মরুর বুকে বৃষ্টি ২ পর্ব-২৪+২৫

0
199

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি(S-2)
পর্ব-২৪ (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
®মেহরুমা নূর

★স্নেহা আজ ভীষণ খুশি।আজ তার নতুন জীবনের প্রথম দিন। রুগীর সেবা করার মতো মহৎ কাজে নিয়োজিত হতে পেরেই এই খুশি তার। ঢাকার বড় একটা হসপিটালে নার্সের চাকুরী হয়েছে তার।আজই জয়েন করবে। তাই সকাল সকালই উঠে রেডি হয়ে গেছে স্নেহা। রুমের বাইরে আসলে বাবার দেখা পেল সে।।সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছিলেন তিনি।মেয়েকে দেখে তিনি মুচকি হেসে বললেন,
“কিরে মা রেডি হয়ে গেছিস! তৈরিতো নতুন উদ্বোগের জন্য।”
স্নেহা সৌগর্বে হেঁসে বলল,
“হ্যাঁ বাবা,একদম রেডি স্টেডি গো টাইপ রেডি।আমারতো এক্সাইটমেন্টে ঘুমই আসেনি সারারাত। কখন সকাল হবে আর কখন আমি নতুন কাজে জয়েন করতে পারবো সেই উৎসাহে ঘুমই আসেনি।”
“আচ্ছ এখন নাস্তা করে নে। তারপর আমি তোকে পৌঁছে দিয়ে আসবো।”
“আচ্ছা বাবা।”
স্নেহার ছোট ভাই তখন ছুটে এসে বলল,
“আপু আমিও যাবো তোমার সাথে। আমি ডাক্তার হয়েছি না!”
স্নেহা হেঁসে দিয়ে বলল,
“ডক্টর ডক্টর খেললেই ডাক্তার হয়ে যাওয়া যায় নাকি!”
“আরে তুমি জানোই না আমি কতবড় ডাক্তার। কাল স্যামের পা ভেঙে গিয়েছিল। এই অমিত ডাক্তার অপারেশন করে তার পা আবার লাগিয়ে দিয়েছে। এখন সে আবার চলতে পারছে।”
“আচ্ছা! কাল অপারেশন করলে আর আজই চলতে পারছে! বাহ! তা এই সৌভাগ্যবান রুগী স্যামটা কে শুনি?”
“কেন আমার রোবট স্যাম! ওর কাল পা খুলে গিয়েছিল। আমি অপারেশন করে পা লাগিয়ে দিয়েছি।”
স্নেহা হাসলো অমিতের বাচ্চামো কথায়। স্নেহার মা জাকিয়া তখন ডাকলো সবাইকে নাস্তার টেবিলে। সবাই খেতে বসলো। জাকিয়া স্নেহার জন্য আজ টাকি মাছ ভর্তা করেছে। স্নেহার খুব পছন্দ।মেয়ের প্লেটে গরম গরম ভাত বেড়ে তার পছন্দের মাছ ভর্তাটুকু প্লেটে দিলো। স্নেহা তা দেখে খুশি হয়ে বলল,
“ওয়াও মা,মাছ ভর্তা! থ্যাংক ইউ মা।”
জাকিয়া মমতাময় হেঁসে স্নেহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।তা দেখে অমিত বলে উঠল,
“আম্মু,তোমার মেয়ে মহারনীর সেবা শেষ হলে এই গরীব অসহায়দের উপরও একটু দয়া দীক্ষা করো! আল্লাহর ওয়াস্তে একটু খাবার আমাদের পাতেও দাও। তোমারতো মেয়ে ছাড়া কাউকে চোখেই পড়ে না। এত কেন অবিচার আমাদের সাথে!”
স্নেহা হেঁসে দিয়ে অমিতের মাথায় আলতো চাপড় মেরে বলল,
“কিরে এত হিংসে কেন তোর! মা আমাকে নাহয় একটু বেশি ভালোবাসে তাই বলে হিংসে করবি!”
“একটু! কি যে বলো আপু! আমারতো মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা বোধহয় এই বাড়িতে আশ্রিতা আর তুমি হলে মহারানী। আমাদের থাকতে দিছো এটাই আমাদের চৌদ্দ গুষ্টির সৌভাগ্য টাইপ অবস্থা।”
জাকিয়া হালকা ধমকের সুরে বলল,
“এই অমি,খাবার সময় এত কথা বলতে নেই বলেছি না! চুপচাপ খাবার খেয়ে নে। তোর স্কুলের সময় হয়ে গেছে। মেয়েটা আজ নতুন কাজে যাচ্ছে ওকে বিরক্ত করিস নাতো। খেতে দে ওকে।”
অমিত বলল,
“নাও ঠেলা! এখন কথাও বলতে পারবেনা বান্দা! মানবতা আজ কোথায়!”
