#মরুর_বুকে_বৃষ্টি (S-2)
পর্ব-২৮
®মেহরুমা নূর
★পিটপিট করে ভারি নেত্রপল্লব মেলে তাকালো স্নেহা। মাথাটাও ভীষণ ভারী আর ব্যাথাময় লাগছে তার। এক হাতে মাথা চেপে ধরে কপাল কুঁচকে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো সে। সর্বপ্রথম তার চোখের সামনে ধরা দিলো আদিত্যর চিন্তায় বিধ্বংস, অস্থির, পাগল মুখখানি। যে এমুহূর্তে স্নেহার হাত ধরে তার মাথার কাছে অধীর,করুন মুখে তাকিয়ে আছে৷ যেন তার জান বুঝি বেড়িয়ে যাচ্ছে। স্নেহার চোখের পাতা মেলতে দেখে আদিত্যর ভয়ার্ত মুখমন্ডলে স্বস্তিময় হাসির ঝলক দেখা দিলো তৎক্ষনাৎ। সে অধীর কন্ঠে বলল,
“এইতো এঞ্জেল তাকিয়েছে! এঞ্জেল দেখো এইযে আমি। কি হয়েছে তোমার বলো।”
স্নেহা এক হাতে মাথা চেপে ধরে ধীরে ধীরে উঠে বসলো। ক্লান্ত কন্ঠে বলল,
“কি হয়েছিল আমার? আমি বেডে কেন?”
পাশ থেকে আবির বলল,
“আপনি হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন৷ এখন ঠিক লাগছে আপনার?”
স্নেহা মাথা নাড়িয়ে বুঝাল সে এখন ঠিক আছ
আদিত্যও অস্থির কন্ঠে বলল,
“হ্যাঁ এঞ্জেল কি হয়েছে তোমার বলোনা? তুমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললে কেন?”
আদিত্যর উত্তেজিত ভাব কমাতে আবির বলে উঠল,
“আরে তোর রুপের ঝলক দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে ভাবি। আচমকা এতো সৌন্দর্য একবারে নিতে পারেনি সে। তোর রুপের যাদুই এমন।”
স্নেহা জোরপূর্বক স্মিথ হাসার চেষ্টা করল। তার সাথে এমনটা কেন হলো সে নিজেও জানে না। এটা নতুন না। এর আগেও তার সাথে এমন হয়েছে। মাঝে মাঝেই তার স্মৃতিতে ঝাপসা খেয়াল এসে হানা দেয়। আর তখনই এমন তীব্র যন্ত্রণা হয় তার মাথায়। এমনটা হয় তার সাথে প্রায় দু বছর ধরে। এর আগে হতোনা। আসলে এর আগে কি হতো তাতো তার তেমন মনেই নেই। দু বছর পূর্বের কথা ভাবতে গেলে স্নেহার স্মৃতিতে হাতে গোনা কয়েকটা স্মৃতি ছাড়া সবকিছু তেমন মনে নেই তার। এই ব্যাপারে সে নিজের মা বাবার কাছে জানতে চেয়েছিল। তখন তারা জানায় স্নেহার নাকি স্মল ব্রেন স্টোক হয়েছিল দুবছর পূর্বে। যার কারণে তার স্মৃতিশক্তি দূর্বল হয়ে গেছে। বেশি দূরের স্মৃতি তার মনে থাকে না। স্নেহাও মা বাবার জবাবটাই মেনে নেয়। তবে মাঝে মাঝে এই অস্পষ্ট স্মৃতিগুলো তাকে অনেক যন্ত্রণা দেয়। আর আদিত্যর সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে যেন অনেক বেশিই হচ্ছে এটা। আজ আদিত্যর এই পরিবর্তিত রুপ দেখেতো যেন হৃদপিণ্ড কেঁপে তার কেমন। চোখের সামনে ঝাপসা স্মৃতির ভীড়ে মাথা ফেটে যাচ্ছিল তার। কেন এমনটা হলো তার সাথে! স্নেহা একাগ্র নজরে তাকালো আদিত্যর উদ্বেগ ভরা ভীতিগ্রস্ত মুখটার দিকে। যার চোখে মুখে শুধুই আকাশ সমান চিন্তার ছাপ। স্নেহা কেমন মায়াময় অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আদিত্যর দিকে। লোকটাতো তার জন্য অচেনা। তাহলে কেন তাকে দেখে কোনো স্মৃতির ঝাপ্সা আয়না তাকে এভাবে আহত করছে! কেন? কে সে?
