মরুর বুকে বৃষ্টি ২ পর্ব-১২+১৩

0
333

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি (S-2)
পর্ব-১২
®মেহরুমা নূর

★ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে নিচে আসল আদিত্য। চোখ খুলে নূরকে সামনে পায়নি তাই সবার আগে তাকে দেখতে বের হয়েছে আদিত্য। তবে নিচে আসতেই সবাই কেমন অদ্ভুত নজরে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখতে পেল। আবির,বিহান সহ উপস্থিত সার্ভেন্ট গুলো সবাই কেমন টাস্কি খাওয়া নজরে তাকিয়ে আছে আদিত্যর দিকে। আদিত্য বিষয়টা দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“হোয়াট? এভাবে তাকিয়ে কি দেখছিস?আর এঞ্জেল কোথায়? ”
আবির আর বিহান হা হয়ে একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। পরপরই হঠাৎ ঘর কাঁপিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল তারা। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে রিতীমত।সার্ভেন্টরাও মুখ লুকিয়ে হাসছে। ভয়ে জোরে হাসতে পারছেনা তারা। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে আদিত্য বলল,
“সকাল সকাল নেশা করে এসেছিস নাকি! অকারণে হাসছিস কেন?”
ওরা হেসেই যাচ্ছে। আবির কোনোরকমে হাসি থামিয়ে বলল,
“বাহ! ইয়ার, কি সুন্দর লাগছে তোকে। আমিতো ফিদা হয়ে গেলাম। আমার সব গার্লফ্রেন্ড গুলাও তোর সামনে ফিকে লাগছে।”
আদিত্য রাগ দেখিয়ে বলল,
“হোয়াট ননসেন্স! কি বলছিস এসব! ”
বিহান বলল,
“তুই আগে ওই আয়নায় চাইয়া দেখ। বুঝবার পারবি কি কইতাছি।”
আদিত্য ভ্রু কুঁচকে লিভিং রুমের ওয়ালে টানানো আয়নায় চোখ রাখল। রাখতেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল সে। আদিত্যর চুলে দুই ঝুটি বাঁধা, ঠোঁটে এলোমেলো ভাবে ছড়ানো লিপস্টিক , চোখেও ছড়ানো কাজল। পুরো জোকার লাগছে আদিত্যকে। একারণেই হাসছে সবাই। আবির আবারও বলল,
“ওল্লাহ! কেয়া খুবসুরতি! এত হুসন কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলি তুই! আমারতো চোখে ধাঁধা লেগে যাচ্ছে। এত সুন্দরী হওয়ার কোনো হক নেই তোর। মারডালা একেবারে।”
বলেই আবার হাসতে লাগল আবির।বিহান বলল,
“এক্কেরে হাঁচা কইছছ আবির‍্যা। মাশাল্লাহ, কি চুন্দর লাগতাচে। আমারতো দিল আইতাচে তোর উপরে।”
আবির বিহানের কথার প্রতিত্তোরে বলল,
“ছ্যা ছ্যা! এটাই শোনা বাকি ছিলো! এটা শোনার আগে আমি সুইজারল্যান্ড কেন চলে গেলাম না! আমার আগে থেকেই সন্দেহ ছিলো তোর উপর।এ কারণেই সবসময় আদির আগে পিছে ঘোরোস। এই ছিলো তাহলে তোর মনে! আমার বেচারী ভাবি জানেই না তার সতীনতো তার ঘরেই বসে আছে। থুক্কু সতীন না,সতান। সতীনের মেল ভার্সন সতান।”
“কি কছ হালা! আমারে কি তোর মতো লুইচ্চা পাইছছ! মাইয়া দেখলেই ক্ষ্যাপা ষাড়ের মতো দৌড়াছ। সতান হইলে তুই হইবিগা। ছকল বিয়াত্তা পুরুছের সতান হইলি তুই।”
“আরে ওটাতো সমাজ সেবা। এটা আমার মহত্ত্ব। তোর মতো তুচ্ছ মানব আমার মহত্ত্ব বুঝবি না। এই সেবা এত সহজ না। নিজেকে পুরো বিসর্জন করে দিতে হয়।”
“হ,ছাথে ধরা খাইয়া তার প্রতিদানও পাইয়া যাছ তাইনা!”
“এইজন্যই তো বললাম। সমাজ সেবা সহজ না। ভালো কাজে পদে পদে বাঁধা আসে। এই সেদিনের কথাই ধর। আমার গার্লফ্রেন্ডের বাসায় গেছি সমাজ সেবা করতে।মাত্রই গুরু ইমরান হাসমির ” ভিগে হোঠ তেরি” শুরু করেছি।ইতিমধ্যে বাঁধা হয়ে হাজির তার বাবা। তুই বল,এভাবে আসাটা কি তার ঠিক হয়েছে! আরে ফোন দিয়েওতো আসতে পারতি।ভুল সময়ে এসে ভুলটা সে করল। অথচ রাগ দেখালো এই মহৎ সমাজসেবক কে। আজকাল ডিগনিটি নামের জিনিসই নেই মানুষের মাঝে। মানবতা আজ কোথায়! নাজানি এই সমাজের কি হবে!”
এদের ফালতু সব কথায় বিরক্ত আদিত্য। হঠাৎ সে দেখতে পেল সিঁড়ির পেছন থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে নূর দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে। আদিত্যের বুঝতে বাকি রইলো না, এই কাজ তার দুষ্টু পরিটারই। আদিত্য নূরের উদ্দেশ্যে বলল,
“এঞ্জেল! বেড়িয়ে এসো। আমি জানি এসব কারসাজি তোমারই। বেড়িয়ে এসো।”
নূর বের হলোনা। বরং উল্টো পালানোর উদ্দেশ্যে অন্য দিকে যেতে লাগল।আদিত্য তা দেখে নূরের দিকে যেতে যেতে বলল,
“এই দুষ্টু দাঁড়াও। কোথায় যাচ্ছ!”
আদিত্যকে আসতে দেখে নূর আরও জোরে দৌড়ে ছুটল। আদিত্যও তার পিছে ছুটল তাকে ধরতে। নূর লিভিং রুমের চারিদিকে গোল গোল দৌড়াচ্ছে আর খিলখিল করে হাসছে। আদিত্যও তাকে ধরতে দৌড়াচ্ছে তার পিছে পিছে। আবির আর বিহানও ওদের কান্ড দেখে মজা নিচ্ছে। আবির টিভির রিমোট মাইকের মতো মুখের সামনে ধরে ভাস্করদের মতো করে বলতে লাগল,
“জি হ্যাঁ ভাইসব আর তাদের হট হট বোনসব, আপনাদের সামনে হতে চলেছে এক দুর্ধর্ষকর,শ্বাসরুদ্ধকর, পৃথিবী কাঁপান, বাঙ্গি ফাটানো, ডাল ঘোটানো,ফালুদা ফেলানো, লুঙ্গি উড়ানো রেস।রেসটি স্পনসর করেছেন,মদনলাল চুলকানি পাউডার, বিএ ফেল প্লাস্টিক বদনা, মফিজ জাঙ্গিয়া আর গন্ডার মার্কা ঢেউটিন। হ্যাঁ তো আপনারা দেখতে পাচ্ছেন নূর ভাবি এমুহূর্তে রেসে এগিয়ে আছে। আদি প্রাণপণে চেষ্টা করছে তাকে ওভারটেক করার। তবে মনে হচ্ছে না আদি পারবে জিততে। কারণ বউয়ের কাছ থেকে জেতা মুশকিলই নয়, অসম্ভব। ভাবি তুমি এগিয়ে যাও, আমরা তোমার সাথে।”
আবিরের মহান কমেন্টেরি শুনে বিহান হাসছে সমানে। এদিকে আদিত্য এক পর্যায়ে নূরকে পেছন থেকে ধরে ফেলল। তারপর পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে বলল,
“এখন কই পালাবে দুষ্টুপাখি! অনেক দুষ্টু হয়ে গেছ আজকাল।”
নূর হাসতে হাসতে বলল,
“আচ্ছা ভুল হয়ে গেছে, আর করবোনা। ছেড়ে দাও আমাকে।”
“না ছাড়ছি না এত সহজে। চলো আমিও মজা দেখাচ্ছি তোমাকে।”
বলতে বলতে আদিত্য নূরকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমের দিকে গেল। আর নূর ছাড়া পাওয়ার ছটফট করছে। ওদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আবির নেকা সুরে বলল,
“কেউ একটু আমারে এমনে কোলে নিলো না। এই মাছুম টাকে যদি কেউ কোলে নিতো তাহলে সারাজীবন ল্যাংড়া হয়ে থাকতাম।”
বিহান পাশ থেকে বলে উঠল,
“আহানারে কইবার পারছ। হে নিশ্চয় তোরে মানা করবোনা।”
আবির দাঁতে দাঁত চেপে বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সমস্যা কি তোর! কথায় কথায় আহানাকে টেনে আনিস কেন তুই? ”
“কারণ হ্যারে বহুত ভাল্লাগচে আমার।”
“এভাবেতো আমারও ক্যাটরিনা কাইফকে ভালো লাগে। তাই বলে সে আমার হয়ে যাবে! দেখ আমি জানি তুই কিসের জন্য এসব বলিস। তবে শুধু শুধু ভাঙা কলসিতে পানি ঢালছিস। এসবে আমি ইফেক্ট হইনা। আহানা আমার জন্য কি তা, না আমি বলতে পারবো আর না তোরা বুঝবি। সো কাট দ্য ক্রাপ ব্রো। আর নিজের চরকায় কলপ দে। যাতে কোনো মাইয়ার কৃপাদৃষ্টি হয় তোর উপরে।”
স্মিথ হাসলো বিহান। দৃষ্টিতো তার পড়েছে। ওই সুনয়নার উপর। যে দৃষ্টি কিছুতেই ভুলতে পারছেনা সে। এখন সত্যি করেই হিয়ার কৃপাদৃষ্টির খুব করে প্রয়োজন তার।

