফিউমও ব্যবহার করি না। তবে কি অন্য কেও আমার রুমে এসেছিল? না না এটা কিভাবে সম্ভব? হয়তো আমারই কোথাও ভুল হচ্ছে। নূর তাই আর বেশিকিছু না ভেবে উঠে ফ্রেশ হতে গেল।

নূর ফ্রেশ হয়ে রোজকার অভ্যাস অনুযায়ী একটু ছাঁদে গেল। নূর রোজ সকালে উঠে ছাঁদে ওর ফুলগাছ গুলো দেখতে যায় তাদের পানি দেয়।এই বিষয় টা নূরের অনেক ভালো লাগে। তাই আজও তার ব্যাতিক্রম হলোনা। নূর ছাঁদে ওর ফুলগাছ গুলোর কাছে যেতেই হঠাৎ দেখতে পেল আদিত্য ছাঁদে উপুড় হয়ে পুশআপস করছে। আদিত্যকে দেখে নূর একটু থতমত খেয়ে গেল। তাড়াতাড়ি করে নেমে যেতে নিয়ে আবার মনে মনে বললো, এক মিনিট আমি কেন যাবো? এটা আমার বাসা,আমার ছাঁদ। তাহলে আমি কেন যাবো? সে তার কাজ করছে। আমিও আমার মতো আমার কাজ করবো।

এসব ভেবে নূর আর গেলনা। পানির পাইপ টা চালু করে গাছে পানি দিতে লাগলো। না চাইতেও নূরের অবাধ্য চোখ দুটো শুধু আদিত্যের দিকেই যাচ্ছে। একটা হাতা কাটা ঢোলা টি শার্ট পড়েছে আদিত্য। যার দরুন আদিত্যের ফুলে ওঠা মাসলস গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এক্সারসাইজের কারণে আদিত্যর বলিষ্ঠ শরীরে ঘাম জমে গেছে। সব মিলিয়ে আদিত্যকে এই মুহূর্তে অনেক অ্যাট্রাকটিভ লাগছে। নূর বারবার আরচোখে আদিত্যের দিকে তাকাচ্ছে। এই কারনে নিজের ওপর নিজেই বিরক্ত হচ্ছে নূর।মনে মনে নিজেকে নিজেই বকে দিয়ে বললো।
–তুই কবে থেকে এতো লুচু হয়ে গেলি নূর? এর আগে কি কখনো ছেলেমানুষ দেখিস নি নাকি? এভাবে হা করে গেলার কি আছে? খবরদার আর তাকাবি না।

নিজের মনকে ধমক দিলেও মন ওর কথা না শুনে আবারও আদিত্যর দিকেই যেতে লাগলো। নূরের এবার আদিত্যের ওপরও রাগ লাগছে। এক্সারসাইজ করবে নিজের রুমে বসে করুক।এখানে সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে করার কি আছে? অসহ্যকর।

আদিত্য আরচোখে নূরের সব কার্যকলাপই দেখছে । বিষয় টা ওর অনেক মজা লাগছে। একটু পরে আদিত্য উঠে দাঁড়িয়ে নূরের সামনে এসে দাঁড়াল। আদিত্যকে দেখে নূর একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। আদিত্য নূরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।
–এক্সকিউজ মি নূর। ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমাকে কি একটু পানির পাইপ টা দেওয়া যাবে?

নূর জোরপূর্বক হেসে পানির পাইপ টা আদিত্যের দিকে এগিয়ে দিল। আদিত্য পাইপ টা নিয়ে পাইপের পানি নিজের মুখের ওপর ধরলো। মুখে পানি দিতে দিতে মাথাটা ঝাঁকাতে লাগলো। যারফলে আদিত্যের চুলের পানি ছিটে নূরের মুখে লাগছে। নূর চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিল। শরীর টা কেমন যেন কেঁপে উঠল ওর। আদিত্য একটু পরে পানির পাইপ টা আবার নূরের হাতে দিয়ে বললো।
–থ্যাংক ইউ।
তারপর আদিত্য ছাঁদ থেকে নেমে এলো। নূরের অগোচরে আদিত্যের ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো।

আর নূর কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো পানির পাইপ হাতে নিয়ে ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো।
____

বিহান আদিত্যের বাসার ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে কিছু হিসাব নিকাশের কাজ করছিল। তখনই হঠাৎ আয়াত সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। বিহানের সামনে এসে বিহানের দিকে একটা ইনভিটেশন কার্ড এগিয়ে দিল। বিহান ভ্রু কুঁচকে একবার কার্ডের দিকে তাকিয়ে আবার আয়াতের দিকে তাকিয়ে বললো।
–এটা কি?