ভাবনার মাঝে কখন তার চোখের কোন বেয়ে উষ্ণ দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল তার খেয়াল নেই তার। আদিত্যর চোখে তা ঠিকই পড়ল। এবং তা দেখেই অস্থিরতার মাত্রা বাড়ল তার। দুই হাতে স্নেহার মুখটা ধরে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“এঞ্জেল! কাঁদছ কেন? কি হয়েছে? শরীর বেশি খারাপ লাগছে তোমার? বলোনা এঞ্জেল! ”
স্নেহা নিজেকে একটু সামলে নিয়ে জোরপূর্বক মুচকি হেঁসে বলল,
“আরে না, কিছু হয়নি আমার। এই দেখো একদম ঠিক আছি আমি।”
“না, একদম ঠিক নেই তুমি৷ তুমি অনেক অসুস্থ। শরীরও দূর্বল। তোমাকে এখন বেশি বেশি খাবার খেতে হবে আর রেস্ট করতে হবে। আমি কিচ্ছু শুনবো না। এই বিহান যা এঞ্জেলের জন্য খাবার নিয়ে আয়তো।”
বিহান মাথা ঝাকিয়ে বেড়িয়ে গেল।স্নেহা বলল,
“আরে না না, এসবের কোনো দরকার নেই। আমি ঠিক আছি একদম। এমনি একটু মাথা চক্কর দিয়ে উঠেছিল। এখন ঠিক আছি আমি।”
কিন্তু আদিত্য কোনো কথা শুনল না স্নেহার। বিহান খাবার নিয়ে এলে আদিত্য নিজের হাতেই স্নেহাকে খাইয়ে দিতে নিলো। স্নেহা মানা করলেও কিছুই মানলনা সে। অগত্যা খেতেই হলো স্নেহাকে। ওদের রেখে বিহান আর আবির আপাতত বাইরে চলে গেল। আদিত্য যত্ন সহকারে স্নেহাকে খাইয়ে দিতে লাগল। স্নেহার মনটা হঠাৎই আবেগী হয়ে উঠল কেমন। সে মায়াময় নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল তার সম্মুখের পুরুষটার দিকে। তার প্রতি কেমন অবাধ্য অনুভূতির জোয়ার উপচে পড়ছে প্রবল বেগে।অনুভূতির প্রগাঢ়তার স্রোতে তার হৃদয়, মন যেন যাচ্ছে কোনো সিন্ধু নগরে। চোখের পারদেও তার প্রভাবে ছেয়ে যাচ্ছে। কেমন অদম্য ভাবনা জাগছে মন জুড়ে। যে ভাবনা তাকে ভাসিয়ে দিতে চাচ্ছে খুব করে। খাওয়ানো শেষ হয়ে গেল তবুও স্নেহার ওই একাগ্র নজরে বিঘ্ন হলোনা। খাওয়ানো শেষ করে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিলো আদিত্য। স্নেহা আবেগের জোয়ারে ভেসে এই পর্যায়ে হঠাৎ সে আদিত্যর বুকে আছড়ে পড়ল। দুই হাতে আদিত্যকে জড়িয়ে ধরে তার বুকের মাঝে নিজেকে সামিল করে নিলো সে। আদিত্যও মুচকি হেঁসে তার এঞ্জেলকে দুই হাতে জড়িয়ে নিলো আরও নিবিড়ভাবে। স্নেহা তার উষ্ণ বুকটাতে নিজের সুখের সাম্রাজ্যের ঠিকানা খুঁজে পেল যেন।আদিত্যর শরীরের এই মনমাতানো ঘ্রাণটা যেন খুব চেনা তার। এই উষ্ণতা, এই ঘ্রাণ যেন তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে খুব করে। স্নেহা আদিত্যর বুকে নিজের নাক ঘষে তার ঘ্রাণে মিশালো নিজের শ্বাসপ্রশ্বাস। আদিত্যও তার বাঁধন আরও মজবুত করল। প্রাণভোমরাটাকে লেপ্টে নিচ্ছে নিজের বক্ষপিঞ্জিরায়।
বাহারি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এভাবেই দুজন দুজনাতে মিশে ছিলো নিজেদের আপন ভুবনে। তাদের এই নিজস্ব ভুবনের মাঝে ব্যাঘাত ঘটলো হঠাৎই। যখন বিকট শব্দে সজোরে ঠাস করে দরজার পাল্লা ধাক্কিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকলো কেউ। সেই শব্দে চমকে উঠল দুজনেই। ভেতরে ঢুকেছে পাভেল। স্নেহাকে এভাবে আদিত্যর বাহুবন্ধনে আলিঙ্গনরত অবস্থায় দেখে ক্রোধে ফেটে পড়ল সে। এমনিতেই স্নেহা ওভাবে এনগেজমেন্টের মাঝ থেকে উঠে আসায় চরম রাগ হচ্ছিল তার। সে কারণেই সে এখানে এসেছিল স্নেহার সাথে কথা বলতে। কিন্তু এখানে ওদের এই অবস্থায় দেখে তার ক্রোধ সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যায়। সে রাগে চিল্লিয়ে বলল,
“স্নেহা.……!!”
স্নেহা ধড়ফড়িয়ে ওঠে তার ডাকে। পাভেলকে এমুহূর্তে এখানে দেখে অনেকটা ঘাবড়ে যায় সে। তাকে কিছু বলতে যাবে সেই সুযোগেরও সময় দেয়না পাভেল। সে তেড়ে এসে কোনোকিছু বুঝে উঠার আগেই খপ করে স্নেহার হাত টেনে ধরে ঝটকা মেরে বেড থেকে নামালো। টেনে বাইরে নিয়ে যেতে চাইলে স্নেহা হাত টেনে ধরে বলল,
“পাভেল,কি করছ! ছাড়ো আমাকে।”
পাভেল ক্ষিপ্র স্বরে বলল,
“আমি কি করছি! তুমি কি করছ সেটা আগে বলো! এইজন্যই বুঝি এনগেজমেন্ট না করে চলে এসেছো! এই পাগলটার সাথে এসব রাসলীলা করার জন্য!”
স্নেহা প্রতিবাদী গলায় বলল,
“পাভেল! কি বলছ এসব! পাগল হয়ে গেছ!”
“হ্যাঁ পাগল হয়ে গেছি আমি। তুমি আমাকে পাগল হতে বাধ্য করেছ। অনেক হয়েছে তোমার মন-মর্জি। এখন আর এক মুহূর্তও এখানে থাকবে না তুমি। চলো এখান থেকে। ”
বলেই আবারও টেনে নিয়ে যেতে লাগল পাভেল স্নেহাকে। কিন্তু তাতে সফল হলোনা। পাগল আদিত্য ততক্ষণে হিংস্র রুপ ধারণ করেছে। তার এঞ্জেলকে কেউ নিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে থেকে তা দেখে শান্ত থাকে কিভাবে সে! সে’তো সুস্থ থাকতেই এমন কিছু হলে ক্ষিপ্ত বাঘ হয়ে যেত। এখনতো তার মানুষিক অবস্থা আরও খারাপ। এমতো অবস্থায় আরও ভয়ংকর হয়ে, হিংস্র হয়ে উঠল সে। ভয়ংকর দানবের মতো তেড়ে এসে সোজা পাভেল গলা চেপে ধরল। আচমকা আক্রমণে পাভেল স্নেহার হাত ছেড়ে দিয়ে নিজেকে আদিত্যর হাত থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু হিংস্র আদিত্যর সাথে পারা সম্ভব কই! আদিত্যর এই রুপ দেখে স্নেহাও ঘাবড়ে গেল। সে আদিত্যর হাত ধরে তাকে সরানোর চেষ্টা করে বলল পাভেলকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু আদিত্যর এখন কোনো কিছুর হুঁশ নেই। তার মাথায় কেবল একটাই জিনিস চলছে তা হলো,এই লোকটা ওর এঞ্জেলকে কেঁড়ে নিতে চেয়েছে। তার আর বেঁচে থাকার অধিকার নেই কোনোমতে। আদিত্য পাভেলকে নিচে ফেলে দিয়ে তার উপর এক হাঁটু ভর দিয়ে চড়ে বসে পাভেলের মুখে ইচ্ছেমতো ঘুষি মারতে লাগলো। মারতে মারতে নাক মুখ দিয়ে র,ক্ত বের করে হয়ে গেল। তবুও থামছে না আদিত্য। মারছে আর ক্রুদ্ধ স্বরে বলছে,
“তোর সাহস কি করে হলো আমার এঞ্জেলকে নিয়ে যাওয়ার! হাত কিভাবে লাগালি তুই! ছোঁয়ারও সাহস কি করে হলো তোর!….”
