মরুর বুকে বৃষ্টি ২ পর্ব-১৪+১৫

0
234

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি (S-2)
পর্ব-১৪
®মেহরুমা নূর

★সকালে ঘুম থেকে চোখ মেলে তাকাতেই থতমত খেয়ে গেল আদিত্য। নূর ওর পেটের উপর উঠে বসে আছে। মাথার উপর চাদর টেনে আদিত্যকে সহ পুরো ঢাকা। তার ভেতর নূর হাতে টর্চ জ্বালিয়ে নিজের মুখের দিকে আলো ধরে আছে। চোখ খুলে এমন কিছু দেখে কিছুটা তব্দা খেয়ে গেল আদিত্য। সাদা চাদরের নিচে এভাবে আলো ধরে থাকায় কেমন ভুতের মতো লাগছিল প্রথম। আদিত্যর চোখ খুলে তাকানো দেখে নূর গলার স্বর মোটা ভারী করে ভয় দেখানোর ভঙ্গিতে বলল,
“মুহ হা হা….হালুম, ভালুম…. হাউ মাউ খাউ, মানুষের গন্ধ পাও। আমি বটগাছের পেত্নী। তোর ঘাড় মটকে খাবো আমি।”
আদিত্য কপাল কুঁচকে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর শরীর কাঁপিয়ে হেঁসে উঠল সে।সকাল সকাল তার পাগলীর কান্ড দেখে ভীষণ রকম হাসি পেল তার। আদিত্যকে হাসতে দেখে নূর টর্চ নামিয়ে চাদর সরিয়ে ফেলল। মুখ বেজার করে বলল,
“আরে হাসছ কেন? জানো এমন করলে পল্টু,বিল্টুরা ভয়ে কাঁপত। আর তুমি হাসছ। ভয় পাও। ”
আদিত্যের হাসির মাত্রা যেন বাড়ল৷ তা দেখে রাগ হলো নূরের। সে মুখ গোমড়া করে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে সোফায় গাল ফুলিয়ে অভিমান করে বসে রইল। আদিত্য বুঝল তার পরিটা অভিমান করেছে। তাই হাসি থামিয়ে উঠে গিয়ে নূরের পাশে বসে বলল,
“আচ্ছা সরি, ভুল হয়ে গেছে। তুমি আবার করো, এবার ভয় পাবো আমি।”
নূর তাও গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখল৷ আদিত্য বলল,
“আচ্ছা আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ছি। তারপর ভয় দেখিও কেমন!”
আদিত্য গিয়ে বিছানায় আবার চিত হয়ে শুয়ে চোখ বুজে রইল। এক চোখ হালকা খুলে দেখল নূর আসছে। নূর এসে আবারও আদিত্যর পেটের উপর আগের মতো বসল।তারপর মাথার উপর চাদর টেনে আগের মতো টর্চ জ্বালাল। আদিত্য চোখ মেলে তাকাতেই আবারও ভয় দেখালো। আদিত্য অনেক কষ্টে নিজের হাসি আঁটকে রেখে ভয় পাওয়ার মতো করে বলল,
“না না, আমাকে খাবেন না পেত্নী জি। প্লিজ ছেড়ে দিন আমাকে। আমাকে ছাড়া আমার এঞ্জেলের কি হবে! ছেড়ে দিন আমাকে। আমার অনেক ভয় করছে!”
নূর ভারী গলায় বলল,
“ঠিক আছে যাও। তোমার এঞ্জেলের জন্য ছেড়ে দিলাম আজ। নাহলে তোমার ঘাড় মটকানো পাক্কা ছিলো।”
আদিত্য মুখ টিপে হেঁসে বলল,
“তাই!”
বলেই নূরকে কাতুকুতু দেওয়া শুরু করে দিলো আদিত্য। আর নূর ছটফট করতে করতে খিলখিল করে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে একসময় শুয়ে পড়ল বিছানায়। আদিত্য টর্চ জ্বালিয়ে নূরের চোখের দিকে ধরছে আর নূর মুখের সামনে হাত রেখে বাঁচার চেষ্টা করছে। দুজন দুষ্টুমিতে মেতে হাসির আলোড়ন সৃষ্টি করছে। আর তাদের এই হাসির শব্দ কাটার মতো বিঁধছে ঝুমুরের কানে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে শুনতে পাচ্ছে সে তাদের হাসির আওয়াজ। এমনিতেই সকালে যখন বুঝতে পারল তার প্ল্যান ফ্লপ হয়ে গেছে তখন মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তারউপর এদের হাসি যেন ঘিতে আগুনের কাজ করছে। তবে ব্যাপার না। একবার ফেল হয়েছে তো কি হয়েছে! ঝুমুর এত সহজে হার মানবে না। সে জানে কি করতে হবে! খুব আহ্লাদ করা হচ্ছে না পাগলীর সাথে! দেখি কতদিন এই আহ্লাদ করতে পারে! কারণ পাগলীর সব খবর ওর জানা আছে। কিভাবে কি করতে হবে তাও জানে সে। এখন দেখবে আসল পাগলী কাকে বলে। তখন দেখা যাবে কত ভালোবাসা বাঁচে! মনে মনে এসব ভেবে সয়তানি হাসলো ঝুমুর।

