মরুর বুকে বৃষ্টি পর্ব-৪৬ এবং শেষ পর্ব

0
2245

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-৪৬

★সবাই মিলে নূরকে হসপিটালে নিয়ে এসেছে। নূরের এখানো জ্ঞান ফেরেনি। ডক্টর ভেতরে নূরকে দেখছে। আর কেবিনের বাইরে সবাই বোধশক্তিহীন হয়ে বসে আছে। একদিকে আদিত্যর ফ্লাইটের ওই নিউজ। আর অন্যদিকে নূরের এই অবস্থা। সবার যেন মাথাই কাজ করছে না। নীলা আর আয়াত তো সেই কখন থেকে শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। আবির আর বিহানের খুব মন চাইছে ওদের মতো চিৎকার করে কান্না করতে। কিন্তু পুরুষদের যে কাঁদতে নেই। তাইতো তারা শুধু ভেতরে ভেতরেই কাঁদতে পারে।

বিহান আর আবির শুধু বারবার আদিত্যের নাম্বারে ফোন করছে। তবে বারবার সেই বিরক্তিকর কন্ঠটাই ভেসে আসছে। আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারে এই মুহূর্তে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। বিহাম লন্ডনে আবিরের ম্যানেজার কেউ ফোন দিয়েছে। সে বলেছে আদিত্য স্যার তার ফ্লাইটের জন্য চলে গেছেন। আরও কয়েক জায়গায় খবর নিয়েছে। তারাও একই কথা বলেছে। ধীরে ধীরে ওদের সব আশায় নিভে যাচ্ছে। চোখের সামনে অন্ধকার দেখতে পাচ্ছে ওরা।

দশ মিনিট পর নূরের জ্ঞান ফিরলো। নূর চোখ পিটপিট করে খুলে তাকালো। চোখ খুলে আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো কোথায় আছে ও। নিজেকে হসপিটালে দেখে একটু অবাক হলো নূর। তখনই ওর সেই ভয়ংকর নিউজ টার কথা মনে পড়লো। নূরের সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। সমস্ত শিরা উপশিরা গুলো কাটা দিয়ে উঠলো। হৃৎস্পন্দনের গতি অস্বাভাবিক ভাবে চলতে শুরু করলো। নূর হঠাৎ উচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠলো।
—হিরোওওওওওওও

নূরের চিৎকার শুনে সবাই দ্রুত দৌড়ে কেবিনে ঢুকলো। ওরা কেবিনে ঢুকে দেখলো নূর অস্থির হয়ে হাতের স্যালাইনের পাইপ টেনে খুলছে। স্যালাইনের পাইপ খুলতেই হাত দিয়ে রক্ত বের হওয়া শুরু হলো।নীলা আর আয়াত নূরকে ধরে আটকানোর চেষ্টা করছে। নূর অস্থির হয়ে অস্বাভাবিকভাবে বলতে লাগলো।
–হি হিরো কোথায়?কোথায় আমার হিরো? ওকে আসতে বলো তাড়াতাড়ি। আ আমি না অনেক বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছি। স্ব স্বপ্নে দেখলাম ওর প্লেন…. না না ওসব কিছুই না। ওগুলো শুধুই খারাপ স্বপ্ন। আমি জানি আমার হিরোর কিছুই হয়নি। ও এখানেই আছে তাইনা? ও ওকে ডাকনা তাড়াতাড়ি? হিরোওও, হিরোওও কোথায় তুমি? এ এসোনা জলদি। দে দেখ তোমার এঞ্জেল ডাকছে তোমাকে।

