মরুর বুকে বৃষ্টি ২ পর্ব-৩২+৩৩

0
229

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি (S-2)
পর্ব-৩২
®মেহরুমা নূর

★ডক্টরের কেবিনে বসে আছে নূর আর আবির।আদিত্যর নতুন রিপোর্ট চেক করছে ডক্টর। নূরের চেহারায় চিন্তার ভাজ। আদিত্যর রিপোর্ট যেন এবার ভালো আসে এমনটাই মনেপ্রাণে দোয়া তার। রিপোর্ট দেখার পড়ে ডক্টর বলল,
“মিসেস শাহরিয়ার, মিঃ আদিত্যর রিপোর্টে এবার অনেকটা ইম্প্রুভমেন্ট দেখা যাচ্ছে। এটা অনেক ভালো সাইন। তার শারীরিক অবস্থারও অনেক উন্নতি হয়েছে।”
নূরের মুখে স্বস্তিকর আনন্দের হাসি ফুটল। আবিরও ডক্টরের কথায় খুশি হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল,
“তাহলে কি আদিত্য একেবারে সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে যাবে ডক্টর? ”
“হুম যাবে,তবে তারজন্য আমাদের এবার ট্রিটমেন্টের ডোজ বাড়াতে হবে। মিঃ আদিত্য যেহেতু এখন সব মেডিসিন নিতে আর সমস্যা করে না। তাই এবার আমাদের তাকে কিছু পাওয়ারফুল ডোজ দিতে হবে। এর সাথে নিয়মিত থেরাপি দিতে হবে। এই কোর্স শেষ করলে আশা করি মিঃ আদিত্য পুরোপুরি আবার আগের মতো একেবারে স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ এই কোর্সের কিছু সাইড ইফেক্টও আছে।”
নূর চিন্তিত সুরে বলল,
“কেমন সাইড ইফেক্ট ডক্টর? ”
“এই মেডিসিনের অনেক পাওয়ারফুল।এবং শরীরে যাওয়ার পর অনেক যন্ত্রণাদায়কও হয় এটা। তাই এটা নেওয়ার পর রুগী নিজের মাঝে থাকে না। যন্ত্রণায় নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। আশেপাশে যেকোনো ব্যাক্তি বা বস্তু যাই হাতের কাছে পায় তার উপরই এই এর বহিঃপ্রকাশ করে।আমরা বেশিরভাগ সময় এই মেডিসিন দেওয়ার পর রুগীকে চেয়ার বা বেডের সাথে হাত পা লক করে রাখি। যাতে কোনোকিছু করতে না পারে। আর হ্যাঁ আরও একটা কথা আছে এখানে।মেডিসিনের প্রভাব যখন কমে আসবে তখন রুগীর মাঝে অনেকরকম পরিবর্তন দেখা যায়। সেটা যেকোনোরকম হতে পারে। তাই সবাই মানুষিক ভাবে প্রস্তুত থাকবেন। যদিও প্রথম প্রথম এই পরিবর্তন শুধুই ক্ষনিকের জন্য অস্থায়ী ভাবে হয়। তবে কোর্স শেষ হতে হতে সব পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবে।”
ডক্টরের কথায় নূরের মনে আতঙ্কের বৃহৎ পাহাড় জমলো। কেমন পরিবর্তন আসবে! আদিত্য কি ওকে ভুলে যাবে তখন! স্নেহার চেহারার এই নূরকে কি আর সে মেনে নিবে না! নাহ,এসব এখন ভাববো না আমি।আমি এতটা স্বার্থপর হতে পারি না।শুধু নিজের কথা ভাবতে পারিনা। এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি আদিত্যর সুস্থ হয়ে ওঠা। এরবেশি আর কিছু জরুরি না।”
নূর ডক্টরের উদ্দেশ্যে বলল,
“যেটা করলে আদিত্য ভালো হবে আপনি সেটাই করুন। ওর সুস্থতার পরিবর্তে সব মঞ্জুর।”
“ঠিক আছে তাহলে আজ থেকেই শুরু করা যাক। আমি মেডিসিন লিখে দিচ্ছি ওটা ফার্মেসী থেকে আনান। তারপর নার্স কেবিনে এসে ইনজেকশন পুষ করে দিবে।”
নূর বলে উঠল,
“ডক্টর আমি নিজেই ইনজেকশন পুষ করতে পারি। তাই অন্য নার্স লাগবেনা।”
“আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে সেটাই করুন।”
নূর আর আবির মাথা নেড়ে ডক্টরের কেবিন থেকে বেড়িয়ে এলো। আবির গেল ডক্টরের দেওয়া মেডিসিন গুলো আনতে। আর নূর আদিত্যর কাছে গেল। বিহান আদিত্যকে নিয়ে ওর সেই ভিআইপি কেবিনে বসেছিলো। নূর আসতেই আদিত্য দ্রুত নূরকে ধরে অস্থির কন্ঠে বলল,
“কোথায় গিয়েছিলে এঞ্জেল! একা একা কোথাও যেতে নেই। হারিয়ে যাবে তো। আর আমরা এখানে কেন এসেছি? চলো বাসায় যাই। ভালো লাগছে না আমার এখানে।”
“যাবোতো হিরো। এইতো আর কিছুক্ষণ। তারপরই চলে যাবো। আমিতো তোমার সাথেই আছি এই দেখো।”
নূর আদিত্যর হাত ধরে বেডে বসালো। কিছুক্ষণ পর আবির মেডিসিন নিয়ে ঢুকলো কেবিনে। তার হাতে মেডিসিন দেখে আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বলল,
“এতো মেডিসিন কেন এনেছিস? কি হবে এগুলো দিয়ে?”
আবির একবার নিজের হাতে থাকা মেডিসিনের দিকে তো,আরেকবার আদিত্যর দিকে তাকালো।আদিত্যর প্রশ্নের জবাব প্রস্তুত করতে সময় নিচ্ছে সে।সরাসরি ওর কথা বললে ঝামেলা করতে পারে।তাই কিছু একটা ভেবে হুট করে ফিচেল হেঁসে বলে উঠল,
“আরে এগুলো! এগুলোতো বিহানের জন্য।”
হঠাৎ আবিরের এমন কথায় বিহান বেচারা যেন টুস করে আকাশ থেকে এইমাত্র ধরণীতে প্রকট হলো। আদিত্য জিজ্ঞেস করল,
“কেন? বিহানের কি হয়েছে? ”
“আরে কি হয়েছে! বল, কি হয়নি! বিহাইন্নাতো পুরাই গেছে গা। ওর শরীর এখন অসুখের গোডাউন। এত অসুখ যে শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ লিক হয়ে অসুখ চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে! গবেষকগণ এখন ওর কাছ থেকে অসুখ ধার নিতে আসে।”
“কি বলিস! কিভাবে এতো অসুস্থ হলো ও? আসলে কি কি অসুখ হয়েছে ওর?”
