মরুর বুকে বৃষ্টি ২ পর্ব-৪২ এবং শেষ পর্ব

0
288

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি ( S-2)
পর্ব-৪২ (শেষ পর্ব)
®মেহরুমা নূর

★গাজীপুরে আদিত্যদের ফার্মহাউসে বেড়াতে যাবে আজ সবাই। আদিত্য-নূরের প্রায় দু সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। কিন্তু বাইরে কোথাও যাওয়া হয়নি তাদের। যদিও আদিত্য নূরকে নিয়ে কোনো আউট অফ কান্ট্রি যেতে চেয়েছিল। কিন্তু নূরের ইচ্ছে সবার সাথে বেড়ানোর। আর হিয়া ছোট বাচ্চা নিয়ে এখন বেশি দূরে ট্রাভেল করতে পারবেনা। তাই আপাতত ফার্মহাউসের প্ল্যান করা হয়েছে। এরমাঝে আবার আবিরকেও ধরে বেঁধে বিয়ের বাঁধনে আটকিয়ে ফেলা হয়েছে শেষমেশ। সেই খুশির কারণও যোগ হয়েছে এই আনন্দে। সকাল সকালই সবাই রেডি হচ্ছে বেরোনোর উদ্দেশ্যে। বিহান ছেলেকে কোলে নিয়ে দোলাচ্ছে আর হিয়াকে তাড়া দিয়ে বলছে,
“হইচে নি তোমার? আরে আমরা বাপ,বেটা ছেই কখন রেডি হইয়া বাছি হইয়া গেলাম। আর তোমার অহোনো ঠোঁটপালিছ,নখপালিছ দেওয়া ছ্যাস হইলো না!”
বিহানের ক্যাচক্যাচে হিয়া হাতের লিপস্টিকটা ঠাস করে ড্রেসিং টেবিলের উপর ফেলে বলল,
“ঠিক আছে, হলাম না রেডি। যাওয়াও লাগবেনা আমার। আমার জন্যইতো সব ঝামেলা তাইনা! এত এত দেরি হয়ে যাচ্ছে তোমার। আরে তোমাদের সময় লাগবে কেন? তোমরাতো একটা ফাটা জিন্স আর গেঞ্জি গলায় ঢুকালেই শেষ। আর কি কাজ আছে তোমাদের? আর মেয়েদের কত ধাপ পেরোতে হয় জানো! আরে একটা শাড়ি পড়তে গেলেও আগে তাকে পেটিকোট, ব্লাউজ পড়তে হয়। তারপরে আসে শাড়ির পালা। সেই শাড়ি পড়া লুঙ্গি পড়ার মতো সহজ কাজ না যে, কোমড়ে একটা গিট্টু মেরে দিলাম আর হয়ে গেল শাড়ি পড়া! আরে শাড়িটা প্রথমে পড়ার আগে উচ্চতা মাপতে হয়, হিলের উচ্চতা মেপে তারপর পড়া শুরু করতে হয়। তারপর কুঁচি করতে গেলেতো ধৈর্যের মা-বাপ হয়ে যায়। কুচি কতগুলো হলো,ঠিক মাপের হলো কিনা,পাটে পাটে বসছে কিনা,উঁচু নিচু আছে কিনা আরও কতকিছু লেভেল করতে হয়। এত চড়াই উৎরাই পেরিয়েও যখন দেখা গেল পড়া ঠিক হয়নি। তখন পুরো শাড়ি খুলে আবার নতুন করে শুরু করতে হয়। তাহলে বুঝতে পারছ কতটা কঠিন কাজ এটা! আরে আইনস্টাইনের বাপেরও ক্ষমতা হবে না শাড়ি পড়ার সহজ উপায় আবিষ্কার করার। আর তোমরা পুরুষরা বলো আমাদের সময় লাগে। একবার শাড়ি পড়ে দেখাও তাহলে বুঝবে কত শাড়িতে কত কুঁচি! ”
হিয়ার শাড়ি পূরাণ শুনে বেচারা বিহান তব্দা খেয়ে গেল। কেমন অনুভূতি শূন্য হয়ে হা হয়ে গেল। দাঁড়ানোর উপরই যেন কোমায় চলে গেল বেচারা। শাড়ির মাঝেও যে রহস্য আছে আজ জানলো সে। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বিহান বলে উঠল,
“হাঁচা কইছ বউ। আমার ভুল হইয়া গেছে গা। আর জীবনেও কিছু কমুনা। তুমি তোমার ছময় নিয়া রেডি হও। ছমছ্যা নাই৷ আমরা এই জনমে যাইতে না পারি, পরের জনমে যামুগা! তাতে কি ওইচে!তয় তুমি চাপ লইও না। আরামছে রেডি হও।”