নূরের এমন অবস্থা দেখে নীলা আর আয়াত চোখের পানি ছেড়ে দিল। ওরা এখন কি বলবে নূরকে? কি বলেই বা শান্ত করবে ওকে? কোন ভাষাই খুঁজে পাচ্ছে না ওরা। আর নূর আদিত্যকে না দেখে ধীরে ধীরে আরও হাইপার হয়ে উঠছে। কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করলো। নূর নিজেকে ওদের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলতে লাগলো।
–ছাড় আমাকে। আমি হিরোর কাছে যাবো। হিরওও হিরোওওও আসছ কেন তুমি? ঠি ঠিক আছে আমি তোমার কাছে আসছি। এই ছাড় আমাকে আমি হিরোর কাছে যাবো।

ওরা কিছুতেই নূরকে সামলাতে পারছে না। নূর প্রচুর হাইপার হয়ে যাচ্ছে।এতক্ষণে নার্স আর ডক্টরও চলে এসেছে। তারাও অনেক চেষ্টা করছে কিন্তু নূরকে শান্ত করতে পারছে না। একসময় এমন করতে করতে নূর আবারও জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। ডক্টর সবাইকে বাইরে যেতে বললো। সবাই বাইরে এসে পুরো ভেঙে পড়লো। সবকিছু মুহূর্তেই শেষ হয়ে যাচ্ছে ওদের চোখের সামনে। আদিত্যর কিছু হয়ে গেলে যে নূরকেও বাঁচানো অসম্ভব হয়ে যাবে। সেটা ওরা হারে হারে টের পাচ্ছে। নীলার এদিকে কাঁদতে কাঁদতে বেহাল অবস্থা। তখনই ওখানে নূরের মা বাবাও ছুটে এলো। আবির তাদের ফোন করে খবর দিয়েছিল। নূরের মাও জামাতার ওমন খবর আর মেয়ের এমন অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। নূরের বাবারও করুন অবস্থা। সবমিলিয়ে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশ তৈরি হয়েছে এখানে।

বিশ মিনিট পর নূরের আবারও জ্ঞান ফিরলো। আর জ্ঞান ফিরে আসতেই সে আবারও আদিত্যর জন্য পাগলামি শুরু করে দিল। পাগলের মতো শুধু হিরো হিরো ডেকে যাচ্ছে আর প্রচুর হাইপার হয়ে যাচ্ছে। এভাবে করতে করতে সে আবারও জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। ডক্টর নূরের চেকআপ শেষে বাইরে এসে ওদের বললো।
–দেখুন রুগীর অবস্থা খুবই ক্রিটিকাল। ওনার এমনিতেই দু দুবার ব্রেইন অপারেশন হয়েছে। উনি যদি এইভাবেই হাইপার হতে থাকেন তাহলে উনি যেকোনো সময় ব্রেইন স্টোক করে কোমায় চলে যেতে পারেন।তাই ওনাকে শান্ত করা খুবই জরুরি। আপাতত আমি ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে দিয়েছি। তবে তার প্রভাব কেটে গেলে উনি আবারও পাগলামো শুরু করবেন। তাই যা করার জলদি করুন। নাহলে কিন্তু রুগীকে বাঁচানো যাবে না

ডাক্তারের কথায় সবাই আরও ভেঙে পড়লো। চারিদিকে যেন অকুল পাথার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ওরা। এখন শুধু আল্লাহর কাছে দয়া চাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই ওদের।

প্রায় তিন ঘন্টা পর নূরের আবারও জ্ঞান ফিরলো। আর চোখ খুলে আবারও পাগলামি শুরু করে দিল। অস্বাভাবিক ভাবে চিৎকার করছে আর শুধু আদিত্যকে ডাকছে।
–হিরোওওও,হিরোওওও কোথায় তুমি? আসোনা আমার কাছে? দেখ আমি কিন্তু কান্না করবো বলে দিলাম। তাড়াতাড়ি আসোনা? হিরোওওও,,,,,