“অনেক ভয়ানক অসুখ হয়েছে ওর। পুরো অঙ্গে অঙ্গে অসুখ ঝুলে ঝুলে আছে। ওর মাথায় এপেন্ডিসাইট হয়েছে, চোখে কোলেস্টেরল হয়েছে, নাকে ডায়রিয়া,দাঁতে ছানি পড়েছে, ফুসফুসে রাতকানা হয়েছে, পায়ে গ্যাস্টিক হয়েছে। আরও অনেক অসুখ হয়েছে ওর। ওর অসুখের বর্ণনা দিতে গেলে আমার চুল পেকে যাবে তাও শেষ হবে না।”
“কিন্তু ওকেতো দেখেতো মনে হচ্ছে না ও এতো অসুস্থ।”
“আরে তুইতো জানিসই বিহান কত মহৎ ব্যক্তি! ভেতরে ভেতরে অসুখের বুড়িগঙ্গায় ডুবে যাচ্ছে তবুও আমাদের সামনে একটুও দেখাবেনা। কিন্তু আমিতো জানি ও কতো অসুস্থ! ওইযে দেখ, তাকা একবার ওর দিকে।”
আবিরের কথায় আদিত্য তাকালো বিহানের পানে। পর্যবেক্ষণ স্বরূপ চাহুনি তার। বেচারা বিহান হ্যাবলা বনে গেল। সে কেমন প্রতিক্রিয়া দিবে বুঝতে পারছেনা। বোকার মতো চাহুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু। আবির সহমর্মিতার ভঙ্গিতে নেকা সুরে বলল,
“ওই দেখ! দেখ বেচারার কি অবস্থা! এইযে তাকিয়ে আছে,কখন নাজানি চোখের মনি খুলে হাতে চলে আসে বেচারার। তবুও কেমন নিজেকে ঠিক দেখানোর কঠিন পরিশ্রম করে যাচ্ছে!”
আবির বিহানের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে নেকার ডোজ বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আয় ভাই আয়, আমার বুকে আয়। তুই সত্যিই মহান ভাই! কেমনে পারিস এত মহান হতে! আই সেলুট ইউ ভাই!”
বলতে বলতে বিহানকে জড়িয়ে ধরল আবির। বিহান তখন আবিরের কানের কাছে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“ওই হারামির বাচ্চা! কি বকতাছচ এইছব! মাথায় কি গ্যাস্টিক হইচে তোর!”
আবিরও কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“দেখ যা কবি আমারে ক। আমার না হওয়া স্পার্ম টারে টানতাছোস ক্যান। আরে আদিরে বুঝানোর জন্য মিথ্যে বলতে হয়েছে। বোঝ ভাই।”
আবিরের পর আদিত্যও এগিয়ে গিয়ে বিহানকে জড়িয়ে ধরে সহমর্মিতা প্রকাশ করে বলল,
“চিন্তা করিসনা বিহান। আমি কিছু হতে দিবোনা তোকে। ভালো ডাক্তার দেখিয়ে সাড়িয়ে তুলব তোকে। আমি আছি না তোর ভাই!”
বেচারা বিহানের এমুহূর্তে যেন কুরবানির বকরি টাইপ ফিলিং হচ্ছে।

নূর ইনজেকশনে মেডিসিন ভরে আদিত্যর কাছে গেলে আদিত্য বলল,
“আমাকে কেন দিচ্ছ! অসুখতো বিহানের ওকে দাও।”
নূর বিপাকে পড়ে গেল। সাহায্যের জন্য আবিরের দিকে তাকালে আবির বলে উঠল,
“আরে আদি,বিহান না অনেক ভীতু। ইনজেকশন নিতে বাচ্চাদের মতো গড়াগড়ি কান্না করে। তাই তুই ওকে সাহস দিতে আগে নিজে নে। তাহলে ও ভয় পাবে না।”
“কি যা তা বলছিস! ও কি বাচ্চা নাকি! ভয় পাওয়ার কি আছ!”
“তোর বিশ্বাস হচ্ছে না! ঠিক আছে এখুনি দেখতে পাবি তুই। ভাবি বিহানকে ইনজেকশন লাগান।”
আবির বিহানের উদ্দেশ্যে ফিসফিস করে বলল,
“তুই কান্না শুরু করে দে।”
বিহান প্রথমে বুঝতে পারলনা। আবিরের চোখ রাঙানিতে একটু বুঝতে পারল সে। কিন্তু আনাড়ি বিহান মিছে কান্না করতে গিয়ে শুধু “আহ্,আহ্” শব্দ করে উঠল। আবির দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“সালা তুই কি এখানে পর্ণ ভিডিও বানাচ্ছিস! ঠিক করে কাদতেও জানিস না।”
আবির বুঝতে পারল এই গাধাকে দিয়ে কাজ হবে না। তাই সে সবার অগোচরে বিহানের পিঠে শক্তি প্রয়োগ করে দুম করে একটা কিল বসিয়ে দিলো। সাথে সাথে বিহান “আআআআ…” করে আর্তনাদ করে উঠল। তা দেখিয়ে আবির বলল,
“দেখলিতো আদি, কেমন বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। তুই একটু নেনা আগে। তাহলে ওর ভয় কমে যাবে। বন্ধুর জন্য তুই এইটুকু করতে পারবিনা!”
আদিত্য তখন বন্ধুর ভয় দূর করার দায়িত্ব নিয়ে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে, দাও আমাকে আগে দাও।”
নূর এবার আদিত্যর দিকে যেতে নিলে আবির ধীর কন্ঠে বলল,
“ভাবি ডক্টরতো বলল রুগীকে আগে বেঁধে নিতে হয় নাহলে আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে যায়।”
নূর বলল,
“দরকার নেই। হিরোকে আমি সামলে নিবো। তাকে কোনো শেকলে বেঁধে থাকার কষ্ট ভুগতে দেবোনা আমি। যা হয় আমি তার জন্য প্রস্তুত।”

অতঃপর নূর আদিত্যকে বেডে শুইয়ে দিয়ে,হাতে ইনজেকশন পুষ করল। এবং আদিত্যকে দেখানোর জন্য মিছেমিছি বিহানকেও সুই ঢুকালো। বেচারা বিহানের বিনা দোষে সুঁইয়ের চুবুনি খেতে হলো।ইনজেকশন দেওয়ার পর নূর আবির আর বিহানকে বলল,
“আপনারা বাইরে যান। নাহলে ও আপনাদের হার্ম করতে পারে।”
আবির বলল,
“পাগল হয়ে গেছেন ভাবি! আপনাকে আর আদিকে এমন সিচুয়েশনে ফেলে কিভাবে যেতে পারি আমরা! আপনি একা ওকে কিভাবে সামলাবেন!”