একটু পর নূরকে নিয়ে নিচে আসতেই দেখল সার্ভেন্টরা দরজার সামনে ফুল দিয়ে সাজাচ্ছে। বিহানের বউয়ের স্বাগতমের উদ্দেশ্যে। আদিত্যই বলে দিয়েছিল সবাইকে।নূর উৎসুক হয়ে এগিয়ে গেল সাজ দেখতে। তবে আদিত্যর ভ্রু কুঁচকে আসল আবিরকে দেখে। যে এমুহূর্তে সোফায় বসে বসে ন্যাকা কান্না করে যাচ্ছে। টিস্যু দিয়ে নাক মুছে মুছে সামনে টিস্যুর পাহাড় গড়ে ফেলেছে। আদিত্য নাক সিটকে বলল,
“কি করছিস এসব? এটা আবার কোন নাটক তোর?”
আবির নাক মুছতে মুছতে নেকা কান্নার সুরে বলল,
“নাটক নারে বন্ধু, নাটক না। এটা হলো বন্ধু হারানোর শোক। আজ আমার আরও একটা বন্ধু, তরতাজা প্রাণ অকালে শহীদ হতে চলেছে। তো কাঁদবোনা আমি! শোকে কলিজায় আমাশয় হয়ে যাচ্ছে আমার। জানিস সকাল থেকে দশবার বাথরুমে গেছি শোক প্রকাশ করতে। আমার দুই দুইটা বন্ধুই শহীদ হয়ে গেল! একজনতো বিয়া কইরা ময়নার বাপও হয়ে গেল। আরেকটা নাজানি কার বাপ হইবো। সব নওজোয়ান এমন শহীদ বনে যেতে লাগলে দেশের কি হবে আমার হলো সেই চিন্তা। এত চিন্তা করতে গিয়ে আমার মগজে ট্রাফিক জ্যাম বেধে গেছে জানিস!”
আদিত্য বিরক্তির সুরে বলল,
“তুই কি ফেড আপ হোসনা! এত ড্রামা কিভাবে করতে পারিস! নরমাল ব্যাক্তির পক্ষে সম্ভব না এত ড্রামা করা। টপ লেভেলের ড্রামাবাজ!”
আবির এই পর্যায়ে গর্বিত ভঙ্গিতে বলল,
“থ্যাংকস ইয়ার,তোর কমপ্লিমেন্টের জন্য। আসলে এই পর্যায়ে আসা এত সহজ ছিলোনা। এমন সফলতা পেতে অনেক মেহনত করতে হয়েছে আমাকে। দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে, অক্লান্ত পরিশ্রম করে, মাথার ঘাম টিস্যুতে মুছে আজ এই সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি আমি। এতবড় সফলতা পেয়েও দেখ,একফোটা অহংকার করিনি আমি। একেবারে উকুনের ডিম সমানও অহংকার নেই আমার। ভাবতে পারিস কত মহান আমি!”
“সে আর বলতে! মন চায় তোর মতো মহৎপ্রাণ ব্যাক্তিকে গাধার পিঠে বেঁধে এলিয়েনদের গ্রহে পার্সেল করে দেই।”
“সাথে নোরা ফাতেহিকেও দিয়ে দিস। তাহলে শীত লাগবেনা৷ ওর কাছে আছে,♪হায় গারমী..”
আদিত্য মাথা নেড়ে হাসল। এটা আর শুধরাবে না।ওদের কথার মাঝেই বিহানকে দরজার সামনে আসতে দেখা গেল।আবির তাকে দেখেই তার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
“আরে আরে আইসা পড়ছে আমগো দুলহে রাজা। সাথে নিয়ে আমগো নতুন ভাবি। আচ্ছা শোন,ভাবিকে একটু ধীরেসুস্থে আমার দিকে তাকাতে বলিস বুঝলি! আমার মতো এমন ভয়ংকর সৌন্দর্যের অধিকারী, আগুনের গোলার মতো হ্যান্ডসাম দেবর হঠাৎ করে দেখলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে। তাই ভাগে ভাগে তাকাতে বলিস।”
আবির মজা করলেও বিহানের মুখয়ব কেমন বিষন্ন দেখা যাচ্ছে। আদিত্য বিষয় টা খেয়াল করল। আর বিহানকে একাই দেখা যাচ্ছে। বিয়ে করেতো বউ সাথে আনার কথা। আদিত্য একটু চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“বিহান! তুই একা কেন? হিয়াকে সাথে আনিস নি? নাকি আপাতত একসাথে থাকার কথা ডিসাইড করিসনি?”
আবির মাঝখান থেকে বলে উঠল,
“একসাথে থাকবেনা মানে! কস কি মামা! বিয়া কইরা বাসর ছাড়া থাকব! এটাতো তেমন কথা হয়ে গেল,বিরিয়ানি থাকা সত্বেও ক্ষুদার্ত থাকা।”
আদিত্য হালকা ধমকের সুরে বলল,
“তুই একটু চুপ করবি! বিহান, হয়েছে কি? বলতো?”
বিহান এবারে ব্যাথিত চোখে তাকালো আদিত্যর দিকে। আস্তে করে বলল,
“ও আছেনই আদি। আমি কাজী অফিসের ছামনে বইছা অপেক্ষা করতাছিলাম। কিন্তু ও আইলোনা। একসময় কাজী অফিছও বন্ধ হইয়া গেল। মাগার ও আইলোনা।”
আদিত্য, আবির দুজনের খুব খারাপ লাগল বিহানের জন্য। আবির ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
“আসে নাই মানে কি! আসবেনা কেন! আমার বন্ধুকে ফাঁকি দেওয়া! এই আদি চল উঠিয়ে নিয়ে আসি। বিয়েতো আজ হয়েই ছাড়বে।”
বিহান বলল,
“না এমন কিছুই করবিনা তুই।”
আদিত্য নরম সুরে বলল,
“কিন্তু হয়েছে টা কি? কোনো সমস্যা হয়েছে? ”
“জানি না, হয়তো এই ছন্নছাড়ার লগে ছাদী করবার চায়না। তাই আহে নাই।”
“আমি কথা বলে দেখবো হিয়ার সাথে? ”
“না, দরকার নাইক্কা। আর তোরা চিন্তা করিছ না। আমি ঠিক আছি।”
বলেই ভেতরে চলে গেল বিহান। বন্ধুর জন্য আদিত্য, আবির দুজনেরই খারাপ লাগছে। এতিম ছেলেটা এই প্রথম নিজের জন্য কিছু আশা করেছিল। তাও এমন হয়ে গেল।
__

