মরুর বুকে বৃষ্টি ২ পর্ব-২৬+২৭

0
214

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি (S-2)
পর্ব-২৬
®মেহরুমা নূর

★ফ্লোরে আঁকানো নূরের মুখয়বের সাথে লেপ্টে মিশে আছে আদিত্য। মনের জগতে অনুভব করছে শুধুই নূরকে। বিলীন হওয়ার যাত্রায় সে। তার এই যাত্রার মাঝেই হঠাৎ খুট করে দরজা খুলে ধীর পায়ে প্রবেশ করল কারো কদম। নুপুরের রুনুঝুনু বাদ্য ছড়াল তার কদমের সাথে। আদিত্য তখনও তার নূরের মাঝে বিলুপ্ত। তার হুঁশ নেই আর কিছুতে। তবে আদিত্য প্রতিক্রিয়া দেখায় যখন সামনে থেকে কেউ ডাকে,”হিরো…”। অচেতন প্রায় পড়ে থাকা আদিত্যর শরীর যেন প্রতিক্রিয়াশীল হয়। দূর্বল শরীরে মাথাটা ধীরে ধীরে তুলে সামনে তাকায় সে। তাকাতেই তার চোখে মুখে এক অসামান্য খুশির প্রভাব দেখা যায়।যেন হাজার, লক্ষ জনম ধরে যার অপেক্ষায় তৃষ্ণার্ত ছিলো মন, তাকেই যেন আজ সম্মুখে দেখতে পেল সে। চোখে মুখে সেই খুশির খেয়া ধীরে ধীরে ছেয়ে গেল। হাতে ভর দিয়ে পড়িমরি করে দ্রুত উঠতে নিলো আদিত্য।দূর্বল শরীরে তাড়াহুড়ো করে উঠতে নিয়ে পড়ে গেল সে। তাতেও সময় ব্যায় না করে অতি দ্রুত ধড়ফড়িয়ে আবারও উঠল সে। হাত পায়ের শেকলের ভার বয়ে নিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে সামনের দিকে দৌড়াল মুখে নিয়ে অসামান্য খুশির হাসি। কিন্তু শেকলের দৈর্ঘ্য কম থাকায় কাঙ্খিত ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলোনা। আদিত্য হাত পা টেনে যেন শেকলই ছিঁড়ে ফেলবে এবার। কিন্তু তার সংঘর্ষের সমাপ্তি ঘটিয়ে সামনের মানবীটি নিজেই এগিয়ে এলো আদিত্যর কাছে। মিষ্টি করে হেঁসে বলল,
“হিরো..দেখো এসে গেছে তোমার এঞ্জেল!”
আদিত্য অশ্রুসজল র,ক্তিম চোখ আর ঠোঁটে হাসি সাজিয়ে দুই হাতের মাঝে জাপ্টে ধরল মানবীর মুখখানা। পাগলের মতো হাত বুলিয়ে তাকে দেখতে দেখতে কান্না আর খুশি মিশ্রিত গলায় বলল,
“এঞ্জেল! আমার এঞ্জেল! তুমি এসে গেছ এঞ্জেল! এসে গেছ তোমার হিরোর কাছে!”
বলতে বলতে তাকে বুকের মাঝে জাপ্টে ধরে বলতে লাগল,
“এত দেরি করলা কেন এঞ্জেল! তোমার হিরোকে কতো অপেক্ষা করালে!”
স্নেহার হৃদপিণ্ডে আবারও সেই অজানা সমীকরণের সৃষ্টি হলো। যা সেই প্রথমবারও হয়েছিল। চোখের কোন অজান্তেই ভারী হয়ে গেল। এটা কি সহানুভূতি নাকি অন্যকিছু তার মধ্যে বৈষম্য করতে অক্ষম এমুহূর্তে সে। শুধু মনে হচ্ছে এই মানুষটার কষ্ট তাকে খুব করে ব্যাথিত করছে। তাইতো তাকে এই অবস্থা থেকে ভালো করতে স্নেহা আজ নূরের স্থান নিয়েছে। কেন যেন হঠাৎ সে বাকি সবার কথা ভুলে নিজের মন যা বলছিল সেটাই করেছে। কোনোকিছু না ভেবে সে রাজি হয়ে গিয়েছে হেল্প করতে। যা করতে তার মন খুব করে বাধ্য করেছে। হ্যাঁ, সেই নূর সেজে এসেছে আজ আদিত্যর সামনে। আবির আর বিহান তাকে সব শিখিয়ে দিয়েছে। নূরের আচার-আচরণ, কথা-বার্তা,পোশাক-পরিধান এসব বিষয়ে যতটা সম্ভব বুঝিয়ে দিয়েছে। নূরের মতো করে পোশাক পড়ে এসেছে আজ সে। এবং তার মতো করেই কথা বলছে। প্রথমে ভয় পাচ্ছিল যদি তাকে নূর না ভেবে। তবে এখন ভয়টা কম লাগছে। লোকটা তাকে আজও নূর ভেবেছে। হয়তো উনার বন্ধুদের উপায় সত্যি কাজে দিবে। স্নেহা চোখের পানি মুছে নিজেকে নূরের রুপে ফিরিয়ে এনে মাথা উঠিয়ে মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলল,
“হ্যাঁ হিরো,আমি এসে গেছি এই দেখো। আর যাবোনা কোথাও।”
আদিত্য পাগলের মতো বলল,
“আমি যেতেও দেবোনা কোথও। এইযে শেকলের সাথে তোমাকে আমার সাথে বেঁধে রাখব। কোথাও যেতে পারবেনা।”

দরজা দিয়ে আবির আর বিহান প্রবেশ করল।তাদের দেখে আদিত্য বিস্তর হাসিমুখে বলল,
“বিহান,আবির তোরা দেখেছিস আমার নূর, আমার এঞ্জেল এসেছে। আয় আয় দেখ তোরা দেখ দেখ। আমি না বলেছিলাম আমার এঞ্জেল আসবে! দেখলিতো এখন! আমার এঞ্জেল তার হিরোর কাছে ঠিকই চলে এসেছে।”
আবির, বিহান জোরপূর্কব হাসিমুখ করে বলল,
“হ্যাঁ হ্যাঁ আদি তুই ঠিকই বলেছিলি। ভাবি সত্যিই এসেছে। এখনতো তোকে সুস্থ হতে হবে তাইনা! নাহলে কিন্তু ভাবি তোর মতো এমন মরা ধরা মানুষের কাছে থাকতে চাইবে না। আবার চলে যাবে।”
আদিত্য স্নেহার হাত বুকের সাথে এটে ধরে বলল,
“না না না,একদম যাবে না আমার এঞ্জেল। আদিত্য ভালোতো। একদম অসুস্থ না। আমার এঞ্জেল এসেছে আর কোনো অসুখ নেই।”
“তাহলে কিন্তু আমরা যা বলবো তাই শুনতে হবে। শুনবি তো!”