বলেই ফিচেল হেঁসে বিহান ছেলেকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। বাইরে আসতে আসতে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হুন বাপ! জীবনে আর যাই করছ, বউরে শাড়ি কিনা দিছ না। দরকার হইলে শার্ট প্যান্ট কিন্না দিছ তাও শাড়ি কিনা দিছ না। বাপের অভিজ্ঞতা থাইকা শিক্ষা লইছ।”

আদিত্য বাইরে গিয়েছিল একটা জরুরি কাজে। আসলে ওদের এক্সিডেন্টের পেছনে যারা দায়ী ছিলো তাদেরই শাস্তির ব্যবস্থা করতে গিয়েছিল সে। অপরাধী ওর শত্রু পক্ষের লোক ছিলো। যারা ওর উপর অনেকবার হামলা চালানোর চেষ্টা করেছিল। আর সেদিন কামিয়াব হয়ে যায় তারা। এটা আবির আর বিহান আদিত্যকে জানায় যখন সে সুস্থ হয়।আদিত্য তখনই গ্যাঙের লোকজন দিয়ে অপরাধীকে ধরে এনে শাস্তির ব্যবস্থা করে। ওদের জন্য দু দুটো বছর নূরকে হারিয়ে মৃ,ত্যুযন্ত্রণা নিয়ে ভোগ করতে হয়েছে। সেই অপরাধীদের ভয়ংকর শাস্তি দিয়েছে আদিত্যে। সেখান থেকেই আদিত্যর লোকের ফোন এসেছিল। ফোনে কথা বলতে বলতে রুমে ঢুকলো সে। অন্য খেয়ালে সামনে তাকালে থমকে যায় আদিত্যর দৃষ্টি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সজ্জিত করতে থাকা ওই মহীয়সী নারীতে। হালকা গোলাপি রঙের জামদানী শাড়ি অঙ্গে জড়িয়েছে নূর। আদিত্যর মুগ্ধ, অপলক, ধ্যানমগ্ন দৃষ্টি তাকে দেখতেই সক্রিয়। ফোনের ওপাশের ব্যক্তিটি সাড়াশব্দ না পেয়ে হ্যালো,হ্যালো করতে করতে একসময় ফোন কেটে দিলো। আদিত্যর সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে’তো তার বঁধুকে দেখতে ব্যাস্ত। নূরকে এভাবে যখন দেখে তখন শীতল অনুভূতিতে বুকটা জুড়িয়ে তার। এই নারীটি আদিত্যর বঁধু, একান্তই তার। আদিত্যর রাজ্যের একমাত্র রাণী সে। ভাবতেই যেন সুখময় আবেগের এক প্রলয় উপচে পড়ে আদিত্য অন্তর্দেশ জুড়ে। আদিত্য ফোনটা বিছানার উপর ছুঁড়ে মেরে ধীরে ধীরে নূরের কাছে অগ্রসর হলো সে। নূর তখন এক কানে মাত্র দুল পড়তে নিয়েছিল। ঠিক তখনই আদিত্য পিছে এসে দাঁড়াল নূরের। এক হাত পৌঁছে গেল নূরের শাড়ির ফাঁকে খোলা কোমড়ে। নরম তুলতুলে কোমড়,পেটে হাতের বিচরণ চালালো। নূরকে চেপে মিশিয়ে নিলো নিজের সাথে। কাঁধের উন্মুক্ত স্থানে অধর ছোঁয়ালো গভীর স্পর্শে। কেঁপে উঠে চোখ বুঁজে নিলো নূর। আজ প্রায় দু সপ্তাহ হয়ে গেল তাদের কাছে আসার। তবুও যেন প্রতিবারই আদিত্যর আলিঙ্গন তাকে প্রথম দিনের মতোই কম্পিত করে দেয়। যেন নতুন করে স্পর্শ করছে সে। নূরের কানের কাছে মুখ নিয়ে আদিত্য নেশালো কন্ঠে বলল,
“আর কত ভাবে ঘায়েল করবে এঞ্জেল! এত সুন্দর লাগছে তোমাকে! আমারতো এখন যেতেই ইচ্ছে করছে না। আমরা বরং আজ থেকে যাই৷ ওরা যাক। তারপর এবাড়িতে শুধু আমরা দুজন। মজা হবে না বলো!”