স্নেহা ভীষণ ঘাবড়ে গেল। এভাবে চললে পাভেলকে সত্যি সত্যিই মেরে ফেলবে আদিত্য। স্নেহা বুঝতে পারল ওর একার দ্বারা সম্ভব হবে না। তাই সে বাইরে গিয়ে আবির আর বিহানকে ডেকে আনল। তারাও এসে আদিত্যর অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেল। আদিত্যকে ধরে টেনে সরানোর চেষ্টা করল।কিন্তু ক্ষিপ্র আদিত্যকে সরানো যাচ্ছে না কিছুতেই। এদিকে পাভেল আধমরা হয়ে গেছে প্রায়। স্নেহা আর উপায় না পেয়ে জলদি একটা বেহুশের ইনজেকশন ভরে পুষ করে দিলো আদিত্যকে। ক্ষনিকের মধ্যেই আদিত্য শান্ত হয়ে ঢলে পড়ল। আবির আর বিহান ধরে ওকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। আর পাভেলকে দ্রুত নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলো। খবর শুনে পাভেলের মা-বাবা আর স্নেহার মা বাবাও ছুটে এলো হসপিটালে। পাভেলের মা স্নেহাকে অনেক তিক্ত তিক্ত কথা শোনালো। ছেলের এই অবস্থার জন্য দায়ী করল তাকে। আর যে তার ছেলেকে এভাবে নির্মমভাবে মেরেছে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে চাইলো। কিন্তু যখন আদিত্যর পরিচয় জানলো তখন আর সাহস পেলনা তারা। এমনিতেও অসুস্থ পাগলের অপরাধের কোনো শাস্তি নেই আইনে। জাকিয়াও ভীষণ রুষ্ট হলো মেয়ের উপর। তিনি মেয়ের হাত ধরে সোজা বাসায় নিয়ে এলো। শক্ত গলায় বলল,
“অনেক হয়েছে তোর সেবাদান কর্মসূচী। অনেক মেনে নিয়েছি তোর কথ। আর না৷ এখন আমি যা বলবো তাই করবি তুই। আজ থেকে তোর চাকরি বন্ধ। আর ওই পাগলের কাছে যাওয়াও বন্ধ। আর বিপরীতে আর একটা কথাও শুনবো না আমি। আর আমার কথার যদি হেরফের হয় তাহলে আমার মরা মুখ দেখবি, এই বলে দিলাম আমি।”
স্নেহার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সে কি করবে বুঝতে পারছে না। একদিকে মায়ের এমন কঠোর বাণী। অন্যদিকে আদিত্য,যে জ্ঞান ফিরেই তার এঞ্জেলকে না দেখতে পেলে বেসামাল হয়ে যাবে। অসুস্থ হয়ে পড়বে। স্নেহা যেন মাঝ দরিয়ায় পড়ে গেল। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। আদিত্যর জন্য ভেতরটা ছটফট করছে তার। এখন যে আদিত্য শুধুই তার রুগী না। এরচেয়েও বেশি কিছু যেন হয়ে গেছে তার কাছে। কিন্তু তার মা’কে কিভাবে বুঝাবে তা!
ঘরের মাঝে অস্থির অশান্ত মনে বসে আছে স্নেহা। ইনজেকশানের প্রভাব এতক্ষণে হয়তো শেষ হয়ে গেছে। আদিত্য জ্ঞান ফিরে ওকে না দেখে নাজানি কি করে বসবে! চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে তার।মন চাচ্ছে এখুনি ছুটে যেতে আদিত্যর কাছে।কিন্তু মায়ের বাধার জন্য সে যেতেও পারছে না। অস্থিরতায় সব কেমন বিষাক্ত লাগছে। এরইমাঝে হঠাৎ ফোন বেজে উঠল স্নেহার। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আবিরের কাতর কন্ঠ। সে বলল,
“মিস স্নেহা,কোথায় আপনি! আদির অবস্থা অনেক খারাপ। জ্ঞান ফিরে আপনাকে না দেখে আবার ভায়োলেন্ট হয়ে গেছে ও। ভাবছে ওই ছেলেটা বুঝি আপনাকে নিয়ে গেছে। সব কিছু ভাংচুর করে ফেলেছে। চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে নিজেকে আহত করে ফেলেছে। এখন র,ক্ত বমি করছে। প্লিজ আসুন আপনি। নাহলে আর বাঁচবে না ও। প্লিজ জলদি আসুন।”