“হ্যাঁ, শুনবো তো। সব শুনব।”
“ঠিক আছে, তাহলে খাবার খেয়ে ওষুধ খেয়ে নে ভালো ছেলের মতো।”
নার্স খাবারের ট্রলি ঢেলে ভেতরে নিয়ে এলো। আদিত্য স্নেহার হাত বুকের সাথে এটে ধরেই বসে আছ বেডের উপর। নার্স খাবার দিয়ে চলে গেলে আবির খাবার নিয়ে আদিত্যকে খাওয়াতে চাইলে আদিত্য বলল,
“না, খাবো না।”
“কেন? এই না বললি সব কথা মানবি!”
“আরে আমি আগে কি করে খাবো! আগেতো এঞ্জেলকে খাইয়ে দিতে হবে না! তোরা জানিস না এঞ্জেল আমার হাতে ছাড়া খায় না! দে, আগে ওকে খাইয়ে দেই। তারপর খাবো।”
আদিত্য আবিরের হাত থেকে খাবারের বোলটা ছোঁ মেরে নিজের হাতে নিয়ে নিলো। তারপর চামচে খাবার তুলে স্নেহার মুখের সামনে ধরে বলল,
“নাও এঞ্জেল খাও। তোমার অনেক খিদে লেগেছে তাইনা! তুমি খাও আগে।”
স্নেহার চোখ আবারও ছলছল হয়ে উঠল। এমন মানুষিক ভাবে অসুস্থ অবস্থায়ও সে শুধু তার এঞ্জেলের কথাই ভাবছে। এতটা ভালোবাসা কি আদৌও সম্ভব! আবির স্নেহার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় বুঝাল খেয়ে নিতে। স্নেহা আদিত্যর এগিয়ে দেওয়া চামচের খাবারটুকু মুখে নিলো। তারপর চামচটা হাতে নিয়ে বলল,
“আমার পেট ভরে গেছে হিরো। এবার তুমি খাও নাহলে কিন্তু আমি রাগ করব!”
“না না, রাগ করোনা। আমি খাবোতো। এই দেখ আ…”
আদিত্য বাচ্চাদের মতো করে মুখ হা করে দেখালো। স্নেহা চামচে খাবার তুলে আদিত্যর মুখের সামনে ধরলে আদিত্য ভদ্র ছেলের মতো খেয়ে নিলো। খাওয়া শেষে বিহান আদিত্যর ওষুধ এগিয়ে দিলো স্নেহার হাতে। স্নেহা সেটাও আদিত্যকে খাইয়ে দিলো।এতকিছুর মাঝে আদিত্য স্নেহার হাত ছাড়লনা কিছুতেই।একটা হাত সেই তখন থেকেই জাপ্টে ধরে আছে বুকের সাথ। স্নেহা বলল,
“এবার তুমি একটু রেস্ট করো হ্যাঁ! ”
আদিত্য তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,
“না না, আমি শুবো না। আমি ঘুমালে তুমি যদি আবার চলে যাও! আমি ঘুমাবোনা কিছুতেই।”
“না না, আমি এখানেই আছি তোমার পাশে৷ কোথাও যাচ্ছি না। তুমি শুয়ে থাকো।”
“তাহলে তুমিও শোও আমার সাথে। আমার বুকে মাথা রেখে শোও আগের মতো!”
স্নেহা একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। যতোই হোক লোকটাতো পরপুরুষ। এভাবে তার সাথে শোওয়া বেমানান দেখায়। কিন্তু লোকটাতো কোনোকিছু বোঝার পরিস্থিতিতে নেই। স্নেহার দ্বিধা বুঝতে পারছে আবির, বিহান। তবুও বন্ধুর জন্য তারা করুন চোখের ইশারায় স্নেহাকে অনুরোধ করল আদিত্যর কথা মানতে। স্নেহা অগত্যা মানা করতে পারলোনা। আবির,বিহান বাইরে চলে গেল। আদিত্য বিছানায় শুয়ে স্নেহাকে কাছে টেনে এনে তার মাথাটা নিজের বুকে রাখল। তারপর হাত দিয়ে স্নেহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। যেন তাকেই ঘুম পারাচ্ছে আদিত্য। প্রথমে জড়তা আর অস্বস্তি কাজ করলেও আদিত্যর বুকে মাথা রাখতেই ধীরে ধীরে কেমন যেন অজানা এক প্রশান্তি ছেয়ে গেল তার মাঝে। যেন খুব চেনা এই প্রশান্তি। হৃদয়ের খুব কাছের যেন লোকটার বুকের এই উঞ্চতা। হৃদপিণ্ড শীতল হয়ে যাচ্ছে কেমন। নিজের অজান্তেই স্নেহা কখন যেন নিজে থেকেই আদিত্যর বুকে আরও নরম হয়ে মিশে তা জানলোই না। এত শান্তি অনুভব কেন হচ্ছে তার! মনে হচ্ছে এটাই বুঝি সবচেয়ে শান্তির জায়গা তার। যেখানে সে অনন্তকাল কাটিয়ে দিতে পারবে অনায়াসে। আদিত্যকে ঘুম পারানোর উদ্দেশ্য থাকলেও কখন যে নিজেই প্রশান্তিতে চোখ বুজে ফেলে তা বুঝতেই পারলনা স্নেহা।নেত্রপল্লব বুজতেই চোখের কোন বেয়ে উষ্ণ এক ফোটা জল টুপ করে পড়ল। প্রায় আধাঘন্টা পর হঠাৎ সম্ভূতি ফিরল স্নেহার। নিজের অবস্থান দেখে ভীষণ অবাক হলো সে। এভাবে কিভাবে ঘুমিয়ে গিয়েছিল সে! মাথা তুলে দেখলো আদিত্য ঘুমিয়ে গেছে। কেমন অসামান্য মায়া ওই মুখটাতে খুঁজে পেল সে। এইযে রোগাটে, চোয়াল ভাঙা, চুল-দাড়িতে ভর্তি মুখটা।