মরুর বুকে বৃষ্টি ২ পর্ব-৩৪+৩৫

0
213

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি (S-2)
পর্ব-৩৪
®মেহরুমা_নূর

★সকালে ঘুৃম থেকে উঠে পাশে আদিত্যকে পাশে না দেখে খানিকটা ঘাবড়ে গেল নূর। রোজতো ওকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকে সে। আজ একাই কোথায় গেল! গায়ের ওড়নাটা দ্রুত জড়িয়ে চিন্তিত মুখে দ্রুত বেড়িয়ে এলো রুম থেকে। বাইরে এসে চারপাশটায় চোখ বুলিয়েও কোথাও দেখা গেলনা আদিত্যকে। চিন্তা বাড়ল নূরের। তাকে চিন্তিত অবস্থায় দেখে হিয়া এগিয়ে এসে বলল,
“কি হয়েছে ভাবি,এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন আপনাকে?”
“আদিত্যকে কোথাও দেখেছ তুমি? সকাল থেকে দেখছি না ওকে।”
“কি জানি ভাবি, আমিতো মাত্র এলাম। ভাইয়াকেতো দেখিনি। আর বিহান, আবির ওদেরও দেখা যাচ্ছে না।”
নূরের চিন্তার গতি যেন বেড়েই চলেছে। নূর এবার বাসার মেইন দরজা পাড় হয়ে বাইরে এলো আদিত্যর খোঁজে। বাইরে বের হতেই দেখতে পেল কাঙ্খিত ব্যক্তিকে। আবির আর বিহানের সাথে জগিং করতে করতে বাইরে থেকে মাত্র আসছে সে। পড়নে হালকা সবুজ রঙের হাতা কাটা ঢোলা টিশার্ট আর ট্রাউজার। জগিং করে ঘাম জমেছে তার কপালে, বুকে। তাকে এ অবস্থায় দেখে অনেকটাই অবাক হলো নূর। আদিত্যকে আজ যেন সেই আগের মতো লাগছে। তবে কি আদিত্য ধীরে ধীরে ঠিক হচ্ছে। এই ভাবনাটা যেমন খুশি বয়ে আনছে তেমনি আদিত্যর কাছ থেকে দূরত্ব হওয়ার ভয়ও যেন জেঁকে বসছে তাকে। সেই মুহুর্তটা যদি সত্যিই একদিন আসে সেদিন কি আদৌও বেঁচে থাকবে সে! মাথা ঝাঁকিয়ে আপাতত সেসব খেয়াল ঝেড়ে ফেলল নূর। আদিত্যর সুস্থতার চেয়ে বেশি জরুরি কিছু না। ও সুস্থ হচ্ছে এটাই সবচেয়ে খুশির বিষয়। নূরের পিছু পিছু হিয়াও এসে দাঁড়াল। ওদের দিকে তাকিয়ে হেঁসে ফেলল সে। আবির আর বিহান বেচারাদের এক জিহবা বেড়িয়ে গেছে আদিত্যর সাথে জগিং করে। আবির বেচারারতো এখন কোনোরকমে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসছে নিজেকে। বিহান আর পারলোনা। মাজা বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে পেটে হাত রেখে হাঁপাতে লাগল। গলা শুকিয়ে ধূধূ বালুচর হয়ে গেছে। এখুনি যেন জান বেড়িয়ে যাওয়ার পথে তাদের। আবির নেতিয়ে পড়ার মতো টেনেটুনে এসে বিহানের কাঁধ ধরে ঝুলে পড়ে বলল,
“বাচা ভাই আমারে। এই ভরা যৌবনে মরে গেলে আমার নারীসেবার কি হবে! সবতো সেবা বিহীন অসহায় হয়ে পড়বে। ওদের জন্য হলেও আমারে বাঁচা ভাই।”
“চুপ হালা,পয়লা আমারেতো বাচপার দে।আমি মইরা গেলে গা। আমার বাচ্চা টা বাপ কারে কইবো! মেহনত আমি করলাম আর বাপ ডাক আরেকজন হুনবো! এইদিনের লাইগা কি এত এত জাইগা মাথা ঘাম পায়ে ফেইলা অক্লান্ত শ্রম দিছি!”
“সালার এই আদিডা এতো স্ট্যামিনা পাই কই থেকে? সালা একটু ভালো হতেই আমাদের হাল বেহাল করে।দিচ্ছে। সকাল সকাল আরামের ঘুমডারে টিভি সিরিয়ালের শাশুড়ীর মতো এসে বর্বাদ করে দিলো। এই জগিংডা আবিষ্কার করছে কোন বেডায়! তারে পাইলে হাত পা বেঁধে দিনরাত মাহফুজ রহমানের গান শুনাইয়া হার্ট,ব্রেন সব একসাথে স্ট্রোক দিতাম।”
“আমার মনে হয় এইডা কোনো বউ পীড়িত স্বামীর আবিষ্কার। আছলে ছে হয়তো বউয়ের অত্যাচারে বাড়ি থাইকা ছকাল ছকাল উইঠা পালাবার চাইছিলো। মাগার বউয়ের হাতে ধরা পইড়া যায় তহন বউয়ের মাইর থাইকা বাচনের লাইগা এই জগিং-এর আবিষ্কার করে।”
“বাহ ভাই বাহ! কি দিলি! তোর হার্ডডিস্কে এত ডাটা আছে জানাই ছিলোনা আমার। আমিতো অবাক বনে গেলাম!”
“থ্যাংকস ইয়ার। কহোনো অহংকার করি নাইক্কা।”
এদের এতো বেদরদি অবস্থার মাঝে আদিত্য দিব্যি জগিং করতে করতে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ পেছনে ওদের না দেখে থেমে গিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো সে। ওদেরকে থেমে যেতে দেখে বলল,
“কিরে কি হলো তোদের? থেমে গেলি কেন? এখনো আরও তিন রাউন্ড বাকিতো।”
আবির দুই কানে হাত চেপে ধরে টিভি সিরিয়ালের নায়িকাদের মতো করে বলে উঠল,
“নেহিইইই…..,,,রহম কর জালিম, রহম কর। আর কতো অত্যাচার করবি এই নাদান মাছুম বাচ্চাদের উপর! তোর মনে কি কোনো মায়া দয়া নেই! কি দোষ এই মাছুম বাচ্চাদের! নাহয় দেখতে তোর চেয়ে বেশি কিউট। তাই বলে এভাবে বদলা নিবি! উপরওয়ালাকে ভয় কর জালিম! এত অহংকার ভালো না। দুনিয়াতে নেংটাই এসেছিস, নেংটাই যেতে হবে। কোনোকিছুই সাথে যাবে না। তাহলে কিসের এত অহংকার রে পাগলে!”
