#মহুয়ার_রাতদিন.৫ ✍️ #রেহানা_পুতুল
মহুয়া দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। তার সমস্ত পৃথিবী এক লহমায় দুলে উঠলো ভূমিকম্পের ন্যায়। পাশে থাকা বরই গাছের ডাল শক্ত করে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। বুকের পাঁজরগুলো যেন আমান নিজহাতে হাতুড়ি দিয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিচ্ছে।
মাগরিবের আযান শুরু হলো। আকাশের সমস্ত লালিমা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে মেঘের আড়ালে। পাখিরা ডানা মেলে উড়ে গেলো আপন নীড়ে। মহুয়া অচল পায়ে হেঁটে গিয়ে কলপাড়ে বসলো। পুকুর ঘাটে যাওয়ার মতো জোর তার দুই পায়ে নেই। সে নলকূপ চেপে একটু পানি খেয়ে নিলো হাতের তালুয় করে। অযু করে নিলো নামাজ পড়ার জন্য। ঘরে গিয়ে নামাজ পড়ে নিলো। বুলবুলি ক্ষুধায় কান্না জুড়ে দিলো। মহুয়া নামাজের পাটিতে বসেই বুলবুলিকে স্তন পান করালো।
বাবার মৃত্যু উপলক্ষ্যে মিরন ছুটিতে আছে। মিলে যায় না। মহাজন তাকে ছুটি দিয়েছে। মৃতের ঘর। শোকের পরিবেশ। ঘরে কম বেশী লোক সমাগম রয়েছে। তবে এরা সবাই মহুয়ার নিকটজন। নানী,খালা,মামা,মামী,ফুফু এমন। মহুয়া সবাইকে আমান সম্পর্কে যা জানলো সবটুকুই বললো।
মহুয়ার মা নিরীহ গলায় বললেন,
“বিপদ আইতে লাগলে সবদিক দিয়াই আসে। দুনিয়ায় সবকিছু জোর কইরা করন যায়। কিন্তু মন জোর কইরা পাওন যায় না। আল্লার কাছে বিচার দিয়া আমি সবর রইলাম। মাওলা উত্তম ফয়সালাকারী।”
রাত নয়টার দিকে গলা খাঁকারি দিয়ে সাবের মহাজন এলো।
“কইগো করিমের বেটি, আছো নি?”
মহুয়ার মা সদ্য বিধবা নারী। চারমাস দশদিন ইদ্দত পালন করতে হবে। পর পুরুষের সামনে যাওয়া নিষিদ্ধ তার জন্য। তাই মহুয়াকেই সব সামলাতে হবে। এমন মানসিকতা মহুয়া ইতঃপূর্বেই নিয়ে রেখেছে।
মহয়া বুলবুলিকে মিরনের কোলে দিলো। তার মা পরিবারের সাথে স্বামীর শোক পালনে মশগুল। মহুয়া ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে নিলো।
“চাচা আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। তোমার আম্মা ভালো আছে নি?”
লম্বা করে সালামের জবাব দিয়ে বললো সাবের মহাজন।
“জ্বি চাচা। ভালো আছে।”
মহুয়া পান বানিয়ে দিলো মহাজনকে। তিনি গালভর্তি পান মুখে নিয়ে বললেন,
“রাত হইয়া যাইতাছে। বাড়ি যাইতে হইবো আমার। কামের কথায় আসি।”
“জ্বি চাচা বলেন।”
সাবের মহাজন কাঠের চেয়ারটাতে পায়ের উপর পা তুলে বসলো আরামদায়কভাবে। ঝুলে থাকা নতুন সাদা লুঙিটাকে আঁটসাঁট করে নিলেন দুই পায়ের ভাঁজের মধ্যে।
মিরনও একপাশে বসলো একটি টুলের উপরে। দরজার আড়ালে মহুয়ার নানী ও খালা দাঁড়িয়ে আছে উৎসুক চোখে। মহাজন কী বলে তা শোনার জন্য।
“শোন, তোমার আব্বা এখন জীবিত নাই। তোমার আম্মা বিধবা। তোমার ছোট ভাই হইলো গিয়া শারিরীক প্রতিবন্ধী। সে চাইলেও অন্য সব জোয়ান ছেলের মতো খাটতে পারব না। তোমার বিষয়েও সব অবগত আছি আমি। জীবন ত আর থাইমা থাকতে পারে না। তারে চালায়া নিতে হইবো। তোমরা তিনজন মানুষের প্যাট ত বন্ধ হইব না। আবার তোমার আছে মাছুম একটা শিশু। তারও ত খরচ পাতি আছে কিছু। তাই বলি তুমি একটা কাজে নাইমা পড়ো।”
“কোথায় পাবো কাজ চাচা? কে দিবে আমাকে চাকরি?”
“পাবা, পাবা।সব রকমের যোগ্যতার চাকরি আছে দুনিয়ায়। একটু খুঁইজা নিতে হয়। আমি তোমার বাপের কাছে ঋণী। করিম কম খাটেনাই আমার ধান,চাইলের আড়তের লাইগা। আমার পরিচিত একজনের ফ্যাক্টরি আছে বড় মার্কেটে। সের সাথে আমার ভালোই খাতির। আমি তারে কইছি তোমাগো কথা। সে রাজী হইছে। সেখানে তোমার মতো আরো কর্মজীবী মেয়েরা আছে। তুমি দু চারদিন বাদে আমার লগে চইলো। নিজেই সব বুইঝা নিতে পারবা।”
” চাচা,আমার ত কোলের শিশু আছে। সম্ভব না।”
“এই দুনিয়ায় সবই সম্ভব বেটি। আগে ফাইনাল কইরা আসো।”
“আচ্ছা চাচা, আমি মায়ের সাথে আলাপ করে আপনাকে জানাবো।”
“হ,জানাইয়ো।”
সাবের মহাজন চলে যায় করিমের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে।
মহুয়া, পিছনের রুমে এসে বিষয়টা সবাইকে অবগত করে। মহুয়ার মা বুঝতেছে না কী বলবে। তার নানী বললো,
“আগে ওই ব্যাডার লগে গিয়া বাও বুইঝা আয়। ব্যাডাতো তোগো ভালার লাইগাই কইছে। নইলে কে কার খবর লয় আইজকাইল? পোলাপান দুইটা পড়ানোর টেকা দিয়া কী তোগো চাইরজন মাইনষের চইলবো।”
মহুয়া নিরুত্তর রয়। বুলবুলিকে কোলে তুলে বুকের মাঝে মিশিয়ে নেয়। দুগাল ভরে মায়ের মমতা বুলিয়ে দেয়। রাতে মহুয়া খালি বিছানায় ছটপট করে। একদিকে পরিবারের হাল ধরা,অপরদিকে নিজের ব্যক্তিগত সুখ বির্সজন হয়ে যাচ্ছে,আমান কী সত্যিই দ্বিতীয় বিয়ে করবে? এটা কোনো মানুষের কথা হলো? ছেলে সন্তান না হলে আরেকটা বিয়ে করবে সে? কী হারামি মা ও ছেলে। কিন্তু আমান ত এত খারাপ ছিল না।
মা,তার মন ঘুরিয়ে দিয়েছে। হায়রে নারী! কীভাবে পারিস নিজে একজন নারী হয়ে আরেকজন নারীর জীবনটা তছনছ করে দিতে। এমন বিক্ষিপ্ত ভাবনায় কেটে যায় রাত্রির প্রথম ভাগ।
বাবার মিলাদকে কেন্দ্র করে সারাদিন বহু ধকল গিয়েছে মহুয়ার উপরে। ক্লান্ত,পরিশ্রান্ত শরীরে রাজ্যের অবসাদ নেমে আসে। বুঁজে আসে মহুয়ার অশ্রুসিক্ত আঁখিজোড়া।
তারপর মহুয়া সাবের মহাজনের সাথে বড় বাজারে যায়। একটা ফ্যাক্টরির মধ্যে প্রবেশ করে। চেয়ারে বসা একজন বয়স্ক লোক। সাবের মহুয়াকে নিয়ে তার সামনে যায়। হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে বলবলে,
“কাশেম ভাই,ওর কথাই বলছি আমি আপনারে। আমার মিলের ম্যানেজার করিমের মেয়ে।”
মহুয়া সালাম দিলো কাশেমকে। তিনি সালাম নিলেন। মহুয়ার সাথে কথা বললেন। মহুয়া সব জানালো। শুনে তিনি আশাহত গলায় বললেন,
“ফ্যাক্টরির হিসাব কিতাব বুইঝা নেওয়ার জন্য তুমি যথেষ্ট। সুন্দর কইরা কথা বলতে পারো। বিদ্যাবুদ্ধিও আছে তোমার। দেখতেও চালু আছো। তারপরেও আপাতত তোমাকে রাখা যাইবো না। কারণ তোমার বাচ্চা ছোট। স্তন পান করে। তুমি রোজ তাকে রাইখা আসতে পারবা না। ”
সাবের অনুরোধের সুরে বললো,
“অল্প টাইমের লাইগা মাইয়াটারে কোন কাম দেওন যায় না ভাই? যেহেতু ছোট বাচ্চা আছে,তাইলে কয়েক ঘন্টার জন্য আসবো।”
“বুঝছি আপনি পার্ট টাইম চাকরির কথা কইতাছেন।”
“হ,হ। তাই কইতাছি ভাই। নয়তো ওর মায়ের কাছে আমি বেইজ্জতি হইয়া যামু।”
কাশেম একটুক্ষন ভেবে নিয়ে মহুয়াকে বললো,
“তুমি রোজ ৪/৫ ঘন্টা টাইম দিতে পারবা? আমাদের কসমেটিকস দোকানে?”
“পারবো। এটা কোথায় চাচা?”