–আমার বিয়ের কার্ড।

আয়াতের অনায়াসে বলা কথাটায় বিহানের বুকের ভেতর ধুক করে উঠলো। বিহান বিস্মিত চোখে তাকালো আয়াতের দিকে। তখনই আয়াত সোফায় বসে হেসে দিয়ে বললো।
–মজা করছিলাম। এটা আমাদের এনজিওর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কার্ড। আমাদের এনজিওর জন্য অনুদান কালেক্ট করতে আমরা একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। আপনাকে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। আশা করি আসবেন।

বিহান প্রথমে আগে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। আয়াতের অমন কথায় হঠাৎ কিছু একটা হয়ে গিয়েছিল বিহানের। বুকের ভেতর থাকা যন্ত্র টা কেমন মুহূর্তের জন্য যেন থমকে গিয়েছিল।কিন্তু এমনটা কেন হলো? এমনটা হওয়ার তো কথা না?এমন হলে যে অনেক বড়ো ঝামেলা হয়ে যাবে। আজ মজা করলেও, একদিন না একদিন তো এই দিনটা সত্যিই আসবে। তখন এই বুকের ভেতর থাকা যন্ত্রটা কি করবে? সেকি তখন একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে? নাকি কোনরকমে চলবে?

বিহানকে চুপ থাকতে দেখে আয়াত বলে উঠলো।
–কি হলো, কিছু বললেন না যে? আসবেন তো অনুষ্ঠানে?

আয়াতের কথায় বিহানের ভাবনায় ছেদ পড়লো। বিহান একটু নড়েচড়ে বসে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো।
–দেখুন আমি জানি আপনি আমার সেদিনের কথাগুলোর জন্য এসব করছেন। তবে আপনাকে এসব করার কোন দরকার নেই। আপনার সামনে পুরো লাইফ পরে আছে। আপনি পড়ালেখা করুন, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিন।জীবনটাকে ইনজয় করুন। এসবে জড়ানোর কোন দরকার নেই আপনার। আপনি আগের মতোই লাইফ এনজয় করুন।

আয়াত স্মিত হেসে বললো।
–প্রথমত আমি আপনার জন্য এসব করছি না। জরুরি নয় সব বিষয় শুধু আপনাকে নিয়েই হবে। হ্যাঁ এটা ঠিক, আপনার কথায় আমি এই পাথ খুজে পেয়েছি। তবে এসব আমি আপনার জন্য বা আপনাকে ইমপ্রেস করার জন্য করছি না। আর কে বললো আমি এনজয় করছি না? আরে আমিতো এতদিনে একটা আসল খুশী খুঁজে পেয়েছি। এই কাজটায় যে আমি কতো শান্তি পাই সেটা আপনাকে বলে বুঝাতে পারবোনা। যখন ওই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মুখে একটু হাসি ফোটাতে পারি, নিজেকে যেন তখন ধন্য মনে হয়। তখনকার ওই খুশীটা সবচেয়ে বেশি দামী মনে হয়।

বিহান অবাক চোখে তাকিয়ে আয়াতকে দেখছে। মেয়েটার ভেতর যে এতো মায়া,এতো উদারতা আছে তা কখনো টেরই পায়নি বিহান। সবসময় শুধু ওর চঞ্চলতা দেখে নিতান্তই ইমম্যাচিওর মনে হতো ওকে। অথচ এখন এক অন্য আয়াতকেই দেখতে পাচ্ছে বিহান। বিহানের ভাবনার মাঝেই আয়াত আরও বলতে লাগলো।
–আর এমনিতেও আমি বেঁচে থাকার জন্য একটা উৎস খুঁজছিলাম। আর শেষমেশ পেয়েও গেলাম। এখন এই এনজিও আর এনজিওর কাজই হবে আমার বেঁচে থাকার মূল উদ্দেশ্য। আমার স্বপ্ন আমি এই এনজিওটাকে ভবিষ্যতে আরও অনেক বড়ো করবো। যাতে যতটা পারি আমি সব সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের হেল্প করতে পারি। যাইহোক আজকে বিকালেই অনুষ্ঠান। যদি আসেন তাহলে খুশী হবো।
কথাগুলো বলে আয়াত চলে গেল।