বিহানও সহমত পোষণ করে বলল,
“হ ভাবি,আমরা কুনুহানে যামুনা। এইহানেই থাকুম আদির লগে।”
নূর অগত্যা আর কিছু বলতে পারলোনা। এখন শুধু আদিত্যর উপর সে পুরো মনোযোগ দিলো। আদিত্যর হাত মুঠোয় ধরে তার পাশে পা ঝুলিয়ে বেডের উপর বসে রইল। মিনিট খানেক অতিক্রম করার পর ধীরে ধীরে আদিত্যর প্রতিক্রিয়া শুরু হতে লাগল। প্রথম প্রথম আদিত্য কেমন মাথা ডানে-বামে নাড়াতে লাগল। হাত পা কেমন টেনে টেনে আসছে। নূরের চেহারায় চিন্তার রেখা এবার বৃহৎ হতে লাগল তার। ভীতিগ্রস্ত হলো চোখ মুখ। সময়ের সাথে আদিত্যর শারীরিক প্রতিক্রিয়া বাড়ছে। হাত পায়ের অস্থিরতা বাড়তে লাগল। মুখ দিয়েও ব্যাথাময় গেঙানির আওয়াজ বের হচ্ছে। নূরের চোখে প্রিয়তমের কষ্ট সইতে না পারার অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে আপন বেগে। সে কি করবে! কি করলে তার স্বামীর কষ্ট দূর করতে পারবে সে!নিজেকে এমুহূর্তে বড্ড অপারগ, অসহায় মনে হচ্ছে নূরের। আদিত্য হলে কখনো তার এঞ্জেলকে এভাবে কষ্ট পেতে দিতোনা। ঠিকই কোনো না উপায় করে সব পীড়া দূর করে দিতো।কিন্তু নূর কেন পারে না তার হিরোর কষ্ট দূর করতে! এসব ভাবতে ভাবতে কান্না জড়িত চোখে নূর, একবার মাথা-মুখে হাত বোলাচ্ছে তো একবার আদিত্যর হাত ধরে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার প্রয়াস যেন কোনো ফলাফলই আনছে না। আদিত্যর অবস্থা ক্রমে আরও বেগতিক, ভয়াবহ হচ্ছে। সে এবার উচ্চস্বরে আর্তনাদ করছে আর গলা কা,টা মুরগীর মতো দাপাচ্ছে। বিহান আর আবির দুজন মিলে তার হাত, পা চেপে ধরে রেখেও তাকে শান্ত করতে পারছেনা। যন্ত্রণায় আদিত্যর সারামুখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। কপালের নীল রগ ফুটে উঠেছে। চোখ ফেটে যেন রক্ত বের হবে এখুনি। আদিত্যর এই করুন দশা নূর কিভাবে সইবে! বুকটা যেন ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে তার৷ প্রাণের চেয়েও প্রিয় মানুষটাকে এমন কষ্ট পেতে দেখা মৃত্যুযন্ত্রণার সমান।চোখের নোনাজল বাঁধ ভেঙে গড়াচ্ছে। একপর্যায়ে আদিত্য অনিয়ন্ত্রিত হয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে আবির,আর বিহানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বিছানা থেকে উঠে গেল। কোমল নূর তার শক্তির সাথে পেরে উঠল না। আদিত্য উঠে দাঁড়িয়ে বদ্ধ উন্মাদের মতো আচরণ করতে লাগল।দুই হাতে মাথা চেপে ধরে যন্ত্রণায় চিল্লাতে লাগল।যার দরুন কেবিনের সব ভাংচুর করে ফেলল। আবির, বিহান ঠেকাতে এলে তাদের উপরও আক্রমণাত্বক হলো। তাদের মেরে সরিয়ে দিয়ে সে গিয়ে দেয়ালে নিজের মাথা ঠুকতে লাগল। যেন ভেঙে ফেলবে নিজের মাথা। নূর দৌড়ে গিয়ে তাকে ঠেকানোর চেষ্টা করল কিন্তু পারলোনা।আবির আর বিহান আবারও উঠে এসে আদিত্যকে টেনে সরিয়ে আনতে চাইলো। কিন্তু আদিত্যর জোরের সাথে কোনোমতে পেরে উঠছে না। তখন নূর আর কোনো উপায় না দেখে শেষমেশ সে দ্রুত আদিত্যর বুকে ঝেঁপে পড়ল। দুই হাতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল আদিত্যকে। জাপ্টে ধরে কান্না জড়ানো গলায় অনুনয়ের সুরে বলল,
“শান্ত হও হিরো,প্লিজ শান্ত হও। আর একটুখানি সময় মাত্র। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে আবার। একটু শান্ত হও প্লিজ।”
তবুও যেন আদিত্যর মাঝে শান্ত ভাব আসছে না। সে হুংকার করেই যাচ্ছে। তবে নূরও ছাড়ছেনা আদিত্যকে৷ আষ্টেপৃষ্টে সর্বশক্তি দিয়ে জাপ্টে ধরে রেখেছে সে। আর বারবার আদিত্যকে শান্ত হতে বলছে। এভাবে কিছু সময় যাওয়ার পর আদিত্যর ছটফটানি যেন কমে এলো ধীরে ধীরে। একসময় শান্ত হয়ে এলো সে। এবং শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে পড়ে যেতে নিলো। তখন আবির আর বিহান মিলে ওকে ধরে আবার বেডে এনে শুইয়ে দিলো। বুঝতে পারল ওর মেডিসিনের প্রভাব কমে এসেছে। যার কারণে এখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে সে। ডক্টর বলেছে প্রভাব কমে এলে প্রায় আধাঘন্টার মতো এভাবেই অচেতনের মতো ঘুমিয়ে থাকবে আদিত্য। তাই ওকে বেডে শুইয়ে দিয়ে আবির আর বিহান আপাতত ওদের একা রেখে বাইরে চলে গেল। নূর বসলো আদিত্যর শিয়রের কাছে। আদিত্যর অচেতন মুখখানায় পূর্ণ মনোযোগে চেয়ে রইল সে। মাথা ঝুকিয়ে আদিত্যর মুখোমুখি আনলো। চোখের নোনাজল দু ফোটা টুপটাপ করে আদিত্যর মুখের উপর পড়তেই দ্রুত নিজের চোখের জল মুছে নিলো নূর। মাথা নুইয়ে অধর জমালো আদিত্যর কপালে। তার মাথায়,মুখে পরম আদরে হাত বুলিয়ে মায়াময় চাহুনি টিকিয়ে করুণ সুরে বলল,
“জলদি ঠিক হয়ে যাও হিরো। তোমাকে যে এভাবে দেখতে পারছিনা আমি আর।এভাবে মানায় না তোমাকে। তুমিতো আমার হিরো। সেই হিরোর মতোই আবার হয়ে যাওনা। প্লিজ।”
বলতে বলতে আদিত্যর কপালের সাথেই কপাল ঠেকিয়ে বসে রইল নূর। থাকতে থাকতে একসময় ওভাবেই চোখ লেগে গেল তার। ঘুমের মাঝে মাথা গড়িয়ে আদিত্যর কাঁধে চলে এলো।

ঘুম ভাঙল আদিত্যর বিড়বিড় করার আওয়াজে। নূর ঝট করে নিজেকে ঘুমের ঘোর থেকে টেনে তুলে মাথা তুলে আদিত্যর মুখের দিকে তাকালো ।দেখতে পেল আদিত্য ঘুমের মাঝেই বিড়বিড় করে তার এঞ্জেলকে ডাকছে। নূর আদিত্যর মুখে হাত বুলিয়ে বলল,
“হিরো,চোখ খোলো। দেখো আমি তোমার কাছেই আছি৷ তোমার এঞ্জেল তোমার পাশেই আছে। তাকাও হিরো।”
ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালো আদিত্য। স্বস্তিময় হাসির রেখা ফুটল নূরের ঠোঁটে।সে হাসিমুখ করে বলল,
“এইযে দেখো হিরো, তোমার এঞ্জেল তোমার পাশেই আছে। কোথাও যাইনি আমি।”
নূরের মায়াময় কথার পরিপেক্ষিতে এমন কিছু ঘটলো যারজন্য নূর এমুহূর্তে মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা। হঠাৎ আদিত্য নূরকে দুই হাতে ধাক্কা দিয়ে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিলো। এতজোরে ধাক্কা দিলো যে নূর ব্যালেন্স রাখতে না পেরে নিচে পড়ে গেল। নিচে তখন আদিত্যর ভাংচুর করে ফেলে রাখা বস্তুর কিছু ভাঙা টুকরো নূরের হাতে বিঁধল। তবে এমুহূর্তে সেই ক্ষতের চেয়ে বেশি আহত নূরের নজরে। যে আহত,বিস্মিত নজরে সে তাকালো আদিত্যর পানে। তার আহত আর বিস্ময়ের মাত্রা হাজার গুণ বাড়িয়ে দিয়ে আদিত্য উঠে দাঁড়িয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
“এই মেয়ে কে তুই? তোর সাহস কি করে হলো আমার কাছে আসার! আমার কাছে শুধু আমার এঞ্জেলের আসার অধিকার আছে। এঞ্জেল! আমার এঞ্জেল কোথায়!”