সবাই মিলে ধরেও নূরকে আটকানো যাচ্ছে না। সে শুধু বাইরে যাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করছে। আয়াত আর নীলা নূরের দুই হাত ধরে রেখে ওকে আটকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু নূর কিছুই শুনছে না। একসময় নূর নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে দুজনকে ধাক্কা দিয়ে কেবিন থেকে দৌড়ে বেড়িয়ে এলো। বাকিরাও নূরের পিছে ছুটলো। নূর কিছুদূর দৌড়ে আসতেই ওর মাথাটা কেমন ঘুরে উঠলো। শরীর টাও প্রচুর দূর্বল। নূর আর হাটার শক্তি পাচ্ছে না। তবুও দেয়ালে হাত রেখে দেয়ালে ভর দিয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে আর বিড়বিড় করে শুধু হিরো হিরো বলে যাচ্ছে।

কয়েক কদম এভাবে যেতেই নূর হঠাৎ নিজের শক্তি হারিয়ে পড়ে যেতে নিলেই কারো শক্ত দুটো হাত এসে ওকে ধরে ফেললো। নূর দুর্বলচিত্তে মাথাটা উপরে তুলে লাল হয়ে যাওয়া ভারী চোখে তাকিয়ে দেখলো, এটা আর কেউ না বরং ওর হিরো। আদিত্যকে চোখের সামনে দেখে দূর্বল নূরের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। চোখ দুটো দিয়ে বাঁধ ভাঙা পানি উপচে পড়লো। কাঁপা কাঁপা হাতটা উঠিয়ে আদিত্যের গালে রেখে কম্পিত গলায় বললো।
–হি হি হিরো,,,

নিজের প্রাণভোমরাকে এই এমন অবস্থায় দেখে আদিত্যর কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে। লন্ডন থেকে ফিরে এসে যে তার এঞ্জেল টাকে এইভাবে দেখতে হবে তা কখনোই ভাবেনি আদিত্য। আদিত্য নূরের দিকে থমকে তাকিয়ে আছে। তখনই হঠাৎ নূর আবারও জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। এবার যেন আদিত্য পাগল হয়ে গেল। আদিত্য দুই হাতে নূরের মুখটা ধরে অস্থির হয়ে বলতে লাগলো।
–এই এঞ্জেল। কথা বলো সোনা। কি হয়েছে তোমার? দেখ আমি এসে গেছি। তোমার হিরো এসে গেছে। প্লিজ চোখ খোল। কথা বলো আমার সাথে।

এতক্ষণে বাকি সবাইও চলে এসেছে। আদিত্যকে দেখে ওরা সবাই অবাক আর খুশী দুটোই হলো। বিহান বলে উঠলো।
–আদি তুই ঠিক আছিস? আল্লাহর লাখ লাখ শুকরিয়া তুই ঠিক আছিস।

বাকি সবাইও একই কথা বলতে লাগলো। আদিত্য এদের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো।
–আমার আবার কি হবে? আর আমার কথা ছাড় এখন। নূর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। তাড়াতাড়ি ডক্টরকে ডাক।

আবির দ্রুত দৌড়ে গেল ডক্টর কে ডাকতে। আর আদিত্য নূরকে কোলে তুলে কেবিনে নিয়ে এলো। ডক্টর এসে নূরকে দেখে বললো।
–চিন্তার কারণ নেই। উনি এবার দূর্বলের কারণে জ্ঞান হারিয়েছেন। উনার শরীরে একটা স্যালাইন পুষ করে যাচ্ছি। স্যালাইন শেষ হলে আপনারা চাইলে ওনাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারেন।

আদিত্য স্মিত হেসে বললো।
–ধন্যবাদ ডক্টর।

ডক্টর বললেন।
–ইটস ওকে। তবে হ্যাঁ এখন থেকে উনার একটু বেশি করে খেয়াল রাখবেন। এই অবস্থায় উনার কোন স্ট্রেস নেওয়া ঠিক হবে না।

আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বললো।
–এই অবস্থায় মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি?

–কেন আপনি জানেন না?

–কি জানবো?