বিকালের দিকে ঝুমুর তার প্ল্যান শুরু করে দিলো। আদিত্য এইসময় অফিসে। তাই এটাই মুখ্য সুযোগ। নূর ওর রুমে বসে খেলছিলো তখন। ঝুমুর চুপিসারে গিয়ে প্রথমে জানালা দরজার বন্ধ করে সব পর্দা গুলো টেনে দিলো।তারপর অগোচরে চুপ করে লাইটাটা বন্ধ করে দিলো। রুম তৎক্ষনাৎ অন্ধকারে ছেয়ে গেল। নূর তা দেখে একটু ঘাবড়ে গেল। জোরে জোরে জমিলাকে ডাকতে লাগল। আবছা আলোয় দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলতে চাইলে দরজাও বন্ধ পেল। তাতে যেন ভীতি বাড়ল নূরের। তার আতঙ্ক আরও উচ্চ পর্যায়ে নিতে ঝুমুর তার পরবর্তী ধাপে গেল। মোবাইলের ব্লুটুথ-এর সাহায্যে ছোট স্পিকারে সাউন্ড চালু করল। তাতে অনেকগুলো বাচ্চাদের কন্ঠ একসাথে শোনা যাচ্ছে। যেখানে সবাই একসাথে জোরে জোরে বলছে,” নূর হলো পাগলী,নূর হলো পাগলী,এই পাগলী, এই পাগলী…..” এই সাউন্ড গুলো সারা ঘর জুড়ে ধ্বনিত হচ্ছে। যা শুনে নূর ভীত, শঙ্কিত হয়ে যাচ্ছে। বাইরে যাওয়ার জন্য দরজা চাপড়াছে আর আহাজারি করছে। কিন্তু দরজা খুলছে না। এদিকে এসব আওয়াজে নূরের মানুষিক অবস্থা বেগতিক হচ্ছে। এসব সইতে পারছেনা সে। দুই কান চেপে ধরে নিচে বসে অস্বাভাবিক কন্ঠে শুধু বলছে, “না না, আমি পাগলী না, চুপ করো তোমরা।” তার অবস্থা দেখে ঝুমুর বাঁকা হাসল। গ্রামে নূরকে বাচ্চারা এসব বলে অনেক ক্ষ্যাপাতো। তখন নূর হাইপার হয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলত। এরপর ওকে আর ঠিক করা অনেক কঠিন হয়ে যেত। আজও সেটাই করার উদ্দেশ্যে ঝুমুর এসব করছে। নূরকে আউট কন্ট্রোল করতে চাচ্ছে যাতে নূরের পাগলামিতে অতিষ্ঠ হয়ে যায় আদিত্যরা। আর তার প্ল্যানের প্রথম ধাপ সফলও হয়ে গেল। নূর ধীরে ধীরে ভীষণ হাইপার হয়ে গেল। জোরে জোরে চিল্লাচ্ছে আর হাত পা দাপাচ্ছে। ঝুমুর বুঝতে পারল নূর পুরোপুরি বেগতিক হয়ে গেছে। আর বুঝতে পেরেই সে চুপিসারে দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল। আর পেছনে রেখে গেল আউট অফ কন্ট্রোল,মানুষিকভাবে মুমূর্ষু নূরকে। যে এখন পুরোপুরি উন্মাদের চিল্লাচ্ছে আর হাত পা দাপাদাপি করছে।নূরের চিল্লাচিল্লি শুনে জমিলাসহ সব সার্ভেন্টগুলো দৌড়ে এলো। রুমে এসে প্রথমে লাইট জ্বালাল। কিন্তু নূরের অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেল তারা। নূর শুধু জোরে জোরে চিল্লিয়ে যাচ্ছে। জমিলা তার কাছে গিয়ে তাকে ধরতে নিলেই সে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো জমিলাকে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে চিল্লাতে চিল্লাতে ঘরের সব জিনিসপত্র উঠিয়ে উঠিয়ে সবার দিকে ছুঁড়ে মারতে লাগল আর ভাঙতে লাগল। কিছু জিনিস গিয়ে সার্ভেন্টদের গায়ে লেগে কিছুটা আঘাতও পেল। তাই ভয়ে আর কেউ এগুতে পারলোনা তার কাছে। সবাই ভীষণ ভয়ে পেয়ে গেল। কি করবে বুঝতে পারছেনা। সুযোগ বুঝে ঝুমুরও ওদের সামনে এসে নূরের প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করার নাটক করতে লাগল।