আদিত্য পাগলের মতো এদিকওদিক তাকিয়ে তার এঞ্জেল ডাকতে লাগল। আর নূর যেন পাথরের জমে রইল সেভাবেই। কেমন অনুভূতি শূন্য হয়ে পড়ল সে। আদিত্য তাকে চিনছে না। এটাই তাকে বিমূর্ত বানানোর জন্য যথেষ্ট। আদিত্য যখন এদিকওদিক তাকিয়ে তার এঞ্জেলকে পেলনা তখন যেন আবারও হিংস্র রুপ ধারণ করল। সে নূরকে টেনে তুলে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল,
“আমার এঞ্জেল কই? কি করেছিস তুই আমার এঞ্জেলকে? বল কোথায় রেখেছিস?”
নূর যেন কোনো প্রতিক্রিয়াই দিতে পারছেনা। কেমন বোবার মতো তাকিয়ে আছে শুধু। তা দেখে আদিত্যর পাগলামো আরও বাড়ল। সে ক্ষেপে গিয়ে নূরের গলা চেপে ধরল এক হাতে। গলা চেপে ধরে পেছনের দেয়ালে নিয়ে আঁটকে ফেলল তাকে। ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
“বল এঞ্জেল কোথায়? কি করেছিস আমার এঞ্জেলের সাথে?”
আদিত্যর চিল্লানোর শব্দ শুনে আবির আর বিহান দৌড়ে এলো ভেতরে। আদিত্যকে ওভাবে দেখে তারাও ভীষণ চমকে গেল। দ্রুত গিয়ে ছাড়াতে চাইলো তাকে। কিন্তু পাগল আদিত্যর জোরের সাথে বরাবরের মতোই পেরে উঠছে না তারা। এদিকে নূরের চোখ মুখ নীল হয়ে উঠেছে। দম নিতে পারছেনা সে। অবস্থা বেগতিক দেখে বিহান দ্রুত গিয়ে ডক্টর নিয়ে এলো। ডক্টর সবার প্রথম আদিত্যকে একটা ইনজেকশন পুষ করে দিলো। তৎক্ষনাৎই আদিত্য আবারও অচেতন হয়ে ঢলে পড়ল। আদিত্যর হাত থেকে ছাড়া পেতেই কাশতে লাগল নূর আর বড়ো বড়ো শ্বাস টানতে লাগল। আরেকটু হলেই বুঝি তার নিঃশ্বাস একেবারেই বন্ধ হয়ে যেত। আবির ডক্টরের কাছে জানতে চাইল আদিত্যর এমন আচরণের কারণ। ডক্টর তখন বুঝাল এমনটা হতে পারে সে আগেই বলেছিল। এটা মেডিসিনের প্রভাবে হয়েছে। এটা খারাপ না, ভালো সাইন। তবে এরপর জ্ঞান ফিরলে আর এমন করবে না। আবারও যেমন ছিলো তেমনই হয়ে যাবে। এই প্রক্রিয়া এভাবেই চলতে থাকবে। কোর্স শেষ হলে তখন আদিত্য পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবে। ডক্টর বলল,আদিত্যকে এখন বাসায় নিয়ে যেতে পারে তারা। বলা শেষ করে চলে গেলেন ডক্টর। তবে নূর আতঙ্কে গুটিয়ে গেল যেন। আদিত্য ওকে যদি সত্যি সত্যিই আর চেনে তখন কি করবে সে!

চলবে……

আরও পড়ুন,
হসপিটালে ওটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে আবির। দুঃশ্চিন্তার ছাপ তার মুখমন্ডল জুড়ে। ভেতরে আহানার ডেলিভারি সার্জারী চলছে। অস্থির ভঙ্গিতে ওটির দরজার সামনে পায়চারি করছে সে। কিছু সময় পর ওটির দরজা খুলে ডক্টর বের হলো। আবির দ্রুত তার সম্মুখে যেতেই ডক্টরটি ফিল্মি কায়দায় বলল,”কংগ্রাচুলেশন! আপনার ছেলে হয়েছে। মা ও সন্তান দুজনেই ভালো আছে।নার্স আপনার বাচ্চাকে নিয়ে আসছে।”
আবির খুশিময় স্বস্তির হাসি দিয়ে বলল,”আলহামদুলিল্লাহ।”
নার্স সাদা তোয়ালেতে মুড়িয়ে ছোট্ট নবজাতকে আবিরের কোলে দিয়ে বলল,”আপনার ছেলে।”
আবির অনেক সাবধানে তাকে কোলে নিলো। নিজের সন্তানকে কোলে নিয়ে আবির আবেগে আপ্লূত হয়ে তাকে আদর করতে লাগলো। কিন্তু হঠাৎ কিছুক্ষণ পর নার্স আরেকটা বাচ্চা নিয়ে এসে আবিরের কোলে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “আপনার আরেকটা মেয়ে হয়েছে।”
আবির অবাক হওয়ারও যেন সময় পেলনা। দুই বাচ্চাকে দুই হাতে কোলে নিলো সে। এরপর নার্স আরেকটা বাচ্চাকে নিয়ে আবিরের কাঁধের উপর বসিয়ে দিয়ে বলল, “আপনার আরেকটা ছেলে হয়েছে।”
এভাবে একের পর এক বাচ্চা এসেই চলেছে। আবিরের হাত,কাঁধ, মাথা সব বাচ্চায় ভরে গেছে। আবির বেচারা বুঝতে পারছেনা কি হচ্ছে তার সাথে। সে হটাৎ দরজা খুলে ওটির মধ্যে ঢুকে গেল।আহানার বেডের কাছে পাগলের মতো কিছু খুঁজতে খুঁজতে বলতে লাগল,”মেশিন কোথায়! বাচ্চা হওয়ার মেশিন কোথায়? মেশিন বন্ধ করো। জলদি বন্ধ করো। বাচ্চার পাহাড় হয়ে গেল। বন্ধ করো মেশিন…..”
“কি বলছেন এসব! কিসের মেশিন বন্ধ করো! এই শুনছেন! চোখ খুলুন।”
ঘুমের মাঝেই আবিরকে এমন অস্থির ভঙ্গিতে বিড়বিড় করতে দেখে তাকে হালকা ঝাঁকিয়ে ডাকল তাকে। আবির ঠাস করে চোখ খুলে তাকালো তখন। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে জোরে জোরে হাঁপাতে লাগল। ঘেমে নেয়ে গেছে বেচারা।এতক্ষণে বুঝতে পারল সে স্বপ্ন দেখছিলো। বাপরে! কি ভায়ানক স্বপ্ন। কপালের ঘাম মোছার জন্য হাত তুলতে নিলেই হাতে টান লাগল তার। তাকিয়ে দেখলো তার হাতে স্যালাইন লাগানো। আবির ভ্রু কুঁচকে বলল,”কিরে আমার হাতে স্যালাইন লাগানো কেন?”
আহানা টেবিলের উপর থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে স্মিথ হেঁসে বলতে লাগল,”আপনি সত্যিই ইউনিক পিস।আপনিতো প্রকৃতির নিয়মটাকেই বদলে দিলেন। প্রেগন্যান্ট আমি আর জ্ঞান হারিয়ে স্যালাইন লাগাতে হলো আপনাকে। মানে এখানেও আপনারই ফুটেজ নিতে হলো!”
বলতে বলতে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো আবিরের দিকে। প্রেগন্যান্ট হওয়ার কথা বলায় আবিরের মনে পড়ে গেল তখনকার কথা।একটু আগেই আহানার বলা সেই কথা, “আমি প্রেগন্যান্ট” মাথায় দৌড়াতে লাগল। আত্মা কেমন আতঙ্কিত হয়ে উঠল তার। পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল পুরোটা। তারপর একটু দম নিয়ে ভয়ার্ত চেহারা করে বলল,”তুই কি সত্যি বলছিস! তুই সত্যি প্রেগন্যান্ট?”