এমন বেহাল মুখটাতেও যেন এক অদ্ভুত মায়া ঝলকাচ্ছে। স্নেহার চোখ যেন আটকেই গেল তাতে। লোকটার মাঝে কি এমন আছে! কেন এত অজানা অনুভব ছড়াচ্ছে তাকে ঘিরে! যেন হৃদকম্পন করা অনুভব। এমনটা কেন হচ্ছে এই অপরিচিত একটা লোকের জন্য! এতসব প্রশ্নের কোনো উত্তর আপাতত জানা নেই স্নেহার। অগত্যা ফোৎ করে শ্বাস ছেড়ে আস্তে করে আদিত্যর হাতের বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে বসল স্নেহা। আদিত্যর ওষুধের সাথে ঘুমের ওষুধ দেওয়া আছে। সে জানে আদিত্য আজ আর উঠবে না। তাই বিছানা থেকে নেমে বাইরের দিকে এগুলো সে। যেতে যেতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে আরেকবার দেখল আদিত্যকে। তারপর বেড়িয়ে গেল। কিন্তু দরজার বাইরে আসতেই থতমত খেয়ে গেল স্নেহা। কারণ বাইরে পাভেল চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারল সে সব দেখেছে। পাভেল চোয়াল শক্ত করে আঙুল তুলে স্নেহার উদ্দেশ্যে কিছু বলতে যাবে তার আগেই স্নেহা বলে উঠল,
“এটা হসপিটাল। সিনক্রিয়েট করার দরকার নেই। বাসায় গিয়ে যা বলার বোলো।”
পাভেল দাঁত কিড়মিড় করে স্নেহার হাত খপ করে ধরে টান দিয়ে নিজের সাথে নিয়ে গেল।

বাড়িতে এসেই পাভেল স্নেহার হাত ধরে এক প্রকার ছুঁড়ে মারল সামনে। স্নেহা পড়তে পড়তে বাঁচল প্রায়। এসব দেখে স্নেহার মা-বাবা চিন্তিত ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো। উদ্বেগ প্রকাশ করে জাকিয়া বলল,
“কি হয়েছে? এমন করছ কেন?”
পাভেল চোয়াল শক্ত করে বলল,
“তা আপনার মেয়েকেই জিজ্ঞেস করুন! আপনার মেয়ে অনেক ইনডিপেন্ডেট হয়ে গেছে। কারোর মতামতের ধার ধারে না সে। তাইতো আমাদের সবার বিরুদ্ধে গিয়ে সে ওই পাগলের বউয়ের অভিনয় করতে রাজি হয়ে গেছে। ইভেন আজ সে তার কাজ শুরুও করে দিয়েছে। আমি না গেলে হয়তো আজ তিনি বাসায়ই আসতেন না। ওখানেই ওই পাগলের সেবা করতে থেকে যেতেন।”
জাকিয়া বিস্মিত কন্ঠে মেয়ের উদ্দেশ্যে বলল,
“কিরে স্নেহা! পাভেল কি বলছে! তুই সত্যিই ওই কাজে রাজি হয়ে গেছিস?”
স্নেহা মাথা দুলিয়ে সম্মতি স্বরুপ দেখালো। জাকিয়া বলল,
“কিন্তু কেন? তুই কি জানিস না, ওই ভয়ংকর লোকটার কাছাকাছি যাওয়া কতটা ক্ষতিকর হতে পারে তোর জন্য! সে একটা হিংস্র, উন্মাদ পাগল। যেকোনো সময়, যেকাউকে মেরে ফেলতে পারে সে। আর তুই জেনেশুনে এমন ব্যক্তির সামনাসামনি থাকতে চাস!”
স্নেহা মায়ের হাত ধরে শান্ত সুরে বলল,
“দেখো মা আমি জানি তোমরা আমার জন্য চিন্তা করছ। কিন্তু বিশ্বাস করো আমার কিছু হবে না। আর তাছাড়া আমি একজন নার্স। আর নার্সের কাজই রুগীর সেবা করা। সে যেমন রুগীই হোক৷ তাকে ভালো করার দায়িত্ব ডক্টরের সাথে সাথে একজন নার্সেরও থাকে। আর তোমরা আমাকে নিশ্চয় দায়িত্ব থেকে সরে আসতে শেখাওনি! তাই আমাকে আমার দায়িত্ব পালন করতে দাও। আমার উপর নিশ্চয় বিশ্বাস আছে তোমাদের! আমার বিশ্বাস থাকলে তাহলে আর কোনো দ্বিমত করবে না।শুধু ভরসা রাখো তোমার মেয়ের উপর। সব ঠিক হবে। আমি এখন রুমে যাই ফ্রেশ হবো। তুমি খাবার বাড়ো কেমন! অনেক ক্ষুধা লেগেছে।”
বলেই স্নেহা নিজের রুমের দিকে চলে গেল। স্নেহা যাই বলুক তাতে জাকিয়ার অশান্ত মন শান্ত হচ্ছে না। কোনো এক ভয়ে তার মন মস্তিষ্ক আতঙ্কিত হচ্ছে। অন্যদিকে স্নেহার কথাবার্তায় পাভেলেও ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে। সে মনে মনে পরিকল্পনা করছে জলদিই তাকে কিছু করতে হবে নাহলে স্নেহা হাতছাড়া হয়ে যাবে। সে জানে কি করতে হবে তাকে।
__

রাত তখন একটা বাজতে চলেছে প্রায়। স্নেহার চোখে মাত্রই ঘুমের লেশ লেগেছিল। যদিও বিছানায় অনেক আগেই শুয়েছে সে। তবে কেন যেন ঘুম ধরছিল না। বারবার আদিত্যর খেয়াল আসছিল শুধু। তার বুকে মাথা রেখে ওই মুহুর্তটা স্নেহাকে প্রচুর ভাবান্তর করে দিচ্ছিল। এসব ভাবতে ভাবতেই অনেকটা সময় চলে যায়। যখন একটু ঘুমের দেখা পায় তখনই হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে তার। ঘুম ভেঙে যায় স্নেহার। ফোন হাতে নিয়ে দেখে অপরিচিত নাম্বার। কপাল ভাজ করে ফোন রিসিভ করে ধরতেই ওপাশ থেকে আবিরের উদ্বেগ ভরা উত্তেজিত কন্ঠ শোনা যায়,
“হেলো মিস স্নেহা! আমি আবির বলছি। আম সো সরি আপনাকে এত রাতে ডিস্টার্ব করছি। বাট, সিচুয়েশনই এমন হয়েছে যে আর কোনো উপায় ছিলো না।”
“হয়েছেটা কি?”