এভাবে নূরের অবস্থা আরও বেগতিক হতে লাগল। সে রুম থেকে বেড়িয়ে এসে লিভিং রুমেও সব ভাংচুর করতে লাগল। আর যে সামনে আসছে তার প্রতি আক্রমণাত্মক হচ্ছে। তাই ভয়ে কেউ যাচ্ছেও না তার সামনে। ঘন্টাখানিক এমন চলার একপর্যায়ে আদিত্য অফিস থেকে ফিরল। ঘরের দরজায় পা রাখতেই আৎকে উঠল সে। নূরকে এমন বিক্ষিপ্ত রুপে দেখে পৃথিবী থমকে গেল তার। ভয়ে হৃদপিণ্ড মুচড়ে উঠল তার। একি হয়ে গেছে তার এঞ্জেলটার! তার মাছুম পরিটা এমন কিভাবে হয়ে গেল! ভয়ার্ত, আতঙ্কিত নজর শুধু তার এঞ্জেলটার মুখটা দেখে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে। নূরের মুখমন্ডল কেমন লাল আর অস্বাভাবিক হয়ে আছে। ডাইনিং টেবিলের সব জিনিসপত্র ছুঁড়ে ভাঙছে আর চিল্লাচ্ছে সে। ফ্লোরে কাচের টুকরো গুলো ছড়িয়ে আছে। আদিত্য তার প্রাণভোমরাটার চিন্তায় উত্তেজিত হয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে চিল্লিয়ে বলল,
“নূররররর…… ”
বলেই দৌড়ে নূরের কাছে যেতে চাইল আদিত্য। তবে আদিত্যকে কাছে আসতে দেখেই নূর তার দিকে সব জিনিসপত্র ছুঁড়ে মারতে লাগল আর চিল্লাতে লাগল। আদিত্য তবুও তার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে আদুরে সুরে বলতে লাগল,
“নূর,মাই এঞ্জেল সোনাপাখি, কি হয়েছে কলিজাটা! আমাকে বলো! দেখ তোমার হিরো এসেছে। হিরোকে বলো কি হয়েছে! শরীর খারাপ লাগছে!”
বলতে বলতে নূরের কাছে এসে নূরকে ধরতে নিলেই নূর দুই হাতে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো আদিত্যকে। তারপর টেবিলের উপর থেকে গ্লাস উঠিয়ে আদিত্যর দিকে ছুঁড়ে মারল। যা আদিত্যর বাহুতে লেগে কেটে গেল। তবে আদিত্যর বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই তাতে। তারতো যত চিন্তা শুধু নূরকে নিয়ে। নূরের এমন অবস্থা সইতে পারছেনা সে। বুকের মাঝে হাজারখানা বিষাক্ত তীরে র,ক্তাক্ত হচ্ছে যেন৷ ট্রিটমেন্ট শুরু হওয়ার পর থেকে নূরের কোনো এটাক আর আসেনি। তাহলে আজ কি হয়ে গেল পাখিটার! আদিত্য আবারও নূরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে করুন মায়াবী সুরে বলল,
“আমার ময়না পাখি, শান্ত হও প্লিজ! আমাকে বলো কেমন লাগছে তোমার!”
নূর হুঁশ শূন্য উন্মাদ। সে আবারও টেবিলের উপরের সিরামিকের প্লেট,বাটি উঠিয়ে আদিত্যর দিকে ছুঁড়ে মারল। সেসব আদিত্যর গায়ে লেগে জায়গায় কেটে র,ক্ত বের হচ্ছে। তবুও আদিত্য সেসব মালুম না নূরকে সামলানোর প্রয়াস করছে। নূরের আশেপাশের কাচের টুকরো তার পায়ে গেঁথে যাওয়া থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে।কিছুক্ষণ পর বিহানও এসে উপস্থিত হলো সেখানে। এসব দেখে সে’ও ঘাবড়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে আদিত্যকে ধরে সরিয়ে নিয়ে আসতে চাইল। কিন্তু আদিত্য যাবে না। সে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
“বিহান ছাড়। আমার এঞ্জেল, দেখ ও কেমন করছে! আমার এঞ্জেলকে দেখতে দে। ওর কিছু হয়ে যাবে।”
বিহান আদিত্যকে আটকে রাখার চেষ্টা করে বলল,
“আদি শান্ত হ, এহন ভাবির মাথা ঠিক নাই। এহন ছামনে গেলে তোরে কিছু কইরা বছবো। আমি ডক্টরকে খবর দিতাছি। হেই আইছা দেখব।”
“করলে করবে। তুই ছাড় আমাকে। ওর কিছু হয়ে গেলে আমি কি করব তখন!”
আদিত্য জোর খাঁটিয়ে বিহানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। আবারও ছুটে গেল নূরের কাছে। এবার নূরকে ধরে সে শক্ত করে জাপ্টে ধরল বুকের মাঝে। নূর ক্ষিপ্ত হয়ে হাত পা মারছে আর গোঙ্গাচ্ছে। আদিত্য সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরে রাখল বুকের মাঝে। নূরকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলল,
“হুঁশ হুঁশ হুঁশ… কিছু হয়নি, কিছু হয়নি। সব ঠিক হয়ে যাবে সোনাপাখি। এইযে আমি আছি না।”
নূর কিছুতেই নরম হচ্ছে না। এক পর্যায়ে সে আদিত্যর বুকে সেদিনের মতো কামড়ে ধরল সজোরে। আদিত্য সয়ে গেল দাঁত চেপে। একসময় আবারও জ্ঞান হারিয়ে ফেলল নূর। আদিত্যর হৃৎস্পন্দন থেমে গেল যেন। নূরকে কোলে নিয়ে দ্রুত রুমে নিয়ে গেল সে। বিহান ততক্ষণে ডক্টরকে ফোন করে দিয়েছে আসতে। দূর থেকে এসব দেখে সয়তানি হাসল ঝুমুর।মাত্রতো শুরু হলো। দেখি কতদিন এই পাগলীর পাগলামি সহ্য করতে পারেন। একদিন অতিষ্ঠ হয়ে নিজেই এই পাগলীকে ছুঁড়ে ফেলে দিবেন নিজের জীবন থেকে। তখন এসবকিছু হবে শুধু আমার।

চলবে……

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি (S-2)
পর্ব-১৫
®মেহরুমা নূর

★অচেতন নূর বিছানায় শুয়ে আছে। পাশেই তার হাত মুঠোয় জড়িয়ে নিয়ে বসে আছে বিমর্ষ আদিত্য। ডক্টর মাত্রই দেখে গেছে নূরকে। বলেছে হয়তো কোনো বিষয় নিয়ে ভয় পেয়ে নূর এমন হাইপার হয়ে গেছে। ইনজেকশন দিয়ে গেছে। বলেছে জ্ঞান ফিরলে ঠিক হয়ে যাবে। আদিত্য তখন থেকে ওভাবেই নূরের হাত ধরে ওর পাশে বসে। বিহান অনেক বলে কয়ে ডক্টরকে দিয়ে আদিত্যর গায়ের ক্ষত গুলোতেও ব্যান্ডেজ করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু নিজের জন্য মোটেও কোনো উদ্বেগ নেই আদিত্যর।তারতো সকল উদ্বিগ্নতা কেবল তার এঞ্জেলকে নিয়ে। এইযে অচেতন নূর,বেজানের মতো পড়ে আছে। এমন নূরকে দেখতে পারা আদিত্যর জন্য সবচেয়ে কষ্টকর অনুভূতি। তার হাস্যজ্বল, প্রাণবন্ত, মাছুম পরিটাকে এভাবে দেখতে পারা যেন হাজার বার ছু,রিকাঘাতের চেয়েও বেশি যন্ত্রণাদায়ক তার জন্য। লাল হয়ে ওঠা ব্যাথিত চোখে তাকিয়ে আছে নূরের ফ্যাকাসে মুখপানে। হাতের মুঠোয় ধরে রাখা নূরের হাতটাতে চুমু খেল আদিত্য। নূরের মাথায় হাত বুলিয়ে করুন অপরাধী সুরে বলল,
“আম সরি সোনা। আম রিয়েলি সরি। আমি খেয়াল রাখতে পারিনি আমার এঞ্জেলের। তোমার হিরোটা একদম ভালো না৷ প্লিজ চোখ খোল। আই প্রমিজ, আর কখনো এমন হবে না। আমি আমার এঞ্জেলকে আর কখনো একা ছাড়বোনা। প্লিজ জান,চোখ খুলে তাকাও। তোমাকেযে এভাবে দেখতে পারছিনা আমি।”
বলতে বলতে নূরের কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে রইল আদিত্য। কিছুক্ষণ পর নূর ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো। চোখ মেলে তাকাতেই আদিত্যকে মুখের দেখে দূর্বল স্বরে ডাকল তাকে,
“হিরো..”
চকিত নজরে তড়িৎ গতিতে তাকালো নূরের পানে আদিত্য। নূরের জ্ঞান ফেরা দেখে যেন দেহে প্রাণ ফিরে এলো তার। ঠোঁটে ফুটল অমূল্য রত্ন খুঁজে পাবার মতো হাসি। আদিত্য দুই হাতে নূরের মাথা, মুখে হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
“আমার এঞ্জেল চোখ খুলে তাকিয়েছে। তুমি ঠিক আছ এঞ্জেল! কেমন লাগছে এখন? কোনো কিছু হচ্ছে আর?”
নূর চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ হচ্ছেতো।”
আদিত্য উত্তেজিত হয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
“কি হচ্ছে বলো আমাকে।”
“ওই পায়ের কাছে শুধু চুলকাচ্ছে।”
আদিত্যর চিন্তায় অস্থির মুখটা তৎক্ষনাৎ স্থির হয়ে গেল ভ্যাবাচেকা খেয়ে। চিন্তার মাঝেও নূরের মাছুম কথায় হেঁসে দিলো আদিত্য। তারপর দুষ্টু সুরে বলল,
“আচ্ছা তাই! পা চুলকাচ্ছে! ”
বলেই আদিত্য নূরের পায়ের তালুতে হাত দিয়ে শুরশুরি দিতে লাগল। আর নূর হেঁসে কুটিকুটি হয়ে বিছানায় মোচড়ামুচড়ি করতে লাগল। বাইরে থেকে এসব কিছু লুকিয়ে দেখল ঝুমুর। দেখে রাগ হলো ভীষণ পরিমাণ। এতকিছুর পরেও এদের হাসাহাসি সহ্য হচ্ছে না তার। এই আদিত্য কি দিয়ে তৈরি! এতকিছু হয়ে গেল তাও বিরক্ত হয়না! তবে আমিও ছাড়ার পাত্রী না। দেখি কতক্ষণ সহ্য করতে পারে এসব! এবার আমি এমন কিছু করবো যা সে কল্পনাও করেনি। এবার রাগ হতে বাধ্য হবে আদিত্য। মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতে সরে গেল ঝুমুর।
___