আর বিহান আয়াতের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। আয়াতের শেষের বলা কথাগুলোই ওর ভেতরে থাকা কষ্টের কিছুটা আভাস পেয়েছে বিহান। কেন যেন আজ আয়াতের কষ্টে বিহানের বুকেও চিনচিন ব্যাথা করছে। এমনটা কেন হচ্ছে? তাহলে কি বিহানও এখন আয়াতের ব্যাথায় ব্যাথিত হতে শুরু করেছে?
_____

নূর ব্রেকফাস্ট করার জন্য ডাইনিং টেবিলের কাছে আসতেই ওর মা ওর হাতে একটা গরম ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ ধরিয়ে দিয়ে বললো।
–যাতো কফিটা আদিত্যকে দিয়ে আয়।

নূর যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। বোকার মতো ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো।
–আমি??

নূরের মা সোজাসাপটা বলে উঠলো।
–হ্যাঁ। তুই নাতো কে? এখানে কি আর কেও আছে? যা যা তাড়াতাড়ি কফিটা দিয়ে আয়। নাহলে ঠান্ডা হয়ে যাবে। ছেলেটা তখন কি বলবে, আমরা তাকে এককাফ গরম কফিও দিতে পারি না?

নূর ওর মায়ের কথার পৃষ্ঠে আর কথা বলার সাহস পেল না। অগত্যা দমে গিয়ে কফির মগটা নিয়ে আদিত্যের রুমের দিকে এগুলো।
আদিত্যের রুমের দরজায় এসে টোকা দিল।কয়েকবার নক করার পরেও ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ এলো না। নূর এবার দরজাটা একটু খুলে ভেতরে তাকিয়ে দেখলো রুমে কেও নেই। ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ দেখে বুঝতে পারলো আদিত্য ওয়াশরুমে। যাক ভালোয় হয়েছে, তাহলে উনার মুখোমুখি হতে হবে না। কথাটা ভেবে নূর রুমের ভেতর এগিয়ে গিয়ে কফির মগটা টেবিলের ওপর রাখলো। নূর একটু খেয়াল করে দেখলো রুমটা একদম পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা আছে। কোথাও কোন অগোছালো নেই। ছেলে মানুষ হয়েও এতো নিট এন্ড ক্লিন দেখে নূর একটু অবাক হলো।

নূর ঘুরে চলে আসতে নিবে তখনই হঠাৎ একটা মিষ্টি ঘ্রাণ নূরের নাকে এসে লাগলো। ঘ্রাণ টা কেমন পরিচিত পরিচিত মনে হলো নূরের। নূর এদিক ওদিক তাকিয়ে আর নাক টেনে ঘ্রাণের উৎস খোঁজার চেষ্টা করলো। বেডের ওপর আদিত্যর শার্ট রাখা আছে। নূর সন্দেহজনক ভাবে শার্ট টা হাতে নিয়ে নাকের কাছে ধরলো। হ্যাঁ এখান থেকেই আসছিল ঘ্রাণ টা। ঘ্রাণ টা কেমন যেন তিব্র নেশালো।নূর যেন ঘোরের ভেতর চলে যাচ্ছে। নূরের মনে পড়লো, সকালে এই ঘ্রাণ টাই তো ও ওর জামা থেকে পাচ্ছিল। তাহলে কি উনি কি আমার রুমে এসেছিল?
কথাটা ভাবতেই কেমন যেন বুকটা কেঁপে উঠল নূরের। না না এটা কিভাবে সম্ভব? আমিতো রাতে দরজা আটকিয়েই শুয়েছিলাম। হয়তো আমারই কোথাও ভুল হচ্ছে। কিন্তু এই ঘ্রাণ টা? আর ভাবতে পারছে না নূর।সবকিছু কেমন যেন কনফিউজিং লাগছে। এই লোকটাকে কেমন রহস্যময় লাগছে ওর কাছে।

নূরের ভাবনার মাঝেই ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ এলো। নূর তাকিয়ে দেখলো আদিত্য শাওয়ার নিয়ে শুধু একটা টাওয়াল পড়ে বের হয়েছে। নূরের বেহায়া চোখদুটো যেন আদিত্যতেই আটকে গেল। আদিত্যের ফর্সা সুঠাম শরীরে পানির কনা গলো যেন মুক্ত দানার মতো চিকচিক করছে। নূরকে দেখে আদিত্য টেডি স্মাইল দিয়ে ধীরে ধীরে নূরের দিকে এগিয়ে এলো। নূর দেয়ালের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। আদিত্যকে আসতে দেখে অপ্রস্তুত ভাবে বললো।
–আপনার কফি দিতে এসেছিলাম।