___________________________________

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি (S-2)
পর্ব-৩৩
®মেহরুমা নূর

★আদিত্যর ঘুমন্ত মুখের উপর ঝুঁকে আধশোয়া হয়ে বসে আছে নূর। হাতের কোমল স্পর্শ বুলিয়ে যাচ্ছে আদিত্য মুখময়। চোখের নজরে চিন্তা, মায়া আর ভীতির মিশ্রন। ভীতি আদিত্য তাকে যদি ভুলে যায় তা নিয়ে। যদি এই পরিবর্তিত নূরকে আর মেনে না নেয় সে! তাহলে কিভাবে বেঁচে থাকবে নূর! কিভাবে এই বোঝ তুল্য জীবন বয়ে বেড়াবে সে!সেই হৃদয় দমানো ভাবনাটাই নূরকে আতঙ্কে সিঁটিয়ে দিচ্ছে। অবাধ্য চোখের জল বারবার বেড়িয়ে আসছে বাঁধ ভেঙে। আবার আদিত্যর জন্য চিন্তা তাকে বিবশ করে দিচ্ছে। তার অসুস্থতা স্বস্তি দেয়না ক্ষণিকের জন্যেও নূরকে। সেই মুহুর্তে সব ভুলে শুধু আদিত্যর সুস্থতাই কামনা করে সে। আদিত্যকে বাসায় আনা হয়েছে মিনিট ত্রিশেক হলো। তখন থেকেই তার কাছ থেকে এক সেকেন্ডর জন্যেও নড়েনি নূর। যেন আদিত্য চোখ খুলে নূরকে না দেখলেই বুঝি তাকে ভুলে যাবে এমনটাই ভীতি নূরকে আদিত্যর কাছ থেকে সরতে দিচ্ছে না। আদিত্যর কপালে কপাল ঠেকিয়ে আছে সে। কিছুক্ষণ পর আদিত্যর শরীরে মৃদু নড়নচড়ন অনুভব করল নূর। কপাল থেকে মাথা একটু উঠিয়ে আদিত্যর মুখের দিকে তাকালো উদ্বিগ্ন চোখে। কপাল কুঁচকে ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালো আদিত্য। চোখের পর্দা সরতেই নূরের চিন্তিত মুখটা প্রতীয়মান হলো তার নজরের সীমানায়। নজর কিছুক্ষণ ওভাবেই স্থীর হলো নজর। কেমন আনমনা তার নজর। অন্তর কাঁপছে নূরের। ভীতিতে ভরাট হয়ে যাচ্ছে তার দুচোখ।আদিত্য কি তাকে চিনতে পারছে নাকি পারছে না এই ভয়েই হৃদপিণ্ড জমে যাচ্ছে তার। গলার মাঝে দলা পাকিয়ে আসছে কেমন। ভেজা ঢোক গিলল নূর। চোখের পানি আবারও নতুন উদ্যমে উপচে পড়তে চাচ্ছে যেন। ঠিক তখনই আদিত্য ঠোঁটের প্রশস্ত হাসি টেনে বলল,
“আরে এঞ্জেল! এভাবে কি দেখছ?”
নূরের মনে হলো এতক্ষণ কেউ তার গলা চেপে ধরে নিঃশ্বাস আঁটকে রেখেছিল। আদিত্যর মুখে এঞ্জেল ডাক শুনতেই যেন তার আঁটকে রাখা নিঃশ্বাসটা ছাড়া পেল। চোখের পানি আবারও গড়ালো। তবে এবার খুশির। চোখে জল আর ঠোঁটে খুশির হাসি। কান্না মিশ্রিত হাসি হেঁসে নূর ঝট আদিত্যর বুকে হামলে পড়ল। দুই হাতে জাপ্টে ধরে বুকে পড়ে কাঁদতে লাগল সে। ঘাবড়ে গেল আদিত্য। নূরের দুই বাহু ধরে তাকে বুকের উপর থেকে তোলার চেষ্টা করে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,
“এঞ্জেল! কি হয়েছে?কাদছ কেন? বলো আমাকে।”
নূর উঠলনা। বরং আরও সর্বশক্তি দিয়ে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে লিপ্টে গেল আদিত্যর বুকের সাথে। যেন চামড়া ভেদ করে হৃদপিণ্ডের ঢুকে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছা। এদিকে আদিত্য চিন্তায় আকুল। বারবার ডেকে যাচ্ছে নূরকে। খানিক পর নিজেকে সামলে নিয়ে চোখের পানি মুছে নূর নিজেই মাথা তুলল। ঘাবড়ে যাওয়া আদিত্যর কপালে চুমু খেল, দুই গাল আর নাকের ডগায়ও চুমু ছোঁয়াল। নাকে নাক ঠেকিয়ে আদিত্যর গালে হাত বুলিয়ে, চোখে চোখ রেখে প্রশস্ত হাসি টেনে বলল,
“কিছু হয়নি হিরো। তোমার এঞ্জেল একদম ঠিক আছে। যতক্ষণ এঞ্জেলের হিরো তার কাছে আছে ততক্ষণ তার কিচ্ছু হতে পারে না। তুমি থাকবেতো সবসময় এভাবে আমার সাথে? কখনো দূরে সরিয়ে দিবে নাতো?”
এ পর্যায়ে আদিত্য মুচকি হেঁসে নূরের কানের নিচে হাতের চার আঙুল দিয়ে আর বৃদ্ধাঙ্গুল নূরের গালে রেখে, নূরের মুখটা নিজের কপাল আর নাকের সাথে আরেকটু জড়ালো ভাবে লাগিয়ে নিয়ে বলল,
“এখন তোমার আমার চোখের মাঝে যে দূরত্ব আছে এটাইতো আমার মান্য না। আর তুমি দূরে সরিয়ে দেওয়ার কথা বলছ! সোতো ইহকালেও সম্ভব না এঞ্জেল। আদিত্যর দেহে প্রাণ থাকতে তার এঞ্জেলকে কেউ আলাদা করতে পারবেনা তার থেকে। কেউ না।”
হাসি ফুটল নূরের চোখে মুখে। নূরের কপালে চুমু খেল আদিত্য। এবার সে নিজেই নূরকে বুকের জমিনে মিশিয়ে নিলো। প্রশান্তির বহর বইলো দুজনার মাঝে।

একটু পর নূর আদিত্যর বুক থেকে উঠে বসে বলল,
“চলো গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নাও। তারপর ডিনার করতে হবে।”
আদিত্য কেমন আলসেমি দেখিয়ে বলল,
“আরেকটু শুয়ে থাকিনা, ভালোইতো লাগছিলো। আসো, আমার বুকে আসো।”
আদিত্য নূরকে কাছে টানার জন্য হাত এগুতে নিলেই নূর তার হাত খপ করে ধরে বলল,
“একদম না, অনেক শুয়ে থেকেছ। এখন উঠো। দিনদিন একদম আলসে হয়ে যাচ্ছো।চলো উঠো তাড়াতাড়ি।”
নূর আদিত্যর হাত টেনে ধরে উঠনোর চেষ্টা করছে কিন্তু নাজুক নূর কি এই বিশালদেহী পুরুষটাকে তুলতে পারে। নূরের চেষ্টা অসফল হতে দেখে হো হো করে হাসতে লাগল আদিত্য। নূর ক্লান্ত হয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,
“এমন করছ কেন! উঠোনা প্লিজ! গোসল করে খাবার খেয়ে নাও।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। যেতে পারি কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে। তোমাকেও আমার সাথে যেতে হবে। তুমি আমাকে গোসল করিয়ে দিবে। রাজি হলে বলো তাহলে উঠছি আমি। নাহলে এভাবেই পড়ে থাকবো আমি।”