স্নেহার যেন সব থমকে গেল মুহুর্তের জন্য। কেঁপে উঠল তার অন্তর আত্মা! মাথায় শুধু ওই একটাই কথা বারি খেতে লাগল। বাকি আর কিছু ভাববার পরিস্থিতিতে রইল না সে। ভীতিগ্রস্ত, অশান্ত মন নিয়ে সে এলোমেলো হয়ে পাগলের মতো ছুটে দৌড়াল বাইরে যাওয়ার জন্য। মেইন দরজার কাছে আসতেই জাকিয়া তার সামনে এসে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। শক্ত গলায় বলল,
“তোকে কি বলেছি মনে নেই!কোথাও যেতে পারবিনা তুই। যা ঘরে যা।”
স্নেহা করুন মিনুতির সুরে বলল,
“মা প্লিজ,এমন কোরোনা। লোকটা অনেক অসুস্থ। আমি এখন না গেলে মারা যাবে সে। প্লিজ যেতে দাও আমাকে।”
“যাক মরে। তাতে আমার কিছু যায় আসে না।”
“মা..! তুমি এত পাষাণ কিভাবে হতে পারো! একটা মানুষ মারা যাবে জেনেও তুমি তোমার জেদ পালন করবে! ঠিক আছে করো যা খুশি তাই। কিন্তু মনে রেখো এরপর কিন্তু তোমার মেয়েও আর বেঁচে থাকবে না। যখন একটা মানুষ মারা যাবে এটা জানা সত্ত্বেও যে আমি তাকে হয়তো বাঁচাতে পারতাম কিন্তু আমি তা করিনি। তখন কি আমার মনুষ্যত্ব বেঁচে থাকবে! আমার বিবেক ধিক্কার দিবে আমাকে। বেঁচে থেকেও মরে যাবো আমি। তুমি কি তোমার মেয়েকে মৃ,ত দেখতে চাও! যদি না চাও তাহলে প্লিজ বাঁধা দিওনা আমাকে। যেতে দাও আমাকে।”
জাকিয়ার মুখমন্ডলে যেন হঠাৎ পরিবর্তন দেখা গেল। নরম হলো তার চেহারা। সে কোনোকিছু না বলে মেয়ের সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। স্নেহার মুখে হাসি ফুটল। সে কালবিলম্ব না করে ছুটে বেড়িয়ে গেল হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
আদিত্যের কেবিনে এসে তার অবস্থা দেখে মাথা ঘুরে উঠল স্নেহার। কদম নড়বড়িয়ে গেল যেন তার। র,ক্ত বমি করতে করতে নিস্তেজ হয়ে পড়েছে সে। বিছানায় শুয়েও ছটফট করছে সে।আবির বিহান দুপাশ থেকে ধরে রেখেও তাকে শান্ত করতে পারছে না। প্রায় অচেতন অবস্থাতেও সে শুধু এঞ্জেলকে ডাকছে। স্নেহা নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত ছুটে গেল আদিত্যর কাছে।স্নেহাকে আসতে দেখে আবির সরে গিয়ে তাকে আদিত্যর পাশে বসার জায়গা করে দিলো। স্নেহা আদিত্যর পাশে বসে তার হাত মুঠোয় নিয়ে মায়াময় স্বরে বলল,
“এইযে হিরো, চোখ খোলো। দেখো আমি এসে গেছি। প্লিজ চোখ খোলো।”
আদিত্য দূর্বল চোখ খুলে স্নেহাকে দেখে তার ছটফটানো বন্ধ হলো। তড়িৎ গতিতে উঠে বসতে চাইলো। কিন্তু দূর্বল শরীরে তা হয়ে উঠল না।অন্যপাশে থাকা বিহান তাকে উঠে বসতে সাহায্য করল।আদিত্য উঠে বসে দুই হাতে স্নেহার মুখটা ধরে দুর্বলচিত্তে হেঁসে বলল,
“এসেছ এঞ্জেল! তুমি কেন বারবার চলে যাও? ওই রাসকেলটা তোমাকে নিয়ে গিয়েছিল তাইনা? ওকেতো আমি মেরেই ফেলবো। আমার এঞ্জেলকে নিয়ে যেতে চায় ও!”
“কেউ নিয়ে যাবে না আমাকে। এই দেখ আমি এখানেই আছি তোমার কাছে।”
“না না,ও তোমাকে নিয়ে যাবে।সবাই তোমাকে কেঁড়ে নিতে চায় আমার কাছ থেকে। এখানে থাকা তোমার জন্য সুরক্ষিত না৷ আমাদের সুরক্ষিত জায়গায় যেতে হবে। এখানে আর থাকা যাবে না। নাহলে আবার তেমাকে নিতে আসবে।”
আদিত্য আবির,বিহানদের উদ্দেশ্যে বলল,
“বিহান,আমাকে বাড়ি নিয়ে চল। আমি আমার এঞ্জেলকে নিয়ে বাড়ি যাবো। এখানে আর এক মুহুর্তও থাকবো না।”
আবির,বিহান একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তাদের মুখে একরকম খুশির হাসি দেখা গেল। আদিত্য বাড়ি ফিরতে চাচ্ছে এটা তাদের জন্য অনেক বড় একটা প্রাপ্তি। কিন্তু স্নেহা চিন্তায় পড়ে গেল। আদিত্যর সাথে তাদের বাড়িতে কিভাবে যাবে সে! আর ওর পরিবারই বা কি তা মানবে!