“আসলে আদি হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে যায়।আর আপনাকে পাশে না পেয়ে প্রচন্ড ভায়োলেন্ট হয়ে গেছে। ওকে কিছুতেই কন্ট্রোল করা যাচ্ছে না। দেয়ালের সাথে মাথা ঠুকে র,ক্ত বের করে ফেলেছে। আর চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে শুধু তার এঞ্জেলকে ডাকছে। এখন শুধু আপনিই পারবেন ওকে শান্ত করতে। আপনাকে দেখেই ও শান্ত হবে। নাহলে মাথা ফাটিয়ে নিজেকেই মেরে ফেলবে ও। প্লিজ মিস স্নেহা আপনি এখন একটু আসুন! জানি এভাবে এত রাতে আপনাকে এটা বলা শোভনীয় দেখায় না৷ কিন্তু আমরা হেল্পলেস। এখন আপনিই একমাত্র পারবেন ওকে বাঁচাতে। প্লিজ আসুন। বিহান গাড়ি নিয়ে আপনার বাসার সামনে পৌঁছে গেছে। আপনি বের হলেই নিয়ে আসবে।”
আদিত্যর অবস্থার কথা জেনে স্নেহার যেন বাকি কোনোকিছুর আর খেয়াল থাকলো না। বুকের ভেতরটা অশান্ত হয়ে উঠল। সে দ্বিতীয় কোনো।চিন্তা ছাড়াই বলে উঠল,
“আমি আসছি।”
ফোন কেটে তড়িঘড়ি করে বিছানা হাতড়ে শুধু গায়ের ওড়নাটা হাতে নিয়ে গায়ে জড়াতে জড়াতে দৌড়ে বাইরে বেড়িয়ে গেল। গেটের বাইরে আসতেই বিহানকে গাড়ি নিয়ে থাকতে দেখা গেল। স্নেহা গিয়ে গাড়িতে বসতেই গাড়ি স্টার্ট দিলো বিহান। ফুল স্পিডে চালিয়ে স্নেহাকে নিয়ে আবির পৌঁছাল হসপিটালে। গাড়ি থামতেই স্নেহা দ্রুত নেমে পাগলের মতো দৌড়ে ছুটলো ভেতরে। আদিত্যর কেবিনে পৌঁছাতেই দেখলো আবিরসহ আদিত্যকে চারপাঁচ জন লোক ধরে রেখেও আয়ত্ত করতে পারছে না তাকে। ক্ষেপা বাঘের মতো গর্জে যাচ্ছে সে। মাথা কপাল র,ক্তে ভিজে গেছে। তার এই অবস্থা দেখে যেন স্নেহার বুকের মাঝে মুচড়ে উঠল অজান্তেই। তার ব্যাথায় যেন সেও ব্যাথিত হচ্ছে। স্নেহা দ্রুত এগিয়ে গেল তার সামনে। স্নেহাকে দেখামাত্রই আদিত্যর হাইপারনেস কমে এলো সহসাই। হিংস্র মুখটায় পরিবর্তন ঘটলো তখনই। স্নেহা চোখের ইশারায় সবাইকে বলল আদিত্যকে ছেড়ে দিতে। সবাই ছেড়ে দিতেই আদিত্য তড়িৎ গতিতে দুই হাতে স্নেহার মুখটা ধরে খুশিময় হেঁসে করুন স্বরে বলল,
“এসে গেছ এঞ্জেল! তুমি কোথায় চলে যাও বারবার ? জানো না তোমাকে ছাড়া আমার ভালো লাগে না! তুমি না বলেছিলে আমার পাশেই থাকবে! তাহলে চলে গেলে কেন?”
“সরি হিরো ভুল হয়ে গেছে। আর যাবোনা। কিন্তু তুমি একি করেছ! নিজেকে এভাবে আঘাত কেন করেছ! এমন করলে কিন্তু আমি রাগ করে আর থাকবোনা তোমার কাছে।”
আদিত্য ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
“না না রাগ কোরোনা এঞ্জেল। আর করবোনা প্রমিজ! শুধু তুমি যেওনা আমাকে ছেড়ে।”
“আচ্ছা যাবোনা। আসো বসো এখন।”
স্নেহা আদিত্যকে বেডে বসিয়ে ওর কপালের রক্ত মুছে ব্যান্ডেজ করে দিলো। তারপর একটা এন্টিসেপ্টিক ইনজেকশন পুষ করে দিলো। আবির আর বিহান ছাড়া বাকি সবাই বেড়িয়ে গেল ততক্ষণে। আদিত্য স্নেহাকে এক হাতে পেচিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আর যাবেনা আমার কাছ থেকে হ্যাঁ! এভাবেই থাকবে।”
কিন্তু আদিত্যর কেমন যেন অসুবিধা বোধ হচ্ছে সে বিহানদের উদ্দেশ্যে বলল,
“এই বিহান, আমার হাত পায়ের এসব খুলে দেনা। আমি এঞ্জেলকে ভালোভাবে বুকে নিতে পারছিনা। আর ও ব্যাথা পাবে এগুলোতে। খুলে দে। এসব কেন পাড়িয়ে রেখেছিস আমাকে! আমি কি পাগল নাকি!”