নূর হার মেনে নিলো শেষমেশ। আদিত্যর কথা মেনে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে চলো।”
আদিত্য বিস্তর হেঁসে ঝট করে উঠে নূরের সাথে ওয়াশরুমের দিকে এগুলো। ওয়াশরুমে ঢুকে নূর বলল,
“টিশার্ট খোলো। আদিত্য দুই হাত উঁচু করে বাচ্চাদের মতো করে বলল,
” খুলে দাও।”
নূর অসহায় হাসলো আদিত্যর বাচ্চামো দেখে। টিশার্টের নিচ থেকে ধরে উপর দিকে তুলে মাথা উপর দিয়ে বের করতে চাইলো কিন্তু নিজের থেকে লম্বা আদিত্যর উচ্চতার সামনে সে খাটো পড়ে গেল সে। তাই আদিত্য উপর থেকে ধরে নিজেই খুলে নিয়ে নিচে ফেলে দিলো টিশার্ট। নূরের সামনে দৃশ্যমান হলো আদিত্যর উন্মুক্ত চওড়া বুক আর সুঠাম দেহ। নজর যেন কেমন বেলাজ হলো নূরের। অসভ্য নজর কেমন থমকে গেল। গলা শুকিয়ে আসছে হঠাৎই তার। অদ্ভুত শিহরিত অনুভূতিরা কেমন অপ্রস্তুত করে দিচ্ছে তাকে। কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে নূর বালতি থেকে মগে করে পানি নিয়ে আদিত্যর কাঁধে ঢাললো প্রথমে। তারপর শাওয়ার জেল ফোমে লাগিয়ে আদিত্যর হাতে,পিঠে আর বুকে ঘষে দিতে লাগল। আর আদিত্য দুষ্টুমি করে নিজের শরীরের ফেনা হাতে নিয়ে নূরের গায়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে বারংবার। তার কাজে নূর মিছে বিরক্ত প্রকাশ করলেও তার মুখে ঠিকই হাসি ঝুলে আছ।আদিত্যও হাসছে দুষ্টুমি করে। তার দুষ্টুমি বেড়েই চলেছে। সে এবার অনেকক্ষাণি ফেনা হাতে নিয়ে নূরের কাঁধের খোলা জায়গায় মাখিয়ে দিলো। নূরের মাঝে সহসাই কেমন মৃদু কম্পনের আবির্ভাব ঘটল যেন। তা আরও বৃহৎ হলো আদিত্যর পরবর্তী ক্রিয়ায়। যখন আদিত্য আরও ফেনা হাতে নিয়ে নূরের পেটের কাছ থেকে কামিজ একটু সরিয়ে পেটের উপর সেই ফেনা মাখিয়ে দিলো। বিদ্যুৎ বেগে শিহরণ বয়ে গেল যেন নূরের সর্বাঙ্গে। জমাট বাঁধল সকল র,ক্ত কণাগুলি। কম্পিন ছড়ালো হাত পায়ের মাঝে। নিজের বেসামাল অনুভূতিগুলোকে লুকিয়ে কোনরকমে নূর অসহায় কন্ঠে বলল,
“কি করছ হিরো! এমন করলে গোসল করাবো কি করে!”
আদিত্যর ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি। সে নূরের পেছনে হাত বাড়িয়ে শাওয়ারটা অন করে দিলো হুট করে। শাওয়ারের পানি গায়ে পড়তেই শিউরে উঠল নূর। আদিত্য নূরের হাত ধরে টান দিয়ে নিজের আরও কাছে টেনে নিয়ে বলল,
“এইভাবে।”
নূর হকচকা কন্ঠে বলল,
“আরে আরে কি করছ হিরো! ভিজে গেলামতো আমি!”
“তো যাও। আমি একা কেন গোসল করবো! দুজনেই গোসল করবো একসাথে।”
বলতে বলতে আদিত্য নূরের কোমড় পেঁচিয়ে ধরে তাকে আরও মিশিয়ে নিলো নিজের সাথে। নিজেকে টিকিয়ে রাখতে নূরের দুহাত গিয়ে পড়ল আদিত্যর কাঁধে। ভিজতে লাগল দুজন শাওয়ারের ঝর্ণাধারায়। শীতল পানিতে ভিজে একাকার দুটি মানবদেহ। নূরের বেসামাল অনুভূতি তাকে আরও বিবশ করে দিচ্ছে যেন। নিঃশ্বাসের গতিবেগ হচ্ছে ভারী। এলোমেলো, ছন্নছাড়া হচ্ছে সর্বাঙ্গের ইন্দ্রিয়। আদিত্য তার দুষ্টুমি বজায় রেখে মাথা ঝাঁকিয়ে ভেজা চুলের পানিগুলো নূরের মুখের ছিটিয়ে দিলো। তাতে যেন এবার নিঃশ্বাস আঁটকেই গেল নূরের।শিহরণের পীড়নে জমে গেল তার অঙ্গ খানি। আদিত্যর নজর স্থির হলো নূরের ভিজে মোহনীয় হওয়া মুখয়বে। শাওয়ারের পানি তার মাথা থেকে গড়িয়ে চোখের পলক বেয়ে ঠোঁটের উপর হয়ে থুতনির উপর দিয়ে নিচে গড়িয়ে যাচ্ছে। আদিত্যর নজরের শুভ্রতায় নেশার গাঢ় পারদ জমছে। মনে জাগছে নিষিদ্ধ বাসনা। আদিত্য নূরের থুঁতনির নিচে আঙুল রেখে থুঁতনি ধরে মুখটা উঁচু করে ধরল। চোখ বুঁজে ফেলল তৎক্ষনাৎই নূর। ভারী নিঃশ্বাস আরও বুঝি ভারী হলো তার।কম্পনের মাত্রা হলো তীব্রতর। শাওয়ারের পানি এবার বৃষ্টির ফোটার মতো ঝরঝর করে পড়ছে নূরের চোখ, মুখ,ঠোঁটে। আদিত্যকে যেন মেরে ফেলছে নূরের এই মোহনীয় অবতার।নূরের এই জনজবে ভেজা অধর যুগল দেখে পানির মাঝে দাঁড়িয়ে থেকেও যেন আগুন লেগে যাচ্ছে তার ভেতর বাহিরে। ঝলসে যাচ্ছে তার বক্ষদেশ। নেশায় বিমোহিত আদিত্য ধীরে ধীরে তার মুখ নামিয়ে অগ্রসর হলো নূরের সিক্ত অধর পানে। একসময় মিলিত হলো অধরে অধর। সর্বাঙ্গে তড়িৎ গতিতে বিদ্যুৎ শিহরণ বয়ে গেল নূরের। কাটা দিয়ে উঠল প্রত্যেক লোমকূপে। আদিত্যর নেশা তাকে আরও চাহিদায় মাতাল করে দিলো। সে নূরের অধরের সুমিষ্ট স্বাদে নিজেকে ডুবালো গভীর ভাবে। তীব্র কম্পনের তোড়ে নূরের টিকে থাকা দায় হয়ে গেল যেন। বিবশ হয়ে এলো তার সর্বশক্তি। দ্রবীভূত হয়ে বুঝি এখুনি নিচে পড়ে যাবে সে। নিজেকে টিকিয়ে রাখতে তাই দুহাতে আদিত্যর কাঁধ খামচে ধরল নূর। এতটাই জোরে ধরল যে নকগুলো গেঁথে গেল চামড়ার মাঝে। তাতে ভ্রুক্ষেপহীন আদিত্য। নেশায় পাগল হয়ে যাচ্ছে সে। এক হাত নূরের কানের নিচ দিয়ে চুলের মাঝে দিয়ে আরেক হাত কোমড়ে আরও শক্ত করে ধরে সেভাবেই পিছিয়ে গিয়ে দেয়ালের সাথে লেগে গেল। অধর ছেড়ে আদিত্য এবার ধীরে ধীরে নেমে এলো গলায়,কাঁধে। নূরের গলা,কাঁধে অধর লেপ্টিয়ে বিবশ করে দিলো তাকে। শিহরণের ঝড়ে বেসামাল নূর খামচে ধরল আদিত্যর চুলের গোছা। কম্পনের বশবর্তী নূর এতটাই জোরে ধরল যে আদিত্য হঠাৎ মাথায় যন্ত্রণা অনুভব করল। নূরকে ছেড়ে দিয়ে দুই হাতে মাথা ধরল সে। তার চোখে মুখে ব্যাথার ছায়া দেখা গেল। মাথা ধরে কেমন ঢুলতে লাগল সে। আৎকে উঠল নূর। সে আদিত্যকে ধরে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,