“খাঁড়ান।”
থমকে গেল হিয়ার চলতি কদম।গার্মেন্টস থেকে ফিরছিল সে। হঠাৎই বিহানের ডাকে বুক কেঁপে উঠল সহসাই। ক্ষণিকের জন্য দাঁড়িয়ে গেলেও পরপরই আবারও দ্রুত কদম বাড়াল সে। তবে বেশি দূর অগ্রসর হতে পারল না। সামনে এসে দাঁড়াল বিহান। হিয়া একটুর জন্য ধাক্কা খেতে খেতে বাঁচল তার সাথে। হিয়া বিহানের পাশ কাটিয়ে আবারও চলে যাওয়ার প্রচেষ্টা করল। এপর্যায়ে বিহান হাত ধরে ফেলল তার। গম্ভীর স্বরে বলল,
“পালাইতাচেন! যেমতে কাল পালাইচিলেন!”
হিয়া বিহানের দিকে না তাকিয়েই চাপা স্বরে বলল,
“ছাড়ুন, আমরা রাস্তায়। লোকজন দেখবে।”
বিহানের যেন রাগ হলো খুব করে। সে হিয়ার হাত টেনে ওকে নিয়ে রাস্তার পাশে এক দোকানের আড়ালে নিয়ে এলো। হিয়া নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে পেরে উঠছে না। বিহান হিয়ার হ্যাঁচকা টানে নিজের সামন-সামনি এনে দাঁড় করিয়ে বলল,
“এহন কন, কেউ দেখতাচেনা। কন কাল আহেন নাই ক্যালা? আমিতো আমার কথা রাখছিলাম। ছাদী করনের লাইগা খুছি খুছি আইছা বইছা রইছিলাম। আপনে ক্যান আইলেন না? ক্যান করলেন আমার লগে এমন?”
হিয়া ভীরু নজরে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
“আমার ইচ্ছে হয়নি তাই আসিনি। আপনাকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই আমি।”
বিহান এবার হিয়ার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
“অবছ্যই বাধ্য। আপনিইতো কইছিলেন ছাহছ থাকলে বিয়া কইরা দেখান৷ আমিতো আপনার কথাই রাখছিলাম। তাইলে আইলেন না ক্যালা? এইডার জবাব আপনারে দিতেই হইবো? জানেন, জীবনের প্রথম কতো খুছি হইছিলাম আমি! ভাবতাছিলাম কত ছহজেই মনের মানুছ পাইয়া গেলাম। আমিতো ভালোবাইছা ফালাইছি আপনারে। আপনার লগে অনাগত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতাছিলাম।ক্যান করলেন আমার লগে এমন? কি ছমছ্যা হেইডা আপনারে কইতেই হইবো।”
হিয়া চকিত নজরে তাকালো বিহানের পানে। কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে বলল,
“ভালোবাসা! এতই সহজ ভালোবাসা! জানেনই বা কি আমার সম্পর্কে আপনি! এখনো পর্যন্ত তো চেহারাই দেখলেন না। আর বিয়ে কোনো ছেলেখেলা! যখন খুশি তখন হুট করে বিয়ে করে ফেললাম! মজা চলছে কোনো!”
“মজাতো আপনি করতাচেন আমার লগে। আপনার কথামতোই ছাদী করবার চাইছিলাম! তাইলে আপনি আহেন নাই ক্যালা? কোন কারণে আহেন হেইডা জানোনের অধিকার আছে আমার।”
“কারণ আমি বিয়ে করতে চাইনা। জানেনই কি আমার সম্পর্কে আপনি! যখন আমার সত্যি জানবেন তখন এই বিয়ের ভূত পালাবে। জানেন আমার উপর কতো দায়িত্ব আছে! বুড়ো মা বাবার ভরণপোষণের দায়িত্ব, বাবার অসুখের চিকিৎসা করানোর দায়িত্ব, তার হার্টের অপারেশন করানো লাগবে সেটার দায়িত্ব। এসব দায়িত্ব থেকে হাত ঝেড়ে আমি বিয়ে করে সংসার করবো! তাদের কে দেখবে তখন! আমি ছাড়া তাদের আর কেউ নেই। এইযে আমাকে ভালোবাসা, বিয়ের কথা বলছেন সেটাতো শুধু আমাতেই সীমাবদ্ধ তাইনা! তারপর আমার মা বাবার কি হবে? কে দেখবে তাদের? আপনি কি নিতে পারবেন তাদের দায়িত্ব? আমার সাথে সাথে তাদের বোঝা বইতে পারবেন আপনি? জানি পারবেন না।এটাই স্বাভাবিক। তাই প্লিজ, আমাকে বিয়ে করার চিন্তা ঝেড়ে ফেলুন৷ আমি আমার মা বাবাকে একা ছাড়তে পারবোনা।”
বিহান এপর্যায়ে হিয়ার হাত ছেড়ে দিলো আলগোছে। তারপর হঠাৎ হাসা শুরু করল। আস্তে আস্তে হাসা শুরু করে একসময় উচ্চস্বরে হাসতে লাগল সে। বিহানের এমন হাসা দেখে হিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল,
“পাগল হয়ে গেলেন নাকি! এভাবে হাসছেন কেন?”
বিহান কোনোরকমে হাসা বন্ধ করে বলল,
“আচ্ছা একখান কথা কনতো, ধরেন আপনে তিনদিন হলো না খাইয়া আছেন। এই মুহুর্তে একটা ছুকনা রুটিই শুধু চাওয়া আপনের। ছেইখানে যদি কেউ রুটির সাথে বিরিয়ানি, মাংস সহ রাজভোজ আপনার সামনে দিয়া কয় ‘তোমাকে কি এসব খাবার দিতে পারি?’ তহন আপনার কেমন লাগব! আপনার কথাটাও ঠিক এমনই লাগতাচে আমার কাছে।”
“মানে?”
বিহান দিয়ার চোখে চোখ রেখে বলল,
“হিয়া, আমি অনাথ। শুধু অনাথ না। নামহীন, পরিচয়হীন এক পথশিশু।বুদ্ধি হতেই নিজেরে শুধু রাস্তায় পাইছি। আমার বন্ধু আদিত্য, ছোটবেলায় আমারে ওর সাথে লইয়া আইছিল। তহন থাইকক্কা ওর ছাথেই আছি। আমার আগে,পরে কেউ নেই। মা,বাবা আছে কিনা তাও জানি না। জীবনে মা,বাবা পরিবার কি জিনিস তা পাইনাই। এইছবের তৃষ্ণার্ত আমি। আমিতো ছুধু আপনেরে পাওয়ার আছা করতাছিলাম, কিন্তু আপনিতো আমার জীবনের মা,বাপের কমতিও পূরণ কইরা দিতাছেন। তাইলে আমি না করমু কোন ছাহছে! আরে এইডাতো আমার ছৌভাগ্য হইব যদি আপনার উছিলায় এই অভাগাও একটু মা,বাপের ছায়া পাইলো। আর আপনে কিনা এই কারণে আহেন নাই কাল! আরে আমারে একবার কইয়াতো দেখতেন!
হিয়া তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
” এসব বলা অনেক সহজ, করা অনেক কঠিন। এখন বলছেন ঠিকই। কিন্তু সময়ের সাথে এসব কথা ফিকে হয়ে যাবে। আর মা বাবা হবে আপনার কাছে বোঝা। যা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারবোনা।”
বিহান মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“কি করলে আপনি বিশ্বাস করবেন তা জানি না৷ তয় আমারে একখান সুযোগতো দিতে পারেন নিজেরে প্রমাণ করার! নাকি আমার মতো নাম, পরিচয়হীন কাউকে আপনি চান না?”
“এমন কিছু না। আমার কাছে এসব ম্যাটার করে না।”
“তাহলে আমারে একটা ছুযোগতো দিবারই পারেন। আপনি যেমতে চান হেমতেই করুম।”
হিয়া কিছু না বলে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। বিহানের মুখে অন্ধকার নেমে এলো। ভাবল হিয়া তার কপালে নেই। হঠাৎ হিয়া দাঁড়িয়ে গিয়ে পিছে তাকিয়ে বলল,
“আমি মা, বাবার সাথে কথা বলব আপনার ব্যাপারে।”
বিহানের মুখে হাসি ফুটল তৎক্ষনাৎ। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে হিয়ার কাছে এগিয়ে গিয়ে আমতাআমতা স্বরে বলল,
“আপনের নাম্বার টা! না মানে মা,বাবায় কি কইলো তা জানাইতে ফোন দিবেন কেমতে। আইচ্ছা আমার নাম্বার নিয়া যান। এই নাম্বারে ফোন দিয়েন।”
হিয়া নাম্বারটা নিয়ে আবারও যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল। বিহানের অগোচরে হাসি ফুটল তার মুখেও।
___

নূর তার রুমে বসে খেলনা দিয়ে খেলছিল। আদিত্য অফিসে এই সময়। তখনই ঝুমুর এসে বসল নূরের পাশে। প্রথমে তার সাথে খেলার ছলে একটু ভালো করে খাতের জমালো। তারপর কথায় কথায় বলল,
“আচ্ছা আপু তোমার হিরোটাতো সত্যিই একদম নায়কের মতো তাইনা?”
নূর হাসিমুখে বলল,
“হ্যাঁ, তাতো ঠিকই। আমার হিরো একদম নায়কদের মতো।”
“হুম,তাহলেতো তোমাকেও নায়িকা হতে হবে আপু। নাহলে হিরোর সাথে তোমাকে মানাবে না। আর হিরোও তোমাকে তখন আর পছন্দ করবে না। ভালোবাসবে না।”
নূরের মুখে আধার ছেয়ে গেল। চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বলল,
“তাই! হিরো আমাকে পছন্দ করবে না!”
“উহুম। একদম না।”
নূরের মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। ঠোঁট উল্টে সে বলল,
“না না, হিরো পছন্দ না করলে নূরের অনেক কান্না পাবে। হিরোকে অপছন্দ করতে দিবোনা আমি।”
“চিন্তা কোরোনা আমি আছি না! আমি তোমাকে শেখাবো কিভাবে হিরোর পছন্দ হতে পারো।”
নূর খুশি হয়ে বলল,
“সত্যিই! তুই আমার সাহায্য করবি?”
“হ্যাঁ করবো তো, তুমি আমার বোন না! তোমাকে সাহায্য করবো নাতো কাকে করবো! তবে একটা শর্ত আছে। আমি যে তোমাকে এসব শিখিয়ে দিচ্ছি তুমি কিন্তু এসব কাউকে বলবে না। তাহলে কিন্তু সাহায্য কাজ করবেনা।”
“আচ্ছা কাউকে বলবোনা।”
“ওয়াদা!”
“ওয়াদা।”
সয়তানি হাসির রেখা ফুটল ঝুমুরের ঠোঁটে। অতঃপর সে বলল,
“শোনো, হিরোর সাথে মানানসই হতে হলে তোমাকেও নায়িকার মতো করতে হবে।”
ঝুমুর নূরকে শিখিয়ে দিলো তাকে কিভাবে কি করতে হবে। অবুঝ নূর তা খুব ভালো করেই মেনে নিলো।

সময় তখন রাতের বেলা। আদিত্য, আবির, বিহান লিভিং রুমের সোফায় বসে কথা বলছে। বিহান হিয়ার সাথে হওয়া তার কনভেনশনের ব্যাপারে জানাল ওদের কে। তা শুনে ওদেরও ভালো লাগল। আবির মজার ছলে বলল,
“যা মামা! শেষমেশ এই রাম ছাগলেরও কপালে মাইয়া জুটে গেল! আর এক আমি! ধুপধাপ সিঙ্গেল হয়ে যাচ্ছি! মিঙ্গেল স্টাটাস বেশিক্ষণ টিকেই না। পুরাই চায়না প্রডাক্ট মার্কা জীবন হয়ে গেছে। এ জীবন রেখে লাভ কি! মনডায় চায় বিরিয়ানি খেয়ে জীবন দিয়ে দেই।”
বিহান এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“বিরিয়ানি খাইয়া কেমতে জীবন যাইবো হালা!”
“আরে বিরিয়ানি খাওয়ার পর আমি জুস খাবেনা!”
“তো! জুস খাইয়া মরবি?”
“আরে না, তারপরতো আমি দই খামু।”
“তো হালা মরবিডা কহন?”
“এইযে এতকিছু খাচ্ছি, এগুলো পচাতেও তো হবে! এত জলদি মরলে খাবারগুলো আঁটকে থাকবে তাইনা!”
এদের এসব আজগুবি কথায় আদিত্য বরাবরের মতোই স্মিথ হাসল। হঠাৎ ওদের কথার মাঝেই এক অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটল। যারজন্য কেউই প্রস্তুত ছিলোনা ওরা। ওদের কথার মাঝেই ওখানে নূর এসে উপস্থিত হলো। তবে নূরকে দেখেই যেন আদিত্যর মাথা ঘুরে উঠল। কারণ নূর এই মুহুর্তে ভীষণ অশালীন ধরণের পোশাক পড়ে আছে। হাতা কাটা গেঞ্জি যার দীর্ঘ এতই কম যে, পেটের অংশ পুরেটাই দৃশ্যমান। আর সাথে শর্ট জিন্স, যা হাঁটুর অনেক উপরে উঠে আছে। নূরের এমন অশালীন পোশাক দেখে আদিত্যর মাথায় তড়িৎ গতিতে আগুন ধরে গেল। অন্য পুরুষের সামনে তার বউ এমন খোলামেলা পোশাকে এসেছে তা ভাবতেই শরীরের প্রতিটা ইন্দ্রিয় বিস্ফোরিত হয়ে উঠছে তার। রাগে হিতাহিত বোধশক্তি হ্রাস পাচ্ছে তার।আদিত্য ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে নূরের বাহু ধরে নিয়ে যেতে যেতে চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“নূরর! কি পড়েছ এসব! চলো এখান থেকে।”
বলেই আদিত্য নূরকে ওখান থেকে দ্রুত সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু নূর যাবে না। আদিত্যর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ফেলল।এদিকে নূরের এমন আবতার দেখে আবির আর বিহানও চরম অস্বস্তিতে পড়ে গেল। না পারছে এখানে থাকতে আর না পারছে উঠে যেতে। শুধু চোখ নামিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। বাসায় মেল সার্ভেন্টরাও কাজ করছিল। তারাও নূরকে এভাবে দেখে আদিত্যর ভয়ে চোখ নামিয়ে দ্রুত সরে গেল। আদিত্য নূরকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে কিন্তু নূর যাচ্ছে না কিছুতেই। উল্টো সে আরও বেশি অযাচিত কিছু করে বসলো। নূর মিউজিক প্লেয়ারে একটা আইটেম সং চালু করে সেই গানের তালে নাচতে লাগল সবার সামনে।একেতো এমন পোশাক, তারউপর এমন অশালীন গানে এভাবে নাচতে দেখে আদিত্যের রাগ এবার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ল। সে তীব্র রাগে নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারলোনা।। আদিত্য সব সহ্য করতে পারে কিন্তু এভাবে অন্য পুরুষের সামনে নিজের স্ত্রীর অযাচিত কাজ সহ্য করতে পারছেনা সে। এতটাই রাগ হচ্ছে যে সে ভুলে গেছে নূরের মানুষিক অবস্থার কথা।বারবার চেষ্টা করছে নূরকে নিয়ে যাওয়ার কিন্তু নূর যাচ্ছেই না। উল্টো এসব করে যাচ্ছে।শেষমেশ রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে আদিত্য নূরের গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলো। তৎক্ষনাৎ গালে হাত দিয়ে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে গেল নূর। চোখে জমল নোনাজল।সে’তো হিরোর কাছে পছন্দসই হওয়ার জন্য এসব করছিলো। যা ওকে ঝুমুর শিখিয়ে দিয়েছিল।তাহলে হিরো ওকে মারল কেন? তাহলে কি হিরোর ওকে পছন্দ হয়নি? এসব মনে করেই চোখের জলে টইটম্বুর হয়ে গেল নূরের। আদিত্য উচ্চস্বরে ডাকল জমিলাকে। দৌড়ে এলো জমিলা। আদিত্য তাকে বলল নূরকে নিয়ে গিয়ে ওর পোশাক ঠিক করে দিতে। জমিলা নিয়ে গেল নূরকে। আদিত্য এখনো কাঁপছে রাগে।রাগে পাশের কাচের ফুলদানিটা তুলে সজোরে আছাড় মেরে দিলো।সামনের টি টেবিলটাতেও লাথি মেরে দিলো।আবির, বিহান তৎক্ষনাৎ এগিয়ে এসে ধরল তাকে।বিহান বলল,
“আদি শান্ত হ, তুইতো জানোছই ভাবির মানুষিক অবস্থা কেমন! সে’কি ভালোমন্দ বুঝে!”
আবিরও বলল,
“হ্যারে আদি,নাহয় অবুঝের মতো এসব করেছে। তাই বলে মারবি তুই!”
তখনই হুঁশ এলো আদিত্যের। সে কিভাবে ভুলে গেল তার এঞ্জেল টা স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন না! রাগের মাথায় সে তার মাছুম পরিটার গায়ে কিভাবে হাত তুলতে পারল! নিজের এই হাতটাকে ভয়াবহ শাস্তি দিতে মন চাইছে। আদিত্য নিচে পড়ে থাকা ভাঙা ফুলদানির কাঁচের টুকরো হাতে তুলে সজরো চেপে ধরল হাতের মাঝে। তৎক্ষনাৎ কাচ বিঁধে র,ক্তে ভিজে গেল হাত। বিহান,আবির ঘাবড়ে গিয়ে আদিত্যর হাত খোলার চেষ্টা করল। কিন্তু আদিত্য খুলছে না। সে আজ এই অপরাধী হাতটাকে ভয়াবহ শাস্তি দিবে। আবির, বিহান অনেক চেষ্টা করেও পারছেনা আদিত্যর সাথে। শেষে বিহান বলে উঠল,
“আদি কি করছিস তুই! ছাড় এসব! ভাবিরে গিয়া দেখ।”
আদিত্য এবার ছেড়ে কাচের টুকরো। নূর! হ্যাঁ ওর এঞ্জেল,ওর এঞ্জেলটাকে আবারও কষ্ট দিয়ে ফেলল ও। আমার যেতে হবে এঞ্জেলের কাছে। ভাবতেই আদিত্য পাগলের মতো ছুটলো নূরের কাছে। আদিত্য যেতেই আবির সন্দিহান মুখ করে বলল,
“একটা জিনিস কিন্তু ভাবাচ্ছে আমাকে। ভাবি কিন্তু এসব আগে করেনি কখনো। তাহলে হঠাৎ এমনসব কান্ড কেন করছে!”
আবিরের কথায় বিহানেরও বিষয়টা কেমন খটকা লাগছে। আসলেইতো, হঠাৎ এমন করার কারণ কি!”