স্নেহা হাসলো। সে জানে তার মা তাকে আসলেই একটু বেশিই ভালোবাসে। সবসময় চোখে চোখে রাখে। একা একা কোথাও যেতে নিলে তার চিন্তার শেষ থাকে না। আজও কত চিন্তা করছে সে। নতুন জায়গায় তার মেয়ে যাবে এই নিয়ে চিন্তার ভাজ পড়েছে তার কপালে। খাওয়া দাওয়া শেষে স্নেহা বাবার সাথে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরোতে নিলে জাকিয়া চিন্তিত আঁধার ঘেরা মুখে বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
“সাবধানে নিয়ে যেও ওকে। আর দিয়েই চলে আসবা না। ভেতরে গিয়ে ওর কাজকর্ম শুরু না করা পর্যন্ত তুমি থাকবে।”
স্নেহা মুচকি হেঁসে দুই হাতে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আরে আমার লক্ষী মা,এত চিন্তা করোনা। আমার কিচ্ছু হবে না। তুমি শুধু দোয়া করে দাও তোমার মেয়েকে তাহলেই হবে। ”
স্নেহা যাই বলুক,তাতে মায়ের চিন্তাগ্রস্থ চেহারায় যেন প্রভাব পড়লনা। তবুও জোরপূর্বক হেঁসে মেয়েকে বিদায় দিলেন তিনি।
__

স্নেহা হাসপাতালে এসে কাজে জয়েন করেছে মিনিট ত্রিশেক হলো।এর মাঝে সে তার সহকর্মীদের সাথেও পরিচিত হয়ে নিয়েছে। তারা তাকে হসপিটালটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে।আজ প্রথম দিন বলে তার তেমন কাজ নেই।শুধু হসপিটালের নিয়মকানুন আর রুগীদের ওয়ার্ড কেবিন গুলো ভালোভাবে বুঝে নিচ্ছে। যাতে কাজে সুবিধা হয় তার। তাই সবগুলো ওয়ার্ড কেবিন ঘুরে ঘুরে দেখছে সে।আর রুগীদের সাথেও কথাবার্তা বলছে সে। কার কি অসুখ তা জানার চেষ্টা করছে। এভাবে ঘুরে দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা কেবিনের সামনে এসে থেমে যায় সে। কেবিনটা দেখে কেমন যেন অন্যসব কেবিনের চেয়ে ভিন্ন মন হচ্ছে। এই হসপিটালে যতগুলো কেবিন দেখেছে সেগুলোর থেকে অনেক ভিন্ন এটা। স্নেহার একটু কৌতুহল জাগলো ভেতরে কি আছে তা দেখার জন্য। কোনো রুগী আছে কিনা তা জানতে। স্নেহা আস্তে করে দরজার হাতল ধরে ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে ভেতরে দেখার চেষ্টা করল। ভেতরে নজর যেতেই কিছুটা চমকে উঠল সে। কেবিনের ভেতর ফ্লোরে একটা লোককে মাথা নুইয়ে বসে থাকা দেখতে পেল সে। লম্বা এলোমেলো জটলা পাকানো চুলে ঢেকে আছে তার মুখ। পড়নে হসপিটালের রুগীর পোশাক। হাঁটুর মাঝে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে সে। স্নেহা বুঝতে পারল লোকটাও এই হসপিটালের কোনো রুগী। বাকিদের মতো তার সাথেও কথা বলতে এগিয়ে গেল স্নেহা। মৃদু কদম বাড়িয়ে লোকটির সামনে এসে দাঁড়াল সে। আস্তে করে ডাকল,
“এইযে শুনছেন! কি হয়েছে আপনার?”
লোকটির কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলনা। স্নেহা এবার লোকটির সামনে হাঁটু ভেঙে বসল। লোকটির কাঁধে আলতো করে হাত রেখে ডাকল আবার,
“শুনুন,বলুন কি সমস্যা আপনার!”
লোকটি এবার মাথা তুলে তাকালো। স্নেহার হৃদপিণ্ড কেমন কেঁপে উঠল হঠাৎই। লোকটার ওই র,ক্তিম লাল চোখের নজর চোখে পড়তেই তার বুকের মাঝে অকারণেই কেমন ধুক করে উঠল। চুলের মতো লোকটার দাড়ি মোছও বড় হয়ে এলোমেলো জটলা পাকিয়ে মুখ ঢেকে গেছে। শুধু র,ক্তিম ওই চোখ দুটোই দেখা যাচ্ছে তার।যে চোখের চাহুনি তীব্র ঘাতক। লোকটা স্নেহার দিকে তাকিয়ে কেমন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।তারপর ধীরে ধীরে তার চোখে মুখে অদ্ভুত খুশি ছেয়ে গেল কেমন। যেন আচমকা অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো মহামূল্যবান কোনো খুশির দেখা পেয়েছে সে।যার অপেক্ষা তার হাজার জনম ধরে ছিলো। লোকটি কেমন অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁসে দুই হাতে স্নেহার মুখটা ধরল। ঘাবড়ে গেল স্নেহা অনেকটা। লোকটা পাগলের মতো অস্বাভাবিক সুরে বলতে লাগল,
“নূর! মাই এঞ্জেল! তুমি এসে গেছ! কোথায় চলে গিয়েছিলে তুমি! তোমার হিরোকে ছেড়ে কেন চলে গিয়েছিলে তুমি! আ..আমার এঞ্জেল এসে গেছে! এসে গেছে আমার এঞ্জেল! ”