কথাটা বলে নূর চলে যেতে নিলে তার আগেই আদিত্য নূরের দুই পাশ দিয়ে দেয়ালে হাত রেখে নূরকে মাঝখানে আটকে দিল। নূর চমকে উঠলো। বুকলেট ভেতর আবারও ঢিপঢিপ করে উঠলো। নূর বুঝতে পারছে না এই লোকটা যখনই ওর কাছে আসে তখনই ওর এমন হয় কেন? কেমন যেন অদ্ভুত ফিলিং হয়। হৃদপিণ্ড টা দ্রুত বেগে দৌড়ায়। যেন কোন কিছু ইঙ্গিত করতে চায় সে। কিন্তু কি সেটাই বুঝতে পারে না নূর। নূর কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো।
–ক ককি করছেন?

আদিত্য নূরের দিকে একটু ঝুঁকে নেশালো কন্ঠে বললো।
–আমি কি করছি? যা করার তুমিই তো করছো। আমিতো তোমার হেল্প করতে চাইছি।

–মা মানে?

–ঘ্রাণ নিতে চাইলে শার্ট থেকে নেওয়ার কি দরকার? জলজ্যান্ত মানুষ টাই তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যত খুশী ঘ্রাণ নাও। আই ওন্ট মাইন্ড এ্যাট অল।

আদিত্যের কথায় নূর থতমত খেয়ে গেল। তারমানে উনি দেখে ফেলেছেন? ছি ছি উনি কি ভাবছেন নাজানি? নূর অপ্রস্তুত ভাবে বলে উঠলো।
–ও ওটার একটা কারণ আছে। আসলে সকালে আমার জামা থেকেও এই ঘ্রাণ টাই পাচ্ছিলাম। তাই একটু সন্দেহ হচ্ছিল আর কি। তাছাড়া আর কিছুই না ।

আদিত্য নূরের দিকে নেশা ভরা চোখে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললো।
–তাই? তাহলে তো এটা অনেক বড়ো রোগে আক্রান্ত হয়েছ তুমি। তুমি জানো এমনটা কখন হয়? যখন কেও কারোর কথা সবসময় ভাবে, তখন তার ঘ্রাণ সব জায়গায় পায় সে।এমনকি তাকে দেখতেও পায় সব জায়গায়। তাহলে কি তোমার সাথেও তাই হচ্ছে?

নূর থতমত খেয়ে বললো।
—এ এমন কিছুই না। ছাড়ুন আপনি।

আদিত্য নূরের দিকে আরেকটু ঝুঁকে বলে উঠলো।
–তুমি মানা করলেও তোমার লক্ষণ গুলো তো অন্য কিছু বলছে।
কথাটা বলে আদিত্য নিজের মাথাটা আরেকটু ঝুকিয়ে নূরের ঘাড়ের কাছে মুখ নিয়ে নাক টেনে নূরের শরীরের মিষ্টি ঘ্রাণ টেনে নিল। নূরের সারা শরীর কেঁপে উঠল। চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিল নূর। আদিত্যের এমন কার্যক্রমে সাধারণত নূরের চরম রাগ লাগা দরকার। তবে আশ্চর্যজনক ভাবে কেন যেন নূরের রাগ বা অস্বস্তি কিছুই হচ্ছে না। বরং কেমন জানি রাজ্যের লজ্জা ঘিরে ধরছে নূরকে। লজ্জায় কাঁপছে নূর।

আর নূরের এই কাঁপুনি যেন আদিত্যকে নেশাগ্রস্ত করে দিচ্ছে। এর আগে কখনো নূরের প্রতি আদিত্যর শারীরিক কোন চাহিদা কখনোই জাগেনি। জাগবেই বা কি করে, তখন তো নূর একটা মাছুম পরি ছিল। যাকে শুধু ভালোবাসা যায়।তার প্রতি কখনো চাহিদা করা যায়না। তবে এখনকার এই নূরকে দেখলেই কেন যেন অবাধ্য চাওয়া গুলো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। হারাতে ইচ্ছে হয় নূরের মাঝে। খুব কাছে টানতে ইচ্ছে করে।