“কি হয়েছে হিরো? এমন করছ কেন”
আদিত্য ব্যাথাতুর কন্ঠে বলল,
“জানি না, হঠাৎ মাথা যন্ত্রণা করছে অনেক।”
নূর বুঝতে পারল আদিত্যর মাথার সমস্যা বেড়েছে হয়তো। এক্সিডেন্টে আদিত্যও মাথায় আঘাত পেয়েছিল। সেকারণেই আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। নূর শাওয়ার বন্ধ করে আদিত্যকে শরীর মুছিয়ে দিয়ে তাকে ড্রেস চেঞ্জ করতে বলে বাইরে গেল সে। ড্রেস চেঞ্জ হলে নূর তাকে ধরে দ্রুত রুমে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো রেস্ট করতে। তারপর সে’ও গিয়ে কাপড় পাল্টে নিলো। কাপড় পাল্টে আবার বাইরে এসে দেখলো আদিত্য চোখ বুঁজে শুয়ে আছে। নূর আর ডাকলোনা আর তাকে। কিছুক্ষণ আরাম করলে মাথা ব্যাথা হয়তো কমবে তার। ভীষণ অপরাধবোধ হচ্ছে তার। তখন ওভাবে চুল খামচে না ধরলে এমন হতোনা। সেই মুহুর্ত মনে পড়তেই হঠাৎ লাজে রাঙা হলো নূরের মুখয়ব।ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালে নিজের দিকে তাকাতেই যেন লজ্জায় মরে যাচ্ছে সে। আয়নায় দেখতে পেল তার ওষ্ঠদ্বয় লাল হয়ে কেমন ফুলে আছে। লজ্জায় সাথে সাথে দুই হাতে নিজের মুখ ঢেকে ফেলল নূর। আজ আর আয়নায় তাকাবেনা সে।
_____

রাত তখন প্রায় বারোটা পেরিয়ে। আবির বিছানায় উপুড় হয়ে হাত পা ছড়িয়ে জানপ্রাণ ছেড়ে ঘুমে কাদা কাদা তখন। আদিত্যর বাড়ি ফেরার পর থেকে এই বাড়িতেই থাকে সে। কখন কি ইমার্জেন্সি পড়ে যায় তাই আদিত্য পুরোপুরি ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আবির এবাড়িতেই থাকবে।নিচের লিভিং রুমের সাথে লাগাওয়া রুমে মাত্রই আরামে ঘুমে পড়েছিল সে।হঠাৎ কানে কেমন থেকে থেকে ঝনঝন আওয়াজের শব্দ এলো। কয়েকবার এমন শব্দ আসার পর ঘুম ভেঙে গেল আবিরের। তার কেমন খটকা লাগল মনে। এতরাতেতো সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে তাহলে শব্দ কিসের আসছে! বাসায় চোর টোর ঢোকেনিতো! বিষয়টা খতিয়ে দেখতে আবির ধীরে ধীরে উঠে রুমের বাইরে এলো। বুঝতে পারল শব্দটা রান্না ঘর থেকে আসছে। চোর তাহলে রান্নাঘরে! সালা খাও চোর! আজ তোর একদিন কি, আমার লাঠি যতক্ষণ আস্ত থাকে! আমার বন্ধুর বাড়ি চুরি করা! এই আবির দ্য সুপারহিরো থাকতে কখনোই তা সম্ভব না। আজ যদি তোর চব্বিশ গুষ্টির নাম না ভুলিয়ে দিছিতো আমার নামও আবির না। আবির এদিক ওদিক তাকিয়ে চোরকে প্রহার করার জন্য হাতিয়ার খুঁজতে লাগল। তেমন কিছুই পেলনা সে। শেষমেশ ডাইনিং টেবিলের একটা ফ্রাই প্যান দেখতে পেল। আপাতত সেটাই হাতিয়ার হিসেবে হাতে তুলে নিলো সে। ফ্রাই প্যানের ডাটিটা দুই হাতে শক্ত করে ধরে গোল অংশটা উপর দিকে তুলে চোরকে মারার উদ্দেশ্যে তাক করে রান্নাঘরের দিকে এগুলো। খুব আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে এগুলো সে। রান্নাঘরের দরজায় এসে ভেতরে এক পুরুষ অবয়বকে দেখতে পেল সে পেছন থেকে। চোরকে মারার উদ্দেশ্যে সে এবার ফ্রাই প্যানটা আরও উঁচু করে চোরের দিকে নিয়ে যেতে যেতে চিল্লিয়ে বলল,
“ইয়া আলী….”
তার চিল্লানোর শব্দ শুনেই সামনে থেকে বিহান তড়িৎ গতিতে ঘুরে তাকিয়ে তার দিকে ধেয়ে আসতে থাকা হাতিয়ার দেখে সেও দুই হাত উঁচু করে জোরে চিৎকার করে উঠল,”আআআ..…”। আর তার হাতে থাকা ফোনের টর্চের আলো এসে লাগল আবিরের মুখে। ফ্রাই প্যান একেবারে বিহানের মুখের কাছে ছুঁইছুঁই। সেই মুহুর্তে আবির তার হাতের ব্রেক কষলো। চোরের জায়গায় বিহানকে দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল সে।ভ্রু কুঁচকে বলল,
“বিহাইন্না তুই! এতরাতে তুই এখানে কি করিস! সালা আরেকটু হলেইতো মাথা বাঙ্গি ফাটা করে দিতাম! আর তুই এমন চোরের মতো এখানে করছিসটা কি! ভাবি খাইতে দেয়নাই তোরে,নাকি ঘর থাইকা লাত্থি মেরে বের করে দিছে!”
“আরে আমারে কইতে দিবি তুই! কহন থাইকা নিজেই কইয়া যাইবার লাগছোচ! আরে হালা আমারে বাইর কইরা দিবো ক্যালা!”
“তাহলে এতরাতে এখানে কি পেত্নীর সাথে লুঙ্গি ডান্স করতে এসেছিস! কি করছিস তুই এখানে?”
“আরে আছলে হঠাৎ হিয়ার বিরিয়ানি খাইবার মন চাইছে। এই ছময়ে মাইয়াগো হঠাৎ হঠাৎ আজব ছখ জাগে। তাই ওরজন্য বিরিয়ানি রান্না করতাছিলাম আমি।”
“তো লাইট কেন বন্ধ রেখেছিস!”
“আসলে কেউ যাতে ডিস্টার্ব না হয় লাইট জ্বালাই নাইক্কা। ”
“বাহ! কত মহৎ তুই! আর আমিতো ঘুমের ঘোরে এখানে পাজামা পার্টি করতে এসেছি তাইনা! আচ্ছা বাদ দে। তা তুই কি জানিস বিরিয়ানি কেমনে রাঁধতে হয়। নাকি বিরিয়ানির জায়গায় খাটা রানছিস?”