কিছুক্ষণ পর আদিত্য নূরকে নিয়ে আবারও নিচে এলো নাস্তা করতে। এবারও নূর আদিত্যর কোলে। নূরই বায়না ধরেছে সে কোলে উঠবে। আদিত্যর কেয়ারে সে দিনদিন আহ্লাদী হয়ে যাচ্ছে। আদিত্যকে পেলেই তার বায়নার ঝুলি খুলে বসে। আর আদিত্যও তা সানন্দে পুরন করে। আদিত্য নূরকে কোলে নিয়ে নামছে। আর নূর তার সাথে দুষ্টুমিতে ব্যাস্ত। কখনো কানে ফু দিচ্ছে, কখনো চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে তো কখনো গাল টেনে দিচ্ছে। আদিত্য শুধু হাসছে তার এঞ্জেলের কান্ডতে। নিচে আসতেই আবির বলে উঠল,
“ছ্যা ছ্যা ছ্যা! লজ্জা শরমতো একেবারে কাওরাণবাজারের সবজি মার্কেটে বেঁচে এসেছিস। মাছুম বাচ্চা কাচ্চাদের সামনে এসব কেউ করে!”
বিহান ভ্রু কুঁচকে বলল,
“মাছুম বাচ্চা! ছেইটা আবার কেঠা মাইরি! ”
“কেন তুই! এখনোতো তোর কথাই পরিষ্কার হয়নি। স কে ছ বলিস। তোর মতো ধামড়া বাচ্চা দুনিয়াতে আর একটাও নেই। খালি একটা ফিডারের কমতি।”
বিহান আবিরের মাথা ধরে টেবিলের উপর চেপে ধরে বলল,
“আমি বাচ্চা না! তাইলে তো বাচ্চাতো করনই লাগে।”
এদের কান্ড দেখে মজা পেয়ে হাতে তালি দিয়ে হাসছে নূর। এসবের মাঝেই হঠাৎ নূর বিস্ময়ের সুরে বলে উঠল,
“ঝুমু!”
নূরের কথায় সবাই তার দিকে তাকায়। নূর দরজার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে তারাও দরজার দিকে তাকায়। দরজার সামনে সেদিনের শপিং মলের সেই মেয়েটাকে দেখতে পায়।যাকে নূর বোন পরিচয় দিয়েছিল। তাকে দেখেই নূর প্রফুল্ল হয়ে আদিত্যর কোল থেকে নেমে দৌড়ে গেল বোনের কাছে। উৎসাহিত কন্ঠে বলল,
“ঝুমু! তুই এসেছিস!”
ঝুমুর মুচকি হেঁসে বলল,
“হ্যাঁ আমি এসেছি পাগ…. আই মিন আপু। তোমাকে দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। কেমন আছ তুমি? ”
“অনেক ভালো।”
“আয় আয় ভেতরে আয়।”
নূর ঝুমুরের হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এলো সবার কাছে। তারপর বলল,
“দেখ আমার বোন এসেছে। ও ঝুমুর।”
সবাই সৌজন্যমূলক মুচকি হাসল। ঝুমুর আদিত্যর উদ্দেশ্যে বলল,
“কেমন আছেন দুলাভাই? ”
আদিত্যও সৌজন্যমূলক হেঁসে বলল,
“ভালো, প্লিজ কল মি ভাইয়া। দুলাভাই কেমন অড লাগে।”
“জি আচ্ছা।”
নূর বলল আয় ঝুমুর খেতে বোস। ঝুমুর মাথা দুলিয়ে খেতে বসলো ওদের সাথে। খেতে খেতে বাসার চারিদিকে চোখ বোলাল ঝুমুর। চোখে যেন ধাঁধা লেগে যাচ্ছে তার। এতবড় বাড়ি! এত সুন্দর সবকিছু! আর এসবকিছু ছেড়ে কিনা ও ওই ফোর টুয়েন্টি রকির সাথে ভেগে গিয়েছিল।যে বদমাইশ ওকে মাঝপথেই ছেড়ে দিয়ে ভেগে।গেছে। তাইতো শেষমেশ শপিং মলে সেলসগার্ল এর চাকরি করতে হচ্ছে। বাড়িতে ফিরে যাবে কোন সাহসে! সেদিন না ভাগলে আজ এসবকিছু ওর হতো। যা কিনা এই পাগলছাগলটা পেয়ে গেছে। ভাবতেই আপসোস আর নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে ঝুমিরের। ভাবনার মাঝেই পাশে তাকাতেই দেখল আদিত্য নূরকে নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছে। নূর না খাওয়ার জন্য কত তালবাহানা করছে। কিন্তু আদিত্য ধৈর্য সহকারে নানান কথা বলে বাচ্চাদের মতো মন ভুলিয়ে খাওয়াচ্ছে তাকে। এসব দেখে ঝুমুর বিস্ময়ে হতবাক। এই পাগলিকে এত যত্ন করার রুচি আসে কেমনে উনার! একেতো ওরা কখনো খাবার সময নিজেদের সামনেই বসায় না। খাবার মেখেঝেকে বিচ্ছিরি অবস্থা করে ফেলে। তা দেখে ঘৃণা লাগে ওদের। তাইতো ওকে সবসময় আলাদা জায়গায় বসতে দেয়। আর এই লোক এত আদর করে খাওয়াচ্ছে! কি দেখে এত আহ্লাদ করছে এই পাগলীকে!