দুষ্টু আভাস আদিত্যর কন্ঠে। কথাগুলো বলে নূরের কানের লতিতে আলতো করে কামড়ে ধরল সে। নূর কাঁধ হালকা বাঁকিয়ে লাজুক সুরে বলল,
“একদম মজা হবে না। এসব দুষ্টু বুদ্ধি ঝেড়ে ফেলে জলদি রেডি হয়ে নাও। বেরোতে হবে। আমি তোমার কাপড়চোপড় বের করে রেখেছি দেখো।”
“আরে শোনো না, আমরা থাকি না! সত্যি বলছি অনেক মজা হবে! পরে নাহয় আমরা যাবো।”
নূর একটু মিছে রাগ দেখিয়ে বলল,
“তুমি রেডি হতে যাবে! নাকি তোমাকে রেখেই চলে যাবো আমি! ”
আদিত্যকে নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে ঠেলে রেতি হওয়ার জন্য পাঠালো। আদিত্য হাসতে হাসতে বলল,
“আরেকবার ভেবে দেখো বউ৷ পরে কিন্তু পস্তাবা।”

রেডি হয়ে বেরিয়ে সবাই গাড়ির কাছে এলো। বড় একটা হাইস ভাড়া করা হয়েছে সবার জন্য। গাড়ির কাছে এসে দেখলো আবির আগে থেকেই গাড়িতে বসে আছে। শুধু একা বসে নেই। সাথে আহানাকেও এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে বসে আছে পেছনের সিটে। আহানাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে সে আবিরকে ছাড়তে ইশারা করছে কিন্তু সে ওসবে তোয়াক্কাই করছে না। বেচারি সবার সামনে এভাবে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে। কিন্তু মহা বেশরম আবিরের কি শরমের বালাই আছে! ওদেরকে ওভাবে দেখে বাকিরা ঠোঁট টিপে হাসছে। বিহান বলল,
“কিরে হালা! তুই কহন আইলি? আর আইছাই বউরে নিয়া চিপায় হান্দাইছস ক্যালা?”
আবির ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
“আমার বউরে লইয়া আমি চিপায় হান্দাই আর পাট খেতে হান্দাই তোর কিবে!”
“আরে একটু ছরম কর বেছরম। এইহানে বাচ্চাও আছে। বাচ্চার ছামনেই এইছব করবি বেছরম!”
“এমনভাবে বলছিস যেন বাচ্চা ইউ টিউব থেকে ডাউনলোড দিছস! বাচ্চা আসানোর জন্য তোরাতো কিছু করিসই নি তাইনা! দেখ, হাতটা আমার, বউটাও আমার। আমার যা খুশি তাই করবো। বিয়ে করেছি কি আমাদের মাঝে ভারত পাকিস্তানের বর্ডার রাখার জন্য। আমিতো আমার বউরে একটুও ছাড়মু না।”
বিহান হতাশ কন্ঠে বলল,
“এক আদিই কি কম ছিলো! অহন আবার তুইও ছুরু করলি! তুই কবে থাইকা রোমান্টিক নায়ক হইলি!”