“পারিতো না অতো ভালো। তাও চেষ্টা করতাচি। বউ আমার বাচ্চার জন্য কত কষ্ট করতাছে। আর আমি এইটুক না পারলে কেমন পুরুছ হইলাম!”
“বাহ রে আমার পুরুষের কাঁথা! তা ডায়লগ বাজিই করবি নাকি কিছু কামও করছস? আরে না পারলে ইউ টিউব মামা বইসা আছে কিসের লাইগা!তোর মতো অবলা স্বামীর জন্যইতো ইউ টিউব।”
“আরে জানি,মাগার বাছার ওয়াইফাই লাইনে ছমছ্যা হইছে। নেট নাই অহন।”
“লে হালুয়া! তাইলেতো হইছেই। আচ্ছা চল আমি তোর হেল্প করছি।”
“তুই পারোছ?”
“আবিরের পারা লাগে না। আবির পয়দাগতই সব কাজে পারদর্শী। এক কাজ কর আগে চুলাতে কড়াই দে। তারপর তেল দে।”
“কি তেল দিমু?”
“কেরাসিন তেল দে। আব্বে হালা রান্নার তেল দিবি আর কোন তেল!”
“আচ্ছা, কতখানি দিমু?”
“দেখ তেল চালের পরিমাণ মতো দিতে হইবো। চাল এক কেজি হলে তেল দেড় কেজি। সিম্পল হিসাব।”
“তুই কি তেলের হিসাব বলছিস না পানির হিসাব!”
“আরে তেল আর পানি আমার কাছে দুটোই একসমান মূল্যবান। জাস্ট বিকজ তেলের দাম বেশি আর পানির দাম কম বলে তাদের সাথে কমবেশি করা হবে! আমি আবার জিনিসের মাঝে বৈষম্য পছন্দ করিনা। তাই তেল আর পানির নিয়মও এক।”
“আচ্ছা দিলাম, তারপর কইতে থাক।”
“হ্যাঁ এবার তেলে পেয়াজ কুচি দে। তারমধ্যে লবন,মরিচ,হলুদ এগুলো দে।”
“কতটুকু করে দিবো?”
“আরে বললাম না, আমি জিনিসের মাঝে বৈষম্য পছন্দ করিনা। সব দেড় কেজি করে দিবি। না কম, না বেশি। তারপর দেখ কি টেস্টি বিরিয়ানি হয়! খাইতে খাইতে তোর আঙুলও খেয়ে ফেলে দিবে। আমার কথা আবার বলিসনা। আমার আবার ক্রেডিট একদম পছন্দ না।”
“মাগার আমার জানি সন্দেহ হইতাছে। বিরিয়ানিতেতো কোনো হেলদোল দেখি না। কিছুইতো হয়না।”
আবির ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
“আব্বে আবালের ঘরের আবাল। গ্যাস কি তোর নানা শশুরের ভুত আইসা জ্বালাইবো?”
“কি কস গ্যাসও আবার জ্বালান লাগে নাকি! হেইডাতো জানতামই না।”
“তা জানবি ক্যা! হালা তোর মতো বিশ্ব আবালে ভাবিরে পোয়াতি কেমনে করলো হেইডাই বড়ো আশ্চর্যের বিষয়! চল এখন গ্যাস জ্বালা।”
বিহান দিয়াশলাই এর কাঠি জ্বালিয়ে একপ্রকার ছুঁড়ে মারল চুলার দিকে। সে কাঠি চুলোয় না গিয়ে পড়লো তেল ভর্তি কড়ায়ের মাঝে। আর সাথে সাথে ধপ করে আগুন জ্বলে উঠল কড়াইয়ের মাঝে।ধপ করে আগুন জ্বলায় আগুনের শিখা এসে লাগল আবির,বিহানের মুখে। বেচারাদের মুখ পুরো পোড়া বেগুনের মতো হয়ে গেল। বিহান ক্ষিপ্ত চোখে তাকালো আবিরের দিকে। আবির বলল,
“আমার কি দোষ! আগুন জ্বালাতে পারিস না আবার আইছে বিরিয়ানি রাঁধতে!”
বিহান দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“আবিরের বাচ্চা…..! ”
অবস্থা বেগতিক দেখে আবির এক ছুটে দৌড়ে পালালো রান্নাঘর থেকে। বিহানও দৌড়ে এলো তার পিছে পিছে। তাদের দৌড়াদৌড়ির মাঝে হিয়া বেড়িয়ে এলো রুম থেকে। ওদের এ অবস্থা দেখে বলল,
“আরে কি করছ তোমরা? এতরাতে দৌড়াদৌড়ি করছ কেন?”
বিহান হিয়ার সামনে গিয়ে অপরাধী গলায় বলল,
“সরি হিয়া, আমি তোমার একখান আবদারই পূরণ করবার পারলাম না। বিরিয়ানি রাঁধতে পারি নাইক্কা।”
হিয়া মুচকি হেঁসে বলল,
“আরে সরি বলছ কেন? তুমি চেষ্টা করেছ এই অনেক। এসো আমি নিজেই রাঁধছি।”
“না না, তুমি রাঁধবা না।তুমি শুধু পাশ থাইকা আমারে কইয়া দাও। আমিই রানমু। আমার বউয়ের লাইগা এইটুকু করতে না পারলে কেমন জামাই হইলাম!”
“আচ্ছা ঠিক আছে চলো।”
বিহান হিয়ার কাঁধ জড়িয়ে ধরে ওকে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল।

ওদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো আবির। হঠাৎ তার যেন খুব করে মনে পড়ল আহানার কথা। রুমে এসে ফোন দিলো আহানাকে। আহানা ফোন রিসিভ করে বলল,
“এতরাতে! কিছু হয়েছে? ”
“হ্যাঁ হয়েছেতো! কিসশূন্যতা রোগটা বেড়েছে আমার। ফটাফট এক হালি স্ট্রবেরি ফ্লেবারের কিস দে আমাকে।নাহলে সুস্থ হবোনা। অনেক জোরছে কিস দিবি। একদম ফোনের ভেতর থেকে যেন ঠোঁট বেড়িয়ে এসে আমার গালে ঠাস ঠাস করে লাগে।”
“সরি, দিস সার্ভিস ইজ নট এভ্যালেবল হিয়ার। ট্রাই দিস এট সামহোয়্যার ইলস।”
“দেখ এটা আমার মহত্ত্ব যে আমি তোকে বলছি। আমিতো চাইলেই যে কাউকেই বললে কিসের বস্তুা ঢেলে দিতো। কিন্তু আমি সবার প্রথম তোকে সুযোগ দিয়েছি। ওইযে একটা কথা আছে না,”চ্যারিটি বিগ্যানস এট হোম।” তেমন আমাকে কিস করার মতো সুবর্ণ সুযোগ তোকেই প্রথম দিয়েছি। এটাকে নিজের সৌভগ্য ভেবে এখনই কিস করতে করতে ফোনের স্ক্রিন ফাটিয়ে ফেলা উচিত তোর।”
“আমিও আপনার মতো মহৎ ব্যক্তি হওয়ার পথে চলতে চাই। তাই আমার সুযোগটা আমি অন্যদের জন্য সেক্রিফাইজ করলাম৷ আমার কষ্ট হলেও সয়ে নিবো। আপনি বরং অন্যদেরকেই সুযোগটা দিন। ওকে,গুড নাইট।”
বলেই ফোন কেটে দিলো আহানা। ফোনের দিকে চোখ বুলিয়ে নীরব হাসলো আবির। বিড়বিড় করে বলল,
“চালাক হয়ে যাচ্ছিস আন্নি। তবে ব্যাপার না। কিসতো আমি নিয়েই ছাড়বো তোর কাছ থেকে।”

চলবে….