নূরকে খাওয়ানো শেষে আদিত্য নিজে খাওয়া শুরু করল। আর নূর উঠে গিয়ে ওর বিড়াল ছানার সাথে খেলছে। বিড়ালকে ধরতে তার পিছে পিছে ছুটছে। খেলতে খেলতে হঠাৎ সোফার পায়ার সাথে পায়ে গুতা লাগল নূরের। পায়ে ব্যাথা পেয়ে জোরে আর্তনাদ করে উঠল নূর। খাবারের হাত সহসাই থেমে গেল আদিত্যর।আৎকে উঠে ঝট করে পেছনে ফিরে তাকালো সে। নূর পা ধরে বসে কাঁদছে।আদিত্যর গলায় খাবার আঁটকে গেল। তৎক্ষনাৎই খাবার ছেড়ে দ্রুত উঠে ছুটে এলো আদিত্য নূরের কাছে। নূরের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে তাকে ধরে উত্তেজিত, আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
“কি হয়েছে এঞ্জেল? কাঁদছ কেন?”
নূর কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“পায়ে ব্যাথা লেগেছে। অনেক ব্যাথা লাগছে। ”
“ব্যাথা লেগেছে! কোথায় দেখি!”
আদিত্য নূরের পায়ে হাত দিতেই নূর ব্যাথা পেয়ে আরও জোরে কেঁদে উঠল। আদিত্য যেন আরও উত্তেজিত, অস্থির হয়ে গেল।দুই হাতে নূরের মুখটা ধরে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“ইশশ কত ব্যাথা লেগেছে এঞ্জেলটার! কত কাঁদছে! আমি থাকতেও কিভাবে আমার এঞ্জেল টা ব্যাথা পেল! আমি খেয়াল রাখতে পারিনি। কাঁদে না সোনা। আমি আছি না। ঠিক হয়ে যাবে।”
নূর আরও কেঁদে কেঁদে করুন সুরে বলল,
“ঠিক হচ্ছে নাতে হিরো। ব্যাথা… ”
আদিত্য নূরের মাথা কপালে হাত বুলিয়ে বলল,
“কেঁদো না এঞ্জেল। এইতো এখুনি ঠিক হয়ে যাবে। বিহান… দাঁড়িয়ে কি দেখছিস! ডক্টরকে আসতে বল জলদি। দেখছিস না এঞ্জেল কষ্ট পাচ্ছে! ”
বিহান বলল,
“আইচ্ছা আমি ফোন করতাচি।তুই চিন্তা করিছ না।”
আদিত্যর অবস্থা দেখে ঝুমুর অবাক,হতভম্ব। এত আদিখ্যেতা করার কি আছে সে বুঝলনা। তাও এই পাগলীর জন্য! লোকটাও কি ওর মতো পাগল নাকি! সে হঠাৎ মাঝখান থেকে বলে উঠল,
“আরে এই সামান্য কারণে ডাক্তারের কি দরকার! গ্রামেতো এরচেয়ে কত হাজার গুণ চোট পেত। আবার একাই ঠিক হয়ে যেত। ওর এসবে কিছুই হয়না। গন্ডারের চামড়া ওর।”
ঝুমুরের এমন উক্তিতে আদিত্যর প্রতিটা লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল ক্রোধে। চোয়াল শক্ত হলো। অগ্নিলাল চোখে তাকালো ঝুমুরের দিকে। চোয়াল চিবিয়ে বলল,
“মিস ঝুমুর, ফাস্ট এন্ড লাস্ট টাইম বলছি। ভালো করে মাথায় গেঁথে নিন। নূর আগে কিভাবে ছিলো সেটা আমার দেখার বিষয় না। তবে নূর আমার কাছে আমার নিজের জানের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ফারদার এধরনের কথা বলবেন না। নাহলে ভুলে যাবো আপনি নূরের বোন।”
বলেই আদিত্য নূরকে পাঁজা কোলে তুলে নিলো। তারপর বিহানের উদ্দেশ্যে বলল,
“ডক্টর আসলে রুমে পাঠিয়ে দিস।”
বলেই নূরকে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল আদিত্য। আদিত্যর এমন রিয়্যাকশন দেখে ঝুমুর বিস্মিত। ওদের পাগলীকে লোকটা দেখি সত্যি করে মাথায় তুলে রেখেছে। এসব দেখে যেন তার আপসোস আরও বাড়ছে। বিহান জমিলাকে ডাক দিয়ে ঝুমুরকে গেস্ট রুম দেখিয়ে দিতে বলল। জমিলা ঝুমুরকে নিয়ে গেল সাথে। ঝুমুর যেতেই বিহান আবিরের উদ্দেশ্যে বলল,
“কিরে তোর ছরীরতো ঠিক আছে? মাইয়া মানুষ দেইখাও চুপ কইরা আছচ! পার্টসপাতি ছব ঠিকঠাক আছেতো! নাকি বেছি বেছি অপব্যবহার কইরা ক্ষয় গেছে গা!”
আবির তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আবির এভারগ্রীন। কখনো ক্ষয় যায় না। আসলে সি ইজ নট মাই টাইপ অফ গার্ল। কেমন যেন নেগেটিভ ভাইব আসছে মেয়েটার থেকে।”
“হুম আমারও।”