চলবে……
#মরুর_বুকে_বৃষ্টি (S-2)
পর্ব-২৯
®মেহরুমা নূর
★গাড়ি এসে প্রবেশ করল আদিত্যের বাড়ির গেট দিয়ে। ভেতরে এসে থামলে আবির আর বিহান সামনে থেকে আগে নামল। আদিত্য স্নেহার হাত ধরে পেছনের সিটে বসে ছিলো।বিহান এসে আদিত্যর পাশের দরজাটা খুলে দিলে আদিত্য স্নেহার হাত ধরে আস্তে আস্তে করে নেমে এলো গাড়ি থেকে।স্নেহা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে সামনে তাকাতেই কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল সে। বাড়িটি কেমন যেন তার চিরচেনা মনে হলো। আবারও অদৃশ্য স্মৃতি এসে তার মস্তিষ্কে ছুটতে লাগল এলোমেলো। কেমন ঘোরের মাঝে চলে গেল সে। অদ্ভুত একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে বাড়িটা। যেন কোনো হারানো কিছুর খোঁজ করতে চাচ্ছে সে। তার ঘোরের মাঝেই আদিত্য স্নেহার হাত ধরে বাসার দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
“চলো এঞ্জেল, ভেতরে যাই। বাড়িটা তোমার জন্য কতদিন হলো অপেক্ষা করছে।”
আদিত্য স্নেহার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যেতে লাগল। স্নেহা যত সামনে যাচ্ছে ততই কেমন অদৃশ্য প্রতিচ্ছবিগুলো আরও প্রবল বেগে হানা দিচ্ছে তার চোখের সামনে। ঘোরে ডুবে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে স্নেহা। মেইন দরজা পেরিয়ে বাসার ভেতরে প্রবেশ করল ওরা। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে স্নেহার মাথাও যেন গোলগোল ঘুরছে কেমন। যেন অদৃশ্য প্রতিচ্ছবি গুলো তীব্র গতিতে তার মাথার চারিদিক দিয়ে ঘূর্ণিপাকের মতো ঘুরছে। কানে এসে বাজছে কিছু অস্পষ্ট ধ্বনি সমষ্টি। যেন কারোর খিলখিল করে হাসির শব্দ বাজছে কানে। আবার কোনো পুরুষালি কন্ঠও শোনা যাচ্ছে কেমন। যেন বলছে,”এই এঞ্জেল, দৌড়ায় না এমন। পড়ে যাবেতো বাবা!” এমন হাজারও ধ্বনির কলরব স্নেহার মস্তিষ্ককে অবশ করে তুলছে যেন। লিভিং রুমে উপস্থিত সবাই আদিত্যকে দেখে যেমন খুশি হলো তেমন তার পাশে অন্য একটা মেয়েকে ভীষণ অবাকও হলো। যদিও জাবেদা আর হিয়া সবটাই জানে। তাই তারা তেমন অবাক হলোনা। হিয়া আট মাসের ভারী পেট নিয়ে এগিয়ে এলো সামনে।মুচকি হেঁসে আদিত্যর উদ্দেশ্যে বলল,
“কেমন আছেন ভাইয়া? আপনাকে বাড়ি ফিরতে দেখে অনেক খুশি লাগছে। অনেক মিস করেছি আমরা আপনাকে।”
আদিত্য হাসিমুখে বলল,
“আসবোইতো, দেখোনা আমার এঞ্জেল এসে গেছে! এখনতো আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন। এখন সব ঠিক হয়ে যাবে।যান রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন।”
হিয়া কথা বললেও স্নেহার যেন সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। আদিত্য স্নেহাকে বলল,
“চলো রুমে যাই এঞ্জেল।”
আদিত্য বললেও স্নেহার যেন আদিত্যর প্রয়োজনই হলোনা। সে আদিত্যর হাত ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে একাই সামনে এগিয়ে গেল। ঘোরের মাঝেই সে কেমন হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আদিত্যর রুমের দিকে পৌঁছে গেল। আদিত্যও গেল তার সাথে সাথে। তার মাঝেতো এই নিয়ে কোনো ভাবাবেগ হলোনা। কারণ তারজন্যতো স্নেহাই তার নূর, তার এঞ্জেল।যার কাছে এবাড়ির সব চেনা। কিন্তু স্নেহাকে এভাবে না বলতেই নিজে একাই আদিত্যর রুম চিনে পৌঁছে যেতে দেখে বাকিদের মাঝে ঠিকই ভাবাবেগ হলো অনেকটা। স্নেহা কিভাবে চিনল আদিত্যর রুম সেটাই ভাবাচ্ছে তাদের।
স্নেহা আদিত্যর রুমে এসে যেন আরও ঘূর্ণিপাকের মাঝে পড়ার মতো অবস্থা হলো। রুমে প্রবেশ করতেই হৃদপিণ্ড অজান্তেই কেঁপে উঠল ঝংকারিত হয়ে। রুমের চারপাশে চোখ বোলাতেই সবকিছুর মাত্রা যেন চরম পর্যায়ে বেড়ে গেল। স্নেহার যেন কেমন দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। হাত পা কেঁপে অবশ হয়ে আসছে কেমন৷ স্নেহার নজর পড়ল বেডের মাথার কাছের দেয়ালে টানানো বিশালকার ফটো ফ্রেমটার উপর। যেটাতে আদিত্য নূরের ছবি লাগানো। তাদের হাস্যজ্বল একটা ক্যান্ডিট ফটো। ছবির নূরকে দেখে যেন স্নেহার মস্তিষ্কে এবার বিস্ফোরিত হতে লাগল। তীব্র যন্ত্রণা শুরু হলো তার। দুই হাতে মাথা চেপে ধরে যন্ত্রণায় সে হালকা আর্তনাদ করে উঠল। তা দেখে আৎকে উঠল আদিত্য। দ্রুত ছুটে গিয়ে স্নেহাকে ধরে আতঙ্কিত মুখে বলল,
“এঞ্জেল! কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন?”
আদিত্য স্নেহাকে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিলো। অস্থির কন্ঠে বলল,
“কি হয়েছে তোমার! কোথায় খারাপ লাগছে আমাকে বলো এঞ্জেল! ”
স্নেহা মাথা চেপে ধরে কিছুক্ষণ চোখ বুঁজে বসে রইল। খানিক পরে ধীরে ধীরে ব্যাথাটা একটু কমল তার। আদিত্যর অস্থিরতা শান্ত করতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“কিছু হয়নি আমার, আমি ঠিক আছি চিন্তা কোরোনা।”
“কোথায় ঠিক আছ! তুমিতো কেমন যেন করছিলে! কোথাও কষ্ট হচ্ছিল তোমার। বলো কি হয়েছে? ”
“কিছু হয়নি বাবা। সত্যি বলছি। এই দেখ আমি একদম ঠিক আছি।”
“সত্যি বলছ তো!”
“একদম সত্যি।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। তাও তুমি শুয়ে আরাম করো এখন।”
আদিত্য স্নেহাকে টেনে বালিশে শুইয়ে দিলো। স্নেহা মানা করলেও তা মানলো না সে। স্নেহাকে শুইয়ে দিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল আদিত্য। বাচ্চাদের মতো ঘুম পাড়াতে দেখে হাসি পেল স্নেহার। তবে তার মনে ঠিকই অশান্তি চলছে। নানার প্রশ্নের বেড়াজাল তাকে ঘিরে ধরছে। তার সাথে কি হচ্ছে এসব বুঝতে পারছেনা সে। এই বাড়িতে আসতেই তার এমন কেন লাগছে!কেন মনে হচ্ছে এই বাড়ির প্রতিটা দেয়ালে তার চিহ্ন মিশে আছে! যেন এই ঘরের সবকিছুতে সে নিজেকে ফিল করছে! কেন হচ্ছে তার সাথে এমন! কিভাবে জানবে সে!