–এটাই যে আপনার ওয়াইফ ইজ প্রেগন্যান্ট। উনি মা হতে চলেছেন। উনার ব্লাড টেস্ট করে এই বিষয়ে জানতে পেরেছি আমরা।

ডক্টরের কথায় আদিত্য যেন নির্বিকার হয়ে গেল। মানুষ বেশি শোকে যেমন পাথর হয়ে যায়। তেমনি আদিত্যও যেন অতিরিক্ত খুশিতে পাথর হয়ে গেল। এই মুহূর্তে কোন অভিব্যক্তি আসছে না ওর। জীবনে হঠাৎ করে এতবড় খুশী চলে আসবে সেটার কল্পনাও করেনি ও। ও বাবা হবে? কেও ওকে বাবা বলে ডাকবে? ভাবতেই আদিত্যের গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে।

একটু পরে আদিত্য নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে নিয়ে কেবিনের বাইরে আসলো। বাইরে এসে সবাইকে খুশীর খবরটা জানালো। সবাই তো খুশীতে আত্মহারা হয়ে উঠলো। এমন খুশীর সংবাদে এতক্ষণের সব কষ্ট যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। সবই পরম করুণাময় আল্লাহপাকের ইচ্ছা।

বিহান এবার বলে উঠলো।
–আচ্ছা এহন কতো কিভাবে হইলো এসব? মানে আমরা ভাবছিলাম ওই ফ্লাইটে তুই,,

আদিত্য মুচকি হেসে বললো।
–সবই আল্লাহর ইচ্ছা। আসলে আমার ওই ফ্লাইটেই আসার কথা ছিল। কিন্তু আমার এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায়। যার কারণে আমি ওই ফ্লাইট টা মিস করি। তারপর নেক্সট ফ্লাইটে আমি রওয়ানা হই। আর প্লেনে থাকায় ফোনও বন্ধ ছিল। তাই কারোর সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় আসতেই সার্ভেন্ট দের কাছ থেকে সব খবর জানতে পারলাম। আর সাথে সাথেই আমি এখানে ছুটে আসলাম।

–যাক আল্লাহর অশেষ রহমত শেষমেশ সব ঠিক হয়ে গেছে।

ঘন্টা খানিক পর নূরের স্যালাইন শেষ হলে নূরকে বাসায় নিয়ে আসে আদিত্য। তবে নূর তখনও ঘুমেই আছে।

রাত দশটার দিকে নূরের ঘুম ভাঙলো। নূর চোখ পিটপিট করে খুলে তাকালো। কপাল কুঁচকে আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো কোথায় আছে ও। নূর দেখলো ও ওর নিজের রুমেই আছে। নূরের আদিত্যর কথা মনে আসলো। হিরো? হিরো কোথায়? হিরো কি আসেনি? তাহলে কি আমি তখন স্বপ্ন দেখলাম? আ আমার হিরো কোথায় তাহলে? নূর আবারও অস্থির হওয়া শুরু করতে লাগলো।হাত পা কাঁপছে, গলা কেমন জড়িয়ে আসছে ওর। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। নূর জোরে আদিত্যকে ডাকতে চাচ্ছে কিন্তু গলা দিয়ে যেন আওয়াজই বের হচ্ছে না ওর। তবুও অনেক কষ্টে আদিত্যকে উচ্চস্বরে ডেকে উঠলো।
–হিরোওওওও

রুমে পানি ফুরিয়ে যাওয়ায় আদিত্য মাত্রই নিচে পানি নিতে এসেছিল। হঠাৎ নূরের ডাকে ঘাবড়ে গেল আদিত্য। দ্রুত দৌড়ে ওপরে উঠে গেল ও। রুমে ঢুকেই বলে উঠলো।
–এইতো এঞ্জেল আমি এখানেই আছি।

আদিত্যকে দেখে নূরের দেহে যেন প্রাণ ফিরে পেল। নূর বেড থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে আদিত্যকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। আদিত্য নূরের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো।
–কাঁদছ কেন সোনা? আমিতো এখানেই আছি।