চলবে…..

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি (S-2)
পর্ব-১৩
®মেহরুমা নূর

★ঘুমের লেশ কেটে চোখ মেলে তাকাতেই রোজকার মতোই প্রাণপাখিটাকে বক্ষ মাঝে পেল আদিত্য। কেমন বিড়ালছানার মতো গুটিশুটি মেরে তার বুকের উঞ্চতায় মিশে আছে। রোজ সকালে এই মুহুর্তটা আদিত্যকে সীমাহীন এক সুখময় অনাবিল প্রশান্তি দেয়। যেন এরচেয়ে সুখের প্রশান্তি আর কিছুতেই নেই। নূর মানেই তার জীবন সুখের রাজ্য। হঠাৎ আদিত্যর ফোন বেজে উঠল। ফোনের রিংটোনে নূরের ঘুমন্ত মুখখানা একটু কুঁচকে এলো কেমন। আদিত্য তড়িঘড়ি করে তার ফোনটা খুঁজে কল কেটে দিলো। বড় একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল যেন সে। তার এঞ্জেলটার ঘুম ভেঙে যেত নাহলে। ফোন রেখে আবার নূরের দিকে মনোযোগ দিলো আদিত্য। বাচ্চাদের মতো নিচের ঠোঁট উল্টে ঘুমিয়ে আছে সে। মুগ্ধ মনে হাসলো আদিত্য। নূরের মুখের উপর পড়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো আঙুলের সাহায্যে কানের পিছনে গুঁজে দিলো। মুখ নামিয়ে পরম ভালোবাসায় অধর ছোঁয়াল নূরের কপালে। নূরের হাতের মুঠোয় আদিত্যর টিশার্ট খামচে ধরা। এটাও নূরের অভ্যাস। আদিত্যর টিশার্ট দুই হাতে খামচে ধরে ঘুমায় নূর।যেন ঘুমের মাঝে বোধহয় আদিত্য হারিয়ে যাবে। তা দেখে সুখময় হাসি ফুটল আবারও আদিত্যর ঠোঁটে। নূরের হাতটা টিশার্ট থেকে ছাড়িয়ে মুখের উপর এনে হাতের তালুতেও চুমু খেল আদিত্য। তারপর গায়ে চাদর ভালো করে টেনে দিয়ে উঠে গেল সে বিছানা ছেড়ে।

