মহুয়ার রাতদিন পর্ব-০৬

0
8

#মহুয়ার_রাতদিন.৬ ✍️ #রেহানা_পুতুল
“কার বিয়ে ভাইজান? আপনার?”

“হ্যাঁ আমার।”

মহুয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। আমান মহুয়াকে দেখেই ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।

“মহুয়া! তু..তুমি এখানে কী করছো? কেন এলে?”

“কেন এই দোকানে আপনি ছাড়া আর কেউ আসা নিষেধ না-কি? আপনার দরকার হতে পারে,আর কারো দরকার হতে পারে না?”

ঘৃণামিশ্রিত কণ্ঠে দৃষ্টি তাক করে বলল মহুয়া।

আমান কেনাকাটা বাদ দিয়ে মহুয়ার দিকে মনোনিবেশ করলো। অপরাধী গলায় অনুরোধ করে বললো,

“তুমি একটু বাইরে আসবে?”

মহুয়া অবিচল। দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
“প্রয়োজন মনে করি না।”

দোকানের ম্যানেজার ছেলেটা সন্দেহাতীত চোখে দু’জনকে দেখতে লাগলো। আমান বুঝতে পারলো মহুয়া এক পাও নড়বে না দোকান হতে। তাই সে মহুয়াকে আর বিশেষ ঘাঁটালো না। কেনাকাটা না করেই দোকান হতে সে চঞ্চল পায়ে বেরিয়ে গেলো।

মহুয়া টুলের উপর বসে পড়লো। খেই হারিয়ে ফেলল নিজের উপর। মাথাটা টনটন করছে। মনে হচ্ছে মগজগুলো ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে কিছু বিষাক্ত পোকার দল। হায় মালিক! হায় কপাল! এমন দিন দেখার আগে তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেলো না কেন? সে কপাল ঠেকিয়ে ধরলো ওয়ালের মাঝে। নিজের দূর্ভাগ্যকে অভিসম্পাত দিতে লাগলো মনে মনে। তার ভিতরটা যেন কলাপাতার মতন ফরফর করে চিরে ফেলছে আমান নিজ হাতে। দানবীয় যন্ত্রণায় মহুয়ার মুখ দিয়ে অস্ফুট আওয়াজ বের হলো।

ম্যানেজার ফাহিম মহুয়াকে সহানুভূতি দেখালো না। উলটো খিটখিটে মেজাজে বললো,

“দিলেন ত ব্যবসার বারোটা বাজিয়ে। বিয়ের কাস্টমার রোজ রোজ পাই? সারাদিনে যা বেচাবিক্রি হইতো, তার দিগুণ হয় এমন বিয়ার কাস্টমার হইলে। কাশেম চাচাতো বুঝেনাই। দিলদরদী মানুষ। চোখের পানি ফেলে মন গলায়া ফেলছেন। আর চাকরি হইয়া গ্যালো আপনার। আসিফ ভাই থাকলে এক্ষুনি আপনার সাধের চাকরি নট হইয়া যাইতো।”

মহুয়া চুপ রইলো। ফাহিমের কথাগুলোর কাউন্টার দিল না। ফাহিম আবার জিজ্ঞেস করলো,

“কে উনি? আপনার প্রতারক প্রেমিক না-কি?”

মহুয়া নিঃশ্চুপ! নিশ্চল! তার ভাষারা নির্বাক! কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে পুরো হৃৎপিণ্ডজুড়ে। বিনা অপরাধে অযৌক্তিক বিষয়কে ইস্যু করে তাকে এই নরক যন্ত্রণা কেন দিলো আমান ও তার মা? পুত্র সন্তান হয় নি বলে আমান সত্যিই দ্বিতীয় বিয়ে করতে যাচ্ছে? নাহ। অপরাধী তারা। সাজা তাদের প্রাপ্য! তাদেরকে সাজা দিতে হবে। চোখের জল মুছে ফেলতে হবে। ঘুনে ধরা বাঁশের মতো মচকে গেলে চলবে না। তাকে সেগুন কিংবা মেহগনি গাছের মতো টেকসই ও মজবুত হতে হবে। না ভাঙ্গবে। না মচকাবে। শত ঝড় বৃষ্টিতেও টিকে থাকবে তার নিজস্ব শক্তি নিয়ে।