আদিত্য নূরকে কোলে নিয়ে বেডের ওপর এসে বসলো। নূর আদিত্যের বুকেই মাথা রেখে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো।
–কোথায় চলে গিয়েছিল তুমি? কেন বারবার আমার কাছ থেকে দূরে যাও? জানো আমি কতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম? তুমি খুব পঁচা। একটুও ভালো না। আমাকে শুধু কষ্ট দাও। আমাকে রেখে চলে যাও। আমিও এভাবে তোমাকে রেখে চলে যাবো অনেক দূরে। তখন দেখ কেমন লাগে।

নূরের শেষের কথায় আদিত্যের হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠল। আদিত্য নূরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোয়াল শক্ত করে রাগী কন্ঠে বললো।
–নূরর,, খবরদার আর কখনো এমন কথা বললে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।

–কেন? এখন এমন লাগে কেন? আমি শুধু বলাতেই তোমার এমন লাগছে।তাহলে ভাবো আজ ওই খবর শোনার পর আমার ওপর কি বয়ে যাচ্ছিল?

আদিত্য এবার নরম সুরে বললো।
–আমি সরিতো সোনা। আমি প্রমিজ করছি আমি আমার এঞ্জেল টাকে রেখে আর কোথাও যাবোনা। আর গেলেও তোমাকে সাথে নিয়েই যাবো। প্লিজ এখন কান্না বন্ধ করো লক্ষীসোনা।

একটু পরে নূর একটু শান্ত হয়ে এলো। আদিত্য এবার বলে উঠলো।
–তবে আমিও কিন্ত তোমার ওপর রেগে আছি।তুমি এতবড় কথাটা আমাকে বলোনি কেন?

নূর মাথা তুলে আদিত্যের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কি কথা বলিনি?

আদিত্য বুঝে গেল তারমানে নূর এখনো এই বিষয়ে বুঝতেই পারেনি। আদিত্য মুচকি হেসে মায়াবী কন্ঠে বললো।
–আমি হয়তো প্রথম ব্যাক্তি হবো যে বউয়ের কাছ থেকে শোনার বদলে নিজেই বউকে এই কথা বলছে।

–মানে? কি কথা?

আদিত্য নূরের কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে বলে উঠলো।
–ইউ আর প্রেগন্যান্ট এঞ্জেল। উই গোনা বি প্যারেন্টস। তুমি মা আর আমি বাবা হতে চলেছি।

নূর বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। অবাক চোখে আদিত্যের দিকে তাকিয়ে রইলো। আদিত্য মাথা ঝাকিয়ে বললো।
–হ্যাঁ সোনা আমাদের জীবনে নতুন মেহমান আসছে।আমাদের ভালোবাসার ফসল।আমাদের ছোট্ট সোনামণি আসছে। ডক্টর বলেছে আমাকে।

নূরের চোখে আবারও অশ্রুরা ভীড় করলো।তবে এবার কষ্টের না বরং পরম সুখের অশ্রু। এই অনুভূতি যে ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। এযে অদম্য খুশীর অনুভূতি। নূর অশ্রু চোখে হেঁসে দিল। ডান হাতটা আপনাআপনি ওর পেটের ওপর চলে গেল। এইখানে আছে ওর ছোট্ট সোনাটা। ভাবতেই নূরের খুশিতে হাত পা কাঁপতে লাগলো। আদিত্য নূরের কপালে চুমু খেয়ে আবারও বুকের মাঝে জড়িয়ে নিল।
_____

দুই বছর পর,
আজ আবির আর নীলার বিয়ে। নূর মাত্রই নীলাকে রেডি করে নিজের রুমে আসতেই ওর চোখ কপালে উঠে গেল। পুরো রুমে যেন মাত্রই সিডর বয়ে গেছে। সারা রুমে খেলনার ছড়াছড়ি। চিপস আর চকলেট দিয়ে যেন হোলি খেলা হয়েছে। নূর বিরক্ত হয়ে দাঁত কিড়মিড় বলে উঠলো।
–কোথায় তোমারা দুজন বের হও তাড়াতাড়ি নাহলে কিন্তু খবর আছে।