ঝুমুর সকাল থেকে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখছে। যত দেখছে ততই যেন আপসোসের পাল্লা ভারী হচ্ছে তার। এই রাজ প্রাসাদের রাজত্ব রেখে কিনা সে ওই দুই টাকার ছেলের পেছনে চলে গিয়েছিল! নিজের উপর চরম রাগ হচ্ছে তার। কিন্তু আদিত্য যে এত বড় ধনী তাতো জানতোই না সে। শুধু জানতো দাদার কোন বন্ধুর নাতীর সাথে নাকি বিয়ে। তখন জানলে কখনোই অমন বোকামি করত নাকি সে! যেটা ওর হওয়ার কথা ছিলো তা আজ ওই পাগলীটা ভোগ করছে। এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ আদিত্যর জিমিং রুমের সামনে এসে পড়ল ঝুমুর। দরজা কিছুটা খোলাই ছিলো। সেখান থেকেই ঝুমুরের নজর পড়ল ভেতরে ব্যায়ামরত আদিত্যর উপর। হাতা কাটা ঢিলাঢালা একটা টিশার্ট তার পড়নে। একটা ব্যায়াম মেশিনের নিচে দাঁড়িয়ে দুই হাতের উপর ভারী ওজন উঠানামা করাচ্ছে। হাতের বাহুর বলিষ্ঠ পেশি ফুলে উঠছে তাতে। ঘামে ভিজে চিকচিক করছে শরীর। সাংঘাতিক আকর্ষণীয় লাগছে ঝুমুরের কাছে আদিত্যকে। কেমন লোলুভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে আদিত্যর পানে। তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে আদিত্যর পেছনে গিয়ে দাঁড়াল সে।ঘোরের মাঝেই হাত বাড়িয়ে আদিত্যর পিঠের ঘর্মাক্ত উন্মুক্ত স্থানে আলতো করে আঙুল ছোঁয়াল। ব্যায়াম থামিয়ে তৎক্ষনাৎ পেছনে ফিরে তাকালো আদিত্য। ঝুমুরকে সামনে দেখে কপাল কুঁচকে এলো তার। কিছুটা রাগও হলো তার। ঝুমুরের কাছ থেকে দুরত্ব করে সরে দাড়িয়ে বলল,
“আপনি! এখানে কি করছেন? কোনো রুমে আসতে হলে যে নক করে আসতে হয় এতটুকু নলেজ নিশ্চয় জানা আছে আপনার!”
ঝুমুর আমতাআমতা স্বরে বলল,
“সরি,আসলে আমি পাগ….,আই মিন আপুকে খুজছিলাম। এত বড় বাড়িতে খুঁজে পাচ্ছি না ওর রুম কোনটা?”
আদিত্য কিছুটা কাঠকাঠ গলায় বলল,
“নূর ঘুমিয়ে আছে এখন৷ ঘুম থেকে উঠলে বের হবে।তখন দেখা করে নিয়েন।”
“আপনি,আপনি করে কেন বলছেন? আমিতো বয়স আর সম্পর্ক দুটোতেই ছোট। নাম ধরে বলুন।”
“ছোট বড় ফ্যাক্ট না। আমি আমার অতি ঘনিষ্ঠ কাউকে ছাড়া সবাইকেই আপনি সম্বোধন করি। নাউ, এক্সকিউজ মি!”
বলেই আদিত্য ঝুমুরকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। ঝুমুর সে পানে তাকিয়ে থেকে বাঁকা হাসলো। মনে মনে বলল, “শুধু অর্থ না পার্সোনালিটির দিক দিয়েও লোকটা পুরাই কিলার। আমারতো মনে লেগে গেছে। আর ঝুমুরের যাকে মনে লাগে তাকেতো পেতেই হয়। খুব জলদিই এই ঝুমুরই আপনার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ব্যাক্তি হবে,আদিত্য। ওই পাগলী আপনার কদর বুঝবে না। না আপনাকে সেই সুখ দিতে পারবে৷ আপনারতো আমার দরকার। আপনাকে আমি নিজের করেই ছাড়বো। ওই পাগলিকে আপনার মন থেকে সরানো জাস্ট তুড়ির ব্যাপার আমার জন্য। দেখে যান আদিত্য, কিভাবে আমার জায়গা আমি আবার ফিরিয়ে নেই।”
__