দোকান থেকে বেরিয়ে মহুয়া বাড়িতে চলে গেলো। বোরকা খুলেই হাত মুখ ধুয়ে নিলো। মায়ের আদেশে আগুনে হাত সেঁকে নিলো রোজকার মতো। আগুনের সংস্পর্শ পেলেই না কি জ্বীন ভূতের প্রভাব থাকলে তা দূর হয়ে যায়। মেয়ে বুলবুলিকে কোলে তুলে নিলো। আদর করলো প্রাণভরে।

ভাত খেয়ে নিলো। ভ্যানিটি ব্যাগ হতে মোবাইলটা বের করলো। দেখলো আমানের ভয়েজ মেসেজ। বিষিয়ে আসা মন নিয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও শুনলো।

“মহুয়া দয়া করে ভুল বুঝ না। আমি বিয়ে করতে একদমই চাই নি। এবং এখনো চাই না। মা বিয়ে ঠিক করেছে। এবং নিজেই বলছে যেনো তোমাকে না ছাড়ি। উনি ছেলে নাতির মুখ দেখতে চায়। তুমিতো জানই আমাদের পরিবারে ছেলে নেই রাব্বি ছাড়া। আমার জীবন আর ভবিষ্যৎ নিয়ে মায়ের নানারকম যুক্তির কাছে হেরে যাচ্ছি। আমিতো তোমারই আছি। কোনদিন তোমাকে ছেড়ে যাবো না। তোমাদের বাড়ি আসবো আমার মেয়েকে দেখতে।”

ক্ষোভে,ঘৃণায় মহুয়া মুখ বিকৃত করে ফেললো। মাকেও শোনালো আমানের কথাগুলো। দোকানে আমানের সাথে দেখা হওয়ার বিষয়টাও মায়ের সাথে শেয়ার করলো। শুনে তার মা হালিমা মরিচ কণ্ঠে বললো,

“মা যেমন এক হারামির হারামি। পোলাও হইছে আরেক হারামী। দুই হারামি মিলা যা ইচ্ছা করুক। খেতা পোড় হেগো। যেমনে আল্লায় দিন নিতাছে আমাগো। হাজার শোকর তার দরবারে। টিউশনি করস। চাকরি করস। নিজের মেয়ে নিজে পালতাছোস। তাইলে ওই চামারগোরে দিয়া আর কী কাম তোর জিন্দেগীতে? ভুইলা যা। ধইরা নে স্বামী মইরা গ্যাছে তোর। অহন মাইয়া নিয়া তোর একলাই বাঁচতে হইবো।”

“মা,তাদের একটা টাইট দিতে চাই। আমি একজন উকিল ও একজন বড় মাওলানার সাথে আলাপ করবো বিষয়টা নিয়ে। তারপর থানায় মামলা করবো। আগে বিয়ে কবে সেই খবর নিতে হবে।”

শুনে হালিমা ঘাবড়ে উঠে।
“কী কস? পারবি? ক্যামনে কী করবি?”

“মা,আল্লাহ ভরসা। তুমি দোয়া করো আমার জন্য। আমিতো একদম পড়াশোনা না জানা মেয়ে ন। এসএসসি পাশ। এখনো সময় সুযোগ মিললে কলেজে ভর্তি হওয়া যায়।”

হালিমা একটু ভরসা পেলো মেয়ের মুখে আত্মবিশ্বাসী কথা শুনে।
পরেরদিন সকালে মহুয়া দোকানে গেলো। বোরকা খুলে নিলো। চাইলেও সে বোরকা পরে থাকতে পারে না। এই বোরকাটা মোটা কাপড়ের। অল্পদামের। অস্বস্তি লাগে লম্বাসময় ধরে পরে থাকতে। দোকানে তার দায়িত্ব সামলাচ্ছে সে। কাস্টমারদের সাথে কথা বলছে। কসমেটিকস পণ্য দেখাচ্ছে। বিক্রি করছে। বিদায় দিচ্ছে। ফাহিম ক্যাশে বসে টাকা নিচ্ছে।

ভর দুপুরের দিকে দোকান ফাঁকা হলো। কেউ নেই। ফাহিমের জিহবা চুলকাচ্ছে মহুয়াকে কিছু বলার জন্য। তার কামুক চাহনি লাটিমের মতো বৃত্তাকারে ঘুরছে মহুয়ার বক্ষ যুগলের উপরে। সে বলে ফেললো,

“বুঝলাম না,আপনার জামার বুকের অংশ রোজই ভিজতে দেখি। কারণ কী?”