বলতে বলতেই আচমকা লোকটি স্নেহার সারামুখে পাগলের মতো চুমু খেতে লাগল। তারপর জাপ্টে ধরল বুকের মাঝে শক্ত করে। আর পাগলের মতো হেঁসে বলতে লাগল,
“আমার এঞ্জেল এসে গেছে! এসে গেছে আমার এঞ্জেল।”
স্নেহা যেন থমকে গেল হঠাৎ। স্তম্ভিত হয়ে গেল সে। এমন কিছুর জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা। কিন্তু সে বুঝতে পারল লোকটা হয়তো মানুষিক রুগী। তাই এমন বিহেব করছে। স্নেহা তাই লোকটাকে সামলাতে শান্ত সুরে বলল,
“দে…দেখুন, আপনি ভুল বুঝছেন। আমি আপনার এঞ্জেল না। আমি স্নেহা, এই হসপিটালের নতুন নার্স।”
স্নেহার কথা শুনে লোকটি তাকে এনে ধরল। হঠাৎ যেন লোকটির মুখমন্ডলের সহসাই পরিবর্তন ঘটল। হিংস্র হয়ে উঠল তার চোখ মুখ। চোখ দুটো আরও ভয়ংকর লাভায় ছেয়ে গেল। দেখতে দেখতেই হিংস্রতায় ছেয়ে গেল তার সর্বস্ব। আর হঠাৎই সে গলা চেপে ধরল স্নেহার। আৎকে উঠল স্নেহা। ভয় পেয়ে গেল ভীষণ। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল সে। কিন্তু ছাড়লোনা লোকটা।বরং হিংস্র কন্ঠে বলল,
“তোর সাহস কি করে হলো আমার কাছে আসার! আমার কাছে শুধু আমার এঞ্জেলের আসার অধিকার আছে। তুই কেন এলি! আমার এঞ্জেল যদি রাগ করে আর না আসে! তোকে আমি মেরেই ফেলবো।”
স্নেহা ভয়ে জমে গেল।চোখে মুখে র,ক্ত জমে গেল তার। নিঃশ্বাস আঁটকে যাচ্ছে তার। চোখের সামনে আধার ছেয়ে গেল।নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ওই হিংস্র মানবের সাথে পেরে উঠছে না সে। জীবনের শেষ বুঝি হতে চলল তার। ঠিক তখনই দরজা দিয়ে দৌড়ে ভেতরে ঢুকলো দুটো লোক।সাথে হসপিটালের কিছু স্টাফও এলো। দুজন লোকটিকে টেনে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। তাও যেন লোকটার শক্তির সাথে পেরে উঠছে না তারা। অনেক কষ্টে লোকটির হাত থেকে স্নেহাকে ছাড়াতে সক্ষম হলো তারা। তবুও লোকটি আবারও ক্ষেপা বাঘের মতো তেড়ে আসছে তার দিকে।তাকে ধরে থাকা লোক দুজন তাকে টেনে সরিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
“আদি ছাড় ওকে। শান্ত হ।”
লোকটির হিংস্রতা যেন কোনমতেই কমছে না। স্নেহা ভয়ে কুঁকড়ে গেছে কেমন। তার সহকর্মী নার্সেরা এসে ধরল তাকে।তখন স্নেহার নজরে পড়ল লোকটার হাতে পায়ে লোহার শেকল পড়ানো। অন্য এক নার্স গিয়ে লোকটিকে একটা ইনজেকশন পুষ করল। তার প্রভাবে লোকটা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো। এবং একসময় ঘুমিয়ে পড়ল সে। পাশের দুজন ধরে তাকে বিছানায় শুইয়ে। স্নেহাকে তখন ওর সহকর্মী নার্স ধরে বাইরে নিয়ে যেতে লাগল। আর ফিসফিস করে বলল,
“স্নেহা তুমি এখানে এসেছ কেন! তুমি জানোনা এই রুগী কত ভয়ংকর মানুষিক রুগী! দেখছনা শেকলে বেঁধে রাখ হয়েছে! কত মানুষকে আক্রমণ করে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে এই লোক! শুধু ডক্টর আর উনার ওই দুই বন্ধু ছাড়া কেউ যাওয়ার সাহস পায়না তার কাছে। খবরদার আর কখনো এসোনা এই কেবিনে।”
বলতে বলতে নিয়ে গেল স্নেহাকে।স্নেহা যেতে যেতে তাকিয়ে দেখলো বেডে শুয়ে থাকা ওই ভয়ংকর লোকটাকে। বুকের মাঝে তার কেমন অদ্ভুত অনুভব হচ্ছে। ওই লোকটার জন্য তার কেমন যেন লাগছে। এটা সহানুভূতি নাকি অন্যকিছু তা এই মুহূর্তে বোধগম্য হলোনা তার।

আবির আর বিহান বসে আছে জ্ঞানহীন আদিত্যর পাশে। প্রিয় বন্ধুর এমন করুন পরিস্থিতি দেখতে হবে তা কখনো ভাবেনি তারা। বুকটা ফেটে যায় তাদের আদিত্যর এই অবস্থা দেখে। জীবন হঠাৎ এভাবে মোড় ঘুরাবে তা কখনো ভাবেনি তারা। দুবছর পূর্বের সেই এক্সিডেন্টে সবকিছু তছনছ হয়ে যায়। সেদিন অনেক খোঁজার পর আদিত্যকে মুমূর্ষু অবস্থায় পাওয়া যায়।আদিত্যর পাশের দরজাটা খোলা থাকায় গাড়ি গড়িয়ে যাওয়ার সময় আদিত্য দরজা দিয়ে নিচে পড়ে যায়।তাই ওকে পাওয়া গেলেও নূরকে আর পাওয়া যায় না।সবাই বুঝে যায় কার ব্লাস্ট হওয়ায় সাথে নূরও না ফেরার দেশে চলে গেছে। টানা তিনদিন পর জ্ঞান ফিরে আদিত্যর। কিন্তু জ্ঞান ফিরলে কি হবে! যখন সে জানতে পারে তার নূরই আর নেই। তার এঞ্জেল আর নেই। তখন কি আর আদিত্য ঠিক থাকে।