গার্মেন্টস থেকে বেরিয়ে বাসার রাস্তায় হাটছে হিয়া। তার মনে হলো কেউ তাকে ফলো করছে। এটা আজই নতুন না। আজ কিছুদিন হলোই ওর এমন মনে হয়। সে যেন জানে এসব কে করছে। হিয়া হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। ঝট করে পেছনে ফিরে তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পেল না। সে আশেপাশে চোখ বোলালো। সামনে একটা গাছ দেখা যাচ্ছে। হিয়া এগিয়ে গেল সেদিকে। গাছের ওপাশে গিয়ে দেখল। এবং যা ভেবেছিল সেটাই পেল। হিয়া দুই হাত ভাজ করে গম্ভীর মুখ করে বলল,
“কি চান আপনি!”
চুরি করে ধরা পড়ার মতো অবস্থায় পড়ে গেল বেচারা বিহান। চোরের মতো এদিক ওদিক তাকিয়ে অপ্রস্তুত ফিচেল গলায় বলল,
“মা…মানে! কি কইতাচেন আপনি!”
“দেখুন, ঢং করবেন না৷ আজ কয়েকদিন হলোই খেয়াল করছি আমি। আপনি রোজ এই টাইমে রাস্তায় এসে বসে থাকেন।”
“আরে না না,আপনি ভুল বুঝতাচেন। আমিতো এইহানে একখান কাজে আইছিলাম।”
“তাই! তা কি এমন কাজ আপনার শুনি! যারজন্য রোজ আপনাকে এই রাস্তায় এসে বসে থাকতে হয়!”
বিহান বেচারা থতমত খেয়ে গেল। কি বলবে বুঝতে পারছেনা। আমতাআমতা স্বরে বলার চেষ্টা করল,
“ওই,ইয়ে মানে… ”
হিয়া এই পর্যায়ে হাত উঠিয়ে রাস্তার পাশে থাকা পার্কের বেঞ্চ দেখিয়ে বকল,
“চলুন ওখানে গিয়ে বসি।”
বিহান খানিকটা অবাক হলো। তবে আপাতত চুপচাপ সুবোধ বালকের মতো হিয়ার সাথে এগিয়ে গিয়ে বেঞ্চে বসলো। দুজনের মাঝে খানিকটা দুরত্ব বজায় রেখে বসলো তারা। হিয়া বলে উঠল,
“দেখুন, ভাববেন না আমি কিছু বুঝি না। রোজ রোজ এই সময়ে এখানে এসে কেন বসে থাকেন এতটুকু বুঝতে না পারার মতো বোকা আমি নই।আমি জানি আপনি রোজ আমার জন্যই আসেন। কিন্তু আপনি ভুল মানুষের পিছনে সময় নষ্ট করেছেন।”
এই পর্যায়ে বিহান স্মিথ হেঁসে বলল,
“করলে করতাছি।এমতেও আমার ছময় খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ না। এই তুচ্ছ ছময় নাহয় কারোর লাইগা নষ্টই করলমা। তাতে কি এমন ক্ষতি আছে! ছময় নষ্ট কইরা যদি আপনাকে রোজ দেখপার পারি তাইলে আমি আমার ছব সময় নষ্ট করতে রাজি।”
হিয়া তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“এসব মন ভোলানো কথা বলা অনেক সহজ। জানেনই বা কি আমার সম্পর্কে! এখনোতো আমার চেহারাই দেখলেন না। আমি দেখতে এত কুৎসিত যে একবার দেখলে আর দ্বিতীয়বার এমুখো হবেন না। এসব আবেগ ছুটে পালাবে তখন।”
“একদম না। আমিতো আপনার চেহারার মোহে পড়িইনাই। তাইলে আপনি দেখতে কেমন হইলেন তাতে কি যায় আছে!”
“আচ্ছা! কিচ্ছু যায় আসে না! তাহলে আমার চেহারা দেখা ছাড়া আমাকে বিয়ে করতে পারবেন!”
বিহান বিস্মিত চোখে তাকালো হিয়ার দিকে। হিয়া তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“কি হলো! হাওয়া বেড়িয়ে গেল! সব আবেগ শেষ! শুনুন, এসব আবেগী কথা শুনতে অনেক মধুর শোনায়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বাস্তবে মানুষ চেহারা, স্টাটাস এসবই দেখে সম্পর্ক করে। আপনি আমার উপকার করেছিলেন তাই বলছি আপনি বরং অন্য কারো পেছনে সময় নষ্ট করুন। আর আমার পিছু ছেড়ে দিন। এসব আমার জন্য না। আসি, ভালো থাকবেন।”
বলেই হিয়া উঠে যাওয়ার জন্য দাঁড়াল। হঠাৎ বিহান বলে উঠল,
“অহন কি কাজী অফিস খোলা আছে?”
হিয়া চকিত নজরে ফিরে তাকালো বিহানের দিকে। বিহান উঠে দাঁড়িয়ে হিয়ার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল। হাত ঘড়িটায় চোখ বুলিয়ে বলল,
“অহনতো কোনো কাজী অফিস খোলা পাওয়া যাইবো না। নাহলে অহনি ছুভ কাজ ছাইড়া ফালইতাম। মাগার ব্যাপার না, কাল ছকালেতো খুলবো। আপনি ছকাল ৮-৩০ এ *****কাজী অফিসে চইল্লা আইছেন। আমি অপেক্ষায় থাকুম আপনের। অহন যাই। কাইল আমার ছাদী। কত প্রস্তুতি আছে না!”
বলেই বিহান উল্টো পথে হাঁটা ধরল। হিয়া তার যাওয়ার পানে হতভম্ব নয়নে তাকিয়ে রইলো। যেন অবিশ্বাস্য কিছু ঘটলো তার সাথে।
__