__
আদিত্যর হাত বুলিয়ে দেওয়ায় স্নেহা সত্যি সত্যিই একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুমের মাঝেই হঠাৎ সে কিছু এলোমেলো স্বপ্ন দেখতে পায় সে। আর স্বপ্নে নিজেকে অন্য রুপে দেখতে পায়। নিজেকে নূরের রুপে দেখতে পায় সে। যেখানে সে নূরের রুপে আদিত্যর সাথে খুনসুটি করছে। এমন কিছু দেখতে পেয়েই ঝট করে চোখ মেলে তাকায় স্নেহা। আতঙ্কিত তার চাহুনি। ভয়ার্ত মুখমণ্ডল। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে সে। কপাল ঘামে নেয়ে গেছে। এ কেমন স্বপ্ন! নিজেকে নূরের স্থানে কেন দেখতে পেল সে! কেন মনে হচ্ছিল ওটা আমি নিজেই ছিলাম! এসব কি হচ্ছে তার সাথে! পাগল পাগল লাগছে নিজেকে কেমন। নিজেকে একটু ধাতস্থ করে পাশে তাকিয়ে দেখলো আদিত্য নেই। রুমে কোথাও নেই সে। ভ্রু কুঁচকে আসলো তার। লোকটাতো সবসময় তার কাছেই থাকে। এক সেকেন্ডের জন্যও তাকে একা ছাড়ে না। তাহলে গেল কোথায়! স্নেহার একটু চিন্তা হতে লাগল। সে আদিত্যর খোঁজে বিছানা থেকে নামতেই নিবে তখনই দরজা ঢেলে ভেতরে প্রবেশ করল আদিত্য। হাতে খাবারের ট্রে তার।দেখে বোঝা যাচ্ছে সে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে বাসার কাপড়চোপড় পড়েছে। আদিত্য ধীরে ধীরে কিছুটা নর্মাল হচ্ছে এমন মনে হচ্ছে স্নেহার। হঠাৎ বুকের মাঝে ধুক করে উঠল স্নেহার। আদিত্য ভালো হয়ে গেলেতো আর স্নেহাকে নূর মনে করবে না। আর চিনবেনা তাকে। এই ভাবনাটা মস্তিষ্কে হানা দিতেই হৃদপিণ্ড কেমন কেঁপে উঠল তার। যেন এমনটা সে একদমই সইতে পারবেনা। কিন্তু এটাতো ঠিক না। তাকেতো এই মোহে পড়া যাবে না। কোনো কিছুর আশা রাখা যাবে না। সে শুধুই আদিত্যর ট্রিটমেন্টের জন্য সাহায্য করছে। এরবেশি আশা করা স্বার্থপর আর লোভীর মতো কাজ হবে। মস্তিষ্ক এসব যুক্তি পেশ করলেও। তার মন এসব মানতে মোটেও রাজি হলো বলে মনল হলোনা।যেন সে কোনোকিছু বুঝতেই চায়না এমুহূর্তে।তার ভাবনার মাঝেই আদিত্য হাসিমুখে এগিয়ে এসে বলল,
“আরে উঠে পড়েছ এঞ্জেল! যাক ভালো হয়েছে। এই দেখ তোমার জন্য গরম গরম খবার নিয়ে এসেছি। ফটাফট খেয়ে নাও। অনেক দূর্বল হয়ে গেছ তুমি। বেশি বেশি খেয়ে একদম মোটাতাজা হয়ে যেতে হবে বুঝেছ।”
বলতে বলতে খাবারের ট্রে নিয়ে স্নেহার সামনে এসে বসলো। আদিত্যর বাচ্চামো কথায় হেঁসে দিলো স্নেহা। হেঁসে বলল,
“তাই! তাহলেতো মুটকী হয়ে যাবো। বিশ্রী লাগবে দেখতে। তোমারতো পছন্দ হবে না তখন আমাকে।”
আদিত্য ট্রে-টা পাশে রেখে স্নেহার খুব কাছে এসে বসলো। এক হাত স্নেহার গালে রেখে চার আঙুল কানের নিচে আর বৃদ্ধাঙ্গুল স্নেহার গালে আদরের স্পর্শে বোলালো। স্নেহা তাকালো আদিত্যর চোখের দিকে। মায়াময় ওই অপলক নজরে, নজর স্থাপন করল সে। হৃৎস্পন্দনের গতিভাব হচ্ছে এলোমেলো হঠাৎই। আদিত্য একাগ্র চাহুনি স্থগিত রেখে বলল,
“তুমি যেভাবেই, যে রুপেই আসো ওই রুপেই আমার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হবে। তুমি সব রুপেই আমাকে নতুন করে প্রেমে ফেলবে। তুমি যেকোনো রুপেই আমার হৃদয়ে অনুভূতি জাগাবে। বিলুপ্ত হবে আমার অরণ্য তোমাতেই।”
স্নেহার হৃৎস্পন্দন যেন এবার গতিপথই ভুলে গেল। নিঃশ্বাসটাও হলো বুঝি পথভ্রষ্ট পথিক। আদিত্যর এমন আবেগময় কথাগুলো যেন স্নেহার ভেতরটাকে ঝংকারিত করে তুলল। আদিত্যকে এখন কোনো মানুষিক রুগী মনে হচ্ছে না৷ মনে হচ্ছে কোনো বিমোহিত করা মাদকীয় পুরুষ। যে তার মন্ত্রমুগ্ধের নৈপুণ্য দেখিয়ে স্নেহাকে বিবশ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। আদিত্যর নজরও যেন আরও তীক্ষ্মতর হচ্ছে। যে চাহুনি স্নেহার ভেতর-বাহির আড়পার হয়ে বিঁধছে। কাঁপিয়ে দিচ্ছে সর্বাঙ্গ। আদিত্যর নজরে কেমন নেশার পারদ ছেয়ে গেল। সে ধীরে ধীরে তার মুখটা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে স্নেহার পানে। তা দেখে স্নেহার এবার গলা শুকিয়ে এলো। নিঃশ্বাস হলো ভারী। আদিত্য স্নেহার একেবারে কাছে আসতেই স্নেহা চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল। পরপরই কোমল উষ্ণ ছোঁয়া পেল কপালে। স্থির হয়ে গেল যেন স্নেহা। কম্পিত হাতে খামচে ধরল বিছানার চাদর। আদিত্যর অধর ওভাবেই এটে রইল স্নেহার ললাটে। স্নেহার হৃদয়ে প্রবল বেগে আলোড়নের বিস্ফোরণ সৃষ্টি করল যেন। কিন্তু সেই সাথে তার মস্তিষ্কেও হানা দিলো আবারও সেই অদৃশ্য স্মৃতির অত্যাচার। তার মনে হতে লাগল এই মুহুর্ত,এই স্পর্শ, এই অনুভূতি তার পূর্বপরিচিত। যেন এমন কিছু তার সাথে আগেও ঘটেছে। এমনটাই অস্পষ্ট স্মৃতি তার চোখের পর্দায় ভাসছে যেন। আবারও মাথায় যন্ত্রণা শুরু হলো তার। মাথায় হাত চেপে ধরে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল ব্যাথায়। তা দেখে আদিত্য ভয় পেয়ে গিয়ে বলল,
“এঞ্জেল! কি হলো তোমার?বারবার কি হচ্ছে তোমার সাথে?বলো আমাকে!”