এমনিতেই মাথায় আঘাত পেয়ে অসুস্থ ছিলো তারউপর নিজের প্রাণভোমরাটাকে কাছে না পেয়ে উন্মাদ হয়ে যায় আদিত্য। ধীরে ধীরে ভয়ংকর মানুষীক রুগীতে পরিণত হয় সে। এতটাই ভয়ংকর যে সব ভাংচুর করে সবাইকে মেরে ফেলতে যায়। আর সবচেয়ে বেশি নিজেকে। নিজেকেই মেরে ফেলার অজস্রবার চেষ্টা করেছে সে। একবারতো কাচের টুকরো দিয়ে নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছিল। সকল প্রকার চিকিৎসাও তাকে সারিয়ে তুলতে পারেনি। বরং দিনকে দিন আরও অবনতি হয় তার। এমন পরিস্থিতি হয়ে যায় যে ওকে এভাবে শেকলে বেঁধে রাখতে হয়। একটু আগেই আবির আর বিহান ডক্টরের সাথে কথা বলছিলো আদিত্যর ব্যাপারে। ডক্টর জানিয়েছে আদিত্যর শারীরিক অবস্থাও খুবই খারাপ হচ্ছে দিনদিন। হার্ট দূর্বল হয়ে যাচ্ছে তার। এভাবে চলতে থাকলে তাকে বেশিদিন বাঁচানো যাবে না। এই কথা শুনে আরও ভেঙে পড়ে ওরা। ওর বন্ধুটার সাথে এমনটা কি নাহলেই চলত না! আবির,বিহান দুজনের চোখেই পানি। আদিত্যর এই অবস্থা আর সইতে পারছেনা তারা। আবিরের নজর গেল মেঝেতে। যেখানে আদিত্য মেঝেতে হাতের শেকল দিয়ে খোদাই করে করে নূরের মুখের স্কেচ বানিয়েছে।শুধু মেঝেতে না। কেবিনের প্রত্যেকটা জায়গায় এমন স্কেচ আর নূরের নামে ভরে আছে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে টুপ করে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল আবিরের চোখ থেকে। ঢোক গিলে বেদনার্ত কন্ঠে বলল,
“এমন কেন হয়রে বিহান! যারা এত ভালোবাসে তারাই কেন এমন কষ্ট পায়! কষ্টতো আমার মতো খারাপ মানুষদের পাওয়া উচিত। তাহলে আমার বন্ধুটা কেন পাচ্ছে! কেন? বলনারে বিহান!”
বিহান আঙুলের সাহায্য চোখের পানি মুছে বলল,
“কেন হয় তাতো জানি না। তবে কষ্ট কতটা হয় তাতো দেখতেই পারছিস।”
আবির ঝট করে নজর তুলে তাকালো বিহানের দিকে। যেন সে বিহানের ইঙ্গিত বুঝল। আবির হঠাৎ উঠে বাইরে বেড়িয়ে গেল। বাইরে এসে অতি দ্রুত পকেট থেকে ফোন বের করে তড়িঘড়ি করে কাউকে ফোন দিলো। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হতেই অস্থির কন্ঠে আবির বলল,
“আন্নি,আমি তোকে হারাতে চাইনা আন্নি। তুই তোর বাবার ঠিক করা বিয়েটা করিসনা৷ ভালোবাসা হারালে অনেক কষ্ট হয় আন্নি। আমি ওই কষ্ট পেতে চাইনা।”
আহানার চোখে পানি। তবে প্রাপ্তির অশ্রু। সে অশ্রুসজল চোখে হেঁসে বলল,
“এত দেরি করলেন কেন এটা বলতে! অনেক অপেক্ষা করিয়েছেন আমাকে। যাক অবশেষে বলেছেনতো। আচ্ছা আদি ভাইয়ার কি অবস্থা এখন?”
“ভালোনা আন্নি,একদম ভালোন। আমার বন্ধুটা বোধহয় বাঁচবে না। এভাবে কি কেউ বাঁচতে পারে!”
“ভেঙে পড়েন না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। তিনি নিশ্চয় কোনো কোনো উপায় দেখিয়েই দিবেন।”
“দেখালেই ভালো। নাহলে শুধু চেয়ে চেয়ে আদির শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।”

চলবে….

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি (S-2)
পর্ব-২৫ (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
®মেহরুমা নূর

★হসপিটালের ডিউটি শেষ করে বাইরে আসতেই স্নেহার সামনে সারপ্রাইজিংলী হাজির হলো পাভেল। প্রশস্ত অমায়িক হাসি তার মুখে। স্নেহার সামনে প্রকট হয়েই তার হাসিটা আরও বিস্তৃত করে বলল,
“হেই টুনটুনি!
স্নেহা একটু হকচকানো হাসি টেনে বলল,
“আরে তুমি! কখন এলে?”
“এইতো মিনিট পাঁচেক হবে।”
“তো ভেতরে আসোনি কেন?”
“তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম৷সারপ্রাইজ দিবো বলে টুনটুনির নতুন জীবনের দিন আমি আসবোনা তাকি হয়! তা কেমন গেল তোর প্রথম দিন?”
পাভেলের প্রশ্নে হঠাৎ ওই পাগল লোকটার কথা মনে পড়ে গেল স্নেহার। হঠাৎই কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল সে। তা দেখে পাভেল বলল,
“কিরে কি ভাবছিস টুনটুনি!”