আদিত্যর অফিস থেকে ফেরার সময় হয়েছে। নূর তার অপেক্ষায় বসে আছে দরজায়। গালে হাত ঠেকিয়ে একধ্যানে গেটের দিকে তাকিয়ে আছে সে। কিছুক্ষণ পরই আদিত্যের গাড়ি গেটের ভেতর ঢুকল। তা দেখেই নূরের মুখে হাসির ঝিলিক ফুটল।হাসিমুখে প্রফুল্লচিত্তে সে উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে ছুটল আদিত্যের কাছে। আদিত্য গাড়ি থেকে নামতে নামতেই ঝাপিয়ে পড়ল তার গলা ধরে। আদিত্যও পরমানন্দে তার এঞ্জেলটাকে জড়িয়ে নিলো তার সাথে। সারাদিনের ক্লান্তি মুহুর্তেই প্রশান্তিতে পরিবর্তন হয়ে যায় তার। বাসায় আসার সাথে সাথে নূরের এভাবে ওর কাছে ছুটে আসাটা ওকে অনাবিল সুখময় আনন্দ দেয়। আদিত্য হাসিমুখে নূরকে পেঁচিয়ে উঁচু করে ধরে গোলগোল ঘুরতে লাগল।আর নূর খিলখিল করে হাসছে তাতে। বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে উপর থেকে এসব কিছুই চোখে পড়ল ঝুমুরের। নূরের প্রতি আদিত্যর এত ঢং দেখে সত্যিই বিরক্ত লাগে তার। সে ভেবে পায়না এই পাগলীর মাঝে কি এমন দেখেছে এই লোকটা। তবে ব্যাপার না। এই পাগলীকে সরিয়ে কিভাবে নিজের জায়গা করতে হবে তা জানা আছে তার। মনে মনে কিছু ভেবে বাঁকা হাসল ঝুমুর।

সন্ধ্যার দিকে আবির এলো বাসায়। লিভিং রুমের সোফায় বসে আড্ডা দিচ্ছিল সবাই। আবিরের কমেডি পূর্ণ কথায় আড্ডা মাতোয়ারা তখন। নূর হেঁসে কুটিকুটি হচ্ছে আবিরের কথায়। ঠিক তখনই বিহান আচমকা বলে উঠল,
“আমার ছাদী কাল।”
মুহুর্তেই পরিবেশ স্থির হয়ে গেল। আবির,আদিত্য বিস্মিত চোখে তাকালো বিহানের দিকে। আদিত্য বলল,
“হোয়াট! হোয়াট ডিড ইউ সে!”
বিহান স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,
“কাল ছাদী করুম আমি। তোরা কি কছ!’
আবির, আদিত্য একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারপর আবির বাড়ি কাঁপান অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। পেটে হাত চেপে গড়াগড়ি খাচ্ছে সে। কোনরকমে হাসি নিয়ন্ত্রিত করে বলল,
“তোর সেন্স হিউমার এত ভালো হলো কবে! কি একটা জোক শুনাইলি। ভাবছি আমিও মঙ্গলগ্রহ কিনে ফেলি।”
বিহানকে ভাবলেশহীন দেখে আদিত্য সিরিয়াস হয়ে বলল,
“তুই কি সত্যি বলছিস?”
“হ আদি,এইডা আমার জীবনের ছবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছত্যি। তোরা ছাড়া আমার আর কেঠা আছে! তাই তোগো না বইলা কেমতে করি!”
“আমি তোর জন্য অনেক খুশি। আর অবশ্যই আমরা তোর সাথে আছি।”
আবির বলে উঠল,
“বাহ মামা,তুইতো তলে তলে টেম্পু না পুরা জাহাজ চালাই দিলি। কবে ঘটায় ফেললি ঘটনা!”
হাসলো বিহান। তারপর ওদের খুলে বলল সবটা। আদিত্য, আবির খুশি হলো বন্ধুর জন্য।

রাতে ঝুমুর তার কুবুদ্ধি কারসাজি আরম্ভ করে দিলো। নূরকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে নেকামি করে বলল,
“আপু আমারনা তোমার সাথে শুতে ইচ্ছে করছে আজ রাত। আসলে অনেক দিন তোমাকে দেখিনিতো। তোমার কথা অনেক মনে পড়ছিলো। তাই তোমার সাথে একসাথে একটু ঘুমুতে চাই।আর এই বাড়িতে আমার একা শুতে ভয়ও করে। তুমি থাকলে ভালো লাগবে। ঘুমুবেনা আমার সাথে একটু!”
বোনের এমন অনুরোধে অবুঝ নূর গলে গেল। যে বোন সবসময় শুধু বকাঝকাই করেছে সেই বোনের কাছ থেকে এমন স্নেহপূর্ণ কথা শুনে নূরের খুশি লাগল অনেক। তাইতো মুহুর্ত না ভেবে সে বলল,
“হ্যাঁ হ্যাঁ শুবোতো আমি তোর সাথে। আমরা আজ একসাথেই শুবো। তুই ভয় পাস না। আমি আছি না। ”
“আচ্ছা আপু,তুমি কতো ভালো।”
বলেই ঝুমুর নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে সয়তানি হাসলো। আদিত্যকে পেতে হলে আগে এই পাগলীকে ধীরে ধীরে দূরে সরাতে হবে। আর এটাই তার প্রথম ধাপ।