আদিত্য নূরের চুলের মাঝে নাক ডুবিয়ে দিয়ে নূরের চুলের ঘ্রাণে মাতোয়ারা হতে লাগলো। নূর আর থাকতে পারলোনা। দুইহাতে আদিত্যকে।হালকা ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। আর আদিত্য মাথার চুল নেড়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো।

নূর দৌড়ে রুমে এসে দরজা বন্ধ করে, দরজার হেলান দিয়ে হাঁপাতে লাগলো। আরেকটু হলে বোধহয় ওর নিঃশ্বাসই বন্ধ হয়ে যেত। বুকটা এখনো প্রচন্ড পরিমাণ কাঁপছে। কি হচ্ছে ওর সাথে কিছুই বুঝতে পারছে না নূর। মনে মনে ভাবছে লোকটার থেকে দূরে থাকতে হবে। কেমন যেন মায়াজালে ঘেরা লোকটা। কাছে আসলেই কি যেন হয়ে যায় ওর। মনে হয় কেমন হারিয়ে যায় ও। তাই লোকটার থেকে দূরে থাকাই ঠিক হবে। এমনিতেও লোকটা কেমন যেন রহস্যে ভরা। মনে হয় কিছু একটা লুকানো আছে ওনার মাঝে। উফফ আর ভাবতে পারছে না নূর। আপাতত এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ভার্সিটির জন্য রেডি হয়ে নিল নূর।

নূর রেডি হয়ে নিচে নেমে এলো। নিচে এসে দেখলো আদিত্য ডাইনিং টেবিলে বসে মহারাজের মতো আয়েশ করে নাস্তা গিলছে। আর তার মা বরাবরের মতোই আদিখ্যেতার বহর লাগিয়ে দিয়েছে। এসব দেখে গা জ্বলছে নূরের। রাগে বিড়বিড় করে বললো, উঁহু ঢং দেখে বাচিনা। নিজের মেয়ে না খেয়ে চলে যাচ্ছে সেদিকে কোন খেয়ালই নেই এদের। কোথাকার কোন লোককে নিয়ে এমন আদিখ্যেতা করছে, যেন মাথায় তুলে নিয়ে নাচলে শান্তি পায় এরা। আমি এদের সত্যিকারের মেয়ে কিনা এই ব্যাপারে আজ প্রথমবার ডাউট হচ্ছে আমার। ধ্যাৎ খাবোই না আর।

নূর রেগে চলে যেতে নিলেই আদিত্য বলে উঠলো।
–আরে নূর না খেয়েই চলে যাচ্ছো?

নূর আদিত্যের দিকে আরচোখে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–আপনিই বেশি করে খান। আমার খাওয়ার দরকার নেই। আমার এমনিতেও দেরি হয়ে যাচ্ছে।

নূরের মা ধমকের সুরে বললেন।
–নূর, এভাবে কিভাবে কথা বলছিস? আমি তোকে এই শিক্ষা দিয়েছি? ওতো তোর ভালোর জন্যই খাওয়ার কথা বলেছে। এতে এতো রাগার কি আছে?

আদিত্য বলে উঠলো।
–ইটস ওকে মা। আমি কিছু মনে করিনি।

আদিত্যের ওর মাকে মা ডাকতে দেখে নূরের ছোট্ট মনটা যেন বেলুনের মতো ঠুস করে ফুটে গেল। শেষমেশ কিনা পুরোপুরি আমার মাকে কেড়ে নিল এই লোকটা? এখন আবার আমার মাকে মাও ডাকছে? এই দুঃখ কই রাখবো? কচু গাছের সাথে গলায় দড়ি দিব নাকি? না না থাক। দরকার নেই। শুধু শুধু কচু গাছটাকে আমার কষ্টের ভাগিদার করে কি হবে? এই অভাগিনীর দুঃখের বোঝা নাহয় আমি একায় বয়ে বেড়াবো।নূরের ভাবনার মাঝেই আদিত্য আবার বলে উঠলো।
–তোমার ভার্সিটি কোথায়?

