মহুয়ার রাতদিন পর্ব-০১

0
20

#মহুয়ার_রাতদিন.১ ✍️ #রেহানা_পুতুল
সাতমাসের গর্ভবতী মহুয়াকে তার শাশুড়ী তেঁতো গলায় বললো,
“পরথম সন্তান যদি মাইয়া হয়, তাইলে মা, মাইয়া দুইডারেই লাকড়ি বানায়া জ্বালামু কইলাম। ঘরে বাত্তি দেওনের লাইগা পোলা চাই। এই বংশে এমনিতেই পোলা কম। মাইয়া পয়দা হওয়া মানেই খরচ। আগে পোলা পয়দা কইরা আয়ের ব্যবস্থা করতে হইবো।”

যুবতী মহুয়ার সারা শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে শিউরে উঠলো। আল্লাগো! রহম করো। বলে কী! মহুয়ার প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। সে মাত্রই রান্নাঘরে গেলো ভাত খেতে। মিটসেফ খুলতে নিলেই শাশুড়ী তফুরার কাঠ কাঠ গলায় কথাগুলো শুনতে হলো তাকে। পাঁচমাসের পর হতেই মহুয়ার কেবল ক্ষুধা লাগে। খেতে ইচ্ছে করে এটা ওটা। কিন্তু পায় না। সে নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। বিয়েও হয়েছে মধ্যবিত্ত ঘরে। তার বাবার সংসারের মতো স্বামীর সংসারেও নিত্য টানাপোড়েন। হিসেব করে চলতে হয়।

ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। তাই মহুয়া সংকোচ ভুলে বেহায়া বিড়ালের মতো ভাতের হাঁড়ি দেখে। তলায় কিছু ভেজা ভাত অবশিষ্ট আছে। বড়জোর তিনমুঠি হবে। সে ভালো করে সব ভাত তুলে নিলো প্লেটে। কিন্তু কিছুই নেই। খাবে কী দিয়ে? সবাই খেয়ে শেষ করে ফেলেছে। তারকথা কেউই ভাবল না। মহুয়ার চোখদুটো জলে ভরে যায়। সে দুটো কাঁচামরিচ ও একটা কাঁচাপেঁয়াজ দিয়ে ভাতগুলো খেয়ে নিলো। তাই তার কাছে অমৃতের মতো ঠেকলো। পেট ভরেনি বলে গাছ থেকে দুটো আধপাকা পেয়ারা পেড়ে নিলো। লবন মরিচ মিশিয়ে খেয়ে নিলো। এবার শান্তি। মহুয়া নিজের রুমে গিয়ে মাটিতে পাটি বিছিয়ে শয্যা পেতে শুয়ে পড়লো। খাওয়ার পরেও শরীলটা ক্লান্ত লাগে।

প্রবাসী স্বামী আমানকে ভিডিও ফোন দিলো। কিছুক্ষণ কথা বললো।
আমানের গলা শুনলেই মহুয়া আপ্লুত হয়ে যায়। ভুলে যায় সব। আমান মহুয়ার উদাম পেট দেখতে চায়। মহুয়া লাজুকলতার মতো নুইয়ে যায়। তবুও উঁচা পেট হতে কাপড় সরিয়ে নেয়। আমান পেটে উড়ন্ত চুমু দেয়। এভাবে নানান রোমান্টিকতায় দুধের স্বাদ ঘোলে মেটায় আমান মহুয়াকে নিয়ে। মহুয়ার স্বাস প্রশ্বাস গাঢ় হয়। সুখ সুখ অনুভব করে। আমান লোভাতুর চোখে চেয়ে রয় মহুয়ার মুখের দিকে।

আমানকে, মহুয়া শাশুড়ীর বলা কথাগুলো বলতে গিয়েও থেমে গেলো। পাছে যদি আমান ভুল বুঝে। তাই। থাকুক না। ওতো আমারই আছে। মুরুব্বিরা সব সময় বলে একটা মেয়ের জীবনে স্বামীই সব। গোটা পৃথিবী তার বিপক্ষে গেলেও কিছুই যায় আসে না। যদি স্বামী তার পক্ষে থাকে। তাকে ভালোবাসে।

মহুয়ার বিয়ে হয়েছে তিন বছর। বিয়ের তিনমাস পর আমান বিদেশ চলে গিয়েছে। আবার এসেছে সাতমাস পূর্বে। সে মাসেই মহুয়ার পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায়। তিনমাসের ছুটি কাটিয়ে আমান আবার বিদেশ পাড়ি দেয়। আমান মাকে যেমন প্রগাঢ় ভালোবাসে,তেমনি স্ত্রীকেও। তবে তার দৃষ্টির অগোচরে মহুয়ার সাথে মায়ের বৈরী আচরণ তার অজানা। কেননা ছেলে যে কয়মাস বাড়িতে থাকে, তখন মহুয়ার সাথে তফুরা ভালো আচরণ করে। কথা শেষে মহুয়া ঘুমিয়ে পড়ে।

মহুয়ার কাঁচাঘুম ছুটে যায় তফুরার ঝাঁঝালো কথার তোড়ে।
“কী ব্যাক্কল, বের্তুমিজ, ইতর,চোর মাইয়া আমার কপালে জুটলো। পাতিলের তলার ভাত রাখছি হাঁসমোরগের লাইগা। আর বেটি রাইক্ষসের মতন খাই ফালাইলো। এহন কী দিমু হাঁসগুলানরে। কেমন টইটই
করে ঘুরতাছে আমার ধারে। গাছের পেয়ারা দুইটা পাকন ধরতাছে। আউশ কইরা রাখলাম মাইয়ার জামাইর লাইগা। তাও খাই ফালাইলো। এর মা,বাপরে জানাইতে হইবো। চুপ কইরা থাকন যাইব না আর।”

মহুয়া লজ্জায় কুঁকড়ে যায়। নিজেকে প্রশ্ন করে,
স্বামীর পরিবারের গাছ থেকে ফল পেড়ে খেলে চুরি?
সেই ভাত হাঁসমুরগির হলে, আমার ভাত কই? আমিতো মানুষ। হাঁস-মুরগির ক্ষুধা আছে। আমার নাই?
নিরবে সয়ে যায় মহুয়া। মানিয়ে নেয়। মেনে নেয়। সে যে বড় দূর্ভাগা।

তারপর একদিন তফুরার ননদ সীমা মহুয়াকে বললো,

“ভাবি মা বলছে কালকে ঢেঁকিতে পাড় দিতে হবে। চালের গুড়া শেষ। সকালে নাস্তা বানানো যাবে না নইলে। আমি, বড়ভাবি ও তুমি মিলে চাল ভাঙ্গতে হবে।”

মহুয়া বিস্ময় চোখে তাকায় ননদের দিকে। অস্ফুট স্বরে বলে,

“আমি? এই ভারি শরীর নিয়ে? এটা সম্ভব? পেটে বাবুর সমস্যা হবে না?”

পাশ হতে মহুয়ার কথাগুলো শুনতে পায় তফুরা। তিনি হই হই করে উঠলেন। উচ্চস্বরে শাসনের ঢংয়ে বললেন,
“ফুটানি দেখলে গায়ে ফোসকা পড়ে। আমি স্বশুরের নির্দেশে গাছ কাইটছি। উঠানে ফালাইয়া লাকড়ি করছি। সেই লাকড়ি হুগাইছি রইদের মইধ্যে। হের বাদে ভাত রাইন্ধা খাওয়াছি সক্কলেরে। পোয়াতি থাকাকালীন সব কামই করন যায়। কিচ্ছুই হয় না।”

মহুয়া নিভে যায়। পরেরদিন পেট হাত দিয়ে চেপে ধরে ঢেঁকিতে জোরে জোরে পাড় দিতে হয় তাকে। রাতে মহুয়ার ভীষণ পেট ব্যাথা করে। নিজেই তেল গরম করে মালিশ করে পেটে।

নিদিষ্ট সময়ে ঘরে অপরিপক্ক ধাত্রীর হাতে মহুয়া একটি কন্যা সন্তান প্রসব করে। এক শিশি স্যাভলন আর এক পাতা ব্যথার ট্যাবলেট ছাড়া কিছুই জোটেনি মহুয়ার কপালে। রোজ ভাত গিলতে হয় তাকে পেঁয়াজ ভাজা,অর্ধেক ডিম ভাজা,নিরামিষ লাউ রান্না,কলার মোচার ভর্তা,মাঝেসাঝে দুপুরে এক পিস মাছ। এইই।
অথচ সচ্ছল ঘরের বউরা সন্তান প্রসবের পর কত যত্ন পায়। খেতে পায়,শিং মাছের ঝোল,মুরগী,দুধ,ডিম,কবুতুর ভুনা ও কত পুষ্টিকর ফলফলাদি। ভেবেই প্রলম্বিত স্বাস ছাড়ে মহুয়া।

তফুরার সারামুখজুড়ে অমাবস্যা ভর করলো। রাতদিন মহুয়াকে কথা শোনাতে লাগলো। মহুয়া স্তব্ধ হয়ে যায়। এতে তার ভুল বা দোষ কোথায়? তবুও সে কোন প্রতিবাদ করে না। যদি আমান শুনে রা* গ করে তার উপর। সে হজম করে যায় স্বামীর সংসারে সবার দেওয়া মানসিক অত্যাচারগুলো। আর যাবেই বা কোথায়। বাবার সংসারেরও বেহাল দশা। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়।

এভাবে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, লাঞ্চনা-গঞ্জনার মাঝে মহুয়ার রাতদিন পার হয়। তার আদরে,স্নেহে বড় হতে থাকে তার মেয়েটি। আদর করে মেয়ের নাম রাখে বুলবুলি।

মহুয়া একটু পরপর স্নেহময়ী সুরে ডেকে উঠে,
“আম্মুর বুলবুলি পাখিটা কইরে?”

বুলবুলি প্রজাপতির মতো উড়ে গিয়ে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। খলবল করে হেসে উঠে। সেই পবিত্র মধুর হাসি দেখে মহুয়া ভুলে যায় সব কষ্ট!

কিন্তু নিয়তি বোধহয় মহুয়ার বিপক্ষেই অবস্থান করছিলো। উপহাস করছিলো তাচ্ছিল্য ভরে। তাই তার মেয়ের এক বছর বয়স হওয়াতেও মুখে কোন বোল ফুটছে না। বড় ডাক্তার দেখিয়ে জানা গেলো মেয়েটি তোতলানো স্বরেই কথা বলবে। কারণ সে পেটে থাকা অবস্থায় তার মা অনেক ভারি কাজ করেছে। তার কারণে তার মাথায় চাপ পড়েছে।
শুনে মহুয়ার মাথায় হাত। বাড়িতে গিয়ে সবাইকে জানালো। কেউই পাত্তা দিল না তার কথায়। সবাই বলল এটা খোদার হুকুম। আমানও তাই শোনাল তাকে। মা,বোনকে দোষারোপ করল না।

এভাবেই দুঃখে-বেদনায়, যাতনায়- বিষাদে কাটছে মহুয়ার রাত -দিন।বুলবুলির বয়স দু’য়ে পৌঁছালো। সে এখন হাঁটতে জানে ভালো করে। টুকটুক করে নরম পায়ে দুলে দুলে হাঁসের ছানার মতো উঠান ডিঙিয়ে বাড়ির এদিক ওদিক চলে যায়। মহুয়া মেয়েকে চোখে চোখে রাখে।

এলো গ্রীষ্মকাল। ধানের মৌসুম চলছে। মহুয়া শাশুড়ীর সাথে ধান সেদ্ধ করায় মনোযোগী। অন্যরাও ধানের নানান কাজে ব্যস্ত। মহুয়া মেয়েকে চোখের সামনে না দেখে উঠে গেলো খুঁজতে। কিন্তু নেই। কোথাও তার প্রাণের ধন,বুকের মানিক কন্যাটি নেই। মহুয়া গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছে। হাতের কাজ ফেলে পুরো বাড়ির সবাই বুলবুলিকে খুঁজতে লাগল হন্যে হয়ে।

নিকট পুকুরে জাল ফেলা হলো। জালে করে বুলবুলি উঠে এলো। তবে প্রাণহীন,নিথর অবস্থায়। মহুয়া তার মেয়ের স্বাভাবিক মৃ* ত্যু মেনে নিতে পারে না। তার সন্দেহের তীর চলে যায় অন্য কারো দিকে।

চলবে।