আদিত্য ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখল নূর তার পুতুল নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তা দেখে আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বলল,
“এঞ্জেল! এই সময় কোথায় যাচ্ছ তুমি? ঘুমুবে না?”
নূর আদিত্যর দিকে ঘুরে বলল,
“ঘুমুতেইতো যাচ্ছি।”
“মানে?”
“মানে আমি আজ ঝুমুর সাথে ঘুমোবো। ও আমার সাথে শুতে চাচ্ছে।”
আদিত্য বেচারার মুখে কালো ছায়া নেমে এলো। নূরকে ছাড়া থাকতে হবে ভাবতেই অসহায় লাগছে তার। এঞ্জেলটাকে বুকে নিয়ে ঘুমানোর অভ্যাস হয়ে গেছে যে তার। নূরকে ছাড়া ঘুমাবে কিভাবে সে! আদিত্য এগিয়ে নূরের মুখটা ধরে মলিন মুখে বলল,
“তুমিও তাই চাও? তুমি খুশি হবে তোমার বোনের সাথে শুলে?”
নূর ঘাড় কাত করে বলল,
“হ্যাঁ, হবোতো। গ্রামে আমি ওদের কাছে শুতে চাইতাম কিন্তু ওরা নিতো না। আজ নিতে চাইছে। আমার ভালো লাগছে।আমি যাই?”
আদিত্য মলিন হেঁসে নূরের কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“ঠিক আছে,যাও। আমার এঞ্জেলের খুশির চেয়ে জরুরী কিছুই না৷ তোমার খুশিই সর্বোপরি।”
নূর চলে গেল। আদিত্য দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বসে রইল বিছানায়। আজতো আর তার ঘুমানো হবে না। তার ঘুমের প্রশান্তিটাই যে আজ নেই। তবে নূরের খুশির জন্য আদিত্য এটুকু অনায়াসে সইতে পারে। সেতো শুধু নূরের খুশিটাই চায়।

নূর আর ঝুমুর শুয়ে আছে। যদিও ঝুমুর মনে মনে ভীষণ অস্বস্তি ফিল করছে নূরের কাছে শুয়ে। কিন্তু কি করার! কিছু পেতে হলে কিছু সহ্যও করতে হয়। তার প্ল্যান সঠিক ভাবে চলছে এটা ভেবেই তার মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে। একসময় একেবারে দূরে সরিয়ে ফেলবে সে এই পাগলিকে। তারপর শুধু সে রাজ করবে আদিত্য আর তার রাজত্বের উপর। এটা ভেবেই খুশি হচ্ছে সে। নূরও প্রথম প্রথম বোনের কাছে শুয়ে ভালোই লাগছে। সে অনেক কথার ফুলঝুরিও সাজাচ্ছে। তার এখানকার জীবনের কথা শোনাচ্ছে ঝুমুরকে। কিন্তু অবুঝ নূর জানেই তার স্বার্থপর বোনটা কানে ইয়ারফোন গুঁজে আছে। কারণ সে নূরের অযথা প্যাঁচাল শুনতে চায়না।তাই ইয়ার ফোন কানে গুঁজে আছে। একসময় ঘুমিয়ে গেল ঝুমুর। কিন্তু নূরের কেন যেন ঘুম ধরছে না৷প্রথম প্রথম বোনের কাছে থাকার খুশি থাকলেও এখন কেমন খালি খালি লাগছে তার।রাত বাড়ার সাথে ধীরে ধীরে মনটা কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। এপাশ ওপাশ বারবার কাতচিত হচ্ছে তবুও কেমন স্বস্তি পাচ্ছে না। কিছু একটার অনুপস্থিতি বিচলিত করছে তাকে। কিন্তু অবুঝ নূর তা বুঝতে সক্ষম হচ্ছে না। পাশে ঝুমুর ঘুমিয়ে গেছে কিন্তু নূরের কিছুই ভালো লাগছেনা৷রাত যত বাড়ছে ততই খারাপ লাগা বেশি হচ্ছে যেন। কেমন কান্না পাচ্ছে। হঠাৎ যেন হিরোর কথা মনে পড়ছে তার৷ তার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। হিরোর বুকের মাঝে যেতে মন চাইছে তার খুব করে।হিরোর কথা মনে পরে আরও কান্না পাচ্ছে তার।ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে উঠে বসল সে। নূর আর থাকতে পারলনা। বিছানা থেকে উঠে ধীরে ধীরে দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল সে। হেঁটে এলো নিজের রুমে। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখল আদিত্য কাত হয়ে বুকের উপর হাত ভাজ করে ঘুমিয়ে আছে। নূর এগিয়ে গিয়ে সোজা বিছানায় উঠে আদিত্যর সামনে শুয়ে পড়ল। আদিত্যর ভাজ করা হাত খুলে বুকে নিজের জায়গা করে নিলো। দুই হাতে আদিত্যর টিশার্ট খামচে ধরে বুকের মাঝে সামিল হয়ে গেল সে। হ্যাঁ, এখন ভালো লাগছে তার। এইতো কত শান্তি লাগছে এখন। আর খারাপ লাগছে না৷ সব ঠিক আছে এখন। মুখে হাসি ফুটিয়ে চোখ বুজে নিলো নূর। এই পর্যায়ে আদিত্য ঠোঁটে হাসি বিস্তৃত হলো। সেতো জেগেই ছিলো। এঞ্জেলটাকে ছাড়া ঘুম কোথায় আসছিল আজ তার। কিন্তু নূরকে আসতে দেখেই চোখ বুজে ফেলে সে। দেখতে চায় নূর কি করে। নূর যখন এভাবে বুকের মাঝে এলো তখন আদিত্য বুঝতে পারল ওর এঞ্জেলটাও ওকে ছাড়া থাকতে পারেনি। তাইতো চলে এসেছে তার কাছে। আদিত্য প্রাপ্তিময় হেঁসে প্রাণভোমরাটাকে বুকের মাঝে আরও নিবিড় ভাবে জড়িয়ে নিলো। এতক্ষণ বুকটা খা খা করছিল তার। এখন শুধুই প্রশান্তি। এই সুখপাখিকে ছাড়া তার আর এক মুহুর্তও চলে না। আদিত্য নূরের মাথার উপর চুমু খেয়ে সে’ও শান্তিতে চোখ বুজল।

চলবে………..