এমন একটা সিরিয়াস ভারাক্রান্ত সিচুয়েশনেও হঠাৎ এমন কথায় হাসি পেল আবির আর বিহানের। আবির মজার সুরে বলল,
“না না তুই কেন পাগল হবি! পাগলতো তোর খালা শাশুড়ির গুষ্টি। আর এগুলো লেটেস্ট ফ্যাশন আদি। স্পেশালি তোর জন্য জাস্টিন বিবারের কাছ থেকে ধার আনছি।”
“সে যাইহোক। এগুলো খুলে দে।”
আবির, বিহান একটু চিন্তায় পড়ে গেল। শেকল খুলে দিলে আবার কাউকে হার্ম না করে বশে। স্নেহা চোখের ইশারায় বুঝাল খুলে দিতে। আবির আর বিহানও অগত্যা ওকে শান্ত রাখতে শেকলগুলো খুলে দিলো। স্নেহা খেয়াল করলো শেকল বেধে রাখায় আদিত্যর হাতে পায়ে কেমন কালো জখমের দাগ হয়ে গেছে। কতটা কষ্ট হয়েছে তার। আবারও যেন চোখ ভিজে উঠল তার। তবে আদিত্যর অগোচরেই দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো সে। আদিত্য আবিরদের উদ্দেশ্যে বলল,
“কিরে তোরা দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা বাইরে যা। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে!”
আবির বিড়বিড় করে বলল,
“যাতে মাতাল তালে ঠিক।”
বলতে বলতে বেড়িয়ে গেল ওরা। আদিত্য স্নেহাকে টেনে নিজের বুকের মাঝে নিয়ে বলল,
“হ্যাঁ এখন এভাবেই থাকো আমার বুকের মাঝে। কোথাও যাবে না।”
স্নেহা আবারও খুঁজে পেল সেই প্রসন্নতা। এউ উষ্ণতার মাঝে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে তার খুব করে। এ কেমন আগ্রাসনে খিঁচে যাচ্ছে সে!

চলবে…..

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি (S-2)
পর্ব-২৭
®মেহরুমা নূর

★উষ্ণ আলিঙ্গনের সান্নিধ্যে নিজেকে আরও নিবিড় ভাবে মিশিয়ে নেওয়ার চাহিদায় ঘুমের মাঝেই স্নেহা আদিত্যর বাহুবন্ধনে নিজেকে আরও বেশি করে নিলো। যেন বুকের চাদরে মুড়িয়ে নেওয়ার অদম্য চাওয়া। দু’হাতে জড়িয়ে উষ্ণ বুকটাতে বিড়াল ছানার মতো নাক,মুখ ঘষে আরও লেপ্টে গেল তার সাথে। হঠাৎ হুঁশ এলো স্নেহার। ফট করে চোখ খুলে তাকালো সে। নিজেকে আদিত্যর বাহুবন্ধনে এভাবে নিজ থেকে লেপ্টে থাকতে দেখে ঝট করে উঠতে চাইলো সে। তবে আদিত্যর হাতের বন্ধনে আটকে গেল সে। সাবধানে হাতের বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে বসলো স্নেহা। কেমন অদ্ভুত লজ্জা কাজ করতে লাগল তার মাঝে। কিভাবে সে লোকটার সাথে ওমনভাবে আলিঙ্গন করে শুয়ে ছিলো ভাবতেই ভীষণ লজ্জা লাগছে তার। ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখলো সকাল ছয়টা বেজে গেছে। আদিত্য এখন ঘুমে। তখন ঘুমের ইনজেকশনও দেওয়া হয়েছিল তাকে। এখন আর সময়ের আগে জাগবে না সে। স্নেহা ভাবলো এই সুযোগে বাসায় গিয়ে ঘুরে আসতে হবে। বাসায় নিশ্চয় ওকে না পেয়ে চিন্তা করবে। যদিও আসার পর সে ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিয়েছিল যে,”ইমার্জেন্সি পড়ায় ওকে হসপিটালে আসতে হয়েছে।” তবুও একবার বাসায় না গেলে ওর মা অযথ চিন্তা করবে। তাই আদিত্যকে রেখে সে আপাতত বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সাতটা বেজে গেল। বাসায় এসে খানিকটা অবাকই হলো স্নেহা। সে ভেবেছিলো ওভাবে মাঝরাতে যাওয়ার জন্য নিশ্চয় বকা খেতে হবে মায়ের কাছে। কিন্তু এখনেতো সব উল্টোই দেখা যাচ্ছে। আর কিছুটা অন্যরকমও। পুরো বাড়িতে কেমন যেন তোড়জোড় চলছে। সবাই কেমন নানান কাজে ব্যস্ত। মা রান্নার কাজে লেগে আছে। স্নেহা মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“মা এসব কি? সকাল সকাল এত তোড়জোড় কিসের? ”
জাকিয়া কাজ করতে করতেই বলল,
“এত কথা বলার সময় নেই এখন আমার। তুই যা, রুমে ফ্রেশ হয়ে একটু ভালো কাপড়চোপড় পড়ে থাক।”
স্নেহা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কেন? ভালো কাপড়চোপড় পড়ব কেন? কি হচ্ছে বলবা আমাকে!”
“এখন কি তোর জবাবদিহি না করা পর্যন্ত আমার কথা মানবি না নাকি?”
“আরে তা কখন বললাম! রেগে যাচ্ছো কেন? আচ্ছা ঠিক আছে যাচ্ছি।”
মায়ের হঠাৎ এমন আচরণের আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না সে। কেমন যেন খটকা লাগছে তার। কিছুতো একটা চলছে এখানে যা সে জানে না। বাইরে আসতেই সামনে ছোট ভাইকে পেল সে। তাকে ডেকেই জিজ্ঞেস করল,
“এই কি হয়েছে বাড়িতে? এত আয়োজন কিসের চলছে?”