নূর ওর ভার্সিটির ঠিকানা বললে,আদিত্য বলে উঠলো।
–ওও তাহলে তো সমস্যা নেই। আমি ওইদিকেই একটা মিটিং এর জন্য যাচ্ছি। যাওয়ার সময় তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাবো।

নূর বলে উঠলো।
–তার কোন দরকার নেই। আমি একাই চলে যেতে পারবো।

নূরের মা আবারও কড়া গলায় বলে উঠলো।
–মানা করছিস কেন? ছেলেটা যখন এতোকরে বলছে তখন যানা? তোর দেরিও হবে না।

নূরের ওর মায়ের ওপর চরম রাগ লাগছে। কোথায় আমি এই লোকটার কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছি। আর মা কিনা আরও এই লোকটার কাছে পাঠানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আর কোন উপায়ও তো নেই। এখন যদি মানা করে দেই মা নিশ্চয় আমাকে ঘর থেকেই বের করে দিবে। এখন যে তার সো কল্ড ছেলেই সবকিছু। আমি আবার কোন ক্ষেতের মূলো। তাই নূর আর কথা না বাড়িয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ব্রেকফাস্ট করে আদিত্যর সাথে বের হলো।

গাড়িতে নূর গুপ মেরে বসে রইলো। একটা কথাও বললো না আদিত্যের সাথে। আদিত্য নূরের এমন গাল ফুলানো দেখে মনে মনে হাসলো। আজকে একটু হলেও নূরকে সেই আগের নূরের মতো লাগছে। আদিত্য খুব মিস করে ওর মাছুম পরিটাকে। নাজানি কবে আবর সে তার নূরকে পুরোপুরি ভাবে ফিরে পাবে। কথাটা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আদিত্য।

কিছুক্ষণ পর ভার্সিটির সামনে এসে গাড়ি থামালো আদিত্য। তারপর নিজে নেমে নূরের পাশে এসে দরজা খুলে দিল। নূর নেমে ছোট্ট করে একটা থ্যাংক ইউ বলে সোজা চলে গেল। নূর ভেতরে না যাওয়া পর্যন্ত ওর দিকে তাকিয়েই রইলো।

নূর ওর বান্ধবীদের কাছে আসতেই দেখলো সবকয়টা আবালের মতো হা করে দাঁড়িয়ে আছে। নূর ভালো করে খেয়াল করে দেখলো। এরা সবাই আদিত্যর দিকে ওভাবে হা করে তাকিয়ে আছে। নূর ওদের মাথায় একটা চাটি মেরে বললো।
–এই ছাগলের দল। এভাবে আবালের মতো হা করে দাঁড়িয়ে কি দেখছিস?

ওরা বলে উঠলো।
–ওয়াও দোস্ত কি হট মাল। আমিতো ফিদা হয়ে গেছি। কোথায় পাইলি এমন হট বম।

এদের কথায় নূরের কেমন যেন রাগ হলো।নূর বিরক্তিকর কন্ঠে বললো।
–ছিহ এসব কি ধরনের ভাষা। হট মাল আবার কি? তোরা তো দেখছি একদম উচ্ছনে চলে গেছিস।

–আরে এর জন্য তো উচ্ছনে কেন,মঙ্গলগ্রহেও যেতে রাজি আমি। বলনা কে উনি?

–আমাদের বাসার পেইং গেস্ট। কালকেই এসেছে।

–ওয়াও কত্তো লাকি তুই ইয়ার। এমন একটা হট পেইং গেস্ট থাকলে আর কি লাগে জীবনে। আমি হলে তো পেইং গেস্ট কে বাসার জামাই বানিয়ে দিতাম।

নূর দাঁত কিড়মিড় করে বললো।
–চুপ করবি তোরা? কি যাতা বলছিস?

ওরা সবাই নূরকে চেপে ধরে বললো।
–ইয়ার আমাদের একটু ইন্ট্রো করিয়ে দেনা তোর পেইং গেস্টের সাথে। প্লিজ প্লিজ প্লিজ ইয়ার তুই যা বলবি আমরা তাই শুনবো। শুধু একবার প্লিজ।

নূর চরম বিরক্ত এদের কান্ড কারখানায়। অগত্যা এদের কথা রাখার জন্য বাইরের দিকে তাকালো। তবে এতক্ষণে আদিত্য চলে গেছে। সেটা দেখে নূর যেন মনে মনে খুশি হলো। নূর পর বান্ধবী দের দিকে তাকিয়ে বললো।
–কিন্তু উনিতো চলে গেছেন।

ওর বান্ধবীরা প্রথমে একটু হতাশ হলেও পরে বলে উঠলো।
–আরে আজ চলে গেছে তাতে কি হয়েছে? তোদের বাসায় তো আছে। আমরা তোর বাসায় গিয়ে দেখা করবো।

নূর পরে গেল এক ঝামেলায়। এখন আবাল গুলো আবার কি করে কে জানে।

চলবে…..
( তাড়াহুড়োর জন্য রিচেক করতে পারিনি। ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন)