মহাপ্রস্থান পর্ব-১০

0
257

#মহাপ্রস্থান
#পর্ব_১০ (সারপ্রাইজ পর্ব)
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
রাত ১১টা প্রায় বাজে। দু’চোখের পাতায় ঘুম নেই পৃথুলার। মনেও নেই স্বস্তি। চারদিকে কেমন থমথমে ভাব। একটুও বাতাস নেই। নেই আজ ইলেক্ট্রিসিটিও। সেই সন্ধ্যা থেকেই বাড়িটাকে তার গুমোট অন্ধকার মনে হচ্ছে। যদিও বাড়িতে জেনারেটরের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে পৃথুলার মনে হচ্ছে, এই পরিবেশের সঙ্গে জেনারেটর ঠিক মানানসই নয়। গুমোট ভাবটাই সহনীয়। তাই সে রুমের লাইট বন্ধ করে খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে। আজ বোধ হয় সবকিছুই ‘নেই, নেই’। আছে কেন হয় না? ঘুমেরই বা আজ হলো কী? পালাল কোথায় সে? মনে পড়ল পৃথুলার। সে আজ শিমুলের সঙ্গে চা খাওয়ার কম্পিটিশনে নেমেছিল। জিতেছে সে নিজেই। কিন্তু রাতের ঘুম করেছে হারাম। সে বিরক্তিভাব নিয়েই গুণগুণ করছিল।

ঠিক সেই সময়ে আরশান ব্যস্তভাবে পৃথু্লার রুমের দরজায় নক করে বলল,

“পৃথুলা একটু জলদি বাইরে আসুন তো!”

বিরক্তিতে ভাঁটা পড়ল। তৈরি হলো বিরক্তের প্রাসাদ। এই রাত-বিরাতে লোকটার আবার কী চাই? পৃথুলা লাইট জ্বালিয়ে দরজা খুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। আরশান পৃথুলাকে নিয়ে রুমের ভেতর ঢুকে যায়। হতভম্ব হয়ে যায় পৃথুলা।

“এসব কী? আপনার মতলব কী? আপনি এভাবে…”

পৃথুলার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই আরশান তার মুখ চেপে ধরে থামিয়ে দিয়ে বলল,

“লিসেন, এখন আপনার বকবক শোনার মতো সময় আমার নেই। আমি যা বলছি, সেগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনুন প্লিজ! কয়েকজন ফ্রেন্ড সার্কেল মিলে ঘুরতে এসেছিল এখানে। হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে আসাতে রাত হয়ে যায়। এত রাতে জঙ্গল দিয়ে হোটেলে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ সাথে অনেকগুলো মেয়েও রয়েছে। রিস্ক হয়ে যাবে। তাই ওরা এখানে আশ্রয় নিয়েছে। আপনাকে এখন যেটা করতে হবে তা হচ্ছে, আমার ওয়াইফের ভূমিকায় জাস্ট একটু অভিনয় করতে হবে। বুঝতে পেরেছেন?”

পৃথুলা কিছু বলছে কিন্তু আরশান মুখ চেপে ধরে রাখায় কথাগুলো স্পষ্ট নয়। বিষয়টি খেয়াল করে আরশান হাত সরিয়ে নিল। পৃথুলা জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বলল,

“আপনি কি আমাকে মে’রে ফেলতে চান নাকি?”

আরশান নিজের ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে বলল,

“চুপ! আস্তে কথা বলুন।”

“আস্তে কথা বলব কেন? আমি কি চো-র? চু-রি করতে এসেছি? আর তখন কী বললেন বউ সাজতে হবে আপনার? আপনার বউ কেন সাজব আমি? আমাদের তো বিয়ে হয়নি। আপনি আর আমি তো তিন কবুল বলিনি। মিথ্যে বউয়ের অভিনয় আমি করতে পারব না।”

“প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করুন। নয়তো ওরা বিষয়টা কীভাবে দেখবে একটু ভেবে দেখেছেন?”

পৃথুলা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল,

“বেশ! তবে আমার একটা শর্ত আছে।”

“কী শর্ত?”

“বলেন কবুল। তিনবার বলবেন।”

“এসব কী ছেলেমানুষি? কবুল বলব কেন?”

“ওমা! আপনার বউ না সাজব? তাহলে কবুল বলবেন না কেন?”

“কবুল বলব কেন? এভাবে কি বিয়ে হয়?”

“হয়তো হয় না। কিন্তু তাতে কী? মনকে তো বোঝাতে পারব, বিয়ে না হলেও আপনি কবুল বলেছেন। নয়তো সে এই অভিনয় করতে রাজি হবে না।”

আরশান কটমট করে তাকিয়ে বলে,

“সুযোগ পেয়ে এখন সদ্ব্যবহার করছেন আপনি।”

“বলবেন কিনা?”

“বলতে তো হবেই। কার পাল্লায় পড়েছি দেখতে হবে না?”

পৃথুলা মুচকি হেসে বলল,

“তাহলে বলুন কবুল।”

আরশান কাঠখোট্টাভাবে বলল,

“কবুল।”

“তিনবার বলতে হবে। আরও দু’বার বলুন।”

আরশান বিরক্ত হয়ে বলল,

“কবুল, কবুল।”

পৃথুলা শব্দ করে হেসে বলে,

“কবুল, কবুল, কবুল।”

এরপর আরশানের এক হাত ধরে বলে,

“চলেন যাওয়া যাক আমার মিথ্যে হাজবেন্ড।”

“এটা আবার কেমন সম্বোধন?”

“কেমন আবার? আমাদের তো আর সত্যি সত্যি বিয়ে হয়নি। সত্যি বিয়ে হলে তখন ডাকতাম, ডিয়ার হাজবেন্ড। বিয়ে হয়নি তাই ডাকছি মিথ্যে হাজবেন্ড।”

“ফর গড সেইক, আপনাকে কিছুই ডাকতে হবে না। আর হ্যাঁ, প্লিজ ওদের সামনে এত তুরতুর করবেন না। বেশি কথা বলবেন না। শান্ত স্বাভাবিক, চুপচাপ থাকবেন। মনে থাকবে?”

পৃথুলা মুখ ভেংচি কেটে বলল,

“থাকবে।”
.
.
সোফায় চাপাচাপি ও জবুথবু হয়ে আছে আহনাফ-অর্ষা, আহিল-সকাল, আদিব-মুন, হাসিব, লামিয়া, জুঁই, রেশমি আশিক এবং দিদার। একেকজনের চোখে রাজ্যের ঘুম ভর করেছে। সেই সঙ্গে লেগেছে প্রচন্ড ক্ষুধা। বাকিরা কোনো রকম ক্ষুধার যন্ত্রণা চেপে গেলেও দিদার পারছিল না। সে শিমুলের দেওয়া চা এবং ফল খেতে খেতে বিড়বিড় করছিল। তার বিড়বিড় করার ভাষা ছিল গালি-গালাজ। কোন ভূতে ধরেছিল তখন সবাইকে কে জানে! সন্ধ্যা হওয়ার পরও একেকজনের জঙ্গলে ঘোরার শখ জেগেছে। এডভেঞ্চার, এডভেঞ্চার ফিল নেবে। নে এখন ফিল! ট্যুরের শখ আজীবনের জন্য না মিটলেই হয়।

দিদারের বিড়বিড় শুনে রেশমি কনুই দিয়ে গুঁতা দিয়ে বলে,

“মন্ত্র জপছিস নাকি? এমন বিড়বিড় করিস কেন?”

“আমার শখ জেগেছে তাই। তোর মন চাইলে তুইও কর।” বিরক্ত হয়ে বলল দিদার।

সবাই একরকম চুপচাপ ছিল বলে কেমন যেন অস্বস্তি বাড়ছিল। আহনাফ অস্বস্তিবোধ কাটাতে শিমুলের উদ্দেশ্যে বলল,

“এমন গভীর জঙ্গলেও কোনো বাড়ি পাব এবং সৌভাগ্যবশত সেই বাড়িতে মানুষও থাকবে এটা কল্পনাও করিনি।”

আশিক বলল,

“ভাগ্যিস ছিল ভাই! নয়তো এত রাতে কোথায় যেতাম? সাপ নয়তো ভূতের খাবার হয়ে যেতাম মনে হয়।”

শিমুল মুচকি হেসে বলল,

“আপনারা এত রাতে এদিকে কেন এসেছেন?”

“আর বলবেন না ভাই! এসেছিলাম তো ঘুরতে। এদিকে আসা হয়নি আগে কখনো। জঙ্গলের ভেতর ঢুকেছিলাম এদিক-ওদিক কিছু আছে নাকি দেখার জন্য। একটু বেশি ভেতরে চলে আসায় রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছিলাম। কোনদিকে যাব বুঝতেই পারছিলাম না। রাস্তা খুঁজে পাওয়ার বদলে আরও গোলকধাঁধায় পড়ে যাচ্ছিলাম। নিজেদের নিয়ে তো ভয় নেই। ভয় ছিল সঙ্গে এতগুলো মেয়ে! বোঝেনই তো। আল্লাহ্ সহায় ছিল তাই এই বাড়িটা খুঁজে পেয়েছি।” একদমে কথাগুলো বলল আদিব।

“আল্লাহ্ থাকতে কোনো ভয় নেই। এখানে আপনারা সেইফ থাকবেন।”

“আপনারা কি এখানেই থাকেন?” জানতে চাইল আহিল।

শিমুল উত্তরে বলল,

“না, না। আমরাও ঘুরতেই এসেছি। বাংলোটা স্যারের। যিনি আপনাদের ভেতরে নিয়ে এসেছে। আরশান স্যার।”

“আপনি আর আপনার স্যার এসেছেন?”

শিমুল এই পর্যায়ে এসে চুপসে গেল। এখন সে কী বলবে? তাদের সঙ্গে একটা মেয়েও রয়েছে। আর মেয়েটাকে তারা কি-ড-ন্যা-প করেছে এমনটা বলা যাবে কখনো? এছাড়া পৃথুলা যদি কোনোভাবে সত্যিটা এদের জানিয়ে দেয় তাহলে তো ঘটনা সম্পূর্ণ বদলে যাবে। এতসব ভেবেই দিশেহারা হয়ে পড়ছিল শিমুল। তার অস্বস্তি এবং চিন্তা দূর করতেই যেন আরশান এবং পৃথুলার আগমন ঘটল তখন।

আরশান সবার সামনে পৃথুলাকে নিজের ওয়াইফ বলে পরিচয় করিয়ে দিল। এতে ভেতরে ভেতরে এক বড়োসড়ো ধাক্কা খেয়েছে শিমুল। ডিরেক্ট ওয়াইফ! এছাড়া বেচারা আর বলতই বা কী? পরিচয় পর্ব শেষ হলে আরশান বলল,

“পৃথু, সবার জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করো।”

অর্ষা বাঁধা দিয়ে বলল,

“না, না ভাইয়া। এত রাতে কিচ্ছু করতে হবে না। এতগুলো অপরিচিত মানুষকে আশ্রয় দিয়েছেন এটাই আমাদের কাছে অনেক।”

পৃথুলা বলল,

“তা বললে কী হয়? আপনারা একটুখানি অপেক্ষা করুন। আমি ঝটপট সবকিছুর ব্যবস্থা করে ফেলছি। ততক্ষণে আপনারা চাইলে ফ্রেশ হয়ে নিতে পারেন।”

শিমুলকে উদ্দেশ্য করে আরশান বলল,

“উনাদেরকে ফ্রেশ হতে নিয়ে যাও।”

পৃথুলা এর মাঝেই রান্নাঘরে চলে গেছে। আরশানও গেল পিছুপিছু। শিমুল টেক্সট করেছে,

“এভাবে কি লোকগুলোকে বিশ্বাস করা ঠিক হচ্ছে স্যার?”

আরশান উত্তর লিখল,

“টেনশন কোরো না। আর যাই হোক, এরা শত্রুপক্ষের কেউ না। এটলিস্ট এতগুলো মেয়েকে তাহলে সাথে পাঠাত না। তাছাড়া এই বাংলো বাড়ির খবর কেউ জানেও না।”

“সব বুঝলাম। পৃথুলা যদি ওদেরকে সত্যিটা বলে দেয়?”

“সেই সুযোগ আমি দেবো না। পৃথুকে আমি চোখে চোখে রাখছি। তুমি ওদিকটা সামলাও।”

রিপ্লাই দিয়ে ফোনটা পকেটে রাখল আরশান। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল,

“কী রান্না করবেন?”

“খিচুড়ি। শর্টকাট রান্না। রাত অনেক হয়েছে। বেশি কিছু করার সময় নেই। কিন্তু আপনি এখানে কী করছেন?”

আরশান আমতা আমতা করে বলল,

“এমনিই আপনাকে সাহায্য করতে এলাম।”

“আপনি রান্না করতে পারেন?”

“না।”

“তাহলে আপনার সাহায্যের দরকার নেই আমার। সাহায্য করার বদলে কাজ বাড়াবেন আরও।”

“এতটাও অকর্মণ্য নই আমি। আমাকে বলে দিন কী কী করতে হবে।”

“ওদের সঙ্গে গিয়ে আলাপ করুন।”

“আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি।”

“বেশ! পেয়াজ-মরিচগুলো কাটুন তাহলে।”

পেয়াজ কাটতে গিয়ে আরশানের চোখের পানি, নাকের পানি দিয়ে অবস্থা দফারফা। বাড়িতে এতগুলো মানুষ না থাকলে পৃথুলা এখন দম ফাটিয়ে হাসত নির্ঘাত। আরশানের হাত থেকে পেয়াজ আর ছুরি নিয়ে পৃথুলা হাসতে হাসতে বলে,

“অনেক সাহায্য করে ফেলেছেন। যান এখন। আমি করে নেব সব।”

আরশানকে এক প্রকার ঠেলেই বের করে দিল পৃথুলা।

রান্নাবান্না শেষ করে সবাই একসাথে খেতে বসেছে। শিমুল খাবার সার্ভ করছিল। আদিব এক দৃষ্টিতে পৃথুলাকে দেখছে। তার পৃথুলাকে দেখার পর থেকেই মনে হচ্ছে কোথায় যেন দেখেছে। কোনো নিউজে হতে পারে? সে কৌতুহল আটকে রাখতে না পেরে বলেই ফেলল,

“আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি! মেবি, কোনো নিউজে…”

আরশান পরিস্থিতি সামাল দিতে তড়িঘড়ি করে বলে,

“দেখতে পারেন। কারণ আমার ওয়াইফ ভালো গান গায়। ওর গানের গলা খুব ভালো। বেশ কয়েকবার তো গানের জন্য এওয়ার্ডও পেয়েছে। পৃথুলা চৌধুরী নাম শোনেননি? অবশ্য অনেক আগে গাইত তো! এখন আর গান-টান করে না। মনে চাইলে বাড়িতে টুকটাক গেয়ে আমাকেই শোনায়। আগে যে গাইত ঐগুলোরই কোনো একটা নিউজ দেখে থাকবেন হয়তো।”

এতসব মিথ্যে শুনে পৃথুলার কানে তালা লাগার উপক্রম। চক্ষু চড়কগাছ। মাথা ভনভন করছে। হাত-পা বোধ হয় কাঁপছে। সে মনে মনে আরশানকে গালি দেয় আর দোয়া-দরুদ পড়তে থাকে। কোনোভাবে কেউ যদি একবার গান গাইতে বলে এখন, তাহলেই হলো! রাগে, বিরক্তিতে মনে মনে স্বগতোক্তি করে বলে,

“এরকম একটা মিথ্যা বলার কি আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল? আমার ওয়াইফ ভালো গান গায়! কচু গায় শালা! গানের ‘গ’-টাও আমি জানিনা রে আহাম্মক! আর আমি পেয়েছি এওয়ার্ড? তোর মুন্ডু পেয়েছি, মুন্ডু। এখন যদি ওরা আমাকে গান শোনাতে বলে? তখন কী করব আমি হ্যাঁ? আমার গান শুনলে তো কাক, টুনটুনি সব চলে আসবে। টুনটুনি পাখিতে তো আবার তোর অ্যাসিস্ট্যান্টের এলার্জি আছে। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে যায় নামটা শুনলেই। তুই কেন বলতে গেলি এই কথা!”

আশিক উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলল,

“তাই? তাহলে তো ভাবির কণ্ঠে একটা গান শুনতেই হয়। একটা গান তাহলে হয়ে যাক ভাবি?”

পৃথুলার মাথা ঘোরাচ্ছে। এখনই সে বেহুশ হয়ে পড়ে যাবে। সাড়ে সর্বনাশ বোধ হয় একেই বলে।

চলবে…

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]