আবির এটিটিউড হেঁসে পুষ্পার মতো করে বলল,
“নাম আবির দেখে কমেডিয়ান ভেবে নিয়েছিস নাকি! ইমরান হাশমি আমি।”
“আচ্ছা ভাই ইমরাইন্না!অহন দরজা খোল।”
“পারবোনা। তোর দরজা খুলতে গিয়ে পুরো দুই সেকেন্ড আমাকে বউয়ের কাছ থেকে হাত সরাতে হবে। এই দুই সেকেন্ডে আমার দুই কোটি রোমাঞ্চের লোকসান হয়ে যাবে। অনেক লস মামা! তাই নিজেরটা নিজে দেখ।”
আবিরের কথায় হাসির রোল পড়ল তখন। বেচারি আহানা লজ্জায় শেষ। বিশ্বের সবচেয়ে নির্লজ্জ ব্যক্তির বউ হওয়ার শাস্তি পাচ্ছে আর কি! আদিত্য নূরকে নিয়ে প্রথম সাড়ির সিটে বসলো।মাঝে বিহান আর হিয়া। আর শেষে আবির আহানা। হাসি আনন্দের মাঝেই রওয়ানা হলো তারা।

ঘন্টাখানিক লাগল তাদের ফার্মহাউসে পৌঁছাতে। গাড়ি গেট পার করে এসে থামলো ফার্মহাউসের সামনের বিশাল খোলা জায়গায়। সবাই একে একে নামা শুরু করলো।বিহান ছেলেকে কোলে নিয়ে নামলো নিচে। সাথে নামলো হিয়া। আদিত্য নেমে নূরের হাত ধরে নামালো নিচে। শেষে আবির নামলো। তবে একা না। সে আহানাকে কোলে নিয়ে নামলো নিচে। আহানা বারবার গরম চোখে তাকিয়ে আবিরকে নামানোর ইশারা করছে। কিন্তু আবির তার মতোই করে যাচ্ছে। আবির আহানাকে কোলে নিয়ে বাসার দিকে যাওয়ার আগে বলল,
“শোনো পাবলিকগণস! আমার এখন লিপস্টিকের ব্রেকফাস্ট করার সময় হয়েছে। খবরদার! কেউ ডিস্টার্ব করবিনা।আবার নতুন করে পাক বাহিনী এসে হানা দিলেও ডাকবিনা। চিন্তা করিসনা। তোরা শহীদ হয়ে গেলে তোদের নামে একটা করে পাবলিক টয়লেট বানিয়ে দিবো রাস্তায়।”
বলেই বউ নিয়ে ভেতরে চলে হেল আবির। আবির যেতেই বিহান হতভম্ব চোখে তাকিয়ে বলল,
“দেখলি আদি! নির্লজ্জও এইডারে দেইখা নিজেই লজ্জা পাইয়া যাইবো। এমন কেউ করে! তুই ক!”
আদিত্য বিহানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আচমকা সে নিজেও নূরকে ঝট করে কোলে তুলে নিয়ে বলে উঠল,
“শোন আমাদেরও ডিস্টার্ব করবিনা।আমিও ব্রেকফাস্ট করবো এখন। আমাদের হয়ে তুই নাহয় সব গুলি খেয়ে নিস। দরকার হলে দুটো করে টয়লেট দান করবো।”
বলেই আদিত্যও বউ নিয়ে পাগাড় পার। বেচারা বিহান বেকুবের মতো হা হয়ে তাকানো ছাড়া আপাতত কোনো প্রতিক্রিয়া খুঁজে পেলোনা। তবে হঠাৎ বন্ধুদের ক্রিয়াকর্ম দেখে বিহানও কেমন পুলকিত নজরে তাকালো হিয়ার দিকে। তবে তার আশার উপর বুলডোজার চালিয়ে দিয়ে হিয়া তাতান গলায় বলে উঠল,
“কি! এভাবে কি দেখছ? ঢং বাদ দিয়ে যাও। গিয়ে বাবুর ডাইপার চেঞ্জ করে দাও।”
বলেই হিয়া বাসার দিকে হাঁটা ধরল। বিহান অসহায় মুখে কোলের শিশু ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই আর কিছু দিন পরে এলেওতো পারতি বাপ! আজ আমিও ব্রেকফাস্ট অভিযানে যোগদান করবার পারতাম!”

সবাই একটু রেস্ট করে নিয়ে বের হলো বাইরে। ঘুরে ঘুরে দেখলো ফার্মহাউসের এরিয়া। অনেক সুন্দর আর মনোরম পরিবেশ এখানে। চারিদিকে সবুজ গাছগাছালি আর প্রকৃতির মায়ায় ঘেরা। নূরের অনেক ভালো লাগছে এখানে। আদিত্য হাত ধরে আছে নূরের। নূরও আদিত্য বাহু ধরে আশপাশটায় চোখ বোলাচ্ছে। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে দুপুরের দিকে ছেলেগুলো সুইমিং পুলে নামলো। পুলের মাঝামাঝি নেট টানিয়ে পানিতে ভলিবল খেলবে তারা। কিন্তু সমস্যা হলো দল বিভক্ত করা নিয়ে। তিনজন হওয়ায় দল ভাগ করতে গোলযোগ হচ্ছে। আবির তখন বলে উঠল,
“এক কাজ কর। আমি আর আদি দুই দলে। আর বিহান তুই দুধভাত। দুই পক্ষ থেকেই খেলবি।”
বিহান তেতে উঠে বলল,
“কেন কেন! আমি কেন দুধভাত হইতে যামু!! তুই হ দুধভাত।”
“দেখ ভাই বোঝার চেষ্টা কর। আমরা তিনজন৷ তো ফেয়ার কিভাবে হবে! আরে এতেতো তোরই লাভ। যে দলই জিতুক তুই জিতে যাবি।”
“হ্যাঁ তো, তুই হয়ে যা দুধভাত! আমাকে কেন বলছিস!আমি কি বান্দরের মতো একবার তোর কাছে,একবার ওর কাছে দৌড়াবো! আমাকে কি বোকা ভেবেছিস নাকি!”
“ওমা! এতে ভাবার কি আছে! তুই যে বোকার জাতির পিতা এটাতো সারাবিশ্ব জানে! আজ তুই আছিস বলেই বোকারা এখনো জীবিত আছে। তুইতো এদেশের গর্ব রে পাগলে! পৃথিবী বলবে,” এই সেই দেশ, যেখানে জন্ম হয়েছিল এক মহান বোকা জনগোষ্ঠির মালিকের!”
আবিরের তিরস্কারে বিহান ক্ষেপে গিয়ে আবিরের মাথা ধরে পানিতে ঠেসে ধরল।পানির ভেতরে কিলাতে লাগলো তাকে। ওদের কান্ড দেখে মেয়েগুলো হাসতে লাগল খিলখিল করে। আদিত্য তখন বলে উঠল,
“আরে কি শুরু করলি তোরা! আমি একাই নিজের দলে যথেষ্ট। তোরা দু’জন একদলে হয়ে যা। দেখ তাও পারিস কিনা হারাতে আমাকে।”
অতঃপর সেই অনুযায়ী খেলা শুরু হলো। দেখা গেল ওরা দুজন মিলেও আদিত্যর সাথে পেরে উঠছে না। বিহান তখন আবিরের উদ্দেশ্যে বলল,
“কিরে, তহনতো বহুত বাহাদুরি দেখাইতেছিলি! অহন কি হইলো! এমতেই হইবো। অতি মাত্রায় লিপস্টিক সেবনের ফলে অকেজো হইয়া গেছস তুই।”
অন্য দিকে মেয়েরা পুলের পাশেই বসে আড্ডা দিচ্ছে আর এদের কান্ড দেখে হাসছে। তবে নূরের অবাধ্য নজর তার সুদর্শন পুরুষটাকে অবলোকন করতে পিছুপা হচ্ছে না। হবেই বা কেন! পুরুষটাতো তারই নিজস্ব। যাকে এমুহূর্তে আরও সুদর্শন লাগছ। খালি গায়ে হাফপ্যান্ট পড়ে নেমেছে সে পানিতে।ফর্সা পেশিবহুল শরীরে পানির কণা রোদে চিকচিক করছে যেন। ভেজা চুলগুলো দুই হাতে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে বারবার। এমতো অবস্থায় তার পুরুষটাকে একটু বেশিই আকর্ষণীয় লাগছে। নূরের নজর লোলুপ হচ্ছ যেন। আহানা আর হিয়ার সাথে কথা বললেও তার নজর আর খেয়াল দুটোই বারবার ছুটে যাচ্ছে আদিত্যর পানে। আদিত্যর দিকে তাকিয়ে আছে অবাধ্য দৃষ্টিতে। আহানা আর হিয়াও বিষয় টা খেয়াল করল। দুজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মুখ টিপে হাসলো। নূর তখনও আদিত্যকে দেখতে মগ্ন। আহানা সেই সুযোগে বলল,
“আদিত্য ভাইয়াকে অনেক হট লাগছে তাইনা ভাবি!”
নূর আদিত্যর খেয়ালে থেকেই আনমনে বলে উঠল,
“হুম,অনেক!”
“যেতে মন চাইছে তার কাছে?”
“চাইছেতো।”
“তাহলে চলে যাও।”
হুঁশ এলো যেন নূরের। সে থতমত আর লাজুক পরিস্থিতির শিকার হলো। আমতাআমতা করে বলল,
“এই দুষ্টু মেয়েরা! কি বলছ এসব!”