স্নেহার ভাই চরম বিরক্ত প্রকাশ করে বলল,
“আমি কি জানি! আমার কি কোনো দাম আছে এই বাড়িতে! পিঁপড়ার পটি সমান দামও নেই! বাড়ির এতবড় একটা জেন্টলম্যানকে কেউ দামই দেয়না! মানবতা আজ কোথায়!”
স্নেহা ভাইয়ের আপসোসপূর্ণ বক্তব্য শুনে স্মিথ হাসলো। পাকনা ভাইটার চুলগুলো নেড়ে দিয়ে নিজের রুমের দিকে গেল সে। বুঝতে পারল এখন আর কিছু জানা হবে না তার। তাই আপাতত রুমে এসে কাপড়চোপড় নিয়ে গোসলে ঢুকলো সে। দশটার দিকে আদিত্যর জ্ঞান ফেরার সময় হবে। তার আগেই ওকে আবার হসপিটালে পৌঁছাতে হবে। তাই দ্রুত সব নিত্যকাজ শেষ করতে লেগে পড়ল সে। গোসল শেষ করে এসে একটা সেলোয়ার-কামিজ পড়ে বের হলো সে। আয়নার সামনে এসে চুল মুছতে তার মা এসে চড়া গলায় বলল,
“আরে তোকে আমি কি বললাম! ভালো কাপড়চোপড় পড়তে বললাম না!”
স্নেহা মায়ের পানে ঘুরে তাকিয়ে বলল,
“তো এতে খারাপ কি আছে! ভালোইতো এটা।”
জাকিয়া স্নেহার কাবার্ড খুলে সেখান থেকে পার্পল কালারের একটা সিল্কের শাড়ি বের করে স্নেহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এই নে,এটা পর।”
“শাড়ি! শাড়ি কেন পড়ব সকাল সকাল? আমাকে একটু পর হসপিটালে যেতে হবে। শাড়ি পরে হসপিটালে যাবো!”
“এতকিছু আমি জানি না। পড়তে বললাম পড়। পড়ে রেডি হয়ে আয়।”
স্নেহাকে আর দ্বিতীয় কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল ওর মা। স্নেহা অগত্যা মায়ের কথা রাখতে শাড়িই পড়ে নিলো। শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে একটু পর রুমের বাইরে আসলো সে। ড্রইংরুমে আসতেই থতমত খেয়ে গেল স্নেহা। সামনে সোফায় পাভেল বসে আছে। শুধু বসে নেই, অনেকটা ফর্মাল ড্রেসআপে পরিপাটি হয়ে বসে আছে। সাথে তার বাবা-মা সহ পরিবারও এসেছেন। সবাই কেমন আনুষ্ঠানিক আঙ্গিকে পোশাক পরিধান করে আছে। স্নেহার কেমন যেন সব সন্দেহজনক লাগছে। সে বলতে যাবে কিছু তার আগেই পাভেলের মা অমায়িক হাসি টেনে স্নেহার কাছে এসে তাকে ধরে বলল,
“আরে এসেছ তুমি! বাহ! কত সুন্দর লাগছে তোমাকে এই শাড়িতে! আসো বসো।”
বলতে বলতে পাভেলের মা স্নেহাকে নিয়ে এসে পাভেলের পাশে বসিয়ে দিলো। হাসিমুখে বলল,
“বাহ! কত সুন্দর মানিয়েছে দুজনকে।আমরাতো কবে থেকে এই দিনের অপেক্ষা করছিলাম। আজ এনগেজমেন্ট হয়ে গেলে বিয়ের ডেটও জলদি বের করে ফেলবো।”
স্নেহা যেন হতভম্ব হয়ে গেল।বিস্মিত চোখে তাকালো তার মায়ের দিকে।এবার যেন তার কাছে সবটা ক্লিয়ার হয়ে গেল। সকাল থেকে তাহলে এসবেরই আয়োজন চলছিল! এনগেজমেন্ট! তার এনগেজমেন্ট হবে এ কথা তাকে কেউ জানানো জরুরি মনে করল না! স্নেহা কিছুটা বিভ্রান্ত কন্ঠে বলে উঠল,
“এক মিনিট! কি হচ্ছে এসব! হঠাৎ করে এনগেজমেন্টের কথা কোথা থেকে এলো! আর আমাকে কেউ জানালোনা কেন এই বিষয়ে! মানে আমার এনগেজমেন্ট আর আমিই জানি না! আর হুট করে এনগেজমেন্টের আয়োজনই বা কেন হচ্ছে তাইতো বুঝতে পারছি না! ”
জাকিয়া মেয়েকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই পাভেল বলে উঠল,
“আসলে এসব আমারই আইডিয়া ছিলো। আমি তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। এজন্য সবাইকে মানা করেছিলাম বলতে। আর হুট করে করার কি আছে! আমাদের বিয়েতো সেই ছোটবেলায়ই পাকা হয়ে আছে। এখন আমরা দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক। দুজনই ইনডিপেনডেন্ট। তো এটাইতো সবচেয়ে সেরা সময় আমাদের সম্পর্কটাকে নাম দেওয়ার। বিয়ের বন্ধনে বাঁধার। তাহলে সমস্যা কোথায়?”