কোথাও কারো খবর নাই। নূর একটু এগিয়ে যেতেই আলমারির কোনা থেকে ফিসফিস শব্দ পেল। নূর ওখানে যেতেই দেখতে পেল অপরাধী দুজন এখানে লুকিয়ে আছে। নূর কোমড়ে হাত রেখে বললো।
–তোমরা এখানে লুকিয়েছ? কি ভেবেছ আমি তোমাদের খুঁজে পাবোনা? বেড়িয়ে এসো তাড়াতাড়ি বলছি।

দুজন মাথা নিচু করে ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে সামনে বেড়িয়ে এলো। নূর রাগী কন্ঠে বলে উঠলো।
–এসব কি হ্যাঁ? সারা রুমের কি অবস্থা করেছ দুজন? এসব কে পরিস্কার করবে হ্যাঁ?

১ম অপরাধী,এক বছর চার মাসের পিচ্চি বৃষ্টি তার আদো আদো গলায় বলে উঠলো।
–বাবা তব্বে (করবে)।

নূর এবার দ্বিতীয় অপরাধীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। ২য় অপরাধী আর কেও না বরং স্বয়ং আদিত্য। আদিত্য এবার বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে বললো।
–বাহ্ নোংরা করলে তুমি আর পরিস্কারের বেলায় বাবা? পুরো চাচ্চুর মতো পাল্টিবাজ
হয়ে গেছ।

বৃষ্টি কি বুঝলো জানে না। তবে আদিত্যের কথায় ও খিলখিল করে হেঁসে দিল। আর ওর হাসির সাথে আদিত্যও হেসে দিল। তবে নূরের দিকে তাকাতেই ওদের হাসি বন্ধ হয়ে গেল। পিচ্চি বৃষ্টি সুযোগ বুঝে ওখান থেকে দৌড়ে কেটে পড়লো। আদিত্য নূরের দিকে তাকিয়ে বললো।
–আমি দেখে আসি ও কোথায় গেল হ্যাঁ।
কথাটা বলে আদিত্যও ওখান থেকে কেটে পড়ার চিন্তা করলো।কিন্তু তার সেই চিন্তায় এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে নূর রাগী কন্ঠে বলে উঠলো।
–খবরদার এক পাও নরবে না। এখুনি আমার সাথে পুরো রুম পরিস্কার করবে।এক বাচ্চার বাপ, বুড়ো দামড়া হয়ে গেছ।অথচ কাজকর্ম একদম বাচ্চাদের মতো। মেয়ের সাথে নিজেও যেন ছোট বাচ্চা হয়ে গেছে। কে বলবে উনি একজন গ্যাংস্টার?

এসব বলতে বলতে নূর ঘর পরিস্কার করতে লাগলো। আদিত্য হঠাৎ নূরকে টান দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বললো।
–আচ্ছা আমি বুড়ো হয়ে গেছি? তাহলে তো তোমাকে এখন প্রমাণ দিতেই হয় আমি বুড়ো নাকি জোয়ান।

নূর চোখ বড়বড় করে বললো।
–এই এই খবরদার। একদম এসব চিন্তা ভাবনা মাথায়ও আনবেনা এখন। বাইরে এখন বিয়ের কাজকর্ম শুরু হবে। আমাকে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বাইরে যেতে হবে। আর তুমিও তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।

আদিত্য মুচকি হেসে বললো।
–ঠিক আছে এখনকার মতো ছেড়ে দিলাম।তবে রাতে কিন্তু আমার অ্যাবিলিটি দেখিয়েই ছাড়বো।
__