“এই বয়সেই এই হাল তোদের! দুদিন পরতো তোদের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখতে হবে।”
আবির এবার সটান হয়ে এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“কিহ! এত বড়ো অপমান! তাও আবার দ্য গ্রেট, দ্য সুপার বয় আবিরের! এটা শোনার আগে আমার নানী কেন মরে গেলনা!”
বিহান পাশ থেকে বলে উঠল,
“মাগার তোর নানীতো হাঁচাই টপকাইয়া গেছেগা বহুত আগেই।”
“তুই চুপ থাক হালা! আমার নানী, আমি যতবার খুশি মারি তোর কি বে? তোরতো ইজ্জত এমনিতেও নাই। আমারডাতো বাঁচাতে দে।”
“কেন কেন, আমার ইজ্জত আবার কোন কাউয়াই ঠোকায় খাইয়া হালাইলো!”
“ছি ছি বিহান,তুই ভাবিকে কাউয়া বলছিস! এত সুন্দর বউটাকে কাউয়া বলতে একবারও তোর গলগণ্ডতে বাঁধল না! দাঁড়া আমি এখুনি বলছি ভাবিকে।”
“ওই হালা কি কছ এইছব! হালা মার খাওয়াবি আজ!”
“তাইলে চুপ থাক। আর আমার সাপোর্ট কর।”
আবির আবার আদিত্যর উদ্দেশ্যে বলল,
“হ্যাঁ তো মিঃ আদিত্য দ্য মাচো ম্যান,তুই নিজেকে কি ভাবিস হ্যাঁ! আমরা তোর থেকে কোনো অংশে কম না বুঝেছিস!”
ওদের কথার মাঝে হিয়া এগিয়ে এসে বলল,
“সেটা এখুনি প্রমাণ হয়ে যাবে। কেন না একটা প্রতিযোগিতা হয়ে যাক! দৌড় প্রতিযোগিতা। ওই গেটের কাছ থেকে বাসার দরজা পর্যন্ত। যে আগে পৌঁছাবে সে ফাস্ট। আর বোঝা যাবে তার স্ট্যামিনাই বেশি।”
আবির এটিটিউড নিয়ে বলল,
“আরে এটাতো বা হাতের ছোট আঙুলের ব্যাপার। আমি রাজি।”
বিহান বলল,
“আমিও রাজি।”
হিয়া বলল,
“এত সহজ না। এখানে একটা টুইস্ট আছে। দৌঁড়ানোর সময় তোমাদের অন্য কাউকে কোলে নিয়ে দৌড়াতে হবে। ”
আদিত্য হাসিমুখে বলল,
“আইডিয়া পছন্দ হয়েছে আমার। আমি আমার এঞ্জেলকে নিয়ে দৌড়াবো।”
বলেই নূরের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ মেরে দিলো আদিত্য। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো নূর। বিহান অসহায় কন্ঠে বলল,
“এইডা ঠিক না।আমিতো আমার বউকে এই অবস্থায় কোলে লইয়া দৌড়াবার পারুম না। তাইলে আমি কারে নিমু!”
আবির বলে উঠল,
“তোরতো তাও বউ আছে। আমারতো বউয়ের ছবিও নাই। আমি কারে নিয়ে দৌড়াবো? যদিও আমার আবার এত অহংকার নেই। যেকোনো সুন্দরী রমনীকে আমার কোলে দিয়ে দিলেই আমি ভদ্র ছেলের মতো বিনাবাক্যে কোলে নিয়ে দৌড়াতে রাজি।”
হিয়া বলল,
“আমার কাছে একটা উপায় আছে। যেহেতু তোমাদের দুজনেরই কেউ নেই তাই তোমরাই একজন আরেকজনকে কোলে তুলে দৌড়াও।”
আবির অসহায় কন্ঠে বলল,
“এই দিনই দেখার বাকি ছিলো! এ কেমন বিচার!”
আদিত্য হেঁসে দিয়ে বলল,
“এটাই তোর কর্মের ফল। নে বিহান আবিররে কোলে নে।”
অতঃপর তাই করা হলো। আদিত্য নূরকে কোলে নিলো আর বিহান আবিরকে। আবির বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ছি ছি কেমন বেইজ্জত টাইপ ফিলিং হচ্ছে আমার। দেখ আমার দিকে এমন ভাবে তাকাবিনা। আমি কিন্তু একদম ওই টাইপের ছেলে না।”
“তুই অফ যা হালা। আমারে ডিস্টার্ব করিস না।”
“আচ্ছা আচ্ছা অল দ্য বেস্ট। ”
আদিত্য আর বিহান পজিশন নিলো। তারপর হিয়া হুইসেল বাজাতেই দৌড়ানো শুরু করল দুজন। আবির বিহানকে উৎসাহ দিতে বলল,
“চাল ধান্নো, চাল,আজ তেরি বাসন্তী… থুক্কু, আজ তেরি আবিরের ইজ্জত কা সাওয়াল হে।”
কিন্তু শেষমেশ বেচারার ইজ্জত আর বাঁচল না। আদিত্য মুহূর্তের মধ্যেই নূরকে নিয়ে দৌড়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে গিয়ে ফাস্ট হয়ে গেল। আদিত্য খুশিতে নূরকে নিয়ে গোল গোল ঘুরতে ঘুরতে বলতে লাগল,
“ইয়েস ইয়েস,আদিনূর ইজ দ্য বেস্ট।”
আবির হেরে গিয়ে বিহানের কোল থেকেই তার উদ্দেশ্যে রাগ দেখিয়ে বলল,
“দিলিতো হারাইয়া! আগেই জানতাম তোর দ্বারা কিছু হবে না। তোর মধ্যে আর কোনো আর কোনো হাওয়া নাই।”
বিহান ক্ষেপে গিয়ে বলল,
“আমার হাওয়া নাইক্কা তাইনা! তাইলে তুইই হাওয়া ভর।”
বলেই বিহান আবিরকে তুলে সামনের সুইমিং পুলের মাঝে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। আবির ঝপ করে গিয়ে পড়ল পানির মাঝে। আবির নাকে মুখে পানি খেয়ে কোনরকমে পানির মাঝে দাঁড়িয়ে বলল,
“এটা ঠিক করলি না হারামি। দেইখা নিমু তোরে।”
বিহান হাসতে লাগল। ঠিক তখনই হিয়া এসে পেছন থেকে বিহানকে ধাক্কা দিয়ে পানির মাঝে ফেলে দিলো। তারপর বলল,
“লুজার দুইজনই। তাই একজন কেন ডুববে!”
বিহান অসহায় কন্ঠে বলল,
“তুমি কি আমারই বউ!”
হাসতে লাগল হিয়া।আবির বিহানের দিকে তাকিয়ে এক ভ্রু উঁচিয়ে সয়তানি হেঁসে বলল,
“আব তেরা কেয়া হোগা কালিয়া!মুহ হা হা…..”

ওদের কান্ড কারখানা দেখে হাসছিল নূর। হাসতে হাসতে আদিত্যর দিকে তাকালে তার দুষ্টুমি ভরা হাসিমাখা চাহুনি দেখতে পেল। নূর যেন কিছু একটা আচ করতে পারলো। বুঝতে পারল আদিত্যর মাথায় এমুহূর্তে কি দুষ্টুমি ঘর বাঁধছে। নূর চোখ বড়ো বড়ো তাকিয়ে মাথা দুই দিকে না সূচক নাড়িয়ে বলল,
“নো নো নো..”
আদিত্য তার দুষ্টু হাসি আরও বিস্তর করে বলল,
“ইয়েস ইয়েস ইয়েস..
” দেখো একদম না কিন্তু।”
আদিত্য নূরের অসম্মতির তোয়াক্কা না করে তাকে নিয়ে যেতে লাগল পুলের দিকে। নূর আর উপায় না পেয়ে তড়িৎ গতিতে আদিত্যর কোল থেকে ঝট করে নেমে ছুটে পালানোর চেষ্টায় সামনের দিকে দৌড়াল। আদিত্যও থেমে রইলো না। পিছে পিছে ছুটলো নূরকে ধড়-পাকড় করতে। নূর হাসছো ছুটছে এলোমেলো। আদিত্যও তার পিছে পিছে ছুটে তাকে ধরতে মরিয়া। দুজনেই হাসছে আর ছুটছে। নূর দৌড়াতে দৌড়াতে বাগানের দিকে এসে পড়ল। গাছের মাঝ দিয়ে এলোমেলো ছুটছে সে। উড়ছে তার এলো চুল আর সাদা রঙের লম্বা ওড়নার আঁচল হাওয়ার তালে। আদিত্য তার কাছাকাছি এসে হাত বাড়িয়ে ধরতে চাইছে তার উড়ে বেড়ানো ওড়নার আঁচলের কোণ। কিন্তু ফসকে যাচ্ছে বারংবারই। দৌড়াতে দৌড়াতে বাগানের অনেকটাই গহীনে চলে এলো নূর। সামনের দিকে নজর ছিলো তার। কিছুক্ষণ পর পেছনে তাকিয়ে আদিত্যকে দেখতে নিয়ে দেখলো আদিত্য ওর পিছনে নেই। থেমে গেল নূর। আশেপাশে নজর বুলিয়েও আদিত্যর হদিস দেখা গেলনা। ভ্রু কুঁচকে সামনের দিকে একটু এগিয়ে গেল সে। পাশের একটা গাছে হাত রেখে মাথা একটু উঁচু করে এদিক ওদিক উঁকি দিয়ে খুঁজল খানিক। আদিত্যকে না দেখে ঘুরে দাঁড়াতেই আচমকা ছো মেরে তার সামনে হাজির হলো আদিত্য। তাকে এমন আচমকা দেখে চমকে উঠল ক্ষণিকের জন্য নূর। হকচকানো হাসি ফুটল তৎক্ষনাৎ। আদিত্য বাঁকা হেঁসে এক হাত নূরের মাথার পাশ দিয়ে গাছের উপর রাখলো। আরেক হাত অন্যপাশে নূরের কোমড়ের পাশে গাছের উপর ঠেকালো। মাঝে নূর আবদ্ধ। নূর নিজের দুই হাত পেছনে রেখে সেটে গেল গাছের সাথে আটকে। লাজুক রাঙা হাসি মুখে বিদ্যমান। আদিত্য মোহময় চাহুনি রেখে হালকা ঘাড় কাত করে ঝুঁকল নূরের মুখের উপর। নাক ঠেকেছে নূরের মাথার সাইডের চুলের উপর। দুষ্টুমি লুকানো কন্ঠে বলল
“এখন কোথায় পালাবে জানেমন!”
নজর লুকাতে ব্যাস্ত নূর। লাজুক হাসি যেন আরও বৃহৎ হচ্ছে। তখনই কাঁধের মাঝ বরাবর উষ্ণ কোমল ছোঁয়ার প্রভাবে কেঁপে উঠল তনু বদন। অধর চেপে রইল আদিত্য। চোখ বুঁজে নিজের জামা খামচে ধরল নূর। অধরের জায়গা হলো এবার নূরের কানের লতিতে। শিরশিরানি অনুভবে কাঁধ হালকা বেঁকে গেল তার। পরপরই হঠাৎ নিজেকে শূন্যে অনুভব নূর। হকচকিয়ে চোখ খুলে তাকালে নিজেকে আদিত্যর কোলে পেল সে। তার তাকানো দেখে আদিত্য এক চোখ টিপ মেরে দুষ্টু হেঁসে বলল,
“আদিত্যর হাত থেকে পালানো এতো সহজ না সুইটহার্ট।”
হার মেনে নিলো নূর। বুঝল আজ আর ছাড়া পাবেনা সে। আদিত্য নূরকে নিয়ে পুলসাইডে এলো। তারপর আবির,বিহানের উদ্দেশ্যে বলল,
“ওই পাবলিক! অনেক ঝাঁপাঝাপি করেছিস। যা এখন। নাউ ইজ রোমান্টিক সুইম টাইম। তোরা যা ফুট এখান থেকে।”
আবির বলল,
“আরে ইয়ার, এক বছর পরতো গোসল করছি। এত তাড়াতাড়ি হবে কিভাবে!”
বিহান মুখ শিটকিয়ে বলল,
“ছিহ! পিচাচ হালা,অহনতো এই পুলই নর্দমা হইয়া গেল।”
বলতে বলতে উঠে গেল বিহান। আদিত্য আবিরকেও উঠতে বলল।অতঃপর মেলোড্রামা কিং আবির উঠে যেতে যেতে নেকা সুরে বলল,
“হ হ দিবিইতো তাড়াইয়া! আজ বউ পাইয়া বন্ধুরে ভুইলা গেলিতো! দেখ তোর দেওয়া আঘাতে আমি জর্জরিত। দুঃখে প্যান্ট ভিজে গেছে আমার। তাও বদদোয়া দিবোনা তোকে। আমি আবার কোমলপ্রাণ কিনা!”
আর ওরা চলে যেতেই আদিত্য নূরকে নিয়ে নামলো পুলের পানিতে। মেতে উঠল দুজন জলতরঙ্গের আনন্দে।
___

দেখতে দেখতে দু মাস পার হয়ে গেছে। আদিত্যর ট্রিটমেন্ট নিয়মিত চলছ। এতদিনে আদিত্য অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সাথে বাড়ছে নূরের ভেতরের ভয়। প্রতিবারই মেডিসিন দেওয়ার পর আদিত্য নূরকে চিনতে পারে না। তবে পরে জ্ঞান ফিরলে আবার আগের মতো হয়ে যায়। আজ আদিত্যর মেডিসিন কোর্সের শেষদিন। আজও একইভাবে মেডিসিন দেওয়ার পর আদিত্য হাইপার হয়ে যায়। এরপর নূরকে আর চিনতে পারে না। কিছুক্ষণ পর তাকে ইনজেকশন দিয়ে আবারও ঘুম পারিয়ে দেওয়া হয়। তারপর যথারিতি তাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। আদিত্যকে বাড়িতে নিয়ে আসতেই আরেক ঘটনা ঘটে। হিয়ার ডেলিভারি পেইন উঠেছে তখন। অবস্থা বেগতিক দেখে আবির আর বিহান দ্রুত তাকে হসপিটালে নিয়ে যায়। নূর থেকে যায় আদিত্যর কাছে। জ্ঞান ফিরে যে আদিত্য ওকে না পেলে অস্থির হয়ে যাবে। তাই নূর আর গেলনা হসপিটালে। আদিত্যকে বিছানায় শুইয়ে সে ওয়াশরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হতে। গোসল সেরে রুমে এসে আয়নার সামনে চুল ঝাড়তে লাগল। ঝাড়ার মাঝেই হঠাৎ আয়নায় দেখতে পেল আদিত্য জ্ঞান ফিরে ধীরে ধীরে উঠ বসছে। এক হাতে মাথা চেপে আছে। হয়তো মাথ ভারী লাগছ। নূর তোয়ালে রেখে আদিত্যর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
“ঘুম ভেঙেছে তোমার! ভালো হয়েছে। এসো গোসল করিয়ে দেই তোমাকে।আজকালতো গোসল না করিয়ে দেওয়া পর্যন্ত তুমি জিদ ধরে বসে থাকো। অনেক দুষ্টু হয়ে গেছ আজকাল। এখন চলো।”
বলতে বলতে নূর আদিত্যর হাত ধরে উঠানোর জন্য টেনে ধরল। তৎক্ষনাৎই আদিত্য ঝটকা মেরে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। নূর থমকিত চোখে তাকালে আদিত্য কপাল কুঁচকে বলল,
“হোয়াট ননসেন্স ইজ দিস! কে আপনি? আর আমার রুমে কি করছেন? এভাবে অপরিচিত পুরুষের রুমে ঢুকে হাত ধরে টানাটানি করা এগুলো কি ধরনের অসভ্যতামী!”
নূর যেন মূর্তিতে পরিণত হলো মুহুর্তেই। হৃদয় বরফ কঠিন। সে যে ভয়ে শঙ্কিত ছিলো সেই দিন বুঝি এসে গেছে তার সামনে। আদিত্য আজ সত্যি সত্যিই চিনতে পারছে না এই স্নেহা রুপি নূরকে। অনুভূতি শূন্য নূর প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে পড়ল। তখন আদিত্য আরও রাগী গলায় বলল,
“কথা বলছেন না কেন? কে আপনি? আর বিনা অনুমতিতো আমার রুমে ঢোকার সাহস হলো কি করে!”
আহত চোখ জোড়ায় প্রিয়তমকে হারানোর অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। নিজেকে তবুও কোনোমতে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে নূর বলল,
“দে…দেখো, আমার কথা শুনো। আমি সব খুলে বলছি তোমাকে। আসলে আমি নূ….”
“আমি আপনার কোনো শুনতে মোটেও ইন্টারেস্টেড না। আপনি এক্ষুণি বেড়িয়ে যান আমার রুম থেকে। আমার স্ত্রী দেখলে ভুল বুঝবে।”
হঠাৎ যেন আদিত্যর কপালের চামড়া টান হলো। মনে পড়লো তার নূর, তার এঞ্জেলের কথা। সে কম্পিত গলায় বলল,
“আমার এঞ্জেল! কোথায় আমার এঞ্জেল! আমাদেরতো এক্সিডেন্ট হয়েছিল!নূর কোথায় তাহলে? এঞ্জেল! এঞ্জেল!.. ”
আদিত্য পাগলের মতো ডাকতে ডাকতে এদিক ওদিক খুঁজতে লাগল নূরকে। নূর ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে। সে তবুও চেষ্টা চালালো। আদিত্যর সামনে গিয়ে বলল,
“দেখো আমার কথা শোনো প্লিজ। এমন করোনা। আমি সব বুঝিয়ে বলছি তোমাকে।”
নূরকে কোথাও না পেয়ে আদিত্য এমনিতেই অস্থির মরিয়া হয়ে গেল। যার দরুন সে ক্রোধিত হয়ে বলল,
“ও জাস্ট আপ। জাস্ট গো ফ্রম হিয়ার। খোদেজা,, খোদেজা..”
আদিত্য জোরে জোরে খোদেজাকে ডাকতে লাগল। তার ডাক শুনে খোদেজা দৌড়ে এলে আদিত্য বলল,
“এই মেয়ে আমাদের বাড়িতে কিভাবে ঢুকলো। এক্ষুণি ওকে বের করো এ বাড়িতে থেকে। রাইট নাও।”
খোদেজা কিছু বলতে যাবে তখন নূর চোখের ইশারায় তাকে মানা করল। আদিত্য এমনিতেই অস্থির হয়ে আছে। এমতো অবস্থায় সে কোনো কিছু শোনার পর্যায়ে নেই। এতে হয়তো ওর আরও ক্ষতি হতে পারে। তাই নূর খোদেজাকে ইশারা করল আদিত্যর বলা অনুযায়ী কাজ করতে। খোদেজা নূরের হাত ধরে বাইরে নিয়ে যেতে লাগল। যেতে যেতে অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে রইলো সে আদিত্যর পানে। এটাই হয়তো তার শেষ দেখা তার প্রিয়তমকে।

চলবে……

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি (S-2)
পর্ব-৩৫
®মেহরুমা নূর

★দরজা খুলে দিতেই সম্মুখে নূরকে স্থীর দাঁড়ানো পেল জাকিয়া। হঠাৎ নূরকে এখানে দেখে যেমন খুশি হলো তেমনই চিন্তিত হলো নূরের অবস্থা দেখে। মেয়েটার মুখ কেমন ফ্যাকাসে র,ক্তশূন্য। যেন মৃত কোনো ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। জাকিয়া শঙ্কিত হলো। মেয়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,
“স্নেহা! কি হয়েছে মা? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন? আর হঠাৎ এভাবে এলি যে!”
নূর অশ্রুঝরা নয়নে করুন বেদনার্ত চাহুনিতে তাকালো জাকিয়ার দিকে। কেন যেন এমুহূর্তে তার নিজের গর্ভধারিণী মায়ের চেয়ে বেশি জাকিয়ার কথাই আগে মনে পড়ল। তাইতো নিজের কষ্টের ভার নিয়ে নূর জাকিয়ার কাছে এসে হাজির হয়েছে। অসহায় নিদারুণ বেদনার্ত কন্ঠে কেঁদে উঠে নূর বলল,
“মা, আমি কি করবো? আমার আদিত্য যে আমাকে চিনতে পারছেনা, মা! আমারতো অস্তিত্বই শেষ হয়ে গেল! ”
বলতে বলতে হু হু করে করুন সুরে কেঁদে উঠল। জাকিয়া মেয়ের কষ্টে ব্যথিত হয়ে দ্রুত মেয়েকে জড়িয়ে নিলো মমতার আঁচলে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“শান্ত হ মা, কি হয়েছে আগে খুলে বল! এভাবে ভেঙে পড়লে হবে!আয় ভেতরে আয়।”
জাকিয়া নূরকে ধরে ভেতরে নিয়ে এলো। সোফায় বসিয়ে অনেক চেষ্টার পর তাকে একটু শান্ত করালো। তারপর জানতে চাইলো কি হয়েছে। নূর তখন সব বিস্তারিত বলল জাকিয়াকে। সব শুনে জাকিয়ারও খুব খারাপ লাগল মেয়েটার জন্য। সে নূরের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দিয়ে বলল,
“কাঁদিস না মা,এতো ভেঙে পড়লে হবে! তুই চিন্তা করিসনা। আদিত্য একবার সবটা জানতে পারলে দেখবি ঠিকই চিনতে পারবে তোকে। দরকার হলে আমরা গিয়ে কথা বলবো ওর সাথে।”
নূর তড়িৎ গতিতে বলল,
“না না মা,একদম এটা কোরোনা। মাত্রতো ও সুস্থ হয়েছে। এসব বলে ওকে নতুন কোনো প্রেশার দিতে চাইনা আমি। এতে ওর মানুষিক অবস্থা আবারও খারাপ হতে পারে। ও সুস্থ থাকুক এরচেয়ে বেশি জরুরি কিছু না আমার কাছে।”

“দেখলিতো টুকটুকি! এই ছিলো তোর আদিত্য!”
সামনে আসা কথাটির উৎস খুঁজতে নূর মাথা তুলে সামনে তাকালে পাভেলকে এগিয়ে আসতে দেখলো। গত দুমাসে তার শরীরের আঘাত সেরে গেছে সব। পাভেল আরও সামনে অগ্রসর হয়ে নূরের পাশের সোফায় এসে বসলো। বলতে লাগল,
“কতটা অকৃতজ্ঞ ওই লোকটা! যারজন্য দিনরাত এতো সেবা করলি সেই আজ ভালো হয়ে তোকে চিনলোনা।তুই আমাকে সেদিন বললি আমি নাকি চেহারার জন্য তোকে চাই। তাহলে আজ কি বলবি! আদিত্যওতো তোকে অন্য চেহারায় দেখে চিনতে না পেরে ফিরিয়ে দিলো!তাহলে ওর ভালোবাসা খাটি কিভাবে হলো! আর তুই ওই লোকটার জন্য আমাকে ছেড়ে দিলি। তবে আমি ভুলিনি তোকে। তোকে আমার চেয়ে বেশি কেউ ভালোবাসতে পারবেনা। তুই চিন্তা করিসনা আমি আছিতো তোর পাশে।”
নূর চোখের পানি মুছে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“আমার আদিত্যর ভালোবাসা কতটা গভীর তা বোঝার মতো ক্ষমতা তোমার নেই। আর না তোমার সামনে সেটা প্রমাণ করা প্রয়োজন মনে করি আমি। শুধু মনে রেখো শুধু এক জনম কেন,আরও সাত জনম ভালোবাসলেও আদিত্যর ভালোবাসার সমান কেউ করতে পারবে না। কখনো না। তুমি এসবের মাঝে না পড়লেই খুশি হবো।”
বলা শেষ করেই উঠে নিজের রুমে চলে গেল নূর। তার এখন পাভেলকে অসহ্য লাগছে। সবকিছুই অসহ্য লাগছে তার। মনটা পড়ে আদিত্যর বিরহে।কিভাবে বাঁচবে সে তার আদিত্যকে ছাড়া। আলাদাই করার ছিলো তাহলে এই নতুন জীবন কেন দিলো আল্লাহ তাকে!
___

রাতের দিকে বাসায় ফিরল আবির। হিয়ার ডেলিভারি ভালোভাবেই হয়েছে। ছেলে সন্তান হয়েছে তাদের। বিহান সেখানেই রয়েছে বউ বাচ্চার সাথে। অনেক রাত হওয়ায় আবির বাসায় চলে এসেছে। তবে বাসায় আসতেই খোদেজার কাছে ঘটনার বিবরণ জানতে পারে সে। ভীষণ রকম চমকে যায় সে। একদিকে বন্ধু পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার খুশি। অন্যদিকে নূরকে চিনতে পারার চিন্তা মন খারাপ করে দিলো তার। সে দ্রুত পা বাড়াল আদিত্যর রুমের দিকে। রুমে এসে দেখলো আদিত্য অস্থির ভাবে পায়চারী করছে। আবিরকে দেখেই সে দ্রুত তার সামনে এসে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“আমার নূর কই আবির? বল আবির আমার এঞ্জেল কোথায়? আমাদেরতো এক্সিডেন্ট হয়েছিল! তারপর কি হয়েছে? আর আমার এঞ্জেল কোথায়? ওকে দেখছি না কেন? সত্যি করে বল ওর কিছু হয়নিতো!”
আবির বলল,
“তোর এঞ্জেলতো তোর সামনেই ছিলো। তাকে তুই বের করে দিলি।”
“হোয়াট! কি আবোলতাবোল বলছিস এসব! দেখ হেয়ালি না করে সত্যি করে বল নূর কোথায়? আম স্কেয়ারড নাউ।”
আবির আদিত্যর হাত ধরে বলল,
“শান্ত হ আদি। আমি বলছি তোকে সব। আগে শান্ত হয়ে বোস।”
আবির আদিত্যকে বিছানার উপর বসিয়ে বলল,
“দেখ আমি যা বলবো তা মন দিয়ে শুনবি। আগেই উত্তেজিত হবি না।”
“আবির তুই আগে বল আমার নূর কোথায়?”
“বলছি। তোদের এক্সিডেন্টের দুবছরের বেশি হয়ে গেছে আদি। তুই এতদিন মানুষিক ভাবে অসুস্থ ছিলি। এরমাঝে অনেক কিছুই হয়ে গেছে।”
“দুবছর হয়ে গেছে! এতদিন নূর নিশ্চয় আমার সাথেই ছিলো তাইনা বল!”
আদিত্যর কন্ঠ কম্পিত ভীতিগ্রস্ত। আবির বলল,
“আগে আমার পুরো কথা শোন। এক্সিডেন্টের পর নূর ভাবিকে পাওয়া যায় গিয়েছিল না। আমরা ভেবেছিলাম সে বোধহয়…..।তুই সেকারণেই আসলে মানুষিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলিস। কিন্তু আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে নূর ভাবি আবার ফিরে আসে। আমরা জানতে পারি সে বেঁচেই আছে। গত দুবছর সে অন্য এক জীবন অতিবাহিত করছিলো।”
“কি বলছিস আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুই শুধু বল নূর এখন কোথায়? আমার সামনে কেন আসছে না?”
“আসবে কিভাবে? তুইতো তাকে তাড়িয়ে দিলি। যাকে তুই অসুস্থ অবস্থায় যখন আমরা কেউ চিনতে পারিনি তুই ঠিকই চিনতে পারলি আর সুস্থ হতেই তাড়িয়ে দিলি!”
“কি বারবার একই কথা বলছিস! আমি কেন আমার নূরকে তাড়িয়ে দিবো? পাগল হয়ে গেছিস তুই! নূরকেতো আমি পাগলের মতো খুঁজে যাচ্ছি তখন থেকে।”
“ভাবিতো তোর সামনেই ছিলো।যাকে তুই অন্য মেয়ে ভেবে তখন তাড়িয়ে দিলি ওটাই তোর নূর, তোর এঞ্জেল।”
স্তম্ভিত হয়ে গেল আদিত্য। ধাক্কা লাগল মন মস্তিষ্কে তার। সে কপাল কুঁচকে বলল,
“হোয়াট রাবিশ! ওই মেয়ে কিভাবে নূর হবে! ওতো অন্য কেউ। আমি কি আমার নূরকে চিনবো না!”
“হ্যাঁ আদি, ওটাই নূর ভাবি। এক্সিডেন্টের পর ভাবির চেহারা নষ্ট হয়ে যায় তাই তাকে নতুন চেহারা দেওয়া হয়। শুধু এই না। ভাবি তার স্মৃতিও হারিয়ে ফেলেছিল। গত দু বছর সে অন্য এক পরিবারে স্নেহার পরিচয়ে বেঁচে ছিলো। এবং ঘটনাচক্রে তোর সাথে দেখা হয়।তারপর ধীরে ধীরে তার সব মনে পড়ে যায়। প্রথমে আমরাও বিশ্বাস করিনি তার কথা। কিন্তু পড়ে যখন নূর ভাবির মা-বাবার সাথে ডিএনএ ম্যাচ করা হয় তখন সত্যি সত্যিই জানতে পারি সেই আসলে আমাদের নূর ভাবি। তোর এঞ্জেল।তবে এরমাঝে একটা জিনিস ভালো হয়েছে। নূর ভাবির মানুষিক অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সে এখন বাকি সবার মতোই স্বাভাবিক। এরপর থেকে সে দিনরাত তোর সেবা করে তোকে সুস্থ করে তুলল। তোর বিশ্বাস নাহলে আমি তোকে এখুনি ডিএনএ রিপোর্ট দেখাচ্ছি। তাহলে তুই বুঝতে পারবি।”
আবির ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট এনে দেখালো আদিত্যকে। সবটা শুনে আর রিপোর্ট দেখে আদিত্য থমকে গেল। হৃদপিণ্ড চিপে আসলো তার। অপরাধবোধ গলা চিপে ধরলো তার। নিজেকে তার যেন আজ একেবারেই অযোগ্য ব্যক্তি মনে হচ্ছে। সে কিভাবে চিনতে পারলোনা তার প্রাণভোমরাকে! আজ বাহ্যিক চেহারাটাই শুধু তার চোখে পড়ল! মেয়েটা কতবার বলতে চাইলো কিন্ত আমি অপদার্থ তা শুনতেই চাইলাম না! মেয়েটাকে কিভাবে বের করে দিলাম বাড়ি থেকে! এখন কোন মুখ নিয়ে যাবো আমি তার সামনে! আমাকে কি মাফ করবে সে! ফিরবে কি আর আমার কাছে! নাজানি কোথায় আছে আমার এঞ্জেল টা! না না, এভাবে আমি যেতে দিবোনা তাকে! আরও একবার হারাতে দিবোনা আমি আমার এঞ্জেলকে। যেভাবেই হোক তাকে খুঁজে আনবোই আমি। দূরে যেতে দিবোনা কিছুতেই। আদিত্য অস্থির কন্ঠে বলল,
“আবির আমাদের দ্রুত খুঁজতে হবে নূরকে। নাজানি কোথায় আছে মেয়েটা! ওকি বাড়ি চলে গেছে? ”
“আচ্ছা আচ্ছা শান্ত হ আগে। আমি ভাবির গ্রামের বাড়ি ফোন করে শুনছি ভাবি গেছে কিনা।”
আবির প্রথমে নূরের নাম্বারে ফোন দেয়। কিন্তু নূর যাওয়ার সময় ফোন রেখেই চলে গেছো।তাই ফোন দিলো নূরের গ্রামের বাড়িতে। তবে তারা জানালো নূর সেখানে যায়নি। আবির আদিত্যকে বলল,
“ভাবিতো নাকি ওখানে নেই আদি।”
আদিত্যর সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। পাগলের মতো অস্থির করুন সুরে বলল,
“সব আমার জন্য হয়েছে। এখন কি করবো আমি! আবারও হারিয়ে ফেললাম আমার এঞ্জেলকে! নূর নিশ্চয় কষ্ট পেয়ে কোথাও চলে গেছে। আমার নিজেকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে।”
“শান্ত হ, পেয়ে যাবো ভাবিকে। চিন্তা করিসনা। ভাবি হয়তো উনার নতুন পরিবারের কাছেও যেতে পারে। স্নেহার মা বাবার কাছে। কিন্তু উনাদের নাম্বারতো আমার কাছে নেই।”
“উনাদের বাসা কোথায়? আমাকে নিয়ে চল এখুনি সেখানে।”
“হুম ঠিক আছে চল।”
আদিত্য আবিরের সাথে দ্রুত বের হলো স্নেহাদের বাসার উদ্দেশ্যে। ঘন্টাখানেকের ব্যবধানে তারা পৌঁছে গেল কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়। গাড়ি থেকে নেমে আদিত্য আবির বাসার সামনে পৌঁছালেই হঠাৎ পাভেল সামনে এসে তাদের পথ আঁটকে ধরল। তাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে আসলো আদিত্যর। পাভেল সটান হয়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠল,
“এখানে আর কোন মুখে এসেছিস! স্নেহার ধারে কাছেও যাওয়ার অধিকার হারিয়ে ফেলেছিস তুই। ফিরে যা এখান থেকে। স্নেহাকে পাওয়ার যোগ্য না তুই। ওকে আমি যতটা ভালোবাসি ততটা কেউ বাসতে পারবেনা। এমন কিছু নেই তোর মাঝে যা আমার নেই। তাহলে স্নেহা কেন তোর হবে?”
আবির রেগে গিয়ে বলল,
“গতবারের ধোলাইে বোধহয় স্যাটিসফাই হোসনি তুই। ব্যাপার না, এবার পুরো স্যাটিসফাই করে দিবো।”
আদিত্যর কুঁচকানো ভ্রু যেন আরও কুঁচকে এলো। ছেলেটার কথাবার্তা বুঝতে কিছুটা অপারগ হচ্ছে সে। আদিত্য বিষয়টা জানার উদ্দেশ্যে আবিরের দিকে তাকালে আবির তখন আদিত্যকে পাভেলের বিষয়টা খুলে বলে। তা শুনে আদিত্য এবার ঘাড় বাঁকিয়ে তীক্ষ্ণ সরু চোখের নজর নিক্ষেপ করলো পাভেলের পানে। পাভেলের উপর নিচ স্ক্যান করে দেখলো ক্ষানিকটা। তারপর মাথা অন্য দিকে ঘুরিয়ে হালকা তাচ্ছিল্যকর হাসি টেনে বলল,
“সাদমান শাহরিয়ার আদিত্য একটু ব্রেকে কি চলে গিয়েছে, মিনি বিড়ালও হুংকার দেখানোর সাহস করছে!”
আদিত্য দু-পা এগিয়ে এসে পাভেলের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“হুম তো কি যেন বলছিলি! কম্পারিজন! তোর আর আমার মাঝে এমনিতেও কোনো কম্পেয়ার যায় না।আদিত্যর সাথে কম্পেয়ার করারও একটা লেভেল লাগে। আর নূরকে কতটা ভালোবাসি সেটা নিয়েতো কখনোই কোনো কম্পেরিজন ইম্পসিবল। আমি চাইলে তোর এই দুঃসাহসের শাস্তি হিসেবে তোর কলিজাখানা এই মুহুর্তে টেনে বের করতে পারি। জাস্ট আ সেকেন্ড-এর ব্যাপার। তবে তুই যেহেতু কোনো খারাপ মতলবে না, বরং ভালোবাসার দাবি করছিস তাই তোকে আয়না দেখনোটা জরুরি। তুই বলছিলি না কি আছে আমার মাঝে যা তোর মাঝে নেই। এখুনি দেখাচ্ছি।”
আদিত্য আবিরের উদ্দেশ্যে বলল,
“গাড়ি থেকে আমার গানটা নিয়ে আয়।”
আবির মাথা নেড়ে গাড়ি থেকে আদিত্যর গান বের করে নিয়ে এসে আদিত্যর হাতে দিলো। আদিত্য পিস্তলের ভেতর শুধু একটা গুলি ভরে পাভেলের উদ্দেশ্যে বলল,
“তুই বলছিলি না আমার মাঝে কি এমন আছে যা তোর মাঝে নেই! তো এই হলো জবাব। আমি নূরের জন্য হাসতে হাসতে আমার জান দিয়ে দিতে পারবো। তুই পারবি? এই পিস্তলে একটা গুলি আছে। দেখা যাক কার কপালে জোটে এটা। যা তোর জন্য সহজ করে দিচ্ছি। প্রথমে আমিই শুট করছি।”
বলেই আদিত্য নিজের মাথার পাশে পিস্তল ঠেকিয়ে ট্রিগার চাপলো। তবে ফাঁকা গেল তার। এবার সে পাভেলের দিকে পিস্তলটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“নে এবার তোর ভালোবাসা দেখা রোমিও। ”
পাভেলের কপালে ঘাম ছুটে যাচ্ছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে তার। কাঁপা কাঁপা হাতে পিস্তলটা ধরল সে। ভয়ে ভয়ে মাথার কাছে নিতেই দম বেড়িয়ে গেল তার। ঠাস পিস্তল ফেলে দিলো সে। আদিত্য স্মিথ হেঁসে বলল,
“এবার বুঝলিতো কি আছে আমার মাঝে যা তোর মাঝে নেই! আশা করি এরপর আর বুঝতে সমস্যা হবে না। কারণ এরপর আমি কোনো প্রমাণ দিবোনা। বরং তোর এই প্রশ্ন জাগানো মস্তিষ্কটাই অফ করে দিবো।”
বলা শেষ করে পাভেলকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল আদিত্য আবিরও গেল সাথে। দরজায় নক করলে জাকিয়া দরজা খুলে দিলো। খুলে দিতেই আদিত্য অস্থির কন্ঠে বলল,
“নূর কোথায়?”
জাকিয়া থতমত কন্ঠে বলল,
“স্নেহাতো রুমে।”
আদিত্য আর ক্ষনিক সময় নষ্ট না করে হুড়োহুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। আর আবির ততক্ষণে জাকিয়াকে সবটা বুঝিয়ে বলল।

মেঝেতে নিস্তেজ অচেতনের মতো পড়ে আছে নূর। চোখ দিয়ে নীরব কান্না গাড়িয়ে পড়ছে অঝোরে। নিজেকে যেন নিঃশেষ অনুভব করছে সে। যেন তার বেঁচে থাকার প্রদীপটাই নিভে যাচ্ছে। আদিত্য বিনা বেঁচে থাকা জীবন্ত লাশ বৈ কিছুই না তার জীবন। তার সর্বস্ব জুড়ে যার বাস, তাকে বিনা কিভাবে হবে তার জীবন নিবাস! কতক্ষণ ধরে এভাবে পড়ে আছে তার খেয়ালও নেই এখন। জাকিয়া কয়েকবার ডেকেছিলো তাও যেন শুনতে পাইনি সে। তার কাছে যে এখন দুনিয়ার সব কিছুই বিষাদময় হয়ে গেছে। যে বিষাদের সমাপ্তি কেবল আদিত্যর আগমনেই ঘুচবে।নতুবা আর কিছুতেই না। এবং সেই মুহুর্ত বুঝি এলো সহসাই। কানে এসে বাজল সেই কাঙ্ক্ষিত কন্ঠস্বরটি।
“এঞ্জেল!”
থকমিত হলো নূর। ঝট করে উঠে বসে সে পেছনে ফিরে তাকালো। স্বয়ং আদিত্যকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস হলোনা তার। অপলক অশ্রুভরা করুন চাহুনিতে তাকিয়ে রইলো সে। আদিত্যর চোখে এক আকাশ ভালোবাসার মায়া উপচে পড়া নজর। যেন কতকাল বাদে পেল সে প্রেয়সীর দেখা। নজরে জমলো নোনাজলের পারদ। দুই হাত প্রসারিত করে প্রিয়তমাকে আহ্বান জানালো সে নিজের বাহুডোরে। বিরহে কাতর নূরের যেন এটারই অপেক্ষা ছিলো। সে আর ক্ষণিক সময় ব্যয় না করে উঠে দাঁড়িয়ে পাগলের মতো দৌড়ে এসে হামলে পড়ল আদিত্যর বক্ষস্থলে। দুই হাতে পেঁচিয়ে ধরলো আদিত্য গলা। কাঁধে মুখ গুঁজে কান্নার জোর বাড়াল সে। আদিত্যও তার এঞ্জেলকে দুই হাতে শক্ত বাঁধনে মিশিয়ে নিলো নিজের বক্ষমাঝে। কোমড় পেঁচিয়ে উঁচু করে ধরল আরও নিবিড় বাধনে। নূরের পা জমিন থেকে শুন্যে উঠে গেল। কাঁদছে সে। প্রাপ্তির কান্না। আদিত্য অনুভব করছে তার নূরকে। হ্যাঁ এইতো তার এঞ্জেল! তার নিঃশ্বাস যে আদিত্যর রন্ধ্রে রন্ধ্রে পরিচিত।অনুভব করল খুব করে তার প্রাণভোমরাকে। কিছুক্ষণ সেভাবে থেকে আদিত্য নামালো তাকে। দুই হাতে নূরের মুখটা ধরে সহস্র চুমুর বর্ষণ করল তার মুখ জুড়। কপালে কপাল ঠেকিয়ে অপরাধী গলায় বলল,
“আম সরি এঞ্জেল।আবির আমাকে সব বলেছে। মাফ করে দাও আমাকে। আমি আমার এঞ্জেলকে চিনতে পারিনি। আমার কলিজাটার সাথে কতো খারাপ ব্যবহার করেছি। মাফ করে দাও এঞ্জেল। চাইলে শাস্তি দাও। সব মেনে নিবো। শুধু আমার থেকে আর দূরে যেওনা। এখনতো চোখ বুজতেও ভয় করে। যদি তোমাকে হারিয়ে ফেলি! প্লিজ, আর দূরে যেওনা। আর তোমাকে হারাবার শক্তি নেই।”
নূর মায়াময় সুরে বলল,
“কোথায় যাবো হিরো! আমারতো রাস্তাও তুমি, মঞ্জিলও তুমি। তুমিহীনা সবই শূন্য।”
“চলো এঞ্জেল, তোমার রাজ্য তোমার অপেক্ষায় আছে।”
নূরের কপালে চুমু খেয়ে তাকে কোলে তুলে নিলো আদিত্য। নূরও আবেশে মাথা রাখলো আদিত্যর কাঁধে।

চলবে….