স্নেহা মাথা নেড়ে বলল,
“না, কিছু না। সব ভালোই ছিলো।”
“আচ্ছা চল, বাড়ি যাওয়া যাক।”
পাভেল স্নেহার হাত ধরে সামনে এগুলো। কিছুটা দূরেই পাভেলের বাইক দাঁড় করানো। সেদিকেই নিয়ে যাচ্ছে সে। পাভেল স্নেহার ছোটকালের বন্ধু। শুধু বন্ধু না। দুই পরিবার তাদের বিয়ের কথাও সেই অনেক আগেই পাকা করে রেখেছে। এখন শুধু শুভ দিনের অপেক্ষা তাদের। পাভেল স্নেহার হাত ধরে নিয়ে এসে তার বাইকের পেছনে বসালো। স্নেহার হাতে হেলমেট ধরিয়ে দিয়ে সে নিজেও উঠে বসলো সামনে৷ নিজের হেলমেটটা লাগিয়ে স্টার্ট দেওয়ার জিজ্ঞেস করল,
“বাড়ি যাওয়ার আগে কোথাও যাবি নাকি?তোর প্রথম দিনের ট্রিট নিতে পারিস চাইলে। আজকে ফ্রী অফার আছে। মিস করলে কিন্তু পাবি না।”
স্নেহা স্মিথ সৌজন্যমুলক হেঁসে বলল,
“না থাক। আজ আর কোথাও যাবো না। চলো বাসায়ই যাই।”
“ভেবে বলছিসতো। গরম গরম শিক কাবাব কিন্তু মিস করলি!”
“সমস্যা নেই অন্য কোনোদিন যাবো।”
“ঠিক আছে। তুই যা বলিস।”
বাইক স্টার্ট দিলো পাভেল। সামনে কিছুদূর এগুতেই হঠাৎ একটা কুকুর সামনে আসায় আচমকা জোরে ব্রেক কষে বাইক থামাতে হলো পাভেলকে। যার দরুন স্নেহা ব্যালেন্স রাখতে না পেরে পেছন থেকে উঁচু হয়ে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল পাভেলের কাঁধের উপর। আচমকা এমন হওয়ায় একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল স্নেহা। পাভেল অপরাধী গলায় বলল,
“সরি সরি, তোর লাগেনিতো! আসলে হঠাৎ কুকুরটা সামনে আসায় ব্রেক করতে হয়েছে।”
স্নেহা নিজেকে ঠিক করতে করতে বলল,
“ইটস ওকে,আমি ঠিক আছি।”
পাভেল আবারও স্টার্ট দিলো বাইক। স্নেহার হঠাৎ আবারও ওই লোকটার কথা মনে পড়ে গেল। তখনকার ওই লোকটা ওভাবে তাকে জড়িয়ে ধরার কথা মনে পড়ে গেল। কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভব হচ্ছে তার। পাভেল তার ছোটবেলার বন্ধু, প্রেমিক আবার এখন হবু বর। তবুও তার কাছে গিয়ে কেমন অস্বস্তিতে পড়ে সে। অথচ তখন ওই অপরিচিত লোকটা যখন ওকে ওভাবে জড়িয়ে ধরল তখন কেন যেন তার কোনোরকম অস্বস্তি অনুভব হয়নি। বরং লোকটার বুকে মাথা রেখে তার হৃদপিণ্ডে কেমন অজানা ক্রিয়ার উৎপাদন হচ্ছিল। সেটা কি ছিলো জানেনা স্নেহা। তবে খুবই প্রভাবময় ছিলো সে ক্রিয়া। লোকটার হৃদপিণ্ডের আর্তনাদ যেন স্নেহা অনুভব করতে পারছিলো। বুকের কোনো কোনে মৃদু কম্পন ঘটছিলো তার। চিনচিন ব্যাথার সূচনাও ঘটেছিলো যেন। এমনটা কেন হচ্ছিল তার সাথে তার উত্তর জানা নেই স্নেহার৷ কিন্তু কেন যেন ঘুরেফিরে তার খেয়াল মন থেকে যাচ্ছে না৷ বাসায় আসার পরও তার সেসব খেয়ালই আসছিলো বারবার। রাতে ঘুমাতে নিলেও এই খেয়াল তাকে স্থির দিচ্ছিল না। মন জানতে চাইছিলো কে এই লোক! কেন তার এই অবস্থা! কি হয়েছিল তার সাথে!
__

সকালে ঘুম থেকে চোখ মেলে তাকাতেই পাভেলের একাগ্র দৃষ্টির সাক্ষী হলো স্নেহা। তার মাথার পাশেই বালিশে কনুই ভর দিয়ে হাতে গাল ঠেকিয়ে মুগ্ধ, অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে সে স্নেহার দিকে। স্নেহা একটু হকচকিয়ে উঠে বসে গায়ের ওড়না ঠিক করতে করতে বলল,
“আরে তুমি এখন!”
পাভেল একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্নেহার মুখের উপর এলোমেলো পড়ে থাকা চুলগুলো আঙুলের আলতো স্পর্শে কানের পিঠে গুঁজে দিতে দিতে বলল,
“হ্যাঁ আমি। আমি ছাড়া আর কে আসতে পারে! আমি ছাড়া অন্য কারোর তোর কাছে আসার অনুমতি নেই। আমি তা দিবোনা কখনো। তুই শুধু আমার।”
স্নেহা স্মিথ হাসি টেনে বলল,
“এত সকালে যে! কোনো কাজ ছিলো?”