স্নেহা জবাবে কিছু বলবে তার আগেই জাকিয়া মেয়ের উদ্দেশ্যে বলল,
“ঠিকিইতো বলেছে পাভেল। বিয়ের বয়স আর সনয় দুটোই হয়ে গেছে তোদের। আর এটাইতো হওয়ার ছিলো। তাহলে দ্বিমত করছিস কেন! আর আজতো শুধু এনগেজমেন্ট হচ্ছে। বিয়েতো আর হচ্ছে না। এনগেজমেন্ট করে নে।তারপর বিয়ে নাহয় তোর সময় অনুযায়ীই করা হবে ঠিক আছে! এখন আর কিছু বলিস না।”
স্নেহার বাবাও মেয়েকে বুঝাল আর অমত না করতে। স্নেহা কিছু বলতে চেয়েও যেন পারলোনা৷ তার মাঝে কেমন অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছে। এসব যা কিছু হচ্ছে তা কেমন যেন ঠিক লাগছে না তার কাছে। হাসফাস করছে ভেতরটা। এমনটা কেন লাগছে সে বুঝতে পারছে না। পাভেলের সাথে বিয়ে হবে এটাতো তার জানা কথা। তাহলে এমন অশান্ত হচ্ছে কেন মন! কেন মনে হচ্ছে কিছু একটা ভুল হচ্ছে। সে এই এনগেজমেন্টের জন্য মন থেকে প্রস্তুত হতে পারছে না। কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না। বলবেই বা কি! সে”তো নিজেই বুঝতে পারছে তার সাথে কি হচ্ছে, কি চাইছে তার মন! সব যেন এলোমেলো লাগছে কেমন। স্নেহার নজর দেয়াল ঘড়ির দিকে পড়তেই হঠাৎ আদিত্যর কথা মনে হলো ওর। ওকেতো হসপিটালে পৌঁছাতে হবে। আদিত্য জ্ঞান ফেরার আগে সে হসপিটালে না পৌঁছালে আদিত্য আবারও উত্তেজিত হয়ে নিজেকে আহত করবে। কিন্তু এখন সে যাবে কি করে! এখান থেকেতো বের হওয়ার কোনো পথও দেখছে না সে।সব যেন এলোমেলো হয়ে মাথার মাঝে গোলগোল ঘুরছে তাট। এরইমাঝে আংটি বদলের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে গেল। পাভেলের মা স্নেহার জন্য আনা আংটি টা পাভেলের হাতে দিয়ে বলল স্নেহাকে পড়িয়ে দিতে। পাভেল অমায়িক হেসেছিল আংটি টা হাতে নিয়ে অন্য হাতের তালুতে স্নেহার বাম হাতটা সামনে তুলে ধরল। স্নেহার অস্থিরতা যেন বেড়েই চলল। তার যেন এসব মান্য হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না তা জানে না সে। শুধু মনে হচ্ছে এখান থেকে তার ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। পাভেল আংটিটা পড়াতেই যাবে ঠিক তখনই স্নেহার ফোনটা বেজে উঠল। স্নেহা ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো আবির ফোন করেছে। স্নেহা ভয়ার্ত মুখ করে জলদি ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আবিরের ভারাক্রান্ত কন্ঠে শোনা গেল,
“মিস স্নেহা,প্লিজ জলদি আসেন। আদির শরীর ভীষণ খারাপ করেছে। জ্বরে কাঁপছে থরথর করে। আর জ্বরের ঘোরে শুধু এঞ্জেলকে ডাকছে। প্লিজ আসুন আপনি।”
স্নেহা যেন মুহুর্তেই বাকি দুনিয়ার সকল কিছুর উর্ধ্বে চলে গেল। সে দ্বিতীয় কোনো চিন্তাভাবনার তোয়াক্কা না করে বলে উঠল,
“আমি আসছি এক্ষুনি।”
বলামাত্রই ঝট করে নিজের হাতটা পাভেলের হাতের মাঝ থেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সবার মাঝ থেকে ছুটে বেড়িয়ে গেল সে। পেছন থেকে জাকিয়া কতবার ডাকলো মেয়েকে কিন্তু শুনল না সে। পাগলিনীর মতো ছুটে বেড়িয়ে গেল। তার এই বেপরোয়া কাজ দেখে পাভেল প্রচন্ড পরিমাণ রেগে ফুঁসে উঠল। হাতের আংটি টা মুঠোয় দুমড়েমুচড়ে তা সজোরে মেঝেতে ছুঁড়ে মারল।
__

কেবিনে আসতেই দেখলো আদিত্য বিছানায় প্রায় অচেতন অবস্থায় থরথর করে কাঁপছে। আর বিড়বিড় শব্দে এঞ্জেল বলে ডাকছে। স্নেহার অন্তর্দেশ পীড়িণে আহত হলো যেন তীব্র বেগে। ডুকরে উঠল ভেতরটা। যার বহিঃপ্রকাশ স্বরুপ চোখে জমলো নোনাজলের পারদ। ছুটে গেল সে আদিত্যর কাছে। আদিত্যর হাত ধরে গালে হাত রেখে বলল,
“এইতো হিরো,এইযে আমি এখানেই আছি তোমার পাশে। চোখ খুলে তাকাও একটু। দেখো তোমার এঞ্জেল তোমার কাছেই আছে।”
কয়েকবার ডাকার পর দূর্বল আঁখি যুগল ধীরে ধীরে খুলে তাকালো আদিত্য। স্নেহাকে চোখের সামনে দেখে অসুস্থ মুখটাতেও খুশিময় হাসি ফুটল তার। উঠে বসতে চাইলো সে। তবে দূর্বল শরীরে উঠতে মুশকিল হচ্ছে তারজন্য। তা দেখে স্নেহা তার কাঁধ ধরে তাকে উঠে বসাতে সহায়তা করল। আদিত্য স্নেহার মুখটা দুই হাতের মাঝে আগলে ধরে দুর্বলচিত্তে হেঁসে বলল,
“আমার এঞ্জেল! তুমি আমার কাছেই আছো! কাছেই থেকো হ্যাঁ! কোথাও যেওনা।”
স্নেহা ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল,
“যাচ্ছি নাতো কোথাও। তোমার কাছেই থাকবো সবসময়। তুমি এখন কিছু খেয়ে নেও একটু।”
আদিত্য সুবোধ বালকের মতো বলল,
“তুমি যা বলবে তাই করবো। শুধু আমাকে রেখে যেওনা এঞ্জেল।”
স্নেহা আবিরের আনা চিকেন সুপের বোলটা হাতে নিয়ে আদিত্যকে খাইয়ে দিলো।তারপর জ্বরের ওষুধ খাইয়ে দিলো তাকে। খাওয়া শেষে আদিত্য স্নেহার একটা হাত বুকের মাঝে জাপ্টে ধরে শুয়ে রইল। আর এক দৃষ্টিতে স্নেহার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।যেন পলকটা ফেললেও সেই সময়ে বুঝি তার এঞ্জেল হারিয়ে যাবে কোথাও। তাই পলক পড়াও নিষেধ। এতক্ষণে আদিত্য খেয়াল করল স্নেহার গায়ে শাড়ি জড়ানো। আদিত্য চমকিত চোখে তাকিয়ে বলল,
“আরে বাহ! এঞ্জেল শাড়ি পড়েছ! অনেক সুন্দর লাগছে তোমাকে। একদম আমার পরির মতো।”
কেবিনের সোফায় আবির আর বিহানও বসা ছিলো। রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি আদিত্যর টেনশনে। তাই একটু সোফায় মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে ছিলো সে। আদিত্যর কথায় হঠাৎ সে চোখ খুলে তাকিয়ে মাথা তুলে বলল,
“আর তোকে! তোকে যে ডাইনোসরের চাচা শশুর লাগছে সে খেয়াল আছে তোর! আয়নায় দেখেছিস নিজেকে! পুরো আদিমানব বনে গেছিস। খালি জঙ্গলটাই মিসিং। ভাবি কি তোরে এভাবে পছন্দ করবে! জীবনেও না। তাইনারে বিহান?”