মহুয়া ফাহিমের কথাকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলো। সরল গলায় বললো,
“আমার কোলের শিশু আছে ফাহিম ভাই।ব্রেস্ট ফিডিং করাই। অনেক সময় হয়ে গেলে এমন হয়।”

“ওহ!” বলে ফাহিম খুব আপত্তিকর দুটো বাক্য বলে ফেললো মহুয়াকে। মহুয়ার দু’কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো উত্তপ্ত সীসার ন্যায়। তাতানো মেজাজে এগিয়ে এসে ফাহিমের গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দিলো। ফাহিম মহুয়ার হাত ধরে ফেললো যেনো দ্বিতীয় চড় না দিতে পারে মহুয়া। মহুয়া হাত মোচড়ামুচড়ি করছে ছাড়ানোর জন্য। পারছে না।

ঠিক তখনই দোকানের মালিক আসিফ চলে এলো। ফাহিম চট করেই মহুয়ার হাত ছেড়ে দিলো। মহুয়া রা*গে,লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো,অচেনা,অদেখা, আসিফকে দেখে। আসিফও এর আগে মহুয়াকে দেখেনি। তার বাবার কাছে শুনেছে মহুয়ার কথা। উপস্থিত অপ্রীতিকর পরিস্থিতি দেখে সে নিজেই ইতস্ততবোধ করলো।

কর্কশ স্বরে ধমকে উঠে ফাহিমকে জিজ্ঞেস করলো,
” কী হচ্ছে এসব?”

ফাহিম গাঁইগুঁই শুরু করলো। নমনীয় স্বরে বললো,”কিছু না ভাই।”

“কিছু না মানে? আমি দেখলাম তুই ওর হাত ধরা?”
ফাহিম নিশ্চুপ।

আসিফ গলার ঝাঁঝকে হালকা করে নিয়ে মহুয়াকে বললো,
“দোকানে নস্টামি করতে আসো? নাহ?”

মহুয়ার মন চাচ্ছে মাটির নিচে পুঁতে যেতে। এতবড় অপবাদ নেয়া দুঃসাধ্য তার পক্ষে। মহুয়া তৎক্ষনাৎ চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলো।

আসিফ ভরাট কণ্ঠে বলে উঠলো,
“এই মেয়ে বসো বলছি চুপচাপ। কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”

“আমি চাকরি ছেড়ে দিলাম আপনার দোকানে। মাফ করবেন।”

মহুয়ার কথার দৃঢ়তায়, ব্যাক্তিত্বে,আত্মমর্যাদায়, আসিফ আশ্চর্য হলো। সে বুঝতে পারলো মহুয়া মেয়েটা নির্দোষ। সে শাসনের সুরে বললো,
“আমার দোকানে তোমার চাকরি হয়েছে আমার বাবার ইচ্ছায়। কিন্তু চাকরি যাবে বা তুমি ছাড়বে সেটা আমার ইচ্ছায়। বসো। স্থির হও। আমি দেখছি।”

মহুয়া বসলো। আসিফ বিষয়টা খোলাখুলিভাবে জানতে চাইলো।

মহুয়া বললো,
“সেটা মুখে বলা সম্ভব নয় ভাইয়া। উনি খুব আপত্তিকর কথা বলেছে আমাকে। আমি উনাকে চড় মেরেছি। তখন উত্তেজিত হয়ে উনি আমার হাত ধরেছে।”

আসিফ উঠে এসে ফাহিমের পিঠে,গালে আঘাত করলো হাত দিয়ে। বললো,
“মাফ চা বলছি মহুয়ার কাছে। ”

উপয়ান্তর না পেয়ে ফাহিম মুখে মাফ চাইলো মহুয়ার কাছে। আগে চাকরি বাঁচাতে হবে। পরের খেলা পরে হবে। শা*লী, বলে গোপনে আরো বিশ্রী দুটো বাক্য বললো ফাহিম।