“হুম কাজতো ছিলো। তোর এই ঘুমন্ত মায়াবী মুখখানা দেখার চেয়ে বড় কাজ কিছু আছে পৃথিবীতে! এটাইতো সবচেয়ে বড় কাজ।আরতো মাত্র কটা দিন। তারপর আর আমাকে এত মেহনত করে এসে দেখতে হবে না। রোজ সকালে তোর এই মায়াবী মুখখানার দর্শন পাবো।তাও নিজের বাহুডোরের মাঝ থেকে।”
স্নেহা একটু লজ্জা পেয়ে মাথা নুইয়ে বলল,
“আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
বলেই উঠে দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে এগুলো সে।পেছন থেকে পাভেল হাসতে হাসতে বলল,
“যা যা, শুধু এই কইটা দিনই একা যাচ্ছিস। এরপরতো দুজন একসাথে যাবো।”

একটু পর স্নেহা ফ্রেশ হয়ে বাইরে এলো।কিন্তু লিভিং রুমের সোফায় দুজন অপরিচিত লোককে বসে থাকতে দেখতে পেল সে। ভালো করে খেয়াল করতেই তার মনে পড়ল লোক দুটো কালকের সেই দুজন যারা সেই পাগল লোকটাকে ধরে সরিয়ে দিয়েছিল। লোকটার বন্ধু নাকি ওনারা। কিন্তু উনারা এখানে কি করছে তা বুঝতে পারল না সে। স্নেহা সামনে আসতেই অপর সোফায় বসে থাকা তার বাবা বলল,
“স্নেহা, উনারা তোর হসপিটাল থেকে এসেছে। তোর সাথে দেখা করতে। জরুরি কথা নাকি আছে। দেখতো কি বলতে চায় উনারা।”
স্নেহা মাথা দুলিয়ে পাশের সিঙ্গেল সোফায় গিয়ে বসলো। পাভেল আর জাকিয়াও সেখানে উপস্থিত ছিলো। স্নেহা বিনম্র সুরে বলল,
“জি বলুন কি বলবেন?”
সামনে বসা আবির আর বিহান একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে প্রথমে আবিরই বলা শুরু করল।
“মিস স্নেহা, আসলে আপনার কাছে আমরা একটা সাহায্যের আশায় এসেছি।”
“কেমন সাহায্য? ”
“আসলে আমার বন্ধুর জন্য সাহায্য চাই আপনার। কালতো আপনি দেখেছেনই অসুস্থ বন্ধুকে। ওর নাম সাদমান শাহরিয়ার আদিত্য। এক নামে তাকে সবাই চেনে। আমার বন্ধু সবসময় এমন ছিলোনা। দুই বছর পূর্বে এক এক্সিডেন্টে সে এমন হয়ে যায়। আসলে ওই এক্সিডেন্টে আদিত্য ওর প্রাণপ্রিয় স্ত্রী নূরকে হারিয়ে ফেলে। আর এই শোকেই আমার বন্ধুর এই অবস্থা হয়েছে। নূরকে সে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো। তার চলে যাওয়া মেনে নিতে পারেনি ও। মানুষিক ভাবে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে ও। এতটাই যে ওকে নিয়ন্ত্রণ করা কারোর জন্য সম্ভব হয়না। ধীরে ধীরে ওর অসুস্থতার মাত্রা আরও বাড়তে থাকে। মানুষিক ভাবে প্রচন্ড হিংস্র আর ক্ষিপ্ত হয়ে যায় সে। অন্য মানুষের সাথে সাথে নিজেকেই নিজে আক্রমণ করে আহত করে ফেলে সে। কতবার নিজেকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে তার হিসাব নেই। নিজেই নিজের জানের দুশমন হয়ে যায় সে। শেষমেশ অবস্থা এমন হয়ে যায় যে ওকে শেকলে বেঁধে রাখতে হয়ে। এখনতো ওর শারীরিক অবস্থা আরও অবনতির পথে। ডক্টর জানিয়েছে ওর স্বাস্থ্যের সাথে সাথে হার্ট দিনদিন দূর্বল হয়ে পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে বেশিদিন ওকে বাঁচানো যাবে না।”
লোকটার সম্বন্ধে সবকিছু শুনে অজান্তেই বুকের মাঝে কেমন হু হু করে উঠল স্নেহার। সে বলল,
“কিন্তু এতে আমি কিভাবে সাহায্য করতে পারবো আপনাদের?”
“আসলে আমরা আদিত্যর সর্বোচ্চ ট্রিটমেন্ট করানোর চেষ্টা করেছি। দেশের বাইরেও নিয়ে গিয়ে বেস্ট সাইকোলজিস্ট দেখিয়েছি। কোনোকিছুতে কোনো সুফল পাইনি। কিন্তু কাল এতদিন পর একটা অদ্ভুত জিনিস দেখেছি আমরা। যা দেখে আমাদের মনে ছোট্ট ক্ষীণ একটু আশা জেগেছে। আদির উপর নজর রাখার জন্য ওর কেবিনে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। কাল যখন ওইভাবে আপনার উপর আক্রমণ করে তারপর আমরা ফুটেজ দেখছিলাম যে আদি কি করছিলো তখন। সেটা দেখতে গিয়েই আমরা খেয়াল করি আদি এই প্রথম কোনো মেয়েকে নূর মনে করেছে। নূর মনে করে খুশিও হচ্ছিল তখন। আপনি ওর ভুল না ভাঙালে হয়তো ও বুঝতেও পারতো না৷ আর না আপনাকে এটাক করতো।”
এই পর্যায়ে পাভেল হঠাৎ তেজী গলায় বলে উঠল,
“এক মিনিট! এটাক করেছিলো মানে! টুনটুনি তোর উপর কেউ এটাক করেছিলো আর তুই এটা বলিসনি আমাকে!”