আবির কনুই দিয়ে বিহানকে খোঁচা মেরে ইশারা করল তার সাথে সহমত প্রকাশ করতে।বিহানও তখন তালে তাল মিলিয়ে বলল,
“হ,হাঁচাইতো কইতাচে আবির‍্যা। আমিতো তোরে চাচা বানাইবার চাইছিলাম। এত মেহনত করে বউডারে পোয়াতিও বানাই দিলাম। মাগার আমার পোলা/মাইয়া আইছা চাচার বদলে আদি-মানবের চাচা পাইবো। এইডা কি ঠিক হইবো! আর এত ছুন্দর ভাবিরে তোর ছাথে একদমই মানাইবো না। পুরাই বেমানান।”
আবির, বিহানের কথায় বেচারা আদিত্যর মুখমন্ডলে চিন্তা আর ভীতির ছাপ প্রতিয়মান হলো। সে অসহায় দৃষ্টিতে স্নেহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“সত্যি এঞ্জেল! আমাকে কি তোমার সাথে মানাবে না! তাহলে তুমি পছন্দ করবে না আমাকে!”
স্নেহা কি বলবে বুঝতে পারল না। আবিরদের দিকে তাকালে তারা চোখের ইশারায় হ্যাঁ বলতে বলল।স্নেহা হয়তো ওদের প্ল্যানটা বুঝতে পারল। তাই সে’ও বলল,
“হ্যাঁ ঠিকই বলেছে ওরা। তোমাকে এভাবে দেখে ভালো লাগছে না আমার। আমারতো তোমাকে হ্যান্ডসাম হিরোদের মতো দেখতে ভালো লাগে।”
“আমি হবোতো হিরোর মতো। তুমি আমাকে পছন্দ করবে দেইখো।”
আদিত্য আবিরদের উদ্দেশ্যে বলল,
“আবির আমার জন্য নতুন কাপড়চোপড় নিয়ে আয়। আর বিহান তুই আমার জন্য সেলুন থেকে লোক নিয়ে আয়।”
আবির, বিহানের মুখে হাসি ফুটল। তারা দ্রুত বেড়িয়ে গেল নিজ নিজ অর্ডার পালন করতে। আধাঘন্টার মাঝেই দুজন ফিরে এলো তাদরে জিনিস নিয়ে। হেয়ার ড্রেসার আসলে বিহান আদিত্যকে ওয়াশরুমে যেতে বলল তার সাথে। আদিত্য প্রথমে যেতে চাইলো না স্নেহাকে রেখে। তাকেও সাথে নিয়ে যেতে চাইলো। স্নেহা অনেক বুঝিয়ে বলল,সে কোথাও যাচ্ছে না। ওখানেই তারজন্য অপেক্ষা করবে। অনেক বলার পর আদিত্য রাজি হয়ে ওয়াশরুমে গেল। সাথে আবির,বিহানও ঢুকলো। আবিরের হাতে আদিত্যর জন্য নতুন ড্রেস। তার চুল,দাঁড়ি কেটে একেবারে নতুন লুকে বের করাবে। স্নেহা কেবিনে বসে ওয়েট করতে লাগল। হসপিটালের একটা ম্যাগাজিন হাতে পড়তে লাগল সে।

চল্লিশ মিনিটের মাথায় সেলুনের লোকটা বেড়িয়ে চলে গেল।তার প্রায় মিনিট বিশেক পর ওয়াশরুমের দরজা খুলে ওরাও বেড়িয়ে এলো। আদিত্য বলে উঠল,
“দেখো এঞ্জেল! এখন হিরোর মতো লাগছে না আমাকে!”
ম্যাগাজিনের দিকে নজর ছিলো স্নেহার। আদিত্যর কথায় মাথা তুলে সামনের দিকে তাকায় । সামনে তাকাতেই থমকে যায় সে। বিলম্বিত হয় তার হৃদকম্পন। আদিত্য এখন চুল,দাঁড়ি ছেটে নতুন ড্রেসে একদম পুরনো লুকে হাজির হয়েছে সে। সেই সুদর্শন পুরুষ রুপে। তাকে এভাবে দেখে স্নেহার মস্তিষ্কে কিছু যেন ঘটলো। মনে হচ্ছে এই লোকটাকে সে আগেও দেখেছে। অনেক বার দেখেছে। চোখের সামনে কেমন অস্পষ্ট মুহূর্ত ভাসতে লাগল তার। কিন্তু কোনো কিছুই স্পষ্ট বোঝা যায় না। হঠাৎ হাত পা কাঁপতে লাগল কেমন তার। হাত থেকে ম্যাগাজিনটা পড়ে গেল। মাথায় যন্ত্রণা শুরু হলো প্রচন্ড বেগে। তীব্র যন্ত্রণায় মাথা ফেটে যেতে লাগল তার। দুই হাতে মাথা চেপে ধরে ঢুলতে লাগল স্নেহা। তা দেখে আদিত্যর হাসিমুখটায় ভীতি ছেয়ে গেল। সে দৌড়ে গিয়ে স্নেহাকে ধরে অস্থির, ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
“এঞ্জেল! কি হয়েছে তোমার! এমন করছ কেন?”
স্নেহা আর কিছু বলতে পারলো না। জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ল আদিত্যর হাতে।

চলবে……