মহুয়া তার দায়িত্ব শেষে চলে গেলো। সঙ্গী করে সঙ্গে নিলো এক তিক্তকর,বিদঘুটে অভিজ্ঞতার ঝাঁপি। তার আগে আসিফ তার মোবাইল নাম্বার চেয়ে নিলো।

মহুয়া বাড়িতে গিয়ে মা হালিমাকে জানালো না দোকানের কাহিনীটা। অকারণে বিধবা শোকাহত মাকে অতিরিক্ত চিন্তায় ফেলে দেওয়া ঠিক হবে না। রাতে ভাত খেয়ে নিয়ে মহুয়া তার রুমে শুয়ে পড়লো। শিশু বুলবুলি মায়ের স্তন পান করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লো।

মুঠোফোন বেজে উঠলো। রিসিভ করে মহুয়া সালাম দিলো। ওপাশ হতে ভেসে এলো গাম্ভীর্যপূর্ণ কণ্ঠ।
“ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছো মহুয়া?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন?”

“ভালো আছি। তোমার সাথে আজ দেখা হলো বাজে একটা অবস্থায়। যাইহোক, তুমি মনে কিছু রেখো না।”

“ভাইয়া, আমি আর আগ্রহ পাচ্ছি না আপনার দোকানে যেতে। অন্তত ওই পিশাচটা থাকাবস্থায়।”

আসিফ অনুধাবন করতে পারলো,মহুয়া তার সিদ্ধান্তে অনড়! সে মহুয়াকে শান্তনা দিলো তার সামর্থনুযায়ী। তার বাবার কাছে মহুয়ার প্রশংসা শুনেছে। এবং শুনেছে মহুয়ার নিষ্পেষিত জীবনের গল্প। মহুয়াকে দেখেও আসিফের পছন্দ হয়েছে। প্রমিত ভাষায় মহুয়ার মার্ধূযময় চমৎকার বাচনভঙ্গিতে দোকানে কাস্টমার এখন তেমন ফেরত যায় না। আনুপাতিক হারে বিক্রি বেড়েছে।

সে আরো বললো,
“তুমি কাল ও পরশু তোমার মেয়েকে সময় দাও। দোকানে আসতে হবে না। স্বাভাবিক হও। তারপর এসো। ফাহিমকে বাদ দিয়ে দিবো কিছুদিন পর। সে বহুদিনের পুরোনো বিশ্বস্ত ম্যানেজার। হুট করে বাদ দিলে তারও ক্ষতি। আমারও ক্ষতি। বুঝতে পেরেছো।”

আসিফকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে মহুয়া ক্ষীণকায় স্বরে হুঁ বললো।

আসিফ মোবাইল ফোন রেখে স্বস্তির দম ছাড়লো।

তার একদিন পরেই কাশেম ছেলের রুমে গেলো। আসিফ অন্যদিকে ব্যস্ত। কাশেম নিজের আধপাকা দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

“তোর লগে একটা বিষয় আলাপ করা দরকার।”

“কী বাবা? কোন বিষয়ে? বলেন শুনি?”

“মহুয়া মেয়েটার বিষয়ে। তবে এখন না। ঠান্ডা মাথায় বোঝাপড়ার বিষয় এইটা।”

“সমস্যা নেই। বলবেন।”
অন্যমনস্ক হয়ে বলল আসিফ।

এদিকে আমান মহুয়াদের বাড়ি আসার আগেই মহুয়া জেনে গেলো আমান কোন মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। শুনে মহুয়া বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। মায়ের কাছে ছুটে গেলো।

স্তম্ভিত গলায় মাকে বললো,
“মা জানো,আমান কাকে বিয়ে করবে?”

“কারে?”

আমরা যে সবসময় বলি আমাদের শিউলি। আমাদের শিউলি ফুল। আমাদের সেই শিউলি হতে যাচ্ছে আমানের দ্বিতীয় স্ত্রী।

হালিমা দপ করে মাটিতে বসে পড়লো। হই হই করে উঠলো না। কেবল হায় হায় করে করুণ গলায় বললো,

“কোঁচার ছুরি দিয়ে এইভাবেই প্যাট কাটা যায়। বুঝলি মা।”

“নাহ মা। বুঝতে চাই না। বোঝার কথাও না।”
চোয়াল শক্ত করে বজ্রকণ্ঠে বলে উঠলো মহুয়া।

চলবে…৬