স্নেহা পাভেলকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলল,
“আরে এটা ওইরকম এটাক না। আসলে আমারই ভুল ছিলো।আমি জানতাম না উনি মানুষিক রুগী।”
স্নেহা সবাইকে তখনকার ঘটনাটা খুলে বলল। মেয়ের কথা শুনে জাকিয়া আতঙ্কিত মুখ করে বলল,
“কি বলিস! এতবড় বিষয় হয়েছে আর তুই আমাদের জানালিনা! এইজন্যই বলছিলাম এসব চাকরি ফাকরি করার দরকার নেই। কিন্তু কেউ শুনলেতো আমার কথা! ”
স্নেহার বাবা সবাইকে আপাতত চুপ থাকতে বলে আবিরদের উদ্দেশ্যে বলল,
“আপনারা আসলে চাচ্ছেনটা কি সেটা বলেন।”
“আসলে আমরা চাচ্ছি, মিস স্নেহা যদি আদির ট্রিটমেন্টে আমাদের একটু সাহায্য করতো তাহলে আদিকে হয়তো সুস্থ করা যেতে পারতো। যেহেতু একবার আদি উনাকে নূর ভেবেছে। তাহলে এমন আবারও ভাবতে পারে। তাই মিস স্নেহা যদি নূর সেজে আদির সামনে যায় তখন আদি শান্ত হয়ে যাবে। তাকে যা বলা যাবে তাই শুনবে সে। আমরা খুব সহজেই তার ট্রিটমেন্ট করাতে পারবো। এবং উপরওয়ালা সহায় হলে আদি হয়তো সুস্থও হয়ে যেতে পারবে। এইজন্য আমরা চাই মিস স্নেহা আদির সামনে নূর হয়ে যাক। প্লিজ আমাদের হেল্প করুন।”
“আবিরের বক্তব্য শুনে স্নেহা বা অন্য কেউ কিছু বলার আগেই জাকিয়া আতঙ্কিত স্বরে বলল,
” কি বলছেন এসব আপনারা! পাগল হয়ে গেছেন আপনারা!একজন উন্মাদ পাগল যে কিনা মানুষ মেরে ফেলে সেই মানুষের সামনে আপনারা আমার মেয়েকে যেতে বলছেন! কিছুতেই না। আমার মেয়ে এমন হিংস্র মানুষের সামনে নিজের ক্ষতি করতে যাবে না।কিছুতেই না।”
এই পর্যায়ে বিহান বলল,
“দেহেন ভয় নাই। আমরা ভরসা দিতাছি উনার কোনো ক্ষতি হইবো না। আমরা সেই খেয়াল রাখুম।”
পাভেল বলে উঠল,
“সে যাইহোক। স্নেহা এমন কোনো কাজ একদমই করবেনা। সে কারোর বউ হয়ে তার সামনে কিছুতেই যাবে না। আপনারা এখন যেতে পারেন।”
বিহান দু হাত জোড় করে করুন সুরে বলল,
“দেহেন প্লিজ আমাদের কথাটা বোঝার চেষ্টা করেন। উনার হেল্প পাইলে আমার বন্ধুডারে বাঁচানোর নতুন আশা পামু। হয়তো ও ভলোও হইবার পারবো। আপনারা যা চাইবেন, যেমতে চাইবেন সব মানমু আমরা। শুধু আমগো একটু হেল্প করেন। আপনাদের সামনে হাত জোড় কইরা কইতাছি প্লিজ রাজি হইয়া যান। মানা কইরেন না। একজন মানুষের জীবন বাঁচানোর মতো কাজে মানা কইরেন না। আপনার একটু সাহায্য ওর জীবন বাঁচাতে পারবো। নাহলে মরে যাবে বেচারা।”
বিহানের কথার পরিপেক্ষিতে পাভেল ক্রুদ্ধ স্বরে বলল,
“মরে গেলে যাক। তাকে বাঁচানোর দায় নিয়ে বসে রইনি আমরা। এমনিতেও এভাবে মরে যাওয়ায়ই ভালো। লেট হিম ডায়।”
পাভেলের এমন কটাক্ষ কথা শুনে রাগে মাথায় আগুন ধরে গেল আবিরের। সে ঝট করে উঠে তেড়ে গিয়ে পাভেলের কলার চেপে ধরে চোখ মুখ অগ্নি রুপ ধারণ করে ক্ষিপ্ত স্বরে,
“হাউ ডেয়ার ইউ! ইউ ব্লাডি….! ভালোভাবে কথা বলছি বলে যা মুখে আসে তাই বলবি! শুধু আমার বন্ধুর জন্য সাহায্য দরকার বলে অসহায়। নাহলে তোর মতো রোড সাইড রোমিওকে রোডেই পুতে ফেলতে জাস্ট এ সেকেন্ডের ব্যাপার আমার জন্য। তুই জানিস না তুই কার সম্বন্ধে কথা বলছিস! তার পরিচয় জানলে কলিজা হাতে চলে আসবে! শুধুমাত্র বন্ধুর ভালোর জন্য রিকুয়েষ্ট করতে এসেছি। নাহলে আমরা যদি পাওয়ার দেখানোতে আসি তাহলে শুধু মিস স্নেহা কেন, সাথে তুই নিজেও এসে আমার বন্ধুর নার্স হওয়ার জন্য পা ধরে কাঁদবি।”
আবিরের প্রতিক্রিয়ায় সবাই একটু ঘাবড়ে গেল। পাভেলও বিপরীতে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চাইলো কিন্তু আবিরের শক্তির সাথে পেরে উঠতে বেগ পেতে হচ্ছে তাকে। এই পর্যায়ে বিহান এগিয়ে এসে আবির ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“শান্ত হ আবির। এসবের সময় না এখন৷ চল এখান থেকে।”
রাগী চাহুনি নিক্ষেপ করে আবির আর বিহান বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। এতকিছুর মাঝে স্নেহা নিশ্চুপ থেকে গেল। এই মুহূর্তে সে কি করবে আসলে বোধগম্যই হলোনা তার৷ সবাই যার যার মতামত বলল। কিন্তু স্নেহার মত কেউই শুনল না৷ সে কি চায় তাতো কেউই জানতে চাইলো না। বাকি সবাই চলে স্নেহার বাবা খেয়াল করল জাকিয়া কেমন অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে তার ভীষণ চিন্তা আর আতঙ্কের ছাপ। স্নেহার বাবা তার সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“কি হয়েছে? এত কি ভাবছ?”