“বজরা মার্কেটের দোতলায়। তোমার বাড়ি থেকে সেটা কাছে। অটো বা লেগুনায় কইরা আসা যাওয়া করতে পারবা। রোজ সকালে দশটা থেকে তিনটা পর্যন্ত।”
“জ্বী চাচা, পারবো।”
সাতপাঁচ না ভেবে খুশী খুশী মুখে জানিয়ে দেয় মহুয়া। তাদের জীবনের এই চরম দুর্দিনে এই বা কম কিসের। সে কৃতজ্ঞতার চোখে সাবের মহাজনের দিকে তাকায়। সাবের মহুয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় গুরুজনের মতন।
মহুয়া বাড়িতে গিয়ে নতুন চাকরির আদ্যোপান্ত মা ও ভাইকে জানায়। মিরন উৎফুল্ল হয় এই ভেবে, বেলায় বেলায় আর শাকপাতা খেতে হবে না তার। মহুয়ার মা খুশী হয় এই ভেবে,ছেলেমেয়েকে নিয়ে তিন বেলা পেট ভরে খেতে পারবে এবার। উপোস থাকতে হবে না আর।
মহুয়া তার মাকে বলে,
“মা,তাহলে সামনের সপ্তাহ থেকে যাওয়া শুরু করি? ইরা ও মিরার পড়ার কোন বিঘ্ন ঘটবে না। ওরা ত আসে বিকেল পাঁচটার পরে।”
“হ মা,তাই করতে হইবো একটু ভালোভাবে বাঁচতে হইলে। তুই বুলবুলিরে দুধ খাওয়াইয়া যাইবি। এরপর মাঝখানে তারে আমি ফিডারে কইরা পানি,দুধ খাওইয়াতে পারুম। আশাকরি সমস্যা হইবো না। অমন দুই চারটা বাচ্চা আমি নিজেই পালতে পারি। আর আমার নানুভাইরে পারুম না? তুই প্রস্তুতি নে।”
তারপর নিদিষ্ট দিনে মহুয়া তার চাকরির দোকানে যায়। প্রথম দিন বলে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যায় সাবের মহাজন। অবশ্য তার আগে মহুয়া উনাকে অনুরোধ করেছে সাথে যাওয়ার জন্য। মহুয়ার বেশ পছন্দ হলো দোকান। কাঁচের আয়নার ভিতরে প্রতিটি সেলফে হরেকরকম কসমেটিকস দিয়ে সাজানো। ক্যাশে বসা ছিলো দোকানের ম্যানেজার।
সাবের তাকে বললো,
“ওর নাম মহুয়া। সম্পর্কে আমার ভাতিজি হয়। তোমাদের মালিক তারে চাকরি দিছে এই দোকানে। দোকান কী তুমি একলাই চালাও?”
“নাহ। স্টাফ আরেকজন আছে। এখন ত আবার এই আপা আসলো। এই দোকানে তিনজনেই যথেষ্ট। মাঝে মাঝে আসিফ ভাইও আসে।”
“আসিফ কে?”
“কাসেম কাকার মেজো ছেলে। এটাতো আসিফ ভাইয়ের দোকান।”
“ওহ আইচ্ছা। বুঝলাম।”
তিনি চলে গেলেন দোকান হতে বেরিয়ে। মহুয়া নিজ থেকেই টুকটাক কথা বলছে ক্যাশ ম্যানেজারের সাথে। নতুন চাকরি,নতুন আরেকটি অধ্যায় যুক্ত হলো জীবনে। তবুও বিষাদের গাঢ় আস্তরণে ঢেকে আছে মহুয়ায় হৃদয়ের এপাশ ওপাশ। থাকি থাকি কেবল তার আমানের কথা মনে পড়ছে। অভিমান করে আমানের সাথে যোগাযোগ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আমানও কোন যোগাযোগ করে না মহুয়ার সাথে। রোজ নিয়ম করে মহুয়া দোকানে যাচ্ছে,আসছে। কোন ঝামেলা সৃষ্টি হচ্ছে না। বা মেয়ে বলে বাইরে কোন বিড়ম্বনার স্বীকারও হতে হয়নি তাকে।
তারপর এক মধ্যদুপুরে মহুয়া দোকানে কাজ করছে বিপরীতমুখী হয়ে। হঠাৎ সে শুনতে পেলো তার একান্ত প্রিয়জনের কণ্ঠস্বর!
“মেকাপবক্স দেখান। আর এই লিস্টের আইটেমগুলো হবে আপনাদের কাছে?”
“থাকব না ক্যান? সবই আছে। বিয়ের সাজানি লিস্ট মনে হয়?”
“হ্যাঁ। ঠিক ধরেছো।”
“কার বিয়ে ভাইজান? আপনার?”
“হ্যাঁ আমার।”
মহুয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। আমান মহুয়াকে দেখেই ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।
“মহুয়া! তু..তুমি এখানে কী করছো? কেন এলে?”
চলবে…৫