স্নেহা কিছুক্ষণ মাথা চেপে ধরে বসে থাকলে।ধীরে ধীরে কমে আসে তার যন্ত্রণা। নিজেকে সামলে নিয়ে আদিত্যকে জানায় সে ঠিক আছে। তবে কিছুক্ষণ আগের মুহুর্তের কথা মনে করে ভীষণ লজ্জায় পড়ে যায় সে। ঠিক সেই মুহুর্তে স্নেহার ফোন বেজে উঠল। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে আদিত্যর কাছ থেকে একটু পিছিয়ে গিয়ে সে তার ফোন খুঁজতে লাগল। লজ্জায় আর আদিত্যর দিকে তাকাতেই পারছেনা সে। তাই ফোন হাতে নিয়ে কথা বলার উছিলায় দ্রুত বিছানা থেকে নেমে জানালার দিকে চলে গেল সে। স্নেহার মা ফোন দিয়েছে। আদিত্যর বাড়িতে আসার বিষয়ে তারা খুব চিন্তিত। মেয়েকে অনেক বলেও যখন তারা মানাতে পারেনি তখন আর বাঁধা দেওয়া ছেড়ে দিয়েছে তারা। তবে মেয়ের জন্য তাদের জন্য চিন্তা ঠিকই হচ্ছে। তাই মেয়ের খবর জানার জন্য ফোন দিয়েছে তারা। স্নেহা মায়ের সাথে কথা বলে আস্বস্ত করল সে ঠিক আছে। চিন্তার কিছু নেই। কথা শেষে স্নেহা আদিত্যর দিকে ফিরতেই আবারও কেমন যেন লজ্জা ঘিরে ধরল তাকে। কিন্তু আদিত্যকে দেখে মনে হচ্ছে তার মাঝে কোনো ভাবাবেগই নাই। হবেই বা কি করে! সে’তো মনে করছে সবসময়ের মতো তার এঞ্জেলকে আদর করেছে। কিন্তু স্নেহাতো লজ্জায় টিকতে পারছেনা। তাই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে স্নেহা বলল,
“আমি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
“আচ্ছা।”
স্নেহা ফ্রেশ হয়ে আসার পর। আদিত্য নিজের হাতে স্নেহাকে খাইয়ে দিলো। আর স্নেহাও আদিত্যকে খাইয়ে দিলো। খাওয়া শেষে আদিত্য স্নেহার হাত ধরে ওকে বাইরে নিচে নিয়ে এলো। যেখানে সবাই আপাতত বসে আলাপচারিতা করছে। হিয়া সবার জন্য চা-নাস্তা নিয়ে এলো। আদিত্য এতক্ষণে যেন খেয়াল করল হিয়া প্রেগন্যান্ট। সে বিহানের উদ্দেশ্যে বলল,
“আরে বিহান! তুই বাপ হতে চলেছিস আমাকে আগে বলিসনিতো!”
বিহান বিরবির করে বলল,
“কতবার কইছি! তুই হালা সেইটা বুঝলে না!”
আবির মজা করে বলল,
“আরে আদি ও বলবে কি! বেচারা ছোট্ট জান। পরিশ্রম করতে করতে চুষে খাওয়া আম হয়ে গেছে বেচারা। দিন-রাত খাট ভাঙ্গা মেহনত করে বউডারে পোয়াতি বানালো। তাতেইতো তার সবকিছু শেষ। এখন আর কোনোকিছু বলার শক্তি কোথায় তার!”
বিহান কপট রাগ দেখিয়ে আবিরের পিঠে দুম করে কিল মেরে দিলো। আবির হাসতে লাগল তখন। হিয়া বেচারি লজ্জায় শেষ। আবিরটাও আর শুধরালো না। স্নেহাও মুখ টিপে হাসলো। আবিরযে খুব দুষ্টু প্রকৃতির তা বুঝে গেছে সে। আবির বলল,
“আরে রাগছিস কেন ভাই! আমিতো এজন্য বলছিলাম যে, যে যতো মেহনত করে বউরে পোয়াতি বানায় তার মেহনতের ফল ততোই বেশি হয়। দেখা গেল তোর মেহনতের জোরে একটার বদলে দুইটা বা তিনটা এলো!”
বিহান বলল,
“হালা কি কছ! আমার বউডা ডরাই যাইবো গা!”
“আরে ভয়ের কি আছে! যত বেশি হবে ততইতো ভালো। গুরু বলেছেন,” যার বউ যতগুলো বাচ্চা দেয়। তার জামাইর ভালোবাসা ততো খাটি।”
“আচ্ছা! তো কে এই গুরু হুনি!”