জাকিয়া কেমন ভয়ার্ত চাহুনিতে তাকিয়ে বলল,
“কেন, ভাবনা কি তোমার আসছে না? তোমার মনে কি সেই প্রশ্ন উঠছে না যা আমার মনে উঠছে?”
“আমি জানি তুমি কি ভাবছ। কিন্তু আমার মনে হয়না এমনকিছু। হতে পারে এটা শুধুই কোয়েন্সিডেন্ট। এত ভেবোনা। শুধু শুধু ভয় পেওনা।”
” আমি কি বলি,এই চাকরি টাকরি বাদ দিলে হয়না? কি দরকার করার? যদি মেয়েটার কিছু হয়ে যায়!”
“তুমিতো জানোই এটা আমাদের মেয়ের স্বপ্ন। তুমি অযথা চিন্তা করোনা। কিছু হবে না।”
“তাই যেন হয়।”
__

পরদিন হসপিটালে এসে কাজে নিয়োজিত হয়ে গেল স্নেহা। কাজ করার মাঝেই একসময় আদিত্যর কেবিনের সামনে দিয়ে যেতে নিয়েই হঠাৎ থেমে গেল সে। কি যেন মনে করে সেদিকে এগিয়ে গেল স্নেহা। জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে আদিত্যকে দেখার চেষ্টা করল সে। দেখতে পেল আদিত্য ফ্লোরে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। মেঝেতে একটা মেয়ের অবয়ব খোদাই করে আঁকানো। আদিত্য সেই অবয়বের উপর নিজের গাল ঠেকিয়ে শুয়ে আছে। আঁকানো অবয়বের উপর এক হাত বুলিয়ে বুলিয়ে আদুরে গলায় বলছে,
“এঞ্জেল, আমার এঞ্জেল! কত সুন্দর আমার এঞ্জেল! কত সুন্দর তার হাসি! কত নিস্পাপ সেই হাসি! এঞ্জেল, জলদি আসোনা আমার কাছে। তোমার হিরোর কাছে আসো। আর কতো দূরে থাকবা! আচ্ছা না এলা। আমিই তোমার কাছে আসছি৷ খুব জলদিই চলে আসছি তোমার কাছে। তারপর আমরা একসাথে থাকবো। কখনো আলাদা হবে দিবোনা।”
আদিত্যর এই নিদারুন পরিণতি দেখে অজান্তেই স্নেহার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। অন্তর্দেশের কোনো কোণে চিনচিন ব্যাথার অনুভবও হলো যেন৷ একটা মানুষ এতটা কাউকে কিভাবে ভালোবাসতে পারে! এমন করে ভালোবাসা কি সম্ভব! কত সৌভাগ্যবান সেই নারী যাকে উনি এতটা ভালোবাসেন! স্নেহা সরে এলো ওখান থেকে।নিজের কাজের প্রয়োজনল ডক্টরের কেবিনে যেতে নিলেই কেবিনে আবির আর বিহানকে বসে থাকতে দেখল সে। দরজার বাইরে থেকে সে শুনতে পারল ডক্টরের বলা কথাগুলো। তিনি বলছেন,
“মিঃ আদিত্যর রিপোর্ট ভালো না। কন্ডিশন আরও খারাপ হচ্ছে। উনার বডি যেন ধীরে ধীরে নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে মনে হয়না বেশিদিন সার্ভাইব করতে পারবেন উনি।”
ডক্টরের কথা শুনে যেন আর বসে থাকতে পারলোনা আবির। উঠে বেড়িয়ে এলো কেবিন থেকে। তাকে আসতে দেখে স্নেহা দ্রুত আড়াল হয়ে গেল। আবির বাইরে এসে হাত মুঠো করে মুখের উপর ধরল। বিহানও দ্রুত এলো আবিরের পিছে। আবিরের কাছে আসতেই আবির তাকে জাপ্টে ধরে কেঁদে উঠল। করুন সুরে বলল,
“আমরা কিছুই করতে পারলাম না বিহান। কিছুই না। ওকেও হারিয়ে ফেলব এখন আমরা এখন।”

স্নেহা হঠাৎ ওদের সামনে এগিয়ে গেল। তারপর বলল,
“আমি রাজি। আপনাদের সাহায্য করতে রাজি আমি।”

চলবে………