আবির আর নীলার বিয়ের জন্য পুরো বাড়ি জমজমাট হয়ে উঠেছে। আদিত্যের বাসায়ই অনুষ্ঠান হচ্ছে। আদিত্যই বলেছে ওদের বিয়ের সব অ্যারেজমেন্ট এই বাসায় করতে। সব মেহমান চলে এসেছে। বিয়ের প্রধান কার্য্য এখুনি শুরু হবে। আবিরের মা শরিফা বেগমও এসেছে বিয়েতে। শরিফা বেগম এখন অনেক টা বদলে গেছে। ছেলে মেয়ে তাকে ছেড়ে চলে আসায় সে অনেক একা পড়ে গিয়েছিল। তাই নিজের ভুল গুলো বুঝতে পারছে সে। আর যতটা পারে নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে।

আট মাসের ভরপুর পেট নিয়ে সোফায় বসে আছে আয়াত। বিহানের কড়া আদেশ সে যেন একদম নড়াচড়া না করে। তাই আয়াতও বিহানের ভয়ে চুপচাপ বসে আছে। আর একটু পরপর বিহান এসে এটা ওটা দিয়ে যাচ্ছে আয়াতকে খাওয়ার জন্য।

একটু পরে আদিত্য আর বিহান আবিরকে নিয়ে এলো। আবিরের তো এক্সাইটমেন্টে জ্ঞান হারাবার উপক্রম। বেচারা এতদিন পরে তার কচি বিয়াইন কে বউ বানাতে চলেছে। খুশীতে নাগিণ ডান্স দিতে ইচ্ছে করছে। বিহান ওর পাশ থেকে বাঁকা হেসে গেয়ে উঠলো।
♬ ♬ ইক বেচারা ফির গায়া মারা
♬ ♬ ফাস গায়া দেখ ইয়ে বেচারা
♬ ♬ দো দিন কি হে ইয়ে চাঁদনি
♬ ♬ ফির কারি কারি রাত হে
♬ ♬ তু লটকে বন্ধু আজা

♬ ♬ তাক সির খাজি,তাক সির খাজা
♬ ♬ আজ তেরি শাদি তেরা বাজ গায়া বাজা

আবির বিহানের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–হারামি গান আর দেশে খুঁজে পেলিনা? নিজেরা বিয়ে করে বাচ্চা পয়দা করে ফেললি।আমার বেলায় এই গান গেয়ে আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস?

বিহান বলে উঠলো।
–লে হালুয়া, ভালোর কালই নাই। আমি তো তোর ভালোর জন্যই কইতাচিলাম। অহন তুই নিজে হালাল হইবার চাইলে আমি আর কি করতাম।

আদিত্য এদের কথাবার্তায় হেঁসে দিল। আবিরকে নিয়ে এসে বসালে একটু পরে নীলাকেও নিয়ে আসা হলো। তারপর বিয়ের পর্ব শেষ হলো।

রাত বারোটা আদিত্য নূরকে কোলে নিয়ে ছাঁদে বসে আছে। বৃষ্টি আজ ওর নানুর কাছে রয়েছে।আর সেই সুযোগে আদিত্য নূরকে নিয়ে এখানে চলে এসেছে চন্দ্র বিলাস করতে। আদিত্য নূরের কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে বলে উঠলো।
–তোমার মনে হয়না বৃষ্টির আরেক টা ভাই বোন আনা দরকার। ওর খেলার মানুষ দরকার। মরুর বুকে বৃষ্টি তো নামালে। এবার নাহয় সাগর নদী আনা যাক।

নূর বরাবরের মতো লাজুক হেসে আদিত্যের বুকে মুখ গুঁজল।

এভাবেই অতিবাহিত হলো তাদের মধুর সম্পর্ক গুলো।
____________💖💖সমাপ্ত💖💖 ___________

মরুর বুকে বৃষ্টি সিজন-০২ গল্পটি পড়তে লেখাটির উপর ক্লিক করুন।