“দ্য গ্রেট আবির রায়হান।”
আবারও হাসলো সবাই। তখন আদিত্য ফট করে বলে উঠল,
“তাহলেতো আমার বউয়ের বাচ্চার পাহাড় হয়ে যাবে। কারণ আমিই সবচেয়ে বেশি বউকে ভালোবাসি।”
আদিত্যর কথায় সবাই টাস্কি খেয়ে গেল। আর বেচারি স্নেহা অস্বস্তিতে মরে যাবার জো। আবির বলল,
“ভাই এত ভালোবাসা দেহাইস না। আমাদের উপর একটু রহম কর। তোর ভালোবাসার চক্করে পৃথিবী ডাইব্বাযাইবোগা।”
আবারও হাসির রোল পড়ল সেখানে।
আড্ডা শেষ করে আদিত্য স্নেহার হাত ধরে আবারও রুমে নিয়ে আসে৷দুজন বিছানায় হেলান দিয়ে পা টান করে বসে কথা বলছে।আদিত্য এক মুহূর্তের জন্যও স্নেহার হাত ছাড়ে না। সবসময় জড়িয়ে ধরে রাখে হাত।এখনও স্নেহার হাত বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে। বসে থাকতে থাকতেই মেডিসিনের প্রভাবে আদিত্যর ঘুম পায় । আদিত্য তখন কাঁধ থেকে মাথা তুলে স্নেহার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে। স্নেহার কোলে মাথা রেখে এক হাতে তার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে। আদিত্যর মুখ এসে লেগে থাকে স্নেহার পেটের সাথে।কেঁপে ওঠে স্নেহা। আদিত্যর নাক তার পেটে লেগে আছে। তার নির্গত উষ্ণ নিঃশ্বাসের ছোঁয়ায় বিদুৎ শিহরণ জাগে স্নেহার সর্বাঙ্গে। সে বরফের মতো শক্ত হয়ে জমে যায় যেন৷ চোখ বুঁজে নিজের বেসামাল অনুভূতির প্রলয়কে দমানোর চেষ্টা করে সে। কিছু সময় পর আদিত্যর ঢিলে হয়ে আসা হাতের বাধন অনুভব করতেই চোখ মেলে তাকায় স্নেহা। বুঝতে পারে ঘুমিয়ে গেছে আদিত্য। এবারে একটু নিজেকে প্রশমিত করে সে। তাকায় আদিত্যর ঘুমন্ত মাছুম মুখটার দিকে। কত মায়া সে মুখটাতে। স্নেহার হাত যেন আপনা-আপনি চলে যায় আদিত্যর চুলের মাঝে। পরম যত্নে চুলে বিলি কেটে দেয় সে। যেন চুলগুলোর সাথে আঙুল দিয়ে খেলছে সে। কি আছে এই লোকটার মাঝে। কিভাবে কয়দিনেই তাকে এতটা আকৃষ্ট করে ফেলল। এখন যে তাকে ছাড়া থাকা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভব হয়ে যাবে। কীভাবে থাকবে সে এই লোকটাকে ছাড়া! কিন্তু সুস্থ হয়ে গেলেতো আদিত্য আর ওর মুখও দেখতে চাইবে না। মনটা হঠাৎ বিষন্নতায় ছেয়ে গেল। চোখ বেয় গড়িয়ে পড়ল তার প্রভাব। স্নেহা মুখ নামিয়ে আদিত্যর মাথায় চুমু খেল। তারপর তার মাথার নিচ থেকে সাবধানে পা সরিয়ে নিয়ে বালিশ রেখে দিলো। আদিত্যকে শুইয়ে দিয়ে সে একটু বেলকনিতে এসে দাঁড়াল। মনটা কেমন অকারণে বেদনাময় হচ্ছে তার। আদিত্যকে ছেড়ে বাঁচার ভাবনাটাই যেন তাকে এই বেদনা দিচ্ছে। হঠাৎ দরজায় নক পড়ার শব্দ হলো। স্নেহা ফিরে এসে দরজা খুলে দেখলো আবির দাঁড়িয়ে। আবির বলল,
“আদি ঘুমিয়েছে? ”
“জি।”
“আপনি একটু বাইরে আসুন। কিছু কথা ছিলো আপনার সাথে।”
স্নেহা মাথা দুলিয়ে বাইরে এলো। আবির তাকে নিয়ে আদিত্যর স্টাডি রুমে এলো। যেখানে বিহান আগে থেকেই বসে ছিলো। আবির স্নেহাকে বসতে বলল।স্নেহার বসার পর আবির বলল,
“দেখুন মিস স্নেহা, আদিত্যর মাঝে কিছু ভালো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি আমরা। অল থ্যাংকস টু ইউ। তাই আমাদের এই পর্যায়ে আরও সাবধান হতে হবে। যাতে আদির কোনোরকম সন্দেহ না জাগে আপনাকে নিয়ে। তাই আজ আমরা আপনাকে আদি আর নূরের ভিডিও ক্লিপ দেখবো। এগুলো নানান সময় ক্যামেরার ভিডিও করা হয়েছে সেসব ভিডিও। এগুলো দেখলে আপনার ধারণা হবে নূর এক্সাক্টলি কেমন ছিলো।”
স্নেহা মাথা দুলিয়ে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
আবির সামনের ল্যাপটপে পেন ড্রাইভ লাগিয়ে ভিডিও প্লে করল। ভিডিওতে নূরের বিভিন্ন সময় সময়কার ভিডিও। সাথে আদিত্যসহ বাকিরাও কিছুটাতে আছে।”
কিন্তু ভিডিও শুরু হতেই স্নেহার মাঝেও কেমন ঝড় শুরু হলো যেন। যেন কেউ বিশাল হাতুড়ি দিয়ে তার মাথায় সজোরে বারি মারছে। নূরের ভিডিও গুলো দেখতে দেখতে স্নেহার চোখের সামনে যেন সেসব মুহুর্ত জীবন্ত ফুটে উঠতে লাগল। যেন ধোঁয়াশা অস্পষ্ট স্মৃতিগুলো এবারে স্পষ্ট ভেসে উঠছে তার চোখের সামনে। তীব্র যন্ত্রণায় চোখ মুখ নীল হয়ে গেল যেন তার। কপালের রগ ফেঁপে উঠছে ব্যাথায়। স্নেহা দু হাতে মাথা চেপে উচ্চস্বরে আর্তনাদ করে উঠল। শেষ পর্যন্ত নিজেকে আর টিকিয়ে রাখতে পারলোনা সে। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল নিচে।
চলবে……