অন্যদিকে দূর থেকে এসব দেখে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে ঝুমুর। সে যা চেয়েছিল তেমনটাই হচ্ছে। একদিন এভাবেই আদিত্য নিজের জীবন থেকেও ছুঁড়ে মারবে নূরকে।

আদিত্য পাগলের মতো ছুটে এলো রুমে। এসে দেখল তার প্রাণপাখীটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে জমিলাকে ধরে। জমিলা তার ড্রেস চেঞ্জ করে দিয়েছে। আদিত্য নূরের কাছে এগিয়ে যেতে নিলেই নূর তাকে দেখে ভয়ে জমিলার পেছনে লুকিয়ে পড়ল। আদিত্য বুকের মাঝে মুষড়ে উঠল তা দেখে। তার এঞ্জেল টা তাকে আবারও ভয় পাচ্ছে। আবারও দূরে সরে যাচ্ছে তার কাছ থেকে। নিজেকে এখন খুন করে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। আদিত্য জমিলাকে চোখের ইশারায় চলে যেতে বলল। জমিলা যেতে চাইলে নূর তার আঁচল টেনে ধরল। জমিলা কোনরকমে আঁচল ছাড়িয়ে নূরকে রেখে চলে গেল। আদিত্য করুন অপরাধী চোখে তাকিয়ে নূরের কাছে যেতে নিলেই নূর ভয়ে পিছিয়ে গিয়ে দুই হাত মুখের সামনে আড়াআড়িভাবে ধরে ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
“মেরোনা আমাকে, মেরোনা দয়া করে। আমি আর করবোনা, আর করবোনা।”
আদিত্যর হৃদপিণ্ড পিষে যাচ্ছে যেন। যাকে সে জানের চেয়েও বেশি ভালোবাসে সেই জানটাই আজ ওর কাছে এমন করুন আবেদন করছে। এই প্রহার সে কিভাবে সইবে! আদিত্য কিছু একটা ভেবে নিজের প্যান্টের বেল্ট খুলে ফেলল। তারপর গায়ের টিশার্ট টাও একটানে খুলে ফেলল। বেল্টটা নূরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজে নূরের দিকে পিঠ করে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসল আদিত্য । তারপর বলল,
“নাও, আমি তোমাকে মেরেছি না! এখন তুমি আমাকে যত খুশি মারো। যতক্ষণ ইচ্ছা এই বেল্ট দিয়ে আমাকে মারো। শাস্তি দাও আমাকে।আমি কিচ্ছু বলবো না।”
নূর কতক্ষণ অবুঝ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। একবার বেল্ট, আরেকবার আদিত্যকে দেখছে। কি করবে বুঝতে পারছেনা সে। কতক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সে বেল্টটা তুলে বাড়ি মারার জন্য হাত তুল তুলতেই হঠাৎ কিছু একটা চোখে পড়তেই ঠাস বেল্ট ফেলে দিলো সে। দ্রুত গিয়ে আদিত্যর সামনে বসে আদিত্যর হাত টেনে ধরে সামনে মেলে ধরে ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,।
“তোমার হাতে কেটে গেছেতো হিরো! কত র,ক্ত বের হচ্ছে!”
নূর হঠাৎ কেমন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল আদিত্যর জন্য। কিন্তু অবুঝ নূর আদিত্যর হাতের র,ক্ত থামাতে সক্ষম হতে পারছেনা৷ হঠাৎ কিছু একটা ভেবে গায়ের ওড়না ছিঁড়ে আদিত্যর হাতে কোনরকমে পেঁচিয়ে দিয়ে বলল,
“নেও,এখন ঠিক হয়ে যাবে। টিভিতে নায়িকারা এভাবেই নায়কের হাত বেঁধে দেয়৷ আর নায়ক ঠিক হয়ে যায়। তুমিও এখন ঠিক হয়ে যাবে। ”
তীব্র মায়াময় চোখে তাকালো আদিত্য। পরপরই নূরকে দুহাতে খুব শক্ত করে মিশিয়ে নিলো বুকের মাঝে। অপরাধী সুরে বলল,
“তোর হিরো অনেক পঁচা এঞ্জেল। তোর এই মাছুম, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার যোগ্য না সে। বারবার তোকে কষ্ট দিয়ে ফেলি। খেয়াল রাখতে পারছিনা আমি তোর। আমাকে যত পারিস শাস্তি দে। শুধু দূরে সরিয়ে দিসনা। তোকে ছাড়া নিঃস্ব হয়ে যাবো আমি।”

দরজার বাইরে থেকে এসব কিছু দেখে রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে ঝুমুরের। কিসের তৈরি এই লোক! এতকিছুর পরেও এই পাগলীর জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে! তবে আমিও দেখে নিবো কত সহ্য করতে পারে সে! ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেই ছাড়বো আমি।

চলবে…..