“যা আপনার মনে ভাবি। আসেন আপনাকে হট ভাইয়ার কাছে পৌঁছে দেই।”
নূর উঠে দাঁড়িয়ে সরে যেতে যেতে বলল,
“এই এই ভালো হবে না কিন্তু! যাও সরো।”
ওরা শুনলোনা নূরের কথা। আহানা আর হিয়া মিলে নূরকে ঠেলে নিয়ে এসে পুলের কাছে এসে আদিত্যর উদ্দেশ্যে বলল,
“ভাইয়া! বেচারি ভাবি আপনার হটনেসের তাপে পুড়ে যাচ্ছে। তাকে একটু শীতল করুন।”
বলেই দুজন ধাক্কা মেরে নূরকে ফেলে দিলো আদিত্যর কাছে। আদিত্য নিচ থেকে কোলের উপর ধরে নিলো নূরকে। ভ্রু উঁচিয়ে দুষ্টু নজরে তাকালো আদিত্য। লজ্জায় দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলল নূর। অন্যদিকে নূরকে ফেলার পর আহানা দুষ্টুমি করে হিয়াকেও পুলে ফেলে দিলো। আর হিয়া পড়তে পড়তে আহানার হাত ধরে তাঁকে সহই পড়ল। অতঃপর সবগুলো পানির মাঝে। সবাই মিলেই পানিতে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠল।
__

সারাদিন সবাই অনেক আনন্দের মাঝেই কাটায়। রাতেও ডিনার শেষে অনেকটা সময় সবাই মিলে আড্ডা দেয়। হিয়ার ছোট বাচ্চা থাকায় সে বেশিক্ষণ আর থাকতে পারে না। একসময় দুষ্টু আবিরও তার বউকে টেনে নিয়ে চলে যায়। সবাই চলে নূর আদিত্যকে বলল,
“চলো আমরাও এখন শুয়ে পড়ি গিয়ে। রাততো অনেক হলো।”
নূর এগুতে নিলে আদিত্য হাত টেনে ধরল তার। কাছে টেনে বলল,
“উহুম, আমরা রুমে যাবোনা আজ।”
“তো কোথায় যাবো?”
“আসো দেখাচ্ছি।”
আদিত্য নূরের হাত ধরে বাসার বাইরে নিয়ে এলো। নূরও কৌতুহল মনে পুষে বাধ্য মেয়ের মতো আদিত্যর সাথেই এগুলো। বাসার বাইরে এসে ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফার্মহাউসের উল্টো পাশে নিয়ে এলো। নূর এখনো কিছুই ঠাহর করতে পারছেনা যে, আদিত্য আসলে কি দেখাতে আনলো। আর কিছুটা সামনে এগিয়ে এসে থামলো আদিত্য। সেখানে ছিলো এক বিশাল বড়ো বট গাছ৷ এবং অনেক পুরানো সেটা। ডালাপালায় বিস্তৃত চারিদিক।গাছের সাথে লাগোয়া কাঠের সিঁড়ি দেখিয়ে আদিত্য নূরকে নিয়ে সেই সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে লাগল সাবধানে। যত উপরে যাচ্ছে নূরের বিস্ময় তত বাড়ছে যেন। একসময় সিঁড়ির অন্ত এলো। এবং সামনে যা পেল তাতে নূর অভিভূত। এখানে বট গাছটার উপরে একটা অত্যন্ত সুন্দর ট্রি হাউস করা আছে। অনেকটা বড়সড়ই হাউসটা। ছোটো খাটো সংসার আরামছে থেকে যেতে পারবে এমন ঘর। ঘরের সামনে কাঠের ফ্লোরিং করা খোলা বারান্দা। বারান্দায় বেলিফুল ছিটানো আছে হাজারো। এত অভূতপূর্ব সুন্দর দৃশ্য দেখে নূর সত্যিই যেন বাকরুদ্ধ। আদিত্য মুচকি হেঁসে বলল,
“এটা আমার ট্রি হাউস। দাদাজান আমার জন্য বানিয়ে দিয়েছিল ছোটবেলায়। এখানে আমার অনেক সময় কেটেছে। এই জায়গাটা আমার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। এতটাই যে এটা আমি কাউকে কখনো দেখাইনি৷ আবির, বিহানকেও না। আমি ভেবে রেখেছিলাম এখানে আমি ছাড়া শুধু আমার মনের রানীটাই আসবে এই ছোট্ট প্রাসাদে। তো রানী সাহেবা,স্বাগতম তোমাকে আমার ছোট্ট প্রাসাদে।”
নূর যেন ভাষা হারিয়ে ফেলল ব্যক্ত করার। আদিত্য নূরের হাত ধরে বাসার উপর উঠল। ফুলে সাজানো বারান্দার মাঝে এনে বসালো তাঁকে । নিজেও বসলো তার পাশে। পূর্ণ চাঁদের জোছনায় স্নান করছে নিশি। রুপালী আলোয় আলোকিত তাদের এই ছোট্ট প্রাসাদ। বেলি ফুলের সুবাসে নিঃশ্বাস সুরভিত। শীতল পবনে দেহ-মন অমত্ত। নূর দেখছে এই অপূর্ব জায়গার মায়াবী দৃশ্য। মায়াময় চোখে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল,
“সারাক্ষণতো সাথেই ছিলে তাহলে এসব সাজালে কখন?’
আদিত্য মুচকি হেঁসে নূরের গালে হাত রেখে বলল,
” কি কখন করেছি তা দেখে তোমার কাজ নেই। তুমি শুধু বলো কেমন লাগলো তোমার এই মহলটি?”
নূর মায়াবী হেঁসে দুই হাতে আদিত্যর মুখটি ধরে বলল,
“ঠিক তোমার মতো। যেমন তুমি আমার কাছে সবচেয়ে সেরা মানব। তেমনি এই জায়গাটাও তোমার মতোই সেরা। তুমি মানেই ভালোবাসার বিশাল সাম্রাজ্য। তোমার সবকিছুতেই ভালোবাসাময়। এতো কিভাবে ভালোবাসতে পারো তুমি! আমার যে নিজের উপরই হিংসে হয়। আমি কি পারবো তোমার সমান ভালোবাসতে!”
আদিত্য মায়াবী হাসলো। অধর ছোঁয়ালো নূরের কপালে। দুই চোখে আর গালেও ছোঁয়ালো। এবং নূরের সাথে ওষ্ঠদ্বয় মিলিত করল। চুম্বন শেষে আদিত্য নূরের কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
“তুমি যে নীলাভ সিন্ধু
যার অতলে ডুবে হতে চাই নিলীন
তোমাতে হারাতে চাই
নিঃশেষ করে নিজের প্রতিটি বিন্দু।”

চোখ ভিজে আসে নূরের। সুখের অশ্রু এ যে। আদিত্য নূরের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। নূর মাথা নামিয়ে অধর ছোঁয়ায় আদিত্যর কপালে। পরম আদরে হাত বুলিয়ে দেয় আদিত্যর চুলের গভীরে। আদিত্য নূরের অন্য হাতটা বুকে জড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে তার নিজস্ব চাঁদটাকে। এ দেখার শেষ নেই। অনন্তকাল,অনন্তপ্রহর কাটিয়ে দিতে চায় সে শুধু দেখে দেখেই। মায়ার সাগর চোখে নিয়ে আদিত্য গেয়ে ওঠ,
♬ মে জিতনা তুমহে দেখু
♬ দিল এ না ভারে
♬ মে জিতনা তুমহে সোচু
♬ দিল এ না ভারে
♬ ইন আখো মে ছালাকতা হে
♬ মেরা পেয়ার তেরা পেয়ার
♬ কাহি মুঝমে ধারাকতা হে
♬ মেরা পেয়ার তেরা পেয়ার
♬ মেরা পেয়ার তেরা পেয়ার ……..

______________সমাপ্ত________________

(অতঃপর দ্বিতীয় সিজনের এখানেই সমাপ্তি ঘটলো। যদিও এবার একটা মারাত্মক স্যাড এন্ডিং দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরে আর দিতে পারলাম না। ভাই এমনিতেই মানুষের জীবনে স্যাডনেসের অভাব নেই। গল্পতেতো অন্তত হ্যাপি হ্যাপি থাকুক। সবাই ভালো থাকবেন। আশা করি আবারও নতুন গল্প নিয়ে ফিরবো আপনাদের মাঝে।)

মরুর বুকে বৃষ্টি সিজন ১ পড়তে লেখটির